Aayan Das

Others

2.5  

Aayan Das

Others

সমুদ্র হৃদয়

সমুদ্র হৃদয়

3 mins
10.2K


আজকালকার স্ত্রী'রা তাদের থেকে বয়সে বড় স্বামীদের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করেনা।যদিও এটাই ঠিক কারন স্বামী স্ত্রী র সম্পর্ক আসলে বন্ধুতার সম্পর্ক।

অথচ আমাদের মা কাকিমাদের দেখেছি প্রকাশ্যে বিজয়ার সন্ধ্যেবেলায় বাবা কাকা দের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতে।

আগের নিয়মটাই ভুল ছিল ,আজকের নিয়মটাই ঠিক। পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করার রিচুয়ালসটা আজ অবলুপ্তির পথে এবং আমি নিজেও ধোয়া তুলসিপাতা নই।আমারও দুমদাম করে কারো পায়ে হাত দিতে ইচ্ছা করেনা।

অথচ কোনো শ্রদ্ধেয় মানুষকে প্রণাম করার পর তার আশীর্বাদের হাত যখন মাথার উপর নেমে আসে তখন কিন্তু সত্যিই মন ভরে যায়।নিজেকেই সম্মানিত লাগে।

আমার এক মাষ্টারমশাই বলতেন,-''মনে রাখিস,যাকে প্রণাম করা হল তার চেয়েও সম্মানিত হল সে,যে প্রণামটা করল।''

ছোটোবেলায় বিজয়ার পর দল বেঁধে পাড়ার সব গুরুজনদের পায়ে হাত দিয়ে প্রণামের পর ঘুগনি আর নাড়ু খাওয়ার স্মৃতি আজও নষ্টালজিক করে তোলে।

নব্বই দশকের শেষ থেকে পাড়ার লোকেদের প্রণাম করার রীতিটা বন্ধ হয়ে গেল।এখন প্রণাম আবদ্ধ হয়ে থাকে শুধুই পরিবারের মধ্যে,দায়সারা ভাবে একটা পানিশমেন্টের মত। আমার এক মাসি ছিলেন যার স্বামীটি ছিল নিতান্ত অপদার্থ ও জড়দগব টাইপের।ভদ্রমহিলা নিজে তার স্বামীকে যথেচ্ছ অপমান করতেন অথচ অন্য কেউ কিছু বললেই তার মুখটা সামান্য শক্ত হয়ে যেত।একবার বিজয়া দশমীর সন্ধ্যার গেট'টুগেদারে যথারীতি ভদ্রলোককে নিয়ে তার শালা-শালিরা মজা করছে৷ভদ্রমহিলা কিছুক্ষন বাদে উঠে গিয়ে স্বামী কে প্রণাম করলেন।আমার মনে হল-এই প্রণামটা আসলে একটা প্রতিবাদ,অন্যদের প্রতি একটা নিরুচ্চার অভিমান।

শুধু যে পায়ে হাত দিলেই প্রণাম হয় তা কিন্তু নয়।একবার একটা বাংলা সিরিয়ালের শ্যুটিং দেখতে টালিগঞ্জে গেছিলাম।সেখানে অভিনয় করছিলেন প্রবীন অভিনেতা শ্রী মনু মুখোপাধ্যায় এবং শ্রী পরান বন্দ্যোপাধ্যায়।ঘরে অল্পবয়সি অভিনেতা অভিনেত্রীরা (অনেকেই বিখ্যাত)আড্ডা মারছেন।যতবার এই দুই প্রবীন ঘরে ঢুকছেন ততবার জুনিয়াররা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াচ্ছেন আর এঁরা সবাইকে কাঁধে হাত দিয়ে বসিয়ে দিচ্ছেন।এইরকম প্রায় কুড়ি পঁচিশবার।অবাক হয়ে গেছিলাম দেখে।

একটি মেয়ের সঙ্গে ফেসবুকে আলাপ হয়েছিল।মেয়েটি আমার লেখার ভীষনই ভক্ত।একদিন মেয়েটি বলল,-''অয়ন দা প্লিজ আপনি আর বৌদি আমাদের বাড়িতে একদিন আসুন প্লিজ৷''

বললাম,-''যাব যাব,ঠিক একদিন চলে যাব৷''

-''কবে আসবেন?''

-''যাব একদিন৷''

-''আগামি রবিবার আসুন৷''

-''হবে না গো,একটা মিটিং আছে আমাদের ফ্ল্যাটে৷''

-''সোমবারও তো ছুটি,তাহলে সোমবারে আসুন৷''

-''আসলে সোমবারে....''

-''আসলে আপনি আসতে চাননা,আমি জানি কেন''

-''কেন?''

-''একে আমাকে দেখতে ভালো না তার উপর আমরা খুব গরীব তাই-''

এই রে! এতো ইমোশনাল ব্ল্যাকমেল!

অতএব যাবনা যাবনা করেও স্ত্রী কন্যাকে নিয়ে শীতের রবিবারে সেই আধা মফঃস্বলের নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের কলেজ পড়ুয়া মেয়েটির বাড়িতে হাজির হলাম।

গিয়ে দেখি আমরা আসব বলে এলাহি আয়োজন করে রেখেছে সে।নিজের হাতে প্রায় ছ-সাত রকমের আইটেম রান্না করেছে।গাছ থেকে পাড়িয়ে রেখেছে খেজুরের রস।আমি মিষ্টি ভালবাসি বলে এনে রেখেছে অন্তত পাঁচ রকমের মিষ্টি।

আমাদের দেখে তার এতই আনন্দ হয়েছে যে তা প্রায় ঈশ্বর দর্শনের সমান।ঠাকুরকে ভোগ দেওয়ার মত সে দুপুরে আমাদের আসন পেতে ঝকঝকে মাজা কাঁসার থালায় খেতে দিল।খাওয়ার পর বাড়িতে বানানো মিষ্টি পান।বিকেলে ট্রেনে তুলে দিয়ে জানলা দিয়ে হাত নাড়তে নাড়তে একসময় সে যখন অদৃশ্য হয়ে গেল তখন,কি জানি কেন-আমার চোখদুটো জ্বালা করে উঠল। ভীষন এক অপরাধবোধ আমাকে দংশন করতে লাগল।আমি কী সত্যিই এই প্রণাম,এই সম্মানের যোগ্য?

আর কেউ জানুক না জানুক আমি নিজে তো জানি যে আমি কতখানি 'সাধারন' একটা মানুষ।আমার মধ্যেও একটা খারাপ লোক বাস করে,আমি তো চিনি সেই খারাপ লোকটাকে।

মেয়েটি যে নিষ্ঠার সঙ্গে আমাকে 'প্রণাম' করল তার বদলে তাকে কী সত্যিই কিছু দেওয়ার ক্ষমতা আছে আমার?মানুষকে কিছু দেওয়ার মত সম্পদ আমি আদৌ কী আহরণ করতে পেরেছি কখনও?মানুষকে আশীর্বাদ করার জন্য যে আকাশের মত উদার হৃদয়ের অধিকারী হতে হয় তা কী কখনও আমি হতে পারব?

সেদিন বুঝেছিলাম-বয়সে ছোটো হলেও তাকে প্রণাম করতে কোনো বাধা নেই।আমার থেকে পনেরো ষোলো বছরের ছোটো সেই গরীব অথচ ধনী মেয়েটির মনের 'এক সমুদ্র' ঐশ্বর্যের খোঁজ পেয়ে সেদিন ওকেই প্রণাম করেছিলাম বারবার।


Rate this content
Log in