Sayandipa সায়নদীপা

Drama Inspirational

2.5  

Sayandipa সায়নদীপা

Drama Inspirational

উপহার

উপহার

6 mins
18.3K


“কিরে তুনতাই স্কুলে যাবি না? ওঠ এবার আর কত ঘুমোবি?”

“মা…”

“কি?”

“বলছি যে আমার পেটটা খুব ব্যাথা করছে, আজ স্কুলে যেতে পারবো না মনে হয়।”

“পেট ব্যাথা! কাল স্কুল থেকে ফেরার সময় কিছু উল্টোপাল্টা কিছু খেয়েছিলি?”

“নাতো।”

“হুমম… আজ এই মেঘলা ওয়েদারে খিচুড়ি বানাবো ভাবছিলাম কিন্তু তোর যখন পেট ব্যাথা তখন তো আর বানানো যাবে না। থাক আজকে…”

“খি… খিচুড়ি!”

“হুমম।”

“ওমা খিচুড়ি বানাও না। খিচুড়ি তো ওই চাল, ডাল, সবজি সব পুষ্টিকর জিনিস দিয়ে তৈরি, পেটের জন্য ভালোই হবে।”

“না না… আজ খিচুড়ির প্ল্যান ক্যানসেল।”

“ওমা এরকম কোরো না। দুপুরে খাওয়ার আগে পেটটা ঠিক হয়ে যাবে তুমি দেখো।”

“তাহলে স্কুলে যাওয়ার আগেও ঠিক হয়েই যাবে নিশ্চয়।”

“মানে!”

“তুনতাই তুই কি ভাবলি মা তোর বাহানাটা ধরতে পারবে না? মা সব বোঝে। স্কুলে যেতে চাইছিস না কেন! আজ শিক্ষক দিবস আজকের দিনে স্কুলে যাবি না? যা রেডি হবি যা, স্কুলে গিয়ে সব মাস্টারমশাই, দিদিমনিদের প্রণাম করবি।”

মায়ের কথার ওপর আর কোনো কথা বলতে পারেনা তুনতাই, নিঃশব্দে উঠে যায় রেডি হতে। মনে মনে ভাবে মাকে কিভাবে বোঝাবে সে শিক্ষক দিবসে শুধু প্রণাম করলেই চলে না আরও কিছু লাগে যেটা দেওয়ার সামর্থ্য তুনতাই এর নেই। দু’বছর আগের সেই ভয়ানক এক্সিডেন্টটা বাবাকে শয্যাশায়ী করে দেওয়ার পর মা যে কি কষ্ট করে সংসার চালাচ্ছেন তা তুনতাই ভালো করেই জানে আর তাই তো ও কোনো জিনিসের জন্য বায়না করেনা কখনও। গত বছর শিক্ষক দিবসে দেখেছিল সব বন্ধুরা কত নামী দামী উপহার নিয়ে গেছিল স্যার ম্যামদের দেবে বলে, তাদের মধ্যে আবার প্রতিযোগিতা চলছিল কার উপহার কত দামি, কত সুন্দর। তুনতাই পারেনি কিছু নিয়ে যেতে, মাকে বললে হয়তো মা ওরই মধ্যে কিছু কিনে দিতেন কিন্তু তুনতাই মায়ের সামনে গিয়েও আর শেষমেশ উপহারের কথাটা বলতে পারেনি, গলার কাছে যেন আটকে গেছিলো কিছু। স্কুলে গিয়ে সেদিন যে পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছিল...রণজয়, সাত্যকী, স্নেহারা ওকে নিয়ে কেমন হাসাহাসি করছিল নিজেদের মধ্যে, চোখে চোখে কিসব ইশারা চলছিল ওদের। তুনতাই এর চোখ ফেটে জল বেরিয়ে এসেছিল তখন, ওর ইচ্ছে করছিল ছুটে পালায় ক্লাস থেকে। তারপর মনে মনে সেদিন ঠিক করে নিয়েছিল যে আর কোনোদিনও শিক্ষক দিবসে স্কুলে আসবে না, কিন্তু আজ আবার সেই যেতে হবে ওকে স্কুলে। ওরকম অপ্রিয় পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে।

*****************************************************************

স্কুলে ঢুকে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো তুনতাই, যাই হোক আজ শিক্ষক দিবস বলে এখনো ক্লাস শুরু হয়ে যায়নি। রাস্তায় এমন দেরী হলো… কিন্তু তুনতাই এর স্বস্তি স্থায়ী হলোনা বেশিক্ষণ। ওকে দেখা মাত্রই রণজয় ব্যঙ্গ করে বলে উঠলো, “এবারেও কি সেই হাতে লন্ঠন করে ঠনঠন নাকি রে?”

এবার স্নেহা ওর কথাটা লুফে নিয়ে বললো, “টিচার্স ডে তে এরকম নির্লজ্জের মত খালি হাতে মানুষ কি করে আসতে পারে! যে টিচাররা আমাদের সারা বছর পড়াচ্ছেন তাদের এই দিনে গিফট না দিলে চলে নাকি! আমি এরকম হলে তো বাবা ঘরের মধ্যে মুখ লুকিয়ে বসে থাকতাম, স্কুলেই আসতাম না।”

স্নেহার কথা শেষ হওয়া মাত্রই স্কুলের মধ্যে মৃদু গুঞ্জন শুরু হলো, সেই সঙ্গে শুরু হলো চাপা হাসাহাসি। তুনতাই এর আবার চোখ ফেটে জল আসতে চাইছে, পা দুটো যেন বলছে পালা এখান থেকে। কিন্তু পালাতে পারলোনা তুনতাই, পেছন থেকে কে যেন এসে ওর পিঠে টোকা মারল। জল ভর্তি চোখ নিয়ে পেছন ফিরে তুনতাই দেখল তুষার স্যার দাঁড়িয়ে দরজায়। স্যার ওকে বললেন, “কিরে দরজার সামনে কি করছিস? ক্লাসে ঢোক।” নিঃশব্দে মাথা নেড়ে তুনতাই গিয়ে বসল নিজের জায়গায়।

প্রত্যেক বছরের মত এ বছরও টিফিনের পরে শিক্ষক দিবসের অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে। তুনতাই মাথা নিচু করে চুপচাপ বসে আছে এক ধারে, নিঃশব্দে ওর চোখ দিয়ে নোনা জল চুঁইয়ে পড়ছে। অনেক চেষ্টা করেছিল ওদের আটকানোর কিন্তু পারলোনা শেষমেশ। বারবার মনে পড়ে যাচ্ছে ক্লাসে সবাই কেমন আনন্দ করে স্যারদের উপহার দিচ্ছিল আর তুনতাই এক কোণে বসেছিল ব্রাত্য হয়ে। আকাশ স্যারের দিকে যেন তাকাতে পারেনি ও, স্যার তুনতাই এর সব থেকে প্রিয় শিক্ষক আর তাই হয়তো স্যারকে আজকের দিনে কোনো উপহার দিতে না পারার যন্ত্রণাটা আরও কুরেকুরে খাচ্ছে ওকে।

সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শেষে এবার স্যারদের কিছু বক্তব্য রাখার পালা। আকাশ স্যার প্রথমে উঠলেন স্টেজে। মাইকটা হাতে নিয়ে দর্শকাসনে থাকা সব ছাত্রছাত্রীদের একবার দেখে নিলেন, তারপর বললেন, “আমি আমার বক্তব্য শুরু করার আগে তোমাদের মধ্যে থেকে বিশেষ একজনকে ডেকে নিতে চাই। ক্লাস ফোর, এ সেকশনের তমোঘ্ন সেন স্টেজে এসো একবার।”

নিজের নামটা কানে লাগতেই চমকে উঠল তুনতাই, আশেপাশের সবার দৃষ্টিও ওরই দিকে নিবদ্ধ। স্যার আবার মাইকে ওর নামটা ডাকলেন। চোখটা কোনো রকমে মুছে আস্তে আস্তে স্টেজের দিকে এগিয়ে গেল তুনতাই, পা দুটো অসম্ভব রকমের কাঁপছে, খুব নার্ভাস লাগছে নিজেকে। স্টেজে ওঠা মাত্রই আকাশ স্যার ওকে হাত বাড়িয়ে ওকে টেনে নিলেন কাছে তারপর বললেন, “আজ শিক্ষক দিবস, শিক্ষকদের দিন… এই দিনটায় প্রত্যেক ছাত্র ছাত্রী তার শিক্ষকদের শ্রদ্ধা জানায়, শ্রদ্ধা জানাতে নানান রকম উপহার দেয়। তোমরাও সবাই আজ আমাকে অনেক সুন্দর সুন্দর উপহার দিয়েছো, তার জন্য তোমাদের অনেক ধন্যবাদ। অনেক আশীর্বাদ রইল তোমাদের জন্য। আজ ক্লাসে উপহার দেওয়ার সময় সবাই আমার কাছে আব্দার করেছিলে যে কার উপহারটা সবচেয়ে সুন্দর বলতে হবে আমায়, আমি তখন বলেছিলাম যে পরে বলবো। এখন বলছি সেটা, আজ আমাকে সব থেকে সুন্দর উপহারটা দিয়েছে তমোঘ্ন, শুধু আজকের কেন আমার এই সাত বছরের শিক্ষক জীবনের এখন অবধি পাওয়া সেরা উপহারটা দিয়েছে তমোঘ্ন।”

এই অবধি বলে থামলেন স্যার। চারিদিকে তখন পিন পড়ার নিস্তব্ধতা। তুনতাই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে স্যারের দিকে; এদিকে স্নেহা রণজয়ের কানে কানে বলছে, “ও তারমানে লুকিয়ে লুকিয়ে স্যারকে আগে গিফট দিয়ে দিয়েছিল!” রণজয় স্নেহাকে কিছু বলার আগেই স্যার আবার বলা শুরু করলেন, “আজ তমোঘ্ন যখন স্কুলে আসছিল তখন রাস্তার মাঝে এক বয়স্ক করে মানুষ হঠাৎ করে মাথা ঘুরে পড়ে যান বাজারের ব্যাগ সুদ্ধ। বেলা প্রায় সাড়ে দশটা তখন, রাস্তায় সবাই নিজের নিজের কর্মস্থলে যাওয়ার জন্য ব্যস্ত তাই কেউ সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসেনি। কিন্তু তমোঘ্ন বৃদ্ধকে দেখে ছুটে যায়, ধরে তোলার চেষ্টা করে ওনাকে কিন্তু ছোট্ট শরীরে পারেনা তুলতে। তবে ওকে দেখে তখন কয়েকজন সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসে এবং সবাই মিলে মানুষটিকে তুলে বসায় রাস্তার ধারে। তমোঘ্ন এরপর নিজের জলের বোতল থেকে জল নিয়ে ওই মানুষটার হাতের ছড়ে যাওয়া জায়গাটা পরিষ্কার করে দেয় তারপর ওনার ছেলে না আসা অবধি ওনার কাছেই বসে থাকে। আর ওই মানুষটার ছেলে হলাম এই আমি। আমার বাবার বরাবরের অভ্যাস সকালে বাজার যাওয়ার, আজও গিয়েছিলেন সেরকম কিন্তু প্রেসার ফল করে পড়ে যান রাস্তায়।” এতটা বলে স্যার দম নেওয়ার জন্য থামলেন আবার, ইতিমধ্যে চাপা গুঞ্জন শুরু করে গেছে সবার মধ্যে। তুনতাই চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে স্যারের পাশে। স্যার আবার বলা শুরু করলেন, “আমরা শিক্ষক, শিক্ষা দেওয়াই আমাদের কাজ কিন্তু আমাদের দেওয়া এই শিক্ষাগুলো শুধু পরীক্ষায় ভালো নম্বর পাওয়া বা বড় হয়ে টাকা রোজগার করার জন্য নয়। অবশ্যই পরীক্ষায় ভালো ফল করার এবং বড় হয়ে রোজগার করাটাও জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু তার থেকেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো আমাদের দেওয়া শিক্ষাটাকে নিজের প্রাত্যহিক জীবনে প্রয়োগ করা, যেটা তমোঘ্ন আজ করেছে। ছেলেবেলায় নীতিবোধের শিক্ষা আমাদের সবার শিক্ষক দিয়েছেন, তোমাদের আমরা দিচ্ছি কিন্তু কয়জন আমরা সেটা আমাদের জীবনে সত্যিকারের প্রয়োগ করি? শিক্ষক শিক্ষা দেবেন কিন্তু সেই শিক্ষাটাকে কাজে লাগানোর দায়িত্ব সম্পূর্ণভাবে শিক্ষার্থীদের আর যদি তারা সেটা করে তাহলে সেটাই হয় একজন শিক্ষকের জীবনে পাওয়া শ্রেষ্ঠ উপহার। আজ তমোঘ্ন আমাকে সেই সেরা উপহারটা দিয়েছে…”

শেষ কথাগুলো বলতে বলতে স্যারের গলাটা কেঁপে উঠলো, চুপ করে গেলেন তিনি। তারপরেই গোটা স্টেজ ফেটে পড়ল হাততালিতে। তুনতাই অনুভব করতে পারছে ওর বুকের সেই কষ্টটা কোথায় যেন মিলিয়ে যাচ্ছে আস্তে আস্তে, পরিবর্তে মাথার ওপর স্যারের স্নেহের স্পর্শে এক অনাবিল ভালো লাগা এসে মিশে যাচ্ছে ওর মনে।

***শেষ***


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama