Ariyam Bhattacharya

Horror Tragedy Classics

3.5  

Ariyam Bhattacharya

Horror Tragedy Classics

টান

টান

9 mins
2.9K



বিষয়বস্তু : এই গল্প এক অসহায় বাবার যিনি তাঁর একমাত্র পুত্র সন্তান কে অকালে হারিয়েছেন চিরতরে।ঈশ্বরের বিচার আমরা কতটাই বা বুঝি!


সালটা সম্ভবত ২০০৫। আমি তখন একটি নামকরা রং প্রস্তুতকারী বহুজাতিক সংস্থায় টেকনিকাল সেলস বিভাগে কর্মরত। নতুন চাকরি। অভিজ্ঞতার নিরিখে আমি নিতান্তই আনকোরা। কর্মজীবনের প্রথমদিকের দিনগুলো বোধকরি ভুলতে পারা যায়না কোনোদিনই।। পায়ের তলার জমি শক্ত করার চেষ্টা চালাতে গিয়ে কত বিচিত্র পরিস্থিতির সম্মুখীন যে হতে হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই কোনো। সেলস এর চাকরিতে বিস্তর ঘোরাঘুরি থাকে। আর নতুন ছেলেদের দৌড় ঠিক কতটা তা পরোখ করে নেবার জন্য কোম্পানি ইচ্ছাকৃত ভাবেই অনেক সময় তাদের সবচাইতে সুদূরবর্তী ও প্রত্যন্ত জায়গায় কাজ দিয়ে পাঠায়। ব্যাপারটা প্রথম প্রথম কষ্টকর তা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই বটে, তবে এতে করে বিভিন্ন ধরণের মানুষ,তাদের বিবিধ জীবনযাত্রা এবং সর্বোপরি অঞ্চলভিত্তিক লোকসংস্কৃতি সম্পর্কে যে প্রভূত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করা যায় তা এককথায় অসামান্য। নালিশ বা অভিযোগের ধাত টা আমার বরাবরই কম। হাজার অসুবিধে সত্ত্বেও ভ্রমণ এবং নতুন নতুন মানুষ চেনার বিষয়টা আমি উপভোগ ই করে এসেছি চিরকাল। তা যে সময়ের কথা বলছি সেটা ছিল শীতকাল। জায়গাটির নাম কাসনা। এটি উত্তরপ্রদেশের একটি রুক্ষ গ্রামাঞ্চল। লোকবসতি নেহাত ই কম বিশেষ করে ইন্ডাস্ট্রিয়াল বেল্ট এ প্রতিষ্ঠান গুলো সঙ্গত কারণেই মানুষের বসবাসের এলাকা থেকে বেশ খানিক তফাতে তৈরী করা হয়। এপ্লিকেশন লাইন এ কিছু টেকনিকাল সমস্যা এসে পড়ায় আমাকে সেখানে পাঠানো হয়। মোটামুটি দিন চার এক এর ব্যাপার। প্রথমে ডিপার্টমেন্ট এ গিয়ে সমস্যার ধরণ বুঝে একটা সল্যুশন বের করা এবং কাস্টমার এর সামনে সেই সল্যুশন এর ট্রায়াল করে তার সন্তুষ্টির প্রমান সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে হেড অফিস এ রিপোর্ট করা, এই হলো আমার কাজ। 


কোম্পানির তরফ থেকে আমার থাকার ব্যবস্থা করা হয় একটি স্থানীয় গেস্ট হাউস এ। গেস্ট হাউস টি কারখানা সংলগ্নই বলা চলে। ওই অঞ্চলের বাসিন্দারা যে এলাকায় থাকে সেটি গেস্ট হাউস থেকে বেশ খানিকটা দূরে। ফলত সামান্য দোকানপাঠ বা যেকোনো প্রয়োজনে লোকবসতি অবধি পায়ে হেঁটে পৌঁছনো প্রায় এক অসম্ভব ব্যাপার।গেস্ট হাউস এ রান্নাবান্না বা নিদেন পক্ষে সামান্য চা তৈরী করার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। এইসব কারণে কোম্পানির ট্রাভেলিং সেলস এক্সেকিউটিভ দের যে যখন ওই গেস্ট হাউস এ এসে ওঠে তার থাকা খাওয়ার বিষয়টা দেখা শোনা করার জন্য স্থানীয় একটি লোক কে কোম্পানির তরফ থেকেই ঠিক করে দেওয়া হতো। তার নাম ছিল পারভিন্দর। মাঝারি বয়স ও মাঝারি চেহারার চটপটে মানুষ ছিল পারভিন্দর। সে তার একটি জিরজিরে মোটর বাইকে করে খুব ভোর ভোর আমার জন্য জলখাবার নিয়ে গেস্ট হাউস এ চলে আসতো ।আমার টুকটাক যা যা লাগবে সেইসবের ব্যবস্থা করে দিয়ে সে গ্রাম এ ফিরে যেত। তার কাছে গেস্ট হাউস এর একটা চাবি থাকতো। বিকেলের দিকে সে রাতের রান্না সাথে করে নিয়ে এসে সেসব ঢাকা দিয়ে রেখে ঘরদোর ঝাড়পোঁছ করে সন্ধ্যের মুখোমুখি বিদায় নিতো। গেস্ট হাউস থেকে কারখানা যাতায়াতের জন্য কোম্পানির গাড়ি থাকতো আমার জন্য।


যেহেতু নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করার ব্যাপার ছিল তাই আমার ফিরতে ফিরতে একটু রাত ই হতো প্রতিদিন। প্রত্যন্ত অঞ্চলে নেটওয়ার্ক এর সমস্যার জন্য বাড়িতে বা বন্ধুবান্ধব দের সাথে ফোন এ বেশি কথা বলার উপায় ছিলোনা। কোনো বই সাথে করে না নিয়ে যাওয়ায় সেই পথে সময় কাটানো ও ছিল অসম্ভব। তাই রাতের খাবারের পর বেশ খানিটা সময় স্রেফ বিছানায় শুয়ে শুয়ে এপাশ ওপাশ করতাম। উত্তরভারতের শীত তো আর কলকাতার মতো নয়, হাড়মজ্জা ইস্তক জমে বরফ হয়ে যাবার জোগাড়। কাজেই ঘুম আসতে চাইতোনা কিছুতেই। দুদিন কাটানোর পরেই বুঝলাম সমস্যা যথেষ্ট জটিল এবং তাতে হপ্তা খানেক সময় বেশি লেগে যেতে পারে। সেই মর্মে হেড অফিস এ খবর দিলাম। আমার কাসনা বাস দীর্ঘায়িত হলো। চতুর্থদিন রাতে আমি ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে প্রাণপণ-এ ঘুমোনোর চেষ্টা করছি।এমন সময় একটা অস্পষ্ট খসখস শব্দ কানে এলো। এমনিতে রাত ৯টার পর থেকেই সমস্ত জায়গাটা জুড়ে শ্মশানের নিস্তব্ধতা নেমে আসতো , সামান্য কিছু কোম্পনি যারা রাতেও কাজ চালাতো তাদের কারখানা থেকে মাঝে মাঝে কিছু আওয়াজ আসতো বটে,তবে সেসব ই ছিল আমার পরিচিত শব্দ। কিন্তু এই শব্দটা একেবারেই আলাদা এবং সেটা এসেছে খুব কাছ থেকে।


আমি একইভাবে শুয়ে রইলাম। মিনিট তিন একের মধ্যেই আবার শোনা গেলো শব্দটা। এবার আর একটু স্পষ্ট। শুয়ে শুয়েই ধারণা করলাম সেটা আসছে সবার ঘর সংলগ্ন ছোট্ট বারান্দাটা থেকে। সাহস করে উঠে পড়লাম। আলো জ্বেলে বেরিয়ে এলাম বারান্দায়। হয়তো ইঁদুর বা ঐজাতীয় কিছু হবে। কিন্তু বারান্দার আলো এতটাই ক্ষীণ যে তাতে ইঁদুর এর মতো শশব্যস্ত জীব খুঁজে পাওয়া অসম্ভব। কোথাও কিছু নেই দেখে আবার শোবার ঘরে ফিরে যাবো এমন সময় একটা অদ্ভুত ব্যাপার চোখে পড়লো। এমনিতে এই অঞ্চলে ধুলো খুব বেশি তার ওপর সন্ধ্যের দিকে সামান্য বৃষ্টি হওয়ায় বারান্দাটা কেমন কাদা কাদা হয়েছিল। ভেবেছিলাম সকালে পারভিন্দর এলে প্রথমেই তাকে বলবো জায়গাটা পরিষ্কার করার কথা। কিন্তু দেখলাম বারান্দাটা একেবারে শুকনো খটখটে এবং কাদার দাগের ছিটেফোঁটাও নেই। আপনা থেকেই এরকম পরিষ্কার হয়ে গেলো কিকরে চিন্তা করতে করতে আরও কয়েক পা এগোতেই চোখে পড়লো একজোড়া ফোম এর চটি। ঠিক প্রবেশ দরজার পাশেই রাখা। পারভিন্দর আসাযাওয়া করছে আজ তিন দিন হয়ে গেছে। সে জুতো পরে আসে রোজ আর সাকুল্যে ঘন্টা দেড় একের কাজ থাকে তার। একপাটি চটি বয়ে নিয়ে এসে রেখে যাওয়ার কোনো মানেই হয়না। সবচেয়ে বড় কথা হলো গেস্টহাউসে ফিরে নিজের জুতো ছাড়ার সময় আমি সেখানে আর অন্য কোনো চটি দেখিনি। এখন আমার জুতোর ঠিক পাশেই সেই চটি দেখে বেশ অবাক লাগলো। আগামীকাল সকালে পারভিন্দর কে জিজ্ঞাসা করবো এই ভেবে আবার শোবার ঘরে ফিরে এসে শুয়ে পড়লাম। মিনিট ঘুরতে না ঘুরতেই আবার সেই শব্দ। এবার ঘরের ভিতর থেকে। আমি প্রায় লাফিয়ে উঠে বিছানায় বসে পড়লাম। ভৌতিক কান্ড।


এই পাণ্ডববর্জিত জায়গায় একি বিপদে পড়লাম রে ভাই। হঠাৎ ই মাথার শিয়র থেকে ভাঙাভাঙা কণ্ঠস্বর শোনা এলো,"ডর গায়ে কেয়া সাহাব। " চমকে পিছন ঘুরে দেখি একটি বয়স্ক লোক। অধময়লা খাটো ধুতি আর একটা ধুলোমলিন ছোপ ছোপ সোয়েটার গায়ে কুঁজো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আমার দিকে চেয়ে। বিস্ময় আর ভয়ে তখন আমার প্রাণান্তকর অবস্থা। মুখ দিয়ে কথা বেরোনো দূরস্থান। আমাকে শান্ত করার চেষ্টা করে লোকটি বললো, "গল্তি সে দরওয়াজা খুলা রেহ গায়া থা সাহাব। ম্যায়নে আওয়াজ লাগায়া। আপ সো রাহে থে। ইসলিয়ে অন্দর আয়া দেখনে কেলিয়ে সব ঠিক তো হায়। " আমি হিন্দিতে বললাম অন্দর আ গায়ে মানে? আপনি কে ? আর আমি তো ঘুমোনোর চেষ্টা করছিলাম।ঘুম তো আসেনি। আমি তো কোনো আওয়াজ পেলাম না! " সে আবার বলে উঠলো আমি নাকি সত্যিই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।সেই কারণ এই টের পাইনি কিছু। কি করা উচিত বুঝতে না পেরে থম মেরে বসে রইলাম খানিক ক্ষণ।লোকটাকে দেখে চোর ডাকাত বা কোনো খারাপ মতলব আছে বলে তো মনে হলোনা।দিব্যি গোবেচারা গোছের চেহারা,কথাবার্তাও বেশ সংযত।ভয় ও বিস্ময় এর ভাবটা একটু থিতিয়ে এলে পরে লোকটাকে বসতে বললাম। সে বিছানার পাশের চেয়ার এ না বসে দেখলাম গুটিশুটি মেরে ঠান্ডা মেঝের এক কোনায় বাবু হয়ে বসলো। একটু ইতস্তত করে ছোট্ট ঝোলা ফ্লাস্ক গোছের জিনিস বের করে আমাকে জিজ্ঞাসা ,করলো "চায় পিয়োগে সাহাব ?" খটকা লাগলো


। কোথা থেকে একটা অপিরিচিত লোক বলা নেই কওয়া নেই ঘরে ঢুকে এসে চা খাওয়া তে চাইছে।তবে জানিনা কেনো মুহূর্তে সেই অস্বস্তি টা কেটে যেতে লাগলো। হাড়কাঁপানো ঠান্ডায় অপ্রত্যাশিত গরম চায়ের সন্ধান পেলে ফিরিয়ে দেওয়া বেশ কঠিন। তাই রাজি হয়ে গেলাম। সেও আন্তরিকতার সাথে কাগজের কাপ এ আমার দিকে চা এগিয়ে দিয়ে শুরু করলো নিজের কথা। 


জানতে পারলাম এই গভীর রাতের আগন্তুক অতিথির নাম হেমরাজ রাঠী। কাসনা থেকে বুলন্দশহরের দিকে যেতে মাইল সাতেক ভিতরের দিকে আর একটি গ্রাম পড়ে যার নাম ঘনঘোলা। সেই গ্রাম এ হেমরাজ দের প্রায় চার পুরুষের বাস। পূর্বপুরুষরা চাষাবাদ করে জীবিকা নির্বাহ করলেও বিগত তিরিশ বছরে অতিরিক্ত কম বৃষ্টিপাতের জন্য সেখানকার বেশিরভাগ জমিই চাষের অযোগ্য রুক্ষভূমি তে পরিণত হয়। সরকার এর তরফে যথেষ্ট চেষ্টার অভাবে গ্রাম এর বহু পরিবার চারপাশের প্রধান শহরগুলোতে উপার্জনের আশায় যেতে বাধ্য হয়। তাদের বেশিরভাগেরই আর গ্রামে ফিরে আসা হয়নি। হেমরাজ পৈতৃক জমিজায়গার ওপর নাড়ির টান উপেক্ষা করে যেতে পারেনি। সামান্য চাষজমি সম্বল করে স্ত্রী ও এক পুত্র সন্তান নিয়ে ছিল তার ছোট্ট সংসার।স্ত্রীর মাঝে মাঝেই ঘুষঘুষে জ্বর আর কাশি হতো। ছেলের বয়স যখন আট হঠাৎই মাত্র দুইদিনের জ্বরে স্ত্রী মারা যান। সদর হাসপাতাল থেকে জানানো হয়েছিল ফুসফুসে ইনফেকশন। সময়মতো চিকিৎসার অভাবে কিছুই করা সম্ভব হয়নি। সেই থেকে শুরু হয় হেমরাজের জীবনের এক নতুন লড়াই।ওই বয়সী ছেলের জীবনে একইসাথে বাবা এবং মায়ের ভূমিকা পালন করা এবং তাকে লেখাপড়া শিখিয়ে প্রতিষ্ঠিত করার জেদ নিয়ে স্বপ্ন দেখা শুরু করে হেমরাজ। প্রায় দুঘন্টা সাইকেল চালিয়ে প্রত্যেকদিন ছেলেকে স্কুল এ দিয়ে আসতো সে , নিয়েও আসতো সেইভাবেই। নিজে লেখাপড়া না জানলেও রোজ নিয়ম করে পড়তে বসানো এবং গ্রাম এর বেশিরভাগ সমবয়সী বাউন্ডুলে ছোকরাদের সান্নিধ্যে এসে ছেলে যাতে কিছুতেই বিপথে না চলে যেতে পারে সেইদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতো সে। নিজের যাবতীয় সঞ্চয় এবং যৎসামান্য উপার্জন সবকিছু বাজি ধরে ছেলেকে মানুষ করতে চেয়েছিলো হেমরাজ। ছেলেও তাকে হতাশ করেনি। বাপের কষ্ট সে বুঝতো। মন দিয়ে পড়াশুনো করে দিল্লি টেকনিকাল উনিভার্সিটি থেকে সসম্মানে ডিগ্রি অর্জন করে চাকরি পায় একটি বেশ নামকরা ইলেকট্রনিক কোম্পানি তে। এই অঞ্চলেই তাদের প্লান্ট ছিল। ছেলে চাকরি পাবার পর থেকে হেমরাজের জীবনে ধীরে ধীরে একটা পরিবর্তন আসতে থাকে। দীর্ঘ লড়াই এর পর সুখের কোমল স্পর্শ তাদের নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধান দেয়। সাধ হয় কটা বছর গেলে ছেলের একটা বিয়ে দিয়ে শেষ কর্তব্যটা সারতে পারলেই ব্যাস। জীবনে আর কোনো অপূর্ণতা থাকবেনা। 


এই অবধি বলে দম নেবার জন্য থামলো হেমরাজ। একটা দীর্ঘশ্বাস এর পর বললো ছেলে নাকি কাজের সুবাদে কদিনের জন্য বাইরে কোথাও গিয়েছে। অনেক দূরে। তাই একা একা বাসায় মন টেকে না বলে এদিক ওদিক ঘুরতে থাকে সে। এই গেস্ট হাউস এর আসে পাশে সে প্রায়ই আসে। তবে এর আগে যাদের এখানে থাকতে দেখেছে তারা সবাই বেশ বয়স্ক আর হোমরা চোমরা। তাই যেচে কথা কইবার সাহস হয়নি তার। আমার বয়স একেবারেই তার ছেলের মতো। তাই আমাকে দেখে সে আলাপ করতে এসেছে সঙ্গে করে চা নিয়ে। কথা বলা শেষ করে হেমরাজ ওঠার তোড়জোড় করলো। বলে গেলো আজ সবই আমার কথা বললাম , পরেরদিন এসে আপনার কথা শুনবো। আমি ওকে বিদায় দিয়ে এসে শুয়ে পড়লাম। ঘড়িতে তখন প্রায় একটা। হেমরাজের সাদামাটা সহজ জীবনের গল্প নিয়ে ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়লাম। 


পরেরদিন সকালে পারভীনদর এলে তাকে রাতের গোটা ঘটনাটা বললাম। দেখলাম ওর মুখ গম্ভীর হয়ে আসছে। সব শুনে শুধু একটাই কথা বললো ,"আপনার বয়স কম। এসবের মধ্যে থাকবেন না। কোম্পানি কে বলে তাড়াতাড়ি থাকবার ব্যবস্থা অন্য কোথাও করে নিন। " শুনে আমার ভারী রাগ হলো। এক তো এখানে সন্ধ্যের পর কেউ থাকেনা। একটা লোক এসে কিছুক্ষন সঙ্গে দিলো ,এই প্রবল ঠান্ডায় চা খাওয়ালো এসবের কোনো মূল্য নেই?উল্টে মুখ ভার করছে? আমি আর ওকে কিছু বললাম না। জলখাবার শেষ করে রওনা দিলাম ফ্যাক্টরির দিকে। এর দিন দুএক পরে বিকেলে টি ব্রেক এ কোম্পানির এক বয়স্ক অপারেটর এর সাথে কথা হচ্ছিলো। এটা সেটা প্রসঙ্গ ঘুরে আমি হেমরাজের কথা তুললাম। বললাম এই নামের কাউকে সে চেনে কিনা।লোকটা কেমন। সেই অপারেটর খানিক্ষন আমার মুখের দিকে হাঁ করে চেয়ে থেকে বললো "তার কথা আপনি জানলেন কিকরে?" আমি হালকা ভাবে বললাম যে পারভিন্দর এর মুখে শুনছিলাম বটে তবে সে যে আরো কি কি বলছিলো সেদিকে তেমন মন দিই নি। অপারেটর বললো ,"হেমরাজের কথা এই অঞ্চলে যারা একটু পুরোনো তারা সবাই জানে। বড় ভালো ছিল মানুষটা। একটা সময় এইখানেই বিভিন্ন কোম্পানি তে ঘুরে ঘুরে চা বিক্কিরি করতো। সেই করে ছেলেকে অনেকদূর পড়িয়েছিলো। এখান কার গ্রামগুলোতে লেখাপড়ার তেমন চল নেই।কিন্তু হেমরাজ ছিল একরোখা।ছেলেকে ইঞ্জিনিয়ার বানাবেই।নম্র স্বভাবের জন্য সবার সাথেই আলাপ ছিল হেমরাজের। ওর ছেলে এই এলাকাতেই চাকরি পেয়ে এসেছিলো মেইনটেনেন্স সুপারভাইজার এর। একবার নাইট ডিউটি তে থাকাকালীন সেই কোম্পানি তে কন্ট্রোল প্যানেল রুম এ ভয়াবহ আগুন লাগে। মুহূর্তে কালো ধোঁয়া এতটাই গাঢ় হয়ে যায় যে বেরোবার পথ ঠাহর করতে না পেরে সেই সময় শিফট এ উপস্থিত দুজন মেইনটেনেন্স অপারেটর এর ই প্রাণ যায়। হেমরাজের ছেলে ছিল তাদের একজন। কোম্পানি অবশ্য যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিল। তবে শেষ রক্ষা হয়নি। তারপর থেকে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে হেমরাজ পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিলো। বছর ঘুরতে না ঘুরতে সেও গায়ে আগুন দিয়ে আত্মহত্যা করে। খুবই দুঃখ্যের ঘটনা।আজ প্রায় দশ বছর কেটে গেছে সেই ঘটনার।বাপ্ বেটা দুজনেই খুব ভালো মানুষ ছিল। "


স্তম্ভিত হয়ে শুনছিলাম। হাতের চা টা আর শেষ করতে পারলাম না। একি শুনলাম?একি সম্ভব?সেদিন রাতে কে আমার ঘরে এসেছিলো ,আমাকে চা খাইয়েছিল এ প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই। তবে নাই বা জানলাম। হেমরাজের মতো একজন সহজ সরল, সৎ ,মাটির মানুষ এর সাথে কোনোদিন আমার আলাপ হয়েছিল। নির্বান্ধব শীতের রাতে ভাগ করে নিয়েছিল পরম স্নেহের উত্তাপ। হয়তো আমার মধ্যে ক্ষণিকের জন্য নিজের ছেলে কে খুঁজে পেয়েছিল সে। সেই স্মৃতি আমার আমরণ সঙ্গী হয়ে থাকবে। ঈশ্বরের কাছে আজও প্রার্থনা করি হেমরাজ ও তার ছেলের আত্মা যেন শান্তি পায়। 


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Horror