STORYMIRROR

Partha Pratim Guha Neogy

Tragedy

4  

Partha Pratim Guha Neogy

Tragedy

ত্রাণ

ত্রাণ

4 mins
350

দক্ষিণ ২৪ পরগনার প্রত্যন্ত অঞ্চলের একটি গ্রাম। নদীমাতৃক এই দেশে মানুষ বেঁচে আছে প্রাণ হাতে করে। কথায় আছে - নদীর পাশে বাস, চিন্তা বারো মাস। এখানে জীবনের ভয় প্রতিপদে। একদিকে হিংস্র প্রাণীর জন্য আর আরেক দিকে প্রাকৃতিক দুর্যোগের। এই প্রত্যন্ত অঞ্চলের বেশীর ভাগ মানুষই প্রান্তিক মানুষ। গ্রামগুলি নিম্নবিত্ত মানুষেই ভর্তি - যাদের কাছে ২ বেলা ভাত খেতে পাওয়াটা একটা ভীষণ বড় সৌভাগ্যের ব্যাপার - সাধারণত এরা কোনরকমে একবেলা খেয়ে দিনাতিপাত করে থাকে। এই সব গ্রামের সমস্ত শিশুরা অপুষ্টিজনিত রোগে আক্রান্ত - যাদের দুবেলা পেট ভরে খাওয়া জোটে না, তাদের আবার পুষ্টি। কি রকম হাস্যকর শোনায় না? তবুও প্রাকৃতিক দুর্যোগের সাথে লড়াই করে ওরা প্রতিদিন বাঁচে। সেরকম ভাবে স্থায়ী কর্ম সংস্থান নেই বললেই চলে। এখন অবশ্য সরকারের ১০০দিনের কাজের যোজনায় কিছু কাজ মেলে। তাও সকলের জন্য সমান ভাবে বিতড়িত হয় না। গোটা দিনের পরিশ্রমের সম্পূর্ণ মজুরী ভাগ্যে জোটে না। যারা কাজের জোগানোর দেয় তারা তাদের কমিশন কেটে নেয় দিন মজুরী বাবদ উপার্জিত অর্থের থেকে, প্রতিবাদ করা সম্ভভ হয় না - কারণ তাহলে ভবিষ্যতে আর কাজ মিলবে না। তাই মুখ বুজে অর্ধ - মজুরীতে কাজ করতে হয়। যাদের এই ধরনের সরকারী কাজ না জোটে তাদের করার মত কাজ হল সুন্দরবনের খাঁড়িতে কাঁকড়া ধরার কাজ - ফলে অনেক সময় খাবারের সন্ধানে গিয়ে নিজেই হয়ে যায় হিংস্র পশুর খাদ্য। এই সব পরিবারে রান্নার জন্য উনুনই সম্বল, এল পি জি গ্যাসের উজালা প্রকল্পের পাতা ভরা বিজ্ঞাপনগুলো শুধুই বিজ্ঞাপন এদের কাছে। ওগুলো শহরের বাবুদের ভোটের সময় কাজে লাগে। ঐ ভোটের সময়টুকু বাদ দিলে, ওদের ভাগ্যের মত ওদের সংসার অন্ধকারে ডুবে থাকে। সেজন্য জ্বালানির খোঁজে যখন শুকনো ডাল পালা আর পাতা কুড়োতে বনে যায়, তখন কেউ কেউ বন্য পশুর খাদ্য হয়ে যায়। এছাড়াও রয়েছে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ভয়। সামান্য ঝড় বৃষ্টিতে ওদের দুর্দশার অন্ত থাকে না। তার উপরে যদি প্রচন্ড ঝড় বৃষ্টি বা কোন নিম্নচাপের সৃষ্টি হয়, তখন নদীর উপরের বাঁধ গুলোতে ফাটল ধরে যায় বা কখন কখনও বাঁধ ভেঙে গিয়ে সমস্ত অঞ্চলগুলিকে প্লাবিত করে দেয়। ফলে ওদের ঘর বাড়িগুলো জলের প্লাবনে ভেসে যায়। তখন ওরা হয় গ্রামের স্কুল বাড়িতে অথবা কোন উঁচু জায়গায় অস্থায়ী বাসস্থান তৈরী হয়। সরকারের থেকে ত্রাণ আসে, যদিও তার একটা বড় অংশ চলে যায় মাতব্বরদের দখলে। সেটা টাকাই হোক, ত্রিপল হোক অথবা নগদ টাকা। বাকি অংশ নিয়ে এই গৃহহীন ক্ষুধার্ত মানুষগুলো নিজেদের মধ্যে মারামারি করে মরে। সরকারী সাহায্য ছাড়াও অনেক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন আর সঙ্গে তুলে নেন এই অসহায় মানুষগুলির দুর্গতির ছবি যাতে তাদের ত্রাণ দেওয়ার ছবিও যোগ করা থাকে। এগুলো প্রচারের জন্য খুব কাজে আসে। তাই মানুষগুলো সব সময় প্রচারের পণ্য হিসাবে কাজ করে - সেটা চলচিত্র শিল্প, বিপনন বা ভোটের কাজই হোক। এরাও এটা বুঝে গেছে তাই ওসব নিয়ে মাথা ঘামায় না। জানে এভাবেই জীবনটা একদিন শেষ হয়ে যাবে। এদের জীবনে নেই কোন উচ্চাশা, নেই কোন অহংকার, নেই শিক্ষার সুযোগ - আছে শুধু জীবন সংগ্রামের লড়াই। কখনও কখনও কম বয়েসে ওরা স্বপ্ন দেখে এ জীবনের হাত থেকে মুক্ত হওয়ার। কিন্তু আজ স্বাধীনতার ৭৫ বছরে এদের জীবনের সেরকম কোন পরিবর্তন আসেনি।


মা ভুটভুটি কখন আসবে গো ?” – মঙ্গল মায়ের আঁচল ধরে আর একবার টানলো। ফুল্লরা একটু ঝাঁঝিয়ে উঠে বললো “আহ! জ্বালাতন করিসনা বাপ।” সেই কাকভোর থেকে হাঁটুডোবা জলে লাইন দিয়ে হাপিত্যেশ করে দাঁড়িয়ে আছে ফুল্লরা । ছোটো ছেলে মঙ্গলকে নদীর পাড়ে বসিয়ে রেখেছে। আর বড় মেয়ে খেঁদিকে অন্য এক জায়গায় পাঠিয়েছে ত্রাণের লাইন দিতে। যেটুকু পাওয়া যায় তার জন্য এই প্রাণপণ চেষ্টা। অন্ততঃ দুটো দিন টেনেটুনে চলে যাবে। সময় খুব তাড়াতাড়ি পেরিয়ে যায়। বছর তিন আগেও অবস্থা এতটা খারাপ ছিলনা। মঙ্গলের বাপ মাছ বেচে আর ফুল্লরার জাল বুনে যা আয় হতো সংসারটা চলে যেত। খেঁদিকে সরকারী ইস্কুলে ভর্তি করা হয়েছিল।সেসব যেন এখন স্বপ্নের মত লাগে।মঙ্গলের বাপটা আজ দুই বছর হলো জঙ্গলে কাঠ কাটতে গিয়ে আর ফেরেনি।একটা মাটির ঘর, দুই ছেলেমেয়ে ও কিছু বাসনকোসন রেখে মায়া কাটিয়েছে। বাবা দখিনরায়ের কোপ পড়েছিল।জঙ্গলে শরীরের অবশেষ কিছু খুঁজে পাওয়া যায়নি।তারপর থেকে কোনোরকমে মাছ ধরার জাল বুনে, সব্জি বেচে দুবেলা খাবার জোটে। ফুলমণি কষ্ট করে,মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ছেলেমেয়ের মুখে একটু হাসি ফোটাতে চায়। তাও যেন কপালে সহ্য হয়না। দেবতা ও প্রকৃতির রোষ বছর বছর আছড়ে পরে এই সোঁদরবনে। সেবার আয়লাতে ঘরের চাল উড়ে গেল, খানিক মাটি ধসে গেল। শহরের দাদাবাবু দিদিমনিরা সব এসেছিলেন, কত ত্রাণ দিয়েছিলেন। তারা বলেছিলেন তোদের সব পাকা ঘর হবে,বাঁধ হবে। তাদের কথায় এই আধমরা মানুষগুলো মনে বল পায়। ত্রাণ ও সাহায্যে কিছুদিন চলে যায়। তারপর আবার সব অন্ধকার। মঙ্গল ছেলেমানুষ ,এই সবে ছয় বছর বয়স।অবুঝ মনে এটা ওটা বায়না করে। ফুল্লরার বুকের ভেতরটা হু হু করে, একটা কষ্ট গলার কাছে দলা বাঁধে। আর খেঁদি বারো বছর বয়সেই যেন অনেকটা বড় হয়ে গেছে।মায়ের কষ্ট সে বুঝতে পারে। যতটা পারে ফুল্লরাকে হাতে হাতে সাহায্য করে। ধীরে ধীরে একটু গুছিয়ে নিতে না নিতেই আবার এলো আম্ফান ঝড়। সামান্য মেরামত করা ঘরটাও জলে পড়ে গেল। আর কিছুই অবশিষ্ট নেই, শুধু একবুক হাহাকার ছাড়া। একটা ত্রিপল খাটিয়ে তাতেই রোদ,জল আটকানোর বৃথা চেষ্টা। বাবুরা বলেছিল পাকা বাঁধ হবে; মোদের ও পাকা ঘর হবে। সেই আশাতেই আজও বুক বাঁধা। মঙ্গল আর খেঁদি আবার ইস্কুল যাবে। সব ঠিক হয়ে যাবে আগের মত। হঠাৎ ভুটভুটির আওয়াজে ভাবনার ঘোর কাটলো। মঙ্গল আঁচল ধরে টেনে বললো ” মা!ও মা! ওরা এসে গেছে “। লাইনে দাঁড়ানো সবার মধ্যে হুড়োহুড়ি শুরু হল।কে আগে যাবে, কতটুকু বেশি জিনিস পাবে তার জন্য শুরু হল ঠেলাঠেলি। সেই ভিড়ে ও কোলাহলে ফুল্লরার মত আরও কতজনের দীর্ঘশ্বাস চাপা পড়ে গেল। এই চাপা পড়ে যাওয়া দীর্ঘশ্বাসের মত ওদের ভাগ্যও চাপা পড়ে থাকে।



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy