তোমার আমার গল্প
তোমার আমার গল্প


দুপুরবেলায় ঠিক এই সময়টায় একটা ঝিমুনির ভাব চেপে ধরে ঝিলিককে। বুকে গল্পের বই চেপে ধরে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিল, নিজেই টের পায় নি। আর করে টাই বা কি.. উত্তর কোলকাতার এই রক্ষণশীল বাড়িতে নিজের মতোন থাকার ই কি জো আছে একমুহূর্ত?? তিন ভাইয়ের যৌথ পরিবার। তার মধ্যে ছোট ভাইয়ের ছোট ছেলের বউ সে। শ্বশুর জ্যাঠ- শ্বশুরের সারাক্ষণ বংশ নিয়ে কথা শুনতে শুনতেই তার প্রাণ ওষ্ঠাগত!! একটু এদিক থেকে ওদিক হলেই..
"বৌমা তোমার বাড়ি থেকে কি কিছুই শিখিয়ে পাঠায়নি??
আর যেন কোনো কথা নেই মুখে। এরপর তো আছে বাইরে বেরোনোর ব্যাপারেও নজরবন্দি। পাড়ার দোকানে গেলেও শুনতে হবে..
"কেন আমাদের রঘু কে বলতে পারলে না.. তোমায় আবার যেতে হল??
রঘু মুখুজ্যে বাড়ির অনেক দিনের পুরোনো কাজের লোক। এই ভাইদের ছোটবেলা থেকেই বলতে গেলে সে আছে। তা, তার ও বোধহয় ঝিলিকের থেকে কিছু বেশী স্বাধীনতা ছিল এ বাড়িতে!! বইগুলো সেই এনে দিত তীর্থদার কাছ থেকে। তীর্থ রায় ঝিলিকের বড়ো জ্যাঠশ্বশুরের মেয়ে রিমাকে পড়াতো। সেই থেকেই আলাপ। রিমা প্রায় তার ই সমবয়সী,, এক দু বছরের ছোট হবে। ঝিলিক চুপ করে বসে পড়ানো শুনতো। তাতেও কতো সমস্যা। কেন একটা বাইরের ছেলের সামনে তাকে বসে থাকতে হবে, এতো পড়াশুনা করে হবে টা কি,, তার থেকে সংসারে আর একটু বেশী মন আসা উচিত,, ইত্যাদি ইত্যাদি।।
ঝিলিক এই বাড়িতে এসেছিল বছরতিনেক আগে, একুশ বছর বয়সে। গ্র্যাজুয়েশনের পরে পরেই। আরো পড়ার ইচ্ছা ছিল তার, এরা রাজিও হয়েছিল, কিন্তু পরে আর সেই কথা রাখেনি। জেঠিমা তো একদিন বলেই বসলেন.. যে মেয়েরা বেশী পড়লে তাদের নাকি মাথা খারাপ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। নামের মধ্যে একটু অনন্যতার ছোঁয়া থাকার সাথে সাথেই,, ঝিলিকের মনটাও হাঁটতো এই বাড়ির একদম বিপরীত পথে। স্বামী সৌমেন ও কিছু ব্যতিক্রম ছিল না। নিজের দরকার এবং রাতের বিশেষ কিছু মুহুর্ত তার আর ঝিলিকের সাথে কোনো মনের আদান প্রদান ছিল না। বেচারী ঝিলিকের এই গোটা বাড়িতে তীর্থদা আর বই ছাড়া দ্বিতীয় কোনো সঙ্গী ছিল না।।
ঘুম ভাঙল তার নিজেরই ফোনে সেট করা এলার্মে। কারণ রেডিওয় তার অতি প্রিয় একটি শো 'তোমার আমার গল্প'। প্রতি বুধবার হয়। দুটো থেকে চারটে। এদের বাড়ির অভ্যেস অনুযায়ী প্রায় চারটের আগে মেয়েরা কেউ খেতে বসে না। তার আগে খিদে পেয়ে গেকে পেটে কিল মেরে বসে থাকা ছাড়া আর গতি নেই। এরকমই এক অলস দুপুরে জানালা দিয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বিরক্ত হয়ে রেডিওটা অন করেই এই আবিষ্কার!! দু ঘন্টার জমজমাট গল্প। কখনো তা রোমান্টিক, কখনো রহস্য, কখনো ভৌতিক, কখনো বা অতি সাধারণ কাঠামোয় তৈরি গল্প। অনুষ্ঠানটির বৈচিত্র্যই ছিল ঝিলিকের আকর্ষণের প্রধান কারণ।।
আজকের গল্পের নাম 'অচেনা মানুষ'। চেনা মানুষ অবস্থা পরিপ্রেক্ষিতে যে অনেকটাই অচেনা অজানা হয়ে যেতে পারে.. সহজ পটভূমিকায় তারই এক সাধারণ গল্প। যথারীতি আজকের গল্পটাও ঝিলিকের খুবই ভালোলাগলো আর গল্পের পাখায় ভড় করে সেও যেন হারিয়ে গেল তার নিজের মনোজগতে। মনোজ আর টিয়ার এক হতে না পারার দু:খের সাথে মিশে তারও নিজের কিছু স্মৃতির কথা মনে পড়ে গেল। এমনি ই হারিয়ে গিয়েছিল অনেকদূর, হঠাৎ ঝিলিকের নিজের ডায়েরী টা কাছে নিয়ে একটু বসতে ইচ্ছা হল। এক সময় বেশ ভালোই লেখার হাত ছিল তার। আজ অনেকদিন যাবৎ আর তাতে কোনো আঁচর পড়েনি। এই বাড়িতে আসার পর থেকেই। কিছুটা পরিবেশ আর উৎসাহ দেওয়ার লোকের অভাবের জন্যই বোধহয়। আজ অনেকদিন পর কিন্তু ঝিলিকের কিছু লেখার ইচ্ছা হল, একদম নিজের মতোন করে অন্যরকম কিছু। গল্প চলতে চলতেই রেডিওর সাউন্ডটা একটু কম করেই লিখে ফেলল বেশ কয়েক লাইন। ছোট কবিতা! কিন্তু কথা হল, কাকে শোনাবে? এ বাড়িতে তো শোনানোর মতোন কেউ নেই.. হ্যাঁ এক তীর্থদা ছাড়া। চিন্তায় ডুবে আছে, গল্পও প্রায় শেষ,, এমন সময় হঠাৎ জেঠিমার প্রবেশ..
"ওমা কি লিখছ?
"কই কিছু না.. নিমেষে ডায়েরী বালিশের তলায়।
"খেতে এসো। বলেই তার দিকে একটা সন্দিগ্ধ দৃষ্টিপাত করে খাবারঘরে রওনা দিলেন তিনি। হাঁফ্ ছেড়ে বাঁচলো ঝিলিক। সাথে সাথে খুব খুশি হল এটা দেখে যে এতোদিন পর নিয়ে বসেও তার লিখতে এতোটুকু অসুবিধা হলনা। ঠিক সেইরকমই সাবলীল ও সুন্দর।।
সেইদিন সন্ধ্যাবেলাই তীর্থদা যখন রিমাকে পড়াতে এল, এক ফাঁকে তাকে পড়তে দিল কাগজটা ঝিলিক। রিমা বুঝতে পারলে আর রক্ষে ছিল না.. কথাটা পাঁচকান হয়ে যেত। পড়ে অল্প একটু হাসল সে কেবল.. মুখে কিছু বলল না। যদিও লেখাটা নিয়ে কোনো আলোচনা হতে পারেনি, তবুও তীর্থদার হাসিটা দেখেই মনে হয়েছে যে লেখা পছন্দ হয়েছে তার। সে নিজেও এতোদিন পর আবার কলম ধরতে পেরে খুব খুশি। তীর্থ নিজেও বড়ো একটা খারাপ লিখত না। বেশ কয়েকটি ম্যাগে তার লেখা বেড়িয়েওছে। ঝিলিকের লেখা পড়ার দু দিন পর তীর্থর কাছ থেকে একটা ফোন পেল সে। তার লেখা যদি কোথাও দেওয়া হয় তবে ঝিলিকের কোনো আপত্তি আছে কি না। কথার মানেটাই তখন খুব একটা বোধগম্য হয় না ঝিলিকের!! হয় যখন পরের দিন যখন দেখা হয় তখন তীর্থদার হাতে একটা ম্যাগ দেখে। তার লেখাটা 'কলমের ছোঁয়া' নামে। অবাক হয়ে গেল ঝিলিক। পরিষ্কার হল সেদিনের সেই প্রশ্ন। নামটাও তারই জন্য, সে বলেছিল খুব ভাল হয় তার নাম যদি প্রকাশ না করা হয়। তীর্থদা বলল প্রকাশক তার বন্ধু। প্রথমে নামের ব্যাপারটায় একটু খুঁতখুঁত করলেও পরে রাজি হয়েই যান। লেখাটা নাকি তার দারুণ লেগেছে। এরপর এই নামে তীর্থদা ফেসবুকে ঝিলিককে একটা পেজ খুলে দেয়। মনের দিক থেকে অগ্রণী হলেও, ভার্চুয়াল জগতে খুব একটা বিচরণ ছিল না ঝিলিকের। তাই প্রথম দিকটায় অতোটা উৎসাহ পাচ্ছিল না সে। কিন্তু পুরো বানিয়ে নিজের সম্বন্ধে কিছু লিখে সাজিয়ে নেওয়ার পর, তার বেশ ভাললাগতে লাগলো। 'কলমের ছোঁয়া' র পিছনে চলতে লাগল এক অন্য ঝিলিকের গল্প। একটার পর একটা ছবি সাজিয়ে কখনো মিষ্টি প্রেম, কখনো বিচ্ছেদ, কখনো সেই ছোট্টবেলার কাহিনী ছড়াতে লাগল তার বিস্তার। শুভেচ্ছাও আসতে লাগল প্রচুর। কেউ কেউ তো তার লেখার গুণগানে পঞ্চমুখ। মন ভরে উঠতে লাগল ঝিলিকের। কলমের পাখায় ভড় করে সে ঘুরে আসতে লাগল দূর বহুদূর। খাতায় আগে লিখত সে। পরে পছন্দ হলে ফোনে টাইপ করত। এমন চলার মাসখানেক পরে একদিন এমন এক ঘটনা ঘটল, যা ঘটবে বলে ঝিলিক একদম আশাই করেনি। যদিও সে খুবই সাবধানতা অবলম্বন করত লেখার সময়..
এমন সময় যখন আর সকলে বিশ্রাম করছে, বা আশেপাশে কেউ নেই। তাও একদিন ঝিলিক তার গল্প 'তিয়াসের আত্মকথা' যখন প্রায় শেষ করে এনেছে.. পিছনে একটা গমগমে গলা বলে উঠল....
"এগুলো তুমি কি লিখছ বউমা?? সেদিনও দেখলাম কি লিখছ.. আজও তাই!!
বলেই ঝিলিক কিছু বোঝার আগেই তার হাত থেকে খাতাটা ছিনিয়ে নিলেন জেঠিমা। উল্টেপাল্টে খানিকক্ষণ দেখে চেঁচামেচিতে প্রায় সারা বাড়িকে ঝিলিকের ঘরে এনে জড়ো করলেন তিনি। ঝিলিকের চোখে তখন জল.. পরিস্থিতির আকস্মিকতায় জবুথবু। কি করবে বলবে বুঝে উঠতে পারছে না। প্রায় চারটে বাজে তখন। খাওয়া দাওয়া ভুলে সবাই তখন তার বিচার করতে বসেছে। কত প্রশ্ন যে উঠে আসতে লাগল তার দিকে। কবে থেকে এরকম চলছে.. কি করে শুরু হল.. কে শেখাল ইত্যাদি ইত্যাদি। ঝিলিকের মনে হল যেন লেখালেখি নয়, খুনই করেছে বুঝি গোটা কতক!!! অবশেষে অনেক জল্পনা কল্পনার পর ঠিক হল রাতে সকলে ঘরে ফিরুক, তখন এর বিচার হবে। এতো বড়ো অন্যায় মুখুজ্যেবাড়িতে কিছুতেই ঘটতে দেওয়া যায় না।
সন্ধ্যায় রঘুদাকে দিয়ে তীর্থদাকে কোনোমতে নিজের ঘরে ডেকে পাঠিয়ে সব জানালো ঝিলিক। বলতে বলতে প্রায় ফুঁপিয়ে উঠল। কেউ বোঝেনা এই বাড়িতে তাকে, কেউ না। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল তীর্থরও। কিছু একটা করতেই হয়। তার মাথায় হাত দিয়ে বলে গেল..
"কিছু একটা ব্যবস্থা হবেই.. চিন্তা করিস না। তোর লেখা বন্ধ হতে দেব না।
সেটা ছিল একটা মঙ্গলবার। পরের দিন বুধবার অনেক দিন পর ঝিলিকের মায়ের কাছে যাওয়ার কথা ছিল। ভেবেছিল একসাথে বসে দুজনে 'তোমার আমার গল্প' শুনবে। তা আর হল না। বদলে কি হবে কে জানে। তীর্থদাও কি সত্যি কিছু করে উঠতে পারবে?? সকলে এলে যথারীতি তাকে ডেকে পাঠানো হল। সারা ঘর থমথম করছে। বড়ো কর্তা জিজ্ঞেস করলেন এই বুদ্ধি বা সাহস কোথা থেকে হল তার?? বাড়ির বউ লিখছে,, তা আবার কোথাও নাকি ছাপাও হচ্ছে আবার তারাও কিছু জানতে পারলেন না.. এ সব তো চিন্তা ভাবনার বাইরে। জেঠিমা তো বলেই বসলেন.. আরো কতো কি চলছে নিশ্চই বাইরে.. যা তারা জানতেও পারেন না। ঝিলিকের বুক ফেটে কান্না আসতে লাগল। সেই দুপুর থেকেই সে না খেয়ে আছে, একবার তার শ্বাশুড়ি এসে কোনোরকমে বলে গেছে। সে যায় নি, তার পর থেকে আর কারুর কোনো সাড়া শব্দ নেই!! আরো কিছুক্ষণ বিচার বিশ্লেষণের পর তাকে আপাতত: বেশ কিছুদিন তার মায়ের কাছে পাঠানো স্থির হল। তার বর সৌমেন যথারীতি পরিবারের সাথে একমত। মনখারাপের সাথে সাথে ও কিছুটা স্বস্তির নি:শ্বাসই বা ফেলল ঝিলিক। কয়েকদিনের জন্য হলেও এই কারাগার থেকে মুক্ত।।
সেইদিন রাত থেকে পরেরদিন দুপুর অবধি, যতোক্ষণ পর্যন্ত না সৌমেনের সাথে ঝিলিক মুখুজ্যেবাড়ির বাইরে পা রাখল.. ততক্ষণ অবধি রিমা বাদে কেউ তার সাথে একটা কথাও বলল না। রাতে সে ই ঝিলিককে জোর করে কিছুটা খাইয়েও দিয়েছিল। যাওয়ার সময় কাঁদতে কাঁদতে ঝিলিককে জড়িয়ে ধরেছিল। রিমার এই রূপটা ঝিলিকের অদেখা ছিল। শত হলেও সমবয়সী তো!!
বাড়িতে পৌঁছালো বেলা প্রায় দেড়টা নাগাদ। সৌমেন ভিতরে অবধি ঢুকল না। বাড়ির দরজায় নামিয়ে দিয়েই চলে গেল। তার মা হন্তদন্ত হয়ে এসেছিলেন.. কিন্তু জামাইকে না দেখতে পেয়ে খুব অবাক হয়ে মেয়ের দিকে তাকালেন। ঝিলিক কিছু না বলে ভিতরে ঢুকে গেল। এতো কিছুর মধ্যেও তীর্থদার কথা মনে পড়তেই একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল ঝিলিকের। আর কি কখনো দেখা হবে তার সাথে। কি উৎসাহ দিত তাকে লেখা নিয়ে, নিজের জন্য নিজের মতোন করে কিছু করা নিয়ে। নিজের ঘরে এসে একটু অন্যমনস্ক ভাবেই চালিয়ে দিল রেডিওটা। শুরু হচ্ছে 'তোমার আমার গল্প'। আজকের গল্প "তিয়াসের আত্মকথা", লেখিকা ঝিলিক মুখোপাধ্যায়!! মাও যেন কখন পিছনে এসে দাঁড়িয়েছেন। হাঁ করে তার মুখের দিকে তাকিয়ে। ঝিলিকও নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। এ কি সত্যি! তারই কলমের ছোঁয়ায় তৈরি তার নিজের সৃষ্টি বেজে চলেছে রেডিওতে। এ আর কারুর নয়, নিশ্চই তীর্থদার কাজ। যেদিন তার কাছে কেঁদে ফেলেছিল, সেদিনি তার সেই লেখাটা চেয়ে নিয়ে গেছিল তীর্থদা। ঝিলিক ভেবেছিল আবার কোনো ম্যাগের জন্য হবে বোধহয়। সেটা যে তারই প্রিয় অনুষ্ঠানে তারই বাড়িতে বসে শুনতে পাবে, তা বোধহয় স্বপ্নেও ভাবেনি সে। মায়ের হতবাক মুখের দিকে তাকিয়ে ঝিলিক মনে মনে ভাবল.. তার লেখার কথা সেভাবে মাকে বলাই হয়নি.... বলা হয়নি তার মনের আরো অনেক না বলা কথা.. যা বলার জোর সে আজ পাচ্ছে। সব আস্তে আস্তে করে বলতে হবে। তার লেখার ই মতোন কত না বলা কথা ভাষা পাবে.. গড়ে উঠবে আরো কতো অব্যক্ত গল্প.... এগিয়ে চলবে ঝিলিক.. এই টুকরো টুকরো কথাই হবে তার পথ চলার পাথেয়।।