Debdutta Banerjee

Drama

2  

Debdutta Banerjee

Drama

তন্ত্র

তন্ত্র

7 mins
958


-''প্লিজ অনি, আমার কথা বিশ্বাস কর। আমি বলছি এই বাড়িতে কিছু একটা প্রবলেম আছে। আমাদের ক্ষতি হচ্ছে এখানে থাকলে। চল, অন‍্য কোথাও চলে যাই। ''

-" আচ্ছা! তুমি না বিজ্ঞানের ছাত্রী, ফিসিক্সের এত বড় স্কলার, এসব তুমি কি বলছ বলো তো!!''

-'' আমিও এতদিন মানতাম না। কিন্তু পর পর দু বার ... উফ। ঐ একি স্বপ্ন। আর তারপরেই এই দুর্ঘটনা। প্লিজ অনি। অন্তত কিছু দিন, কয়েকটা বছরের জন‍্য আমরা যদি কোথাও চলে যাই ?''

-'' আমার বৃদ্ধ বাবা মা কে ফেলে এভাবে ... তার চেয়ে তুমি বরং তোমায় মায়ের কাছে কদিন থেকে এসো। '' 

-''কদিনের প্রশ্ন নয় অনি। কয়েকটা বছর... আর আলাদা নয়, তোমার সাথে একসাথে। ''

-''না মেঘনা , তা হয় না। সল্টলেকের এমন একটা প্রাইম লোকেশনে এতবড় বাড়ি ছেড়ে কেনো অন‍্য কোথাও যাবো ? তুমি সবে তিন বছর এসেছ এ বাড়িতে, আমি দীর্ঘ বছর আছি। কখনো কিছু হয়নি। দিভাই আসে ছেলে নিয়ে, ওর কিছু মনে হয় না। নিচের তলায় ভাড়াটে আছে, তাদের ঘরেও বাচ্চা আছে । তাই এসব ভেবো না। কদিন রেষ্ট নাও। সব ঠিক হয়ে যাবে। ''

 হাল্কা আলোটা নিভিয়ে পাশ ফিরে শোয় অনির্বান। ঘরটা অন্ধকারে ডুবে যেতেই মেঘনার অস্বস্তিটা ফিরে আসে। একটু পরেই অনির্বানের নাক ডাকার আওয়াজ শুরু হয়ে যায়। বিছানায় ছটফট করে মেঘনা। ঘুম আসতে চায় না সহজে। চোখ বুঝলেই একটা কচি হাতের স্পর্শ, একটা ছোট্ট বাচ্চার হাসির আওয়াজ ভেসে আসে। চমকে ওঠে মেঘনা। 


তিন বছর আগে অনির সাথে সম্বন্ধ করেই বিয়েটা দিয়েছিল মা। ওদের এই সল্টলেকের বৈশাখীর খালের পারে বাড়ি, ছোট ফ‍্যামেলি, ইঞ্জিনিয়ার ছেলে, বিবাহিত ননদ, মায়ের পছন্দ হয়েছিল এককথায়। ওরাও সুন্দরী মেঘনাকে পছন্দ করেছিল প্রথম দেখাতেই। মেঘনা সল্টলেকের কলেজেই পড়ায়, মা মেয়ে বেলেঘাটায় একটা ছোট ফ্ল্যাট নিয়ে থাকত। কিন্তু এ বাড়িতে এসে থেকে মেঘনা অদ্ভুত কিছু ঘটনার সম্মুখীন হয়েছে। পিওর সাইন্সের মেয়েটা তন্ত্র মন্ত্র কখনোই বিশ্বাস করত না। প্রথম যেদিন সিঁদুর কৌটায় চুল দেখেছিল ভেবেছিল অসাবধানতায় নিজের চুল উড়ে এসেছে। এরপর একদিন তোষকের নিচে একটা সিঁদুর মাখা শুকনো পান পেয়েছিল। কিভাবে এলো হাজার ভেবেও মাথায় আসেনি। পূজার পান হয়তো কেউ রেখেছিল, এই ভেবেই মনকে শাসন করেছিল। 

মাঝে মাজেই ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ারে ছাই জাতীয় কিছু দেখতে পেত মেঘনা। কিন্তু বোঝেনি এর কারন কি ?

প্রথম সন্তানের আগমনের খবরে অনি আর মেঘনা যখন আকাশে উড়ছে তখনি ঘটেছিল ঘটনাটা। নরম শিমুল তুলোর বালিশে রোজ রাতে খোঁঁচা লাগে কেনো? একদিন বালিশের ওয়ার খুলতেই মেঘনা অবাক, শিকড়ের মত কিছু পেয়ে ও শাশুড়িকে দেখাতে ছুটেছিল। মুহুর্তের অসাবধানতায় সিঁড়ি দিয়ে গড়িয়ে পড়েছিল মেঘনা। আর ওদের সব স্বপ্ন চুরমার করে যে আসছিল সে বিদায় নিয়েছিল। 


******


মেঘনার মা সব শুনে প্রথম বলেছিল তন্ত্র মন্ত্রর কথা। কিন্তু মেঘনা বলেছিল -''কে চাইবে আমার ক্ষতি? শ্বশুর শাশুড়ি ননদ ননদাই আর দু জন কাজের লোক, কাকে সন্দেহ করবো বলো তো ? ননদ পাশেই থাকে, তবে রোজ তো আসে না। 

সন্দেহর তীর গেছিল দুই কাজের লোকের দিকে, দশ বছরের পুরানো দু জন কাজের লোককেই বিদায় করতে চেয়েছিল মেঘনা। কিন্তু অনি রাজি নয়, অনির বক্তব‍্য এসব ফালতু সেন্টিমেন্ট। এসব বিশ্বাস করে এত দিনের পুরোনো বিশ্বস্ত লোককে তাড়ানোর কোনো মানে হয় না। ননদ সব শুনে কেঁদে বলেছিল -"এরপর তো আমাদের কেও সন্দেহ করবে বৌ মনি!! আমাদেরও আসা বন্ধ হবে। ''

কিন্তু দ্বিতীয় বার মিস ক‍্যারেজের পর মেঘনা শুধু অনিকে বলেছিল -''এখনো মানবেনা তুমি যে কেউ আমাদের ক্ষতি চায় ?''

অনি চুপ করে বাইরের দিকে তাকিয়ে ছিল। 

তৃতীয় বার প্রেগনেন্ট হয়ে মেঘনা চলে গেছিল মায়ের কাছে, নয় মাসে একটা দিনের জন‍্য এই বাড়িতে ঢোকেনি। শাশুড়ি আর ননদ মিলে রান্না করে সাধ দিয়ে এসেছিল ওর মায়ের বাড়িতেই। আকাঙ্খার জন্মর পর সবাই খুব খুশি ছিল। ফুটফুটে মেয়ে কোলে মেঘনা শ্বশুর বাড়ি ফিরেছিল ঠিকই, কিন্তু মেয়ের দোলনায় তেল সিঁঁদুরের ফোঁঁটা দেখে চমকে উঠেছিল। ঠিক আড়াই মাস থেকে মেঘনার মনে হয়েছিঋ আকাঙ্খা আর পাঁচটা বাচ্চার মত নয়। ও হাত পা ছোড়ে না, হাসে না, দুধটুকুও টেনে খেতে পারে না ঠিক করে। পরীক্ষা করে জানা গেলো মস্তিষ্কের গঠন স্বাভাবিক নয়, ও সেরিব্রেল পালসির শিকার।  

সব টুকু দিয়ে মেয়ের জত্ন করছিল মেঘনা, চাকরী ছেড়ে সারাক্ষণ ঘরে মেয়ে পাহারা দিও। ওর বদ্ধ মুল ধারণা হয়েছিল ওদের কেউ ক্ষতি করছে, শাশুড়ির দেওয়া প্রসাদ বা ফুল , ননদের দেওয়া তাবিজ সবেতেই ওর সন্দেহ। আকাঙ্খার স্নানের জলে তিল আর তেল দেখে চমকে উঠেছিল মেঘনা। মেয়েকে নিয়ে মায়ের কাছে চলে গেছিল। তিনমাস পর অনি অনেক বুঝিয়ে নিয়ে এসেছিল ওকে। কিন্তু তার চারদিন পর গলায় দুধ আটকে চোখ বুজেছিল আকাঙ্খা। 

এরপর মেঘনা যেন পাথর হয়ে গেছিল। দুবার দু জনকে হাত দেখিয়ে ওর ধারণা আরো বদ্ধমূল হয়েছিল। রসরাজ তান্ত্রিক ওকে দেখেই বলেছিল -''তোদের বাড়িতে রয়েছে অতৃপ্ত আত্মা, তাকে দূর করতে হবে ? বন্ধন দিতে হবে বাড়িতে। ''

কিন্তু শ্বশুর শাশুড়ি এমনকি অনি কেউ রাজি হয়নি। এসব বুজরুকি তারা মানবে না। 

অনি বলেছিল -''তোমার আগের কথা গুলো যদি মেনে নেই তবে কি সেই আত্মা এসে রেখে যেত সেই পান, শিকড় এসব ? কি বলতে চাইছো তুমি ?''

মেঘনার কাছে এই বাড়ি তখন আতঙ্ক, ঘুমের মধ‍্যেও ও স্বপ্ন দেখত ওর বাচ্চাকে ছিনিয়ে নিচ্ছে এক মহিলা, বাড়ির চারদিকে জল ছেটাচ্ছে এক মহিলা। 

অনির সাথে অনেক তর্কর পর ও বাড়ি ছেড়ে মায়ের কাছে চলে এসেছিল। কিন্তু অনি আসেনি। 

মা ওকে নিয়ে এসেছিল কামাক্ষ‍্যায়, মায়ের এক বান্ধবী বলেছিল তান্ত্রিক তারামায়ের কথা। প্রথম দিন ওকে সামনে বসিয়ে ওর কপালের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠেছিল তারামা। বলেছিল -''তুই কোথায় থাকিস ? কি ভাবে থাকিস ?''

এরপর ধ‍্যানে বসেছিল তারামা, দু ঘন্টা পরে বলেছিল, ''সব পাপের ফল। ঐ বাড়িতে পাপ রয়েছে। ওখানে থাকলে মারা পড়বি তুই। একটা তাবিজ কোমরে পরিয়ে বলেছিল -''এটা তোর রক্ষা কবচ। আর এই তেল বাড়ির চারদিকে ছিটিয়ে দিবি। এরপর ঐ বাড়িতে থাকতে হলে তোকে পিচাশ সিদ্ধ যজ্ঞ করতে হবে। কিন্তু তার আগে পাপীদের শাস্তি চাই। ঐ বাড়ি কে বানিয়েছে খোঁজ নে । ঐ বাড়িটাই যত নষ্টের মুল। পারলে বেরিয়ে আয়। ''


ছয় মাস পর মেঘনা ফিরেছিল শ্বশুর বাড়ি, কেউ খুব একটা খুশি হয়নি ওকে দেখে। ওর রাজ‍্যপাট তখন ননদের হাতে। বৃদ্ধ বাবা মা কে দেখতে সে স্থায়ী আস্তানা গেরেছে এ বাড়িতে। 

-''এ বাড়ি ঠিক কার ? কে তৈরি করেছিল এ বাড়ি ?'' মেঘনার প্রশ্নে চমকে উঠেছিলেন ওর শ্বশুর। গম্ভীর গলায় বলেছিলেন -''তোমায় এ প্রশ্নের উত্তর দেবো কেন ?''

-''দেবেন, কারণ ক্ষতি আমার হচ্ছে। ভুক্ত ভোগী আমি। আর আপনি না বললে আইনের সাহায‍্য নেবো এবার, করপোরেশনে ছুটবো। ''

-''বাড়ি আমাদের, জমিটা বাবা পেয়েছিলেন সে সময়। বাড়ি আমি করেছি ।'' গম্ভীর গলায় বললেন মেঘনার শ্বশুর মশাই। 


-''আপনি কি সব সত‍্যি বলছেন ? "

-''ছিঃ বৌ মনি, বাবাকে অপমান করছো তুমি। তোমার মাথায় গন্ডগোল আছে, তার ফলে এসব উদ্ভট চিন্তা আসে তোমার মনে। এত শিক্ষিত হয়ে তুমি তন্ত্র মন্ত্র বিশ্বাস করো !! তোমার চিকিৎসা দরকার ।'' অদিতি ওর ননদ চিৎকার করছ ওঠে। 

-''প্লিজ অদিতি, এটা আমার বাড়ি, আমাদের কথার মাঝে তুমি এসো না। আর তন্ত্র মন্ত্র বিশ্বাস করতাম না আগে, কিন্তু এবাড়িতে ঢুকে বিশ্বাস করছি আজ, কারণ যে ক্ষতি আমার হয়েছে তা একান্তই আমার। '' মেঘনার দু চোখ জ্বলে ওঠে।

-''এটা আমার অপমান বাবা। তুমিই বল , এবাড়ি কার ? বৌমনির একার নাকি...?''

-''এর উত্তর তো বাবা কুড়ি বছর আগেই দিয়েছিল। বাবা তাই তো ?'' অনির উত্তরে চমকে ওঠেন ওর বাবা।

-''মেঘনা, এ বাড়ি আমাদের নয়। তুমি ঠিক বলতে, এবাড়িতে অমঙ্গল রয়েছে। এবাড়ির হাওয়া বিষাক্ত। চল চলে যাই। ওরা থাকুক এই সম্পত্তি আর বাড়ি নিয়ে। '' অনি এই প্রথম ওর পাশে এসে দাঁড়ায়। 

-''বাবু ... তুই এসব কি বলছিস !! এই মেয়েটা তোর মাথাটাও খেয়েছে দেখছি। '' অনির মা বেরিয়ে আসে ঘর থেকে। 

-''এই বাড়ির মাটিতে লেগে আছে পিসিমনির চোখের জল। অদিতির লোভ, তোমাদের হিংসা। জানি না পিসিমনি বেঁচে আছে নাকি তোমাদের হিংসার বলি হয়েছে কুড়ি বছর আগেই। তবে আমি জানি এ বাড়ি পিসিমনির। দাদু এই জমি পিসিমনিকে দিয়েছিল, তোমায় বলেছিল পিসির জন‍্য একটা বাড়ি করে দিতে এখানে। বিধবা পিসিমনির নিরাপত্তার জন‍্য দাদু এই জমিটা দিয়েছিল। যা তুমি ছিনিয়ে নিয়েছো।তুমিই বলেছিলে বাবার সম্পত্তিতে শুধুই ছেলেদের অধিকার থাকে। মেয়েদের নয়।''

মেঘনা অবাক হয়ে চেয়ে ছিল। 

-''ছিঃ বাবু, এসব কি কথা? অদিতি তোর বোন !'' শ্বশুরের গলার আওয়াজে সেই জোর আর নেই।

-''আমি দু বার অদিতিকে দেখেছি আমাদের ঘরের বিছানায় কিছু রাখতে, এসব মানতাম না তখন। কিন্তু মেঘনা চলে যেতেই ও যখন এ বাড়িতে উঠে এলো এবং ধরেই নিলো বাড়িটা ঐ পাবে তখন বুঝলাম মেঘনাই ঠিক বলত। ওর ক্ষতি চাইত আমার নিজের মায়ের পেটের বোন। রক্তের দোষ। দাদুও বাড়ি আর জমি দিয়েছিল বিধবা মেয়েকে। যা দখল করেছো তোমরা। তার ফল ভোগ করে চলেছো। আমি আমার বৌ নিয়ে চলে যাচ্ছি এই বিষাক্ত সম্পত্তি ছেড়ে। ভোগ করো তোমরা।''

মেঘনার হাত ধরে অনি বেরিয়ে আসে। 

বলে -''আমায় ক্ষমা করো মেঘ। আমি সব জেনেও অবুঝ হয়ে ছিলাম। বিধবা পিসির চোখের জলে ঐ বাড়ি দুষিত, বোনের হিংসায় বিষাক্ত, তন্ত্র মন্ত্র জানি না, মানুষের লোভে যে আমাদের ক্ষতি হচ্ছে সেটা বুঝেছি। আমরা এবার নিজেদের বাড়িতে থাকবো। আমরা পারবো, দেরি হলেও আবার নতুন করে শুরু করবো সব কিছু। ''

মেঘনার দু চোখের কোনে জল চিক চিক করে ওঠে। 


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama