সূর্যোদয়
সূর্যোদয়


অসময়ে ডোরবেলটা বেজে ওঠায় বেশ চমকেই উঠেছিল নন্দিনী। আসলে এইরকম সময়ে কেউ তো বড়ো একটা আসে না। একলা ঝামেলাহীন সংসারে তার একমাত্র প্রিয় অভ্যাস বই পড়া। তাই তাতেই ব্যাঘাত ঘটাতে একটু ভুরু কুঁচকেই যায় তার।
'আসছি আসছি
সুর যেন একটু চড়ে যায়।
রীতিমতো অভিজাত পাড়ায় একটি নামকরা কমপ্লেক্সে ডাবল বেডরুম ফ্ল্যাটের অধিকারিণী মিস্ নন্দিনী মুখার্জী কিছুদিন আগে অব্দিও এই ফ্ল্যাটে একা ছিলেননা। বরং খুব হাসিখুশি এক সুখী দম্পতির মতোনই সুখে শান্তিতে ঘর করছিলেন। যাতে বিঘ্ন ঘটে মাসকয়েক আগে....
দরজা খুলতেই কপালের বলিরেখা ছোট হয়ে আসে তার। সামনে দাঁড়িয়ে তার কলেজ সহপাঠী অনুপম। অবাক হওয়ার পালা নন্দিনীর। একে ছুটির দিন.. তায় বেলা তিনটে.... এতোদিন পরে দেখা!!!! প্রথম কিছুক্ষণ ঘোরই কাটেনা তার। একটু ধাতস্থ হয়ে....
'এ আমি সামনে কাকে দেখছি?? তুই তো সেই একই রকম আছিস রে..
হাসে অনুপম....
'আর তুই বেশ ভালোই মুটিয়েছিস!!
তারপর বেশ রাগী স্বরেই বলল....
'দেখা কি করে পাবি শুনি....?? একবছর হল আমি দেশে ফিরেছি। এই কয়দিনে যতোগুলো জমায়েত হয়েছে তার একটাতেও এসেছিস তুই....??
অপ্রস্তুত নন্দিনী.... বন্ধুকে প্রাণপণে বলতে চাইলো যে সে এর আগের প্রত্যেকটাতেই গেছে, শুধু এই কয়দিন তার কোথাও যেতে ইচ্ছা করেনা.... কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানেই নয়।।
নন্দিনীর মনের ভাব কতোকটা বুঝতে পেরেই পরিবেশকে হাল্কা করতে চাইল অনুপম....
'আচ্ছা তুই কি বলতো?? এতোদিন পরে এসেছি একটু চা কফি কিছু খাওয়াবিতো নাকি....??
মুহূর্তে নন্দিনী প্রাণোচ্ছল....
'একটু বোস আমি আনছি।
পুরোনো স্মৃতি ভেসে ওঠে অনুপমের মনে। সেই সুন্দর দিনগুলো.... আড্ডায়-গানে-হুল্লোড়ে-ভাল ছবি-খেলাধূলা নিয়ে মেতে থাকতো তারা। কেমন চোখের পলকে কেটে যেতো দিনগুলো টেরই পাওয়া যেতোনা....
অনুপম একই বিষয়ে নন্দিনীর এক বছরের সিনিয়র। আড্ডা দিতে দিতে কখন বন্ধু হয়ে গেছে। নন্দিনীর গানের গলা ছিল খুব ভাল। প্রত্যেক কম্পিটিশনে প্রথম পুরষ্কার ছিল বাঁধাধরা। তাই বন্ধুদের আসরে তার ভক্তের অভাব হতনা। তার মধ্যে অনুপমও ছিল অবশ্যই একজন। ব্যাপারটা শুধুই ভক্ত বা বন্ধুর থেকে যে বেশী কিছু ছিল.. তা বোধহয় অনুপমের বেস্ট ফ্রেন্ড রিক্ত ছাড়া বেশী কেউ জানতোনা।
নিজের মধ্যে হারিয়ে গিয়েছিল অনুপম.... সেই চিরনূতন দিনগুলোর সজীবতার মধ্যে.. নন্দিনীর ডাকে ফিরে আসে....
'তা ডক্টরদের সময় বোধহয় খুব একটা ভাল যাচ্ছেনা না?? তাই ডক্টর অনুপম ঘোষের এই অবেলায় সামান্য ঘরণীকে মনে পড়েছে..??
হাল্কা হাসে অনুপম....
'আসলে এই ডক্টরের তার অনেক পুরোনো পেশেন্টের খবর নিতে খুব ইচ্ছা করছিল তাই.. কি আর করবে সে.. মিস্ নন্দিনী তো আর নিজে থেকে কাউকে ধরা দিতে চাননা....
খানিক্ষণ সব কেমন চুপচাপ....
'তবে একটা উদ্দেশ্য আছে বলতে পারিস। পরের রবিবার মানে আঠারো তারিখ আমরা সকলে একটা আউটিং প্ল্যান করেছি সাউথ সিটিতে.... এইবারে আর তোমায় ছাড়ার কোনো প্রশ্নই ওঠেনা।
বলেই কতোকটা নন্দিনীর মনের ভাব বোঝার চেষ্টা করে অনুপম। যেমনটা আশা করেছিল অন্তত:, অন্য বন্ধুদের মুখে যা শুনেছে.... সেইরকম কোনো রি একশন দেখতে পেলোনা তার চোখেমুখে। কিছুটা নিশ্চিন্ত হল। সেই কারণেই আজ তার এখানে আগমন....
আরও অনেক্ষণ খুব হইহই আড্ডার পরে অনুপম বিদায় নিল। তার আগে অবশ্য নন্দিনীকে মোটামুটি প্রমিস করিয়ে নিল আগামী রবিবার সে তাকে দুপুর তিনটেয় পিক আপ করবে। একটু আপত্তি করেছিল নন্দিনী বিদঘুটে সময় বলে.. কিন্তু তা বেশীক্ষণ ধোপে টেকেনি।
মাঝের কয়েকটা দিন নন্দিনীর বেশ ব্যাস্ততার মধ্যে দিয়ে কাটল। মায়ের শরীরটা ভাল নেই.. তাই কয়দিন ওখানে গিয়ে থাকলো। এতোদিন ব্যাঙ্কের কাজগুলো করতে পারেনি সেইগুলো করল। প্রায় রোজই দিনে একবার অন্তত: অনুপমের সাথে কথা হত। নন্দিনীর স্বামী আর্য চলে যাওয়ার পর এই প্রথম মরুভূমিতে ওয়েসিসের মতোন কিছু পেল নন্দিনী। সব মনখারাপ চিন্তা সবকিছুর মধ্যে অনুপমের ফোন ছিল তাজা হাওয়ার মতো। সেইসব দিনের সজীব হাওয়া.. চনমনে ভাব যেন নন্দিনীর মধ্যে নতুন প্রাণসঞ্চার করতে লাগলো..
অবশেষে সেই দিন চলে এল কাছে। আবার সেই ছোটবেলার বন্ধুদের সাথে নন্দিনীর কতোদিন পর দেখা হওয়ার কথা। সকাল থেকেই তার মনটা ছিল ফুরফুরে। তাড়াতাড়ি লাঞ্চ করে নেয়। ঠিক তিনটেয় কলিংবেল অনুপমের উপস্থিতি জানান দেয়। আর নিজের অজান্তেই নন্দিনীর মন খুশিতে ভরে ওঠে। দরজা খুলতেই....
'বাব্বা তুই রেডি.. বাঁচালি!! আমি তো ভাবলাম ম্যাডামের সাজুগুজুর জন্য ঘন্টাখানেক অপেক্ষা করতে হবে!!!!
হাসল নন্দিনী....
'ভাট না বকে চল তো, দেরী হয়ে যাবে। কতোদিন পরে সকলকে দেখবো....
সাউথ সিটির গেটে পৌঁছে সবকটা চেনা মুখই প্রায় দেখতে পেল নন্দিনী। হাত নেড়ে কাছে যেতেই সকলে হই হই করে উঠল। তার সবথেকে প্রিয় বান্ধবী রঞ্জনা দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরল। সকলে একজোট হয়ে উপরে ফুড্ কোর্টে এসে বসল।
কতো কথা যে ভাষা পেতে লাগল.. কতো না বলা সুর যে গান হয়ে উঠল। হাসি ঠাট্টায় মেতে উঠল সবাই। নন্দিনী আগেরগুলোয় না থাকার জন্য বকা খেল একটু, যদিও কারণটা কারুরই অজানা ছিল না। চিরঞ্জীত বরাবরই আমুদে প্রকৃতির.. সেই পুরো আড্ডা জমিয়ে দিল। এতো হাসি ঠাট্টার মধ্যেও ডক্টর ঘোষ যে মাঝেমধ্যেই তাকেই দেখছেন তা কিন্তু নন্দিনীর নজর এড়ায়নি।
....
আড্ডা শেষ হতে হতে রাত দশটা বাজল। অনুপম আগেই বলেছিল নন্দিনীকে ড্রপ করে দেবে।
ফেরার পথে গাড়িতে নন্দিনী একটু চুপচাপই ছিল। রাতের স্নিগ্ধ রূপ গাড়ির ভিতর থেকে অনুভব করছিল। দিনটা খুব সুন্দর কেটেছে.. এমনই যদি প্রত্যেকটা দিন কাটতো বেশ হত তবে.. মনের কষ্ট হতাশা কিছুটা ভুলতে পেরে অনেক হাল্কা লাগে নন্দিনীর।
হাল্কা করে গান চলছে। নন্দিনীর খুব প্রিয় একটা রবীন্দ্রসঙ্গীত "সখী ভাবনা কাহারে বলে".... অনেক ভাবনার মধ্যে রঞ্জনার একটা কথাই নন্দিনীর খুব বেশী করে কানে বাজছিল....
'নন্দু আলো যদি আসতে না দিস.. জানালা যদি সবসময় বন্ধ করে রাখিস.... তাহলে যে জীবনটা আরো কঠিন করে তুলবি রে। তার চেয়ে যেমন জীবন তোকে নিয়ে যাচ্ছে সেইরকমই চল না....
অজান্তেই দুফোঁটা জল গড়িয়ে পরল নন্দিনীর দুচোখ বেয়ে। হঠাৎ নিজের হাতের ওপর একটা হাতের স্পর্শ অনুভব করল নন্দিনী। তাকাতে পারলোনা.. চোখের জল গোপন করতে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকলো জোর করে। শুধু খুব চেনা কন্ঠস্বর ভেসে এল কানে....
'আমি আছি পাগলি সবসময়, তোর পাশে তোর সাথে.... তাকিয়ে দেখলেই খুঁজে পাবি।
নন্দিনীর তখন তার প্রিয় গানটির সাথে গলা মিলিয়ে গাইতে ইচ্ছা হল....
"প্রতিদিন যদি কাঁদিবি কেবল....
একদিন নয় হাসিবি তোরা....
একদিন নয় বিষাদ ভুলিয়া সকলে মিলিয়া গাহিব মোরা।"