STORYMIRROR

Sanghamitra Roychowdhury

Classics

3  

Sanghamitra Roychowdhury

Classics

সুপ্রিয়াকে মধুকর

সুপ্রিয়াকে মধুকর

4 mins
730


সুপ্রিয়াসু,


বছরটা শেষ হতে চলেছে, মোটে আর দিন পাঁচেক। ঘন্টায় মাপলে একশো কুড়ি ঘন্টা। বেশ একটু বেশি বেশি সময় মনে হচ্ছে, নাকি বলো? তবে সে তুমি যাই বলো না কেন, একশো কুড়ি ঘন্টাও কিন্তু ঠিক একই সময়েই ঝুপ করে শেষ হয়ে যাবে, যখন শেষ হবে চলতি বছরের শেষ পাঁচটা দিন। তবে তোমায় একটা কথা স্বীকার করতেই হবে, অন্য আর বছরগুলোর থেকে এই বছরটা কিন্তু বেশ বেশিরকম ঘটনাবহুল কাটলো। অবিশ্যি তা স্বীকার করতে তোমার বাধা থাকতেই পারে। বাধা থাকাটা উচিৎ বলেই মনে হচ্ছে আজ। আজ খুব ইচ্ছে হলো তোমায় একটা চিঠি লিখি, যখন দূর থেকে তোমার আবছা অবয়ব দেখলাম, তখন ইচ্ছেটা বুকের ভেতর কোল্ডড্রিঙ্কের ছিপি খোলার সময়কার বুদবুদের মতো লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে তোলপাড় হয়ে বুক ফেটে বেরিয়ে আসতে চাইলো। আজ যদি তাকে মুক্তি না দেওয়া যায়, তবে আর কখনো সেই সুযোগ নাও হতে পারে। কে জানে?




সুপ্রিয়া, তোমার সাথে আমার শেষ সাক্ষাৎকারটা মনে আছে তোমার? খুব ঝগড়া হয়েছিলো। অবশ্য সেই প্রত্যেকবারের মতোই পুরোপুরি একতরফা। তুমিই বলে গেলে একলা, মুখ নীচু করে শুনেই গেলাম আমি সেবারেও, প্রত্যেকবারের মতোই। আসলে শুরুটা আবার আমিই করেছিলাম, শেষটা যে তুমিই করবে, এও জানতাম। তবু শুরু যা হয়, নিয়ম মেনে তাতো শেষও হয় একসময়। আমাদের ঝগড়াটাও তাইই হলো। একটা কথা, স্ফুলিঙ্গ হয়ে বেরিয়ে অগ্নিকাণ্ড ঘটিয়ে, যথাসর্বস্ব জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাই করে দিয়ে নিভলো অবশেষে। আর সেই ছাই অস্থি-কলসের মতো বুকে নিয়ে বয়ে বেড়াতে বেড়াতে আজ বোধহয় সেই অস্থি-কলস বিসর্জনের সময় এসেছে মনে হলো। এইই উপযুক্ত সময়।




সেদিন তোমায় বলেছিলাম, "আমি নামে মধুকর, কাজেও তাই। একফুলে চিরকাল বসে থাকবো ডানা গুটিয়ে, এমন কথা তুমি ভাবলে কী করে? যতক্ষণ একফুলে ভালো লাগে ততক্ষণ সে ফুলে থাকি। তারপর আবার অন্য ফুলে, তারপর আবার অন্য আরেক ফুলে, এভাবেই তো কাটে মধুকরদের জীবন। জানো না বুঝি?" প্রথমে তুমি খানিকক্ষণ হাঁ করে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলে আমার মুখের দিকে। তারপরই আমি গালে পেলাম তোমার শেষ স্পর্শ। তোমার গোলাপী পাতাওয়ালা তুলতুলে নরম উষ্ণ হাতের সেই স্পর্শ, হোক না কেন তা সপাটে এক চড়! তবু তো তোমার হাতের ছোঁয়া ছিলো তাতে, আমার সুপ্রিয়ার ছোঁয়া। তখনো, সেই মুহূর্ত পর্যন্ত আমারই একান্ত সুপ্রিয়া ছিলে যে তুমি। আমার মনে হয়েছিলো এই শেষ ছোঁয়া ধরে রাখবো কেমন করে? বৃষ্টি আর স্নানের জল বাঁচিয়ে চলতে পারি বাঁ-গালটা ঢেকে কোনোমতে। কিন্তু চোখের উষ্ণ প্রস্রবণ বড়ো অবাধ্য, কথা শোনে না, বারবার কেবল ধুয়েমুছে সাফ করে দিতে চায় তোমার শেষ স্পর্শটুকুকে। বোঝে না সে, ঐটুকুই আমার শেষ সম্বল। আজ অসতর্ক ছিলাম, ধুয়ে দিলো সে আমার সুপ্রিয়ার শেষ ছোঁয়া।




তুমি যখন পা রাখলে লাক্ষা দ্বীপের এই ক্রুজে, আমার মনে হলো, আরব সাগর আজ যেন বড়ো বেশি উত্তাল। সেই ঢেউয়ের দোলা আমার রক্তস্রোতে চারিয়েছে। গলাটা শুকনো, গালটা ভিজে, আর অদৃশ্য রক্তক্ষরণে সর্বাঙ্গ টকটকে লাল। তবে এসব আর কারো নজরে না পড়ারই কথা। পড়বেই বা কেন? লাক্ষা দ্বীপে যাওয়ার প্রমোদতরী... ক্রুজের এক অখ্যাত অবহেলিত খালাসীর দিকে কেই বা খেয়াল করবে? বেকার নিম্নবিত্ত মধুকরের নামের মাশুল দিতে হয়েছিলো মধুকরকে

। আমি অর্থাৎ মধুকর কি যোগ্য ধনীর দুলালী সুপ্রিয়ার? সুপ্রিয়ার বাবা, হ্যাঁ সুপ্রিয়া, তোমার বাবা প্রশ্নটা করেছিলেন আমাকে। তাঁর ঝাঁ চকচকে কম্পাউন্ডওয়ালা পেট্রোল পাম্প আর লাগোয়া গাড়ীর শোরুমের কাঁচঘেরা ঠাণ্ডা অফিস ঘরে মুখোমুখি চেয়ারে বসিয়ে। একটা টোপও ছিলো সামনে। বত্রিশ পেরোনো আইবুড়ো দিদির বিয়ের যাবতীয় খরচার টোপ, পাত্রসমেত। টোপটা আমায় গিলতেই হলো। একদিকে তোমার রাজরানী হওয়ার সম্ভাবনা, অন্যদিকে দিদির সিঁথি রাঙা হওয়ার সম্ভাবনা। দুটোই আমার কাছে সমান গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। আমার মতো অপদার্থ ভবঘুরে আর্টিস্টের আর কীইবা করার ছিলো? এই বেশ হলো। কেমন একঢিলে দুই পাখি। এইসব কিছুর বিনিময়ে একটা ছোট্ট কথা আমাকে বলতে হবে, "আমি মধুকর, ফুলে ফুলে ঘুরে ঘুরে মধু খেয়ে বেড়ানোই আমার কাজ।" কী স্বার্থপর আমি, ভাবো একবার! নির্দ্বিধায় বলে দিলাম কথাটা, আমার সুপ্রিয়াকে খুব ভালো রাখতে চাইতাম যে মনেপ্রাণে।




তারপর তোমার বাবার দয়ায় আমার বত্রিশের আইবুড়ো দিদি বর পেলো, ঘর পেলো। আর আমি পেলাম পরম শান্তি। আমার সুপ্রিয়া এনআরআই বরের ঘরণী হয়ে সুখে থাকবে, ঐশ্বর্য্যে থাকবে, এইই আমার পরম প্রাপ্তি। তোমার সাথে শেষ দেখার পর সাতদিনের মাথায় আমি পাড়ি দিলাম এই জাহাজের খালাসী হয়ে। যে আঙুল পেন্সিল তুলি ধরতো, তা এখন নোঙরের দড়ি ধরে, আবার কখনো কোনো যাত্রীর মুখের সামনে বমি করার প্যাকেট। যার যেমন যোগ্যতা। তোমাকে যখন বোঝাতাম যে, আমি তো তোমাকে তেমন কিছু দিতে পারবো না, তখনো তুমি ঝগড়া করতে। বলতে, "ভালোবাসা ছাড়া আর কিছু চাই না।" সেই তোমাকে মিথ্যে বলতে ভারী কষ্ট হয়েছিলো। বুক চিরে যাচ্ছিলো আমার। তবু তোমার ভালোর জন্যই তো সেদিন তোমার বাবার শর্তে রাজি হয়েছিলাম, সঙ্গে ছিলো দিদিকে সংসারী দেখার লোভ। তবুও আজ তোমায় দূর থেকে যখন দেখলাম তোমার বরের বাহুলগ্না, তখন বিনা নোটিশে বিদ্রোহ করে বসলো আমার চোখের উষ্ণ প্রস্রবণ। ধুয়েমুছে সাফ করে দিলো আমার সুপ্রিয়ার শেষ স্পর্শটুকুকে।




রাত প্রায় শেষ। ক্রুজের ডেকে পার্টি হলের মিউজিক ব্যাণ্ড বন্ধ হয়েছে। ফালি চাঁদ আর নিশুতি রাতের অন্ধকার আকাশের অগণিত তারারা সাক্ষী। মধুচন্দ্রিমায় আমার সুপ্রিয়া ঘুমিয়ে আছে বরের বক্ষলগ্না হয়ে, নেশাতুর, পায়ের তলায় গড়াগড়ি খাচ্ছে শ্যাম্পেনের খালি বোতল। চুপিসারে গিয়ে তুলে নিলাম বোতলটা। ওতে লেগে আছে তোমার চাঁপার কলির মতো আঙুলের ছোঁয়া। বোতলটার গলায় একটা চুমো খেয়ে তারপর এই চিঠিটা শ্যাম্পেনের ঐ খালি বোতলে ভরে ভাসিয়ে দেবো আরব সাগরের জলে। ভাসতে ভাসতে সেই বোতল হয়তো প্রশান্ত মহাসাগর পেরিয়ে কোনো একদিন আটলান্টিক মহাসাগরের তীরে গিয়ে সাগর সৈকতে বালুরাশিতে আটকে ছুঁয়ে দেবে তোমার পা। আমার সুপ্রিয়ার পা। আমার সুপ্রিয়ার ফর্সা নিটোল পায়ে চুমো খাওয়ার ইচ্ছে পূরণ হয়ে যাবে হয়তো একদিন, এইভাবে, আমার এই বোতলবন্দী ওষ্ঠস্পর্শে।




ভালো থেকো সুপ্রিয়া। ভালো রেখো সুপ্রিয়া। কালকের সকাল সূর্য দেখার আগেই আমি জাহাজী খালাসী হবো মাছ ধরার জাহাজে। সে জাহাজে ফুল ফোটার কোনো সম্ভাবনা নেই, এই আশায়।




নববর্ষের প্রীতি ও শুভেচ্ছান্তে,

মধুকর (শিল্পের জাহাজী)

২৬.১২.২০১৯


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics