সুন্দর পৃথিবী
সুন্দর পৃথিবী


সারা রাত বৃষ্টি হোয়েছে । বৃষ্টি ভেজা সকালে সূর্যের আলোয় আলোকিত চারিদিক। গাছেরা স্নান করে চনমনে হয়ে আছে।পাতারসব নোংরা ধুয়ে পরিষ্কার হয়ে গেছে ।তাই গাছ গুলোকে আজ প্রাণবন্ত দেখাচ্ছে। ভেজা মাটি থেকে ভেসে আসছে সোঁদা গন্ধ।পাখিরাও সারারাত স্নান করে সকালের মিষ্টি রোদ পোহাচ্ছে। রাতে ভাল ঘুম হয়েছে গৌতম এর। সকালবেলায় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে তার মনটাও আনন্দে ভরে গেছে। সেও এই চায়। চনমনে সুন্দর পৃথিবী হবে, সবার সুন্দর বাসস্থান।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে আটটা বেজে গেছে। ওর মা কখন টেবিলে চা জলখাবার দিয়ে গেছে বুঝতে পারেনি। চায়ে চুমুক দিয়ে ভাবে আজ রাতের ফ্লাইটে নিউইয়র্ক যেতে হবে। সে বিশ্ব পরিবেশ সংরক্ষণ কমিটির সদস্য। গৌতম ছাড়া দক্ষিণ ভারতের আর. ভেঙ্কটস্বামী যাবে। দিল্লি বিমানবন্দরে গিয়ে দুজনের সাক্ষাৎ হবে। পৃথিবীর সব দেশেরই প্রতিনিধিরা ওই মহাসভায় অংশগ্রহণ করবে।
যেভাবে পরিবেশ দূষণ হচ্ছে তার ফলে পৃথিবীতে তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। ফলে উত্তর ও দক্ষিণ মেরুতে বরফ গলে যাচ্ছে, সমুদ্রের জলস্তর বেড়ে যাচ্ছে। এতে যেসব দেশ সাগর ঘেঁষে যেসব দেশ আছে সেগুলি সাগরের জলে তলিয়ে যাবে।পৃথিবীতে ছোট-বড় এমন অনেক দেশ আর দ্বীপ রাজ্য আছে যারা এখনই খুব বিপন্ন। এখনই যদি পরিবেশকে সুস্থ করা না যায় তবে দেখা যাবে সমগ্র মানবজাতি বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
প্রতিদিন যেভাবে বন ধ্বংস করা হচ্ছে, দাবানলে আমাজন এর মত মহারন্য পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে তাতে বাতাসে অক্সিজেনের মাত্রা কমে যাচ্ছে, তার ফলে পৃথিবীর ওজন স্তরে প্রভাব পড়ছে।
আমরা প্রতিনিয়ত নদীতে নোংরা আবর্জনা ফেলে নদী এবং সাগর দূষিত করা হচ্ছে আর শব্দদূষণ যেভাবে বেড়ে চলছে তাও ভীষণ ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এসবের ফলে মানুষের দেহে প্রতিদিন নতুন নতুন অজানা জীবনঘাতী রোগ বাসা বাঁধছে। প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ মানুষ এইসব মারণ রোগে মারা যাচ্ছে। এখন থেকে যদি বিশ্ববাসী সচেতন না হয় তবে কয়েক বছর পরেই মানবজাতি কঠিন বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবে। সেদিন হাতে সময় থাকবে না।
গত বছর এই সংগঠনের সভা হয়েছিল লন্ডনে। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়েছিল নিজ নিজ দেশে ,নিজের এলাকাতে এই সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি নিতে হবে। সংগঠনের পক্ষ থেকে প্রতিটি দেশের সরকারের কাছে সংগঠনের কর্মসূচি জানিয়ে চিঠি করা হয়েছে। সব দেশের সরকার আমাদের সহযোগিতা করবে বলে আশ্বস্ত করেছে।
এবারের সভা থেকে ফিরে এসে আমাদের দেশে সব রাজ্যে সংগঠনের সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি করে সমস্ত মানুষদের সচেতন করার কর্মসূচি গ্রহণ করা হবে। সে মত আমাদের দেশে প্রতিটি রাজ্যের কাজও শুরু হয়ে গেছে। মানুষের সাড়াও মিলেছে অনেক। গত সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে, প্রতিটি দেশের সব নাগরিক পাঁচ টি করে গাছ বুনবে , এবং তার রক্ষণাবেক্ষণ করবে।পরে দেশের সব নদী নালা দূষণমুক্ত করতে সরকার যেসব কর্মসূচি নিয়েছে আমরাও তাতে সামিল হবো। নিজ নিজ এলাকায় নদী-নালা গুলো স্থানীয় মানুষদের নিয়ে পরিষ্কার করতে হবে। স্থানীয় পরিবেশ নিজেদেরই পরিষ্কার রাখতে হবে।
এইসব ভাবতে ভাবতে গৌতম হঠাৎ ঘড়ির দিকে তাকায়, নটা বাজতে চলেছে। পুকুরে স্নান করতে যায়, দেখে পুকুরের চারপাশে তার হাতে লাগানো আকাশমনি, ইউক্যালিপটাস, শাল,সেগুন গাছের চারা গুলো কত বড় হয়েছে।কচি পাতায় মাখামাখি করে আছে মুঠো মুঠো সবুজ রং। পরিষ্কার পুকুরের জল টলমল করছে।অসংখ্য মাছের পোনাগুলো চনমনে হয়ে সারা পুকুর ময় ছুটে বেড়াচ্ছে। এসব দেখে গৌতমের মনটা ভরে গেল। পুকুরের পাশে পুরনো সেই বাগান গাছপালায় ঢেকে আছে, আর ওই ঘন জঙ্গলের মধ্যে চেনা অচেনা পাখিরা ডাকছে আর এডাল থেকে ওই ডালে উড়ে বেড়াচ্ছে। মাঝে মাঝে বন্যপ্রাণীদের ডাক শোনা যাচ্ছে। এখান থেকে অনেক আগে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যেত, বেশ কিছু বছর যাবত বায়ু দূষণের ফলে কাঞ্চনজঙ্ঘা আমাদের থেকে হারিয়ে গেছে। আজ নির্মল প্রভাতে উত্তর দিকে তাকিয়ে দেখছে কাঞ্চনজঙ্ঘা মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। বহুদিন পর এমনভাবে সকালে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে পেরে খুবই অভিভূত।
গৌতম স্নান সেরে বাড়িতে চলে আসে, মা ভাত বেড়ে ডাকছে তাকে। এমন সময় চন্দ্রা একটি বাটি হাতে ওর পাশে এসে বসলো। গৌতম বলল, বাটিতে কি আছে? চন্দ্রা বলে,তেমন কিছু নয় তোমার পছন্দের কয়েকটি পোস্তর বড়া নিয়ে এসেছি। গৌতম খুব তৃপ্তি করে খেলো।
এর আগে দুবার চন্দ্রা বায়না ধরেছিল গৌতমের সাথে লন্ডন যাবে বলে। গৌতম বলেছিল, এখন না।যখন আমরা একটা সুন্দর পৃথিবী বিশ্ববাসীকে উপহার দিতে পারব তখন সারা বিশ্বের মানুষ একসঙ্গে উৎসব করবে। আর সেই উৎসবটা হবে আমাদের দেশে। তোমাকে তখন নিয়ে যাব। তুমি সংগঠনের কাজ করো, মানুষদেরকে বোঝাও দেখবে তাদের মাঝেই সারা বিশ্বকে খুঁজে পাবে।
ওর একটু মন খারাপ হয়েছিল, কিন্তু পরে গৌতমের কথায় সায় দেয়। ওরা দুজনে ঘরে গিয়ে বসল। গৌতম এর জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখে, ব্যাগের পকেট এ একটি খাম রেখে দেয়। গৌতম না দেখার ভান করে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে। গৌতম বলে চন্দ্রা তোমাকে একটি কথা বলা হয়নি। গত ডিসেম্বর মাসে সেন্ট টমাস এর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল এসেছিল আমাদের এখানে। আমাদের কাজ দেখার জন্য। আমরা তাকে নিয়ে গেছিলাম দূষণমুক্ত পরিবেশ বান্ধব একটি গ্রামে।সেখানে গ্রামের লোকজনদের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাস্তাঘাট, বাচ্চাদের স্কুল সুন্দর পরিবেশে গ্রামের মাঝখান দিয়ে বয়ে যাওয়া একটি নদী তার পাশে সুন্দর একটি পার্ক। সেখানে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা আপন মনে খেলা করছে। নদীর ধারে বসার ব্যবস্থা আছে, সেখানে গ্রামের বয়স্ক লোকেরা বসে গল্প গুজব করছে। চারিদিকে সবুজ আর সবুজ সুন্দর মায়াবী ছবির মত একটি যেন ক্যানভাস। প্রতিটি বাড়িতে সোলার সিস্টেমের মাধ্যমে আলো জ্বলছে, পাখা ও টেলিভিশন চলছে। প্রতিটি বাড়ির ছেলে মেয়েরা স্কুল কলেজে পড়তে যায়। এসব দেখে টমাস স্যার আমার পিঠ চাপড়ে বলেন, এ যেন একটা সুন্দর ছোট্ট পৃথিবী আমাদের উপহার দিলে। আমরা সব ছবি তুলে নিয়ে যাচ্ছি,সারা বিশ্বের মানুষকে দেখাবো আর বলবো এভাবে ছোট ছোট গ্রাম কে ধরে জেলা রাজ্য দেশ এবং সারা বিশ্বে নতুন পৃথিবী তৈরি হবে। যেখানে কোন দূষণ থাকবেনা আর বরফ গলে আমাদের ডুবে যাওয়ার ভয় থাকবে না। কোন মারণ রোগ আমাদের কিছু করতে পারবে না। কেউ বেকার থাকবে না, ক্ষুধা থাকবে না, যুদ্ধ হানাহানি ও থাকবে না। সেদিন সারা বিশ্বের মানুষ আনন্দ করবে আর উল্লাসে উৎসবে মেতে উঠবে। বন্যরা তাদের বন ফিরে পাবে, জলজ প্রাণীর বিশুদ্ধ জল পাবে, গাছেরা প্রাণভরে সবুজ ছড়িয়ে দেবে আমাদের চোখে। চন্দ্রা বলে, এত সুন্দর গ্রাম? আমাকে নিয়ে যাবে ওই গ্রাম দেখাতে? গৌতম বলে, ফিরে এসে তোমাকে দেখাতে নিয়ে যাবো। কিন্তু একটি শর্ত, ওই গ্রামের মেয়েদের সাথে তোমাকে নাচ গান করতে হবে। চন্দ্রা শুনে বলে, বেশ আমি নাচবো গাইবো ওদের সাথে। গৌতম একবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে উঠে দাঁড়ায়। চন্দ্রার গালে একটা চুমু খেয়ে বলে, এবার তো আমার যাওয়ার সময় হলো মহারানী। চন্দ্রা গৌতমকে সরিয়ে দিয়ে বলে,যাঃ কেউ দেখে ফেলবে। তারপর শান্ত সুরে বলে, বিশ্ব জয় করে এসো, তোমার হাত দিয়ে সূচনা হোক নতুন বিশ্ব গড়ার কাজ।
গৌতম কথা না বাড়িয়ে ব্যাগটি ঘাড়ে নিয়ে মাকে প্রনাম করে রওনা হয় বিমানবন্দরের দিকে। তার মন ভরে যায় বিশ্ব জয়ের আনন্দ।নতুন পৃথিবী গড়ার প্রেরণা ওর মনে আনন্দের দোল খেতে থাকে। ও শুনতে পায় যেন, কে যেন বলছে এগিয়ে যাও গৌতম, সবুজের অভিযান এ। আমরা সবাই তোমার পাশে আছি।