Sanghamitra Roychowdhury

Classics

3  

Sanghamitra Roychowdhury

Classics

সুখ ফ্রেম

সুখ ফ্রেম

6 mins
745


সুখ ফ্রেম

সংঘমিত্রা রায়চৌধুরী

--------------------------------


বাইরে অঝোর ধারায় বৃষ্টি, সাথে থেকে থেকেই বিদ্যুতের ঝলকানি, ঘড়ির দুটো কাঁটাই বারোটার ঘরে, তখনো সুমি শুতে যেতে পারে নি। সবে বুধবার পার হচ্ছে, এখনো পুরো তিনটে কাজের দিন বাকী, তবে গিয়ে শেষ হবে সপ্তাহ, আসবে রবিবার। কী যে সুখ ঐ রবিবাসরীয় কথাটায় এটা সুমি কাউকে ঠিক বলে বোঝাতে পারবে না। সেই ছোট্ট থেকে রবিবার মানেই সুমির আনন্দ আর ধরে না।


সাতপাঁচ ভাবনার মাঝে সুমির চোখটা আবার একবার ঘড়ির দিকে গেলো, বারোটা দশ, শেষ ফাল্গুনের অকাল বর্ষণে বেশ গা শিরশির করছে ভেজা হাওয়ায়। সুমি রান্নাঘরের জানালাটা টেনে বন্ধ করে দিলো। এবার সুমির ঘুম পেয়ে গেছে, কিন্তু এখনো অর্ধেকটা এঁচোড় কাটা বাকী, শ্বশুরবাড়ির গাছের এঁচোড়, রাজীব চিংড়ি দিয়ে খেতে চেয়েছে।


খেতে চেয়েছে মানে রাজীব রান্না করা এঁচোড়-চিংড়ি আর বাসমতী চালের সাদাভাত নিয়ে যেতে চেয়েছে অফিসে, কয়েকজন সহকর্মী বন্ধুকে খাওয়াবে, নিজের বাড়ীর গাছের এঁচোড়। তাছাড়া সুমি রান্নাটাও দুর্দান্ত করে, এনিয়ে রাজীবের একটু প্রচ্ছন্ন অহংকারও আছে, তবে সুমিকে তা কখনোই বুঝতে দেয় না। কিন্তু মজার কথা হোলো এর সবটাই সুমি খুব ভালো করেই বোঝে, আর মনে মনে হাসে আর উপভোগ করে, এবং সেটাও ও মোটেই রাজীবকে বুঝতে দেয় না।


সুমির হাতের ছুরি দ্রুত চলছে, আর চপিং বোর্ডের উপর ছুরির খটখট আওয়াজ রাতের নিস্তব্ধতাকে সামান্য হলেও বিঘ্নিত করছে। তবু কিছু করার নেই সুমির, রাতে শোবার আগে এই কাজটি সেরে না রাখলে সকালে কিছুতেই পেরে উঠবে না সুমি পুরো রান্নাবান্না ঘর গেরস্থালির গোছগাছ সব একাহাতে সারতে। রাত বারোটা পঁচিশ, সুমি হাতে ভালো করে সর্ষের তেল মেখে এঁচোড়ের আঠা নিজের হাত, ছুরি আর চপিং বোর্ড থেকে ছাড়িয়ে, তারপর ভালো করে সাবানজলে ধুয়ে হাত মুছে আলো নিভিয়ে যখন শোবার ঘরে এসে ঢুকলো তখন ঘড়িতে সময় রাত বারোটা চল্লিশ প্রায়।


অসহ্য ক্লান্তিতে সুমির শরীর ভেঙেচুরে আসছে, শরীর আর চলতে চাইছে না। ভাগ্যিস ওর নিজের স্কুল ওর বাড়ীর সামনের স্টপেজ থেকে অটোয় মাত্র মিনিট চারেক এবং স্কুল শুরু সাড়ে দশটায়!

সুমি শুতে এসে দেখে বড় আলো জ্বেলে রেখেই রাজীব আর রাই-রায়ান.... ওদের সাত বছরের মেয়ে আর ছ'বছরের ছেলে ঠান্ডা হাওয়ায় কুঁকড়ে শুয়ে আছে। সুমি পশ্চিমের জানালাটা ভেজিয়ে দিয়ে ওদের গায়ে পাতলা চাদরটা চাপা দিয়ে দিলো। ওদের তিনজনের ঘুমন্ত মুখের দিকে চেয়ে সুমির মনটা তৃপ্তিতে ভরে উঠলো। মোবাইলে ভোর পাঁচটার এলার্ম সেট করে আলো নিভিয়ে সুমি শুয়ে পড়লো।


রাই-রায়ানের মর্নিং স্কুল, সাড়ে সাতটায় পুল-কার ওদের তুলবে। পাঁচটায় না উঠতে পারলে ছেলে-মেয়েকে সময়ের মধ্যে তৈরী করতে পারবে না। দুপুরে রাই-রায়ানের বাড়ী ফিরতে প্রায় আড়াইটে বেজে যায়, কাজেই সকালে স্কুলে যাবার আগে সুমি ওদেরকে একমুঠো গরম ভাত একটু ডাল আলু ডিম সেদ্ধ আর মাখন দিয়ে খাইয়ে দেয়। ওরা যখন বাড়ী আসে তখন সুমি বাড়ীতে থাকে না, রেশমী যদিও খুব যত্ন করেই রাই-রায়ানের দেখভাল করে, তবুও ছেলে-মেয়েকে সকালে একটু পেট ভরে খাইয়ে না দিতে পারলে সুমির মনটাতে ঠিক শান্তি হয় না। এইসব ভাবনার মাঝেই ঠান্ডা ঠান্ডা হাওয়ায় একটা চাদর গায়ে দিয়ে সুমি অঘোর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে গেলো।


"সুবহ সুবহ, কা খায়াল আজ, ওয়াপস গোকুল চলে মথুরারাজ........" মোবাইলে সুমির এলার্ম। রাজীব আগের বছরের বিবাহবার্ষিকীতে নতুন স্মার্টফোনটা যখন গিফট করেছিলো তখনই এই রিং টোন আর এলার্ম টোন সেট করে দিয়েছিলো। সুমির ভীষণ প্রিয় গানটা..... ঋতুপর্ণ ঘোষের 'রেনকোট' ছবিতে ওর প্রিয় শিল্পী শুভা মুদ্গলের প্লেব্যাকে। খুশীতে, নিজের ভরভরন্ত সংসারের সুখযাপনে সুমি মাখনের মতো গলে যাচ্ছে যেন। অভাবী সংসারে জন্মেও লেখাপড়ায় কখনো গাফিলতি ছিলো না সুমির। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় পার করে তাই নিজের পরিশ্রম আর অধ্যাবসায়ের জোরে স্কুলটিচারের চাকরিটা হয়েছিলো সুমির। আর তারপরেই সম্বন্ধের ঢেউ।


লাখ কথার চালাচালির পর দশবছর আগে সুমি রাজীবের বিয়ে, তারপর সন্তানেরা, তারপর সাড়ে চার বছর আগে নিজেদের আলাদা সংসার। নিজেদের রোজগারে কেনা নিজেদের এই আলাদা এগারোশো স্কোয়ার ফিটের ফ্ল্যাট ওদের দুজনেরই কর্মস্থলের একেবারে কাছে। যতদিন বেলঘরিয়ায় শ্বশুরবাড়িতে ছিলো সুমি রাজীবের যাতায়াতেই অনেকটা সময় চলে যেতো। তাই অন্তত সুমির স্কুল কাছে হোক.... এই প্ল্যানে ওরা এই চুঁচুড়া সদর শহরের ফ্ল্যাটটা কেনে। তবে ভাগ্যক্রমে রাইকে স্কুলে ভর্তির আগেই প্রোমোশন নিয়ে রাজীবও এই শহরেই পোস্টিং পায়। সুমির কিন্তু কেমন যেন মনে হয় রাজীব একটু তদ্বির তদারকি করেই এই পোস্টিংটা জোগাড় করেছে..... দু'টো ছোট বাচ্চা চাকরি সামলে সুমির একা একা অসুবিধাই হচ্ছিলো। শুধু যাতায়াতের সময়ই বেঁচেছিলো সুমির, সংসারে রাজীবের সময় মোটেই পাচ্ছিলো না। সবটাই সুমিকে একা একাই কাজের লোক নিয়ে চালাতে হচ্ছিলো। রাজীবের চুঁচুড়ায় পোস্টিং হওয়াতে সুমি তাই হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে যেন।


সুমি মুখ ধুয়ে, প্রাতঃকৃত্য সেরে রান্নাঘরে ঢুকতেই সাড়ে পাঁচটা বেজে গেলো। চা করে দুটো ওভেনে ভাত আর এঁচোড় সেদ্ধ বসিয়ে রাজীব আর রাই-রায়ানকে জাগিয়ে দিলো। ছ'টা বাজে.... ওদেরকে সময়ের মধ্যে তৈরী করতে হবে। ছেলে-মেয়েকে স্কুলের গাড়িতে তুলে রাজীব টুকিটাকি বাজার দুধ ঠাকুর পুজোর ফুল-মিষ্টি নিয়ে নেয়। বাড়ী পৌঁছে তারপর রাজীব নিজের অফিসের জন্য তৈরী হবে।সকালে এই সময়ে খুব তাড়াহুড়ো থাকে। "ফেরার পথে একটু টকদইও আনতে ভুলো না," বলে দিলো সুমি, "এঁচোড়-চিংড়িতে দেবার জন্য।" ওরা সিঁড়িতে নামার সময় সুমি শুনলো রাজীবের ফোন বাজছে।


প্রায় আটটা বাজে, রেশমী এসে গেছে, ওকে কাজ বোঝাতে বোঝাতেই রাজীব ফিরে এলো, সবই মনে করে এনেছে, খালি টকদইটাই আনতে ভুলেছে। যাকগে, ঘি গরমমশলা দিয়ে এঁচোড়-চিংড়ির তরকারিটা নামিয়ে সুমি দ্রুতহাতে রাজীবের টিফিন ক্যারিয়ার গুছিয়ে রাজীবকে রুটি তরকারি খেতে দিয়ে নিজে বাথরুমে ঢুকবে এইসময় রাজীব দায়সারাভাবে বলে উঠলো, "মা ফোন করেছিলো, মা আর মেজদা এগারোটা নাগাদ আসবে, মা দিন দুয়েক থাকবে।"


সুমি যেন জ্বলে উঠলো, "মানে? সপ্তাহের মধ্যিখানে দিন দুয়েক থাকবেন বললেই হোলো? উনি থাকা মানে রেশমীকে দিয়ে কোনো কাজ করানো যাবে না। আমি যদি বছরের শুরুতেই এতো ছুটি নিয়ে ফেলি তবে বছরের অন্য সময় ছুটির প্রয়োজন হলে কি করবো?"


এককথায় দু'কথায় ঝগড়া বিশালাকার ধারণ করলো। রাজীব না খেয়ে, না টিফিন ক্যারিয়ার নিয়ে গজগজ করে বেরিয়ে গেলো। সুমি কেঁদে ফেললো ঝরঝরিয়ে। রেশমী চলে যাবার সময় বারবার বলতে লাগলো দু-তিনদিনের সব বাসনপত্র রেখে দিতে, সুমির শাশুড়ি চলে যাবার পরে এসে রেশমী মেজে দেবে। রেশমীকে অটোভাড়া দিয়ে রেশমীর হাত দিয়ে সুমি রাজীবের টিফিন ক্যারিয়ার পাঠিয়ে দিলো অফিসে। সুমি আলাদা করে নিরামিষ রান্না বসালো আবার।


শাশুড়ি আর মেজো ভাশুরের যথাসাধ্য আপ্যায়ন করলো সুমি, খাওয়া দাওয়া শেষে মেজো ভাশুর চলে গেলেন। গেস্ট রুমের বিছানা ঝেড়েঝুড়ে শাশুড়ির শোবার ব্যবস্থা করে টিভি চালিয়ে দিয়ে সুমি নিজেদের শোবার ঘরে গেলো। সকালের ঝগড়ার কথা মনে করে সুমি খানিক ইতস্ততঃ করেই রাজীবকে ফোন করে জিজ্ঞেস করলো, "রান্না কেমন হয়েছে?" রাজীব মুখ দিয়ে টাকরায় আওয়াজ তুলে বললো, "রাতে পুরষ্কৃত করবো!" সুমির কান গরম, গাল ‍লাল। রাই-রায়ান স্কুল থেকে ফিরে মাকে পেয়ে খুব খুশি। ওদেরকে খাইয়ে দাইয়ে নিয়ে এসে শুয়ে সুমির চোখ গেলো দেওয়ালে টাঙানো বাহারী ফ্রেমবন্দী ওদের চারজনের ছবিটার দিকে। কখন যে ঘুমে চোখ জড়িয়ে এসেছিলো সুমির, ঘুম ভাঙলো ডোরবেলের আওয়াজে।


রাজীব ফিরেছে, সন্ধ্যের চা-জলখাবার পর্ব মিটিয়ে সুমি রাই-রায়ানকে হোমওয়ার্ক করিয়ে খেলতে ছেড়ে দিলো.....বাবা আর ঠাকুমার সাথে। আর নিজে ঢুকলো রান্নাঘরে রাতের খাবারের আয়োজনে। ওদের খাবার যা আছে ফ্রিজে তাই দিয়েই হয়ে যাবে। শুধু কটা রুটি, আর শাশুড়ির জন্য একটু নিরামিষ তরকারি আর ছানা করলেই হয়ে যাবে। সুমি রান্না শেষ করে ছেলে-মেয়েকে খাইয়ে শুতে পাঠালো। নিজেদের আর শাশুড়ির খাবার বাড়তে বাড়তে শুনতে পেলো রাজীব বলছে, "মা, কালকে আর সুমি ছুটি নিতে পারবে না, আমি ছুটি নেবো কাল, যাতে তোমাকে একা থাকতে না হয় সারাদিন। তাছাড়া রাই-রায়ানকেও তো দুপুরে খেয়াল রাখতে হবে স্কুল থেকে ফেরার পর। রেশমী তো আসবে না তুমি যে ক'দিন থাকবে।"


সুমির স্বল্পবাক শাশুড়ির মনোভাব ঠিক বুঝলো না সুমি।


সব কাজকর্ম মিটিয়ে সুমি শুতে এসে দেখে বাবা ছেলে-মেয়েতে হাত-পা ছড়িয়ে প্রায় পুরো বিছানা জুড়ে শুয়ে আছে। বড় আলো নিভিয়ে নীল রাতবাতি জ্বালিয়ে বিছানায় অবশিষ্ট একফালি জায়গায় রাজীবের গায়ে ঘন হয়ে হাত বাড়িয়ে ছেলে-মেয়েকে ছুঁয়ে শুয়ে পড়লো সুমি। দেওয়ালের সুখফ্রেম এখন বিছানায়.... সুমির সমস্ত চেতনা- অস্তিত্ব জুড়ে। মনে মনে সুমি ঈশ্বরকে অশেষ ধন্যবাদ জানালো। সবসময় মুখে বলে সব অনুভূতি প্রকাশ করার দরকার পড়ে না। রাজীব সত্যিই সদাসর্বদা যেভাবে সুমির খেয়াল রাখে, এভাবেই যেন বাকী জীবনটা রাজীব ওর হাত ধরে রাখে। "সকল সুখ-দুঃখের মাঝেই তোমায় পেয়েছি আমার পাশে ওগো আমার অতন্দ্র প্রহরী শ্রীযুক্ত রাজীব লোচন ব্যানার্জি মশাই," অস্ফুটে, ঘুমিয়ে পড়ার ঠিক আগে সুমি নিজেকেই নিজে শোনায় যেন।


এইই তো সম্পর্ক, এইই তো সংসার.... সুখফ্রেমে! সুখের ঠিকানায়... সুখ সন্ধানী... সুমি এখন অচেতন ঘুমে, অবচেতনের সুখস্বপ্নে।


------------------------------------------------------

© সংঘমিত্রা রায়চৌধুরী



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics