Sanghamitra Roychowdhury

Classics Inspirational

3  

Sanghamitra Roychowdhury

Classics Inspirational

সুধাংশু এসেছিলো

সুধাংশু এসেছিলো

5 mins
592


কাল কালান্তর, যুগ যুগান্তর, গ্রাম গ্রামান্তর, দেশ দেশান্তর..... এই শব্দবন্ধগুলির প্রতি বিশেষ এক টান আছে আমাদের। এই শব্দরা যেন মনে মনে নিরন্তর শব্দান্তর ঘটায় জীবনের রোমাঞ্চকর কেন্দ্রাভিমুখে। আজ এদের হাত ধরেই চলা যাক মূল কথায়, মূল আখ্যানের মধ্যেই এদের বিস্তার হোক, গল্প গাঁথায়। 


বছর ষোলো সতেরোর সুশ্রী মনোরমা, বিবাহসূত্রে সে কলকাতার ৫সি উমেশ দত্ত লেনের বাসিন্দা। কৈশোরের শেষেই শরীরে মনে পূর্ণ যুবতী হয়ে ওঠার আগেই, ইস্কুলের পড়া বন্ধ করে, তাকে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে হয়েছে, প্রায় তার দ্বিগুণ বয়সী একত্রিশ বছরের পান্নালাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাথে। গত শতকের প্রথমার্ধে এমন ঘটনায় আশ্চর্য হবার মতো উপকরণ কিছু ছিলো না, অতি স্বাভাবিক একটি ঘটনা। তবে এই স্বাভাবিক ঘটনাই ধীরে ধীরে অস্বাভাবিকের দিকে মোড় নিলো। 



মনোরমার বাবা কলকাতা শহর থেকে বহু দূরের গ্রাম গ্রামান্তরের একমাত্র গ্রামীণ হাতুড়ে চিকিৎসক। সহোদর পাঁচ বোন আর তিন ভাইয়ের এবং অনেকগুলি তুতো ভাইবোন অধ্যূষিত বিরাট হতশ্রী, অথচ শিক্ষালোকপ্রাপ্ত সংসারে জন্ম ইস্তক বড়ো হওয়া মনোরমা, বিবাহসূত্রে শহর কলকাতায় স্বামীর আত্মীয় পরিজন সম্বলিত একান্নবর্তী পরিবারে সংসার করতে এসেছে। মনোরমার নিজের শ্বশুর-শাশুড়ি মনোরমার বিবাহের বহুকাল আগেই দেহ রেখেছেন। তাঁদের অবর্তমানে সংসারের হাল মনোরমার দুই খুড়শ্বশুর খুড়শাশুড়ি, এক বাল্যবিধবা ননদ এবং জ্যেঠশ্বশুরের একমাত্র পুত্র ও পুত্রবধূর হাতে। বাড়ীতে দু-একজন আশ্রিতও আছে, পান্নালালের ঠাকুমার বাপের বাড়ীর সম্পর্কিত মামা। আর আছে গুটিকয়েক আইবুড়ো ননদ দেওর এবং খুড়তুতো দুই আর দুইয়ে চার জা, কমবেশী মনোরমারই সমবয়সী তারা।



গ্রামের মেয়ে মনোরমার চালে চলনে বলনে ঘোর অসন্তোষ সংসারের কর্ণধারদের। সম্বন্ধ আনা ঘটকেরও বাপান্ত হয় সর্বক্ষণ। হেঁশেল লাগোয়া চওড়া দালানে সারি সারি পাত পড়ে রাতের খাবার সময়ে। প্রথমে সব পুরুষেরা খাবে, তারপর বাড়ীর মেয়ে বৌয়েরা খাবে। পুরুষদের খাওয়ার ফাঁকে ফোঁকরে বাড়ীর শিশুগুলিকে রান্নাঘরের ভেতরেই এককোণের দিকে বসিয়ে পেল্লায় মাপের এক কাঁসার বগি থালায় ভাত মেখে গরাস পাকিয়ে পাকিয়ে খাইয়ে দেওয়া মনোরমার দৈনিক বরাদ্দের কাজ, কারণ আর কোনো কাজের ছিরিছাঁদ নেই তার। থালার চারধারে গোল করে শিশুগুলি বসে আর মনোরমা তাদের সবাইকে নানান গল্প বলতে বলতে খাইয়ে দেয়। মনোরমার নিজের কোল আলো করে তখনো কেউ আসে নি। ভাশুরপো, ভাশুরঝি, মামারবাড়ীতে বেড়াতে আসা ভাগ্নে ভাগ্নিদের সাথেই দিনের অনেকটা সময় মনোরমার কাটে।



মনোরমার শ্বশুরবাড়ীর অনেকগুলি পারিবারিক ব্যবসা। তার মধ্যে বৌবাজারের সোনা রূপো ও দামী রত্নের ব্যবসাটি দেখাশোনার দায়িত্ব মনোরমার স্বামী পান্নালালের। সবকটি ব্যবসার যৌথ আয় থেকেই চলে যৌথ সংসারের যাবতীয় খরচ। সে খাওয়া দাওয়া, কাপড় চোপড়, পালা পার্বণ, তেল সাবান মায় কালেভদ্রে বাড়ীর বৌয়েদের বাপের বাড়ীতে যাওয়া বা বাড়ীর মেয়েরা শ্বশুরবাড়ী থেকে বাপের বাড়ীতে বেড়াতে আসা বা লোক লৌকিকতা..... ইত্যাদির যাবতীয় খরচাই চলে পারিবারিক এজমালি আয়ের তহবিল থেকেই।



পান্নালাল ভারী চুপচাপ প্রকৃতির। নতুন বৌয়ের সাথে তার তেমন সখ্য গড়ে উঠতে পারে নি। হয়তো বয়সের ফারাকটাই দায়ী তার জন্য। রোজই রাতে দালানে খেতে বসে পান্নালালকে পালা করে শোনানো হয় মনোরমার সারাদিনের ভুলভাল কার্যকলাপের ফিরিস্তি। বাড়ীর বয়োজ্যেষ্ঠা মহিলারা অত্যন্ত দায়িত্ব সহকারে কাজটি করে থাকে। আর পান্নালালের পুরুষ অগ্রজেরা রোজই উপদেশ দিয়ে থাকে কেমন করে শক্ত হাতে বৌয়ের রাশ টেনে ধরে রাখতে হবে। নির্বিবাদী পান্নালাল নীরবে শোনে আর তার ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে ভাবে, "আহা, বৌ কী ঘোড়া? যে তার রাশ টেনে রাখতে হবে? আর এই রাশ টেনে রাখার উপায়টাই বা কী?" তবে ধন্ধ কাটাতে মুখ ফুটে কাউকে কিছু বলার মানুষও পান্নালাল নয়। এভাবেই মনোরমা আর পান্নালালের বৈবাহিক সম্পর্কের দু'বছর অতিক্রান্ত।



মনোরমা প্রথমবারের জন্য গর্ভবতী, বাড়ীর সব বয়োজ্যেষ্ঠাদের উপদেশের ঢেউয়ে মনোরমা ভীত, সন্ত্রস্ত, জেরবার। পান্নালালকেও সাংসারিক নানা উপদেশ বাণী জ্ঞাত করানোর সময়ও বৃদ্ধি করা হয়েছে, বাড়ীর বয়োজ্যেষ্ঠ পুরুষ মহিলা, উভয় তরফ থেকে। তবে তাতে মনোরমা আর পান্নালালের খুব বিশেষ কিছু আসে যায় না। ততদিনে যে উভয়মুখী টান তৈরী হয়েছে, এদের টান যেন ভিতরের দিকে, আরও গহনে, আদি কেন্দ্রের অভিমুখে, আপাতদৃষ্টিতে স্থূল পর্যবেক্ষণে তার তরঙ্গদৈর্ঘ্য মাপা যায় না।



মনোরমা ও পান্নালালের সম্পর্কের রসায়নে মাধুর্য্য, তা আখ্যান ও উপাখ্যানের বিচিত্র বুনোটে গাঁথা হতে থাকে। সংসার জীবনে এগিয়ে চলতে চলতে পিছন ফিরে তারা দেখে, প্রসঙ্গান্তরে চলে যায় অনায়াসে, কালের ওই বিপুল দোদুল্যমানতাতেই তাদের আনন্দ। বছর কয়েকের ব্যবধানেই তিন তিনটি কন্যাসন্তানের গর্বিত পিতা-মাতার ভূমিকায় তারা। আমাদের দেশের ঘরে ঘরে সংসারে যে পরম্পরা, তার মধ্যে ক্রমাগত এই সামনের ও পিছনের টান, সময়ের একটা নির্দিষ্ট দিকে নয়, কৌণিক দিকগুলো মিলিয়ে একেবারে যেন দশ দিকে দৃষ্টিপাত করতে করতে সরবে চলা। তার যে মহাভার ও বিপুল আয়তন, তা মনোরমা ও পান্নালালের ক্ষুদ্র সংসারে চাপিয়ে দেওয়া যায় নি, এইটাই তাদের বৃহত্তর যৌথ পরিবারের ক্ষোভের কারণ হয়েছিলো।



পুত্রসন্তানের জন্ম দিতে না পারায় মনোরমাকে অনেক গঞ্জনা সহ্য করতে হচ্ছিলো। ভাইফোঁটা নিতে মনোরমার স্বদেশী করা ভাই সুধাংশু এসেছিলো, শুনেছিলো সব। সুধাংশু তার জামাইবাবু পান্নালালকে অনুরোধ করেছিলো, দিদি মনোরমা আর তিন ভাগ্নিকে নিয়ে আলাদা হয়ে যেতে। নিজেদের মতো করে আলাদা বাসাবাড়ী করে কলকাতারই অন্য কোথাও থাকতে, আর ভাগ্নিদের বেথুন স্কুলে ভর্তি করাতে। সুধাংশু খুব সুন্দর করে বুঝিয়েছিলো পান্নালালকে। আর এই প্রথম পান্নালালও অন্যরকম করে ভাবতে শুরু করেছিলো। পড়তে পড়তে বিয়ে হয়ে যাওয়ায় মনোরমার নিজের লেখাপড়ার সাধ মেটে নি। তাই ভাইয়ের প্রস্তাবে পান্নালালের মতো মনোরমাও অন্যরকম করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলো।



বিডন রো ছাড়িয়ে, মিনার্ভা থিয়েটার পেরিয়ে, একটু এগোলেই ৫সি উমেশ দত্ত লেনের বন্দ্যোপাধ্যায় বাড়ীতে বৌ হয়ে আসার পরে, অষ্টমঙ্গলা ছাড়া আর কোনোদিন মনোরমা বাইরে বেরোতে পারে নি। সেদিন যখন বাইরে দাঁড়ানো ফিটনে উঠবে, তখন সব সমালোচনার ঊর্দ্ধে উঠে ঘোমটার তলা থেকেই এধার ওধার তাকিয়ে দেখে তার মনে হোলো, "এতো সূর্যের আলো এই উমেশ দত্ত লেনেও ঢোকে?" ভারী অবাক হোলো, "৫সি-এর ঠিক পাশের বাড়ীটারই নম্বর ৮বি হয় কী করে?"



পিছনে পড়ে রইলো বারো বছর মানে একযুগ ধরে সংসার করে আসার স্থায়ী ঠিকানা। আঠাশ ঊনত্রিশ বছরের স্ত্রী মনোরমা আর পিঠোপিঠি তিন মেয়েকে নিয়ে পান্নালাল চললো শিমলেপাড়ার নতুন ঠিকানায়, নিজের ঠিকানায়, যেখানে মনোরমার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ শুনতে হবে না রোজ। গরীবের মেয়ে মনোরমাকে পুত্রবতী হতে না পারার জন্য নিত্য গঞ্জনা সহ্য করতে হবে না। ফিটন পৌঁছে গেছে নতুন ঠিকানায়। সুধাংশু সেখানে আগেই এসে পৌঁছেছে।



পরেরদিন মনোরমার তিনমেয়েকে বেথুন স্কুলে ভর্তি করে মনোরমা আর পান্নালাল যখন বেরোচ্ছে, সঙ্গে পথপ্রদর্শক মনোরমার ভাই সুধাংশু, ঠিক তখনই ইংরেজ পুলিশ বাহিনীর কর্মীরা কর্ডন করে ঘিরে ধরলো তাদের। কোনো জোর করতে হোলো না, সুধাংশু বিনা বাধায় গ্রেপ্তার হোলো, হয়তো দিদি-জামাইবাবু-ভাগ্নিদের নিরাপত্তার কথা ভেবে। ভাগ্নিদের কপালে চুমো খেয়ে, দিদি-জামাইবাবুকে প্রণাম করে সুধাংশু পুলিশের গাড়ীতে উঠলো। অদূরেই রাস্তার অপর পাড়ে হেদুয়ার কোণটা থেকে ঠিক তখনই পিছন ফিরে হাঁটতে শুরু করেছে পান্নালালের জ্যেঠতুতো দাদা। আসলে এ ছিলো একান্নবর্তী যৌথ পরিবারে বিপ্লব ঘটিয়ে যৌথ পরিবার ভাঙানোয় বিপ্লবী সুধাংশুর শাস্তি। যদিও তখনো সুধাংশুর মুখে হাসি আর "বন্দে মাতরম্" ধ্বনি। মনোরমা আর পান্নালাল ভেজা চোখে। মেয়েদের শিক্ষিত করে তুলতে হবে, ওদের মামা সুধাংশুর কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ওরা।



সালটা ১৯৩৭...... ভারতবর্ষের স্বাধীনতার ঠিক দশ বছর আগে, সুধাংশু এসেছিলো, তার দিদি জামাইবাবুর সংসারে যুগান্তর এনে স্বাধীনতার নব সূর্যোদয়ের চেতনা জাগরূক করাতে। শতকান্তরের আলোকে ভাস্বর হোক সুধাংশুর দিদির পরিবারের এ পদক্ষেপ!


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics