সোনালী আলোর ছটা
সোনালী আলোর ছটা
তখন মৌ সবে কেজি ক্লাসে পড়ে।মৌ’র বেচারা বাড়ীর লোকজন দেওয়ালে মৌ’র হরোপ্পা মহেন্জোদারো আঁকা দেখে খুশী হয়ে নাকি অখুশি হয়ে জানিনা মৌ’র জন্য একটা আঁকার মাষ্টার মশাই নিয়োগ করেছিল।বাড়ীতে এসে তিনি আঁকা শেখাতেন।মৌ’র ভারী পছন্দের মাষ্টার মশাই ছিলেন তিনি।না আঁকার জন্য নয়।সে তো তিনি এমনিতেই ভালো আঁকতেন। পছন্দের কারণ ছিল গল্প। প্রতিবার এসে ওনার প্রথম কাজ ছিল একটা করে গল্প বলা। সেটা ভালো লাগলে তবে মৌ আঁকতে শুরু করতো।না লাগলে জাস্ট আর একটা গল্প। এর অন্যথা হবার যো নেই।অন্যথা হলেই এমন ভালো ছবি আঁকতো যে আর্ট মিউজিয়ামে দেখতে পেলেই টাঙিয়ে দেবে।যেমন দুটো বড় গোল আর একটা ছোট গোল এঁকেই এক ছুটে বাবার কাছে গিয়ে বলতো “এটা স্যার আজ আঁকতে শিখিয়েছে।বাবা মা আর আমি।” তিনটে দাঁড়ি টেনে বলতো “এটা আম।” বেচারা মাষ্টার মশাই চাকরি নিয়ে প্রচন্ড ভয়ে থাকতেন আর আঁকার থেকেও ভালো করে গল্প প্র্যাকটিস করে আসতেন। বাবা মা খুব চিন্তিত হয়ে পড়ত।মৌ’র জন্য না।স্যারের জন্য।প্যাস্টেল রঙ এ আঁকা হতো তখন।এতো ছোটবেলায় স্কেচ পেন বা জল রঙ দেওয়াই হতো না।সেটাও যথেষ্ট রাগের কারণ ছিল।একবার স্যার নিজের কি একটা প্রোজক্ট, মৌদের বাড়ী বসে বসে মৌকে আঁকতে দিয়ে শেষ করছিলেন জল রঙ দিয়ে।অসাধারণ একটা কিছু আঁকছিলেন।কি আজ আর মৌ এর মনে নেই।তখন মৌএর মনে হয়েছিল মৌ কে শেষ করতে দিলে মৌ আরও সুন্দর করে শেষ করবে।বেশ কয়েকবার প্রস্তাবটা দিয়েও দিয়েছিলো।স্যার হেসে মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিলেন “আগে আর একটু বড় হয়ে ওঠ মা।”কথাটা হজম হয়নি।একে তো আঁকতে দিচ্ছে না তাতে আবার ছোট বলে খোঁটা দেওয়া।তক্কে তক্কে ছিলো।মা কিছুক্ষন পর চা দিয়ে যাওয়ার পরই সুযোগ মিললো।একবার স্যার চুমুক দেবার পরই সর্ন্তপনে চা এর কাপ আর রঙ গোলার মগ চেন্জ হয়ে গেল।যথারিতী আপনভোলা স্যার তুলিটা চা এ ডোবালেন।তুলি থেকে রঙটা ধোওয়ার জন্য ভালো করে চা এর কাপে গুললেন।তারপর সেটা শুকাতে দিয়ে অন্য তুলি হাতে রঙ গোলা জলের মগটা চুমুক দিলেন(সে এখন যেটাই মুখ দিতেন একই টেষ্ট পেতেন) আর এমন হাউমাউ করলেন যে মা ছুটে এসে মৌ’র কানটা ধরল।মৌ’র গালে মার হাতের পাঁচ আঙুলের ছাপ পড়ার আগে স্যার যদিও বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন এই বলে যে উনিই ভুল করে অমন কান্ড করেছেন।এখন মনে পড়লে মৌ ভাবে ভাগ্যিস অন্য তুলি তুলে নিয়েছিলেন স্যার তখন, না হলে আঁকাটাও যেত আর আমার গালটাও।
তা ওয়ানে পড়ার সময় মৌ’র সেই স্যারের বিয়ে।কিছুদিন আগে কোন এক আত্মীয়ার বিয়ে থাকায় মা জ্যেঠিমাদের গল্প শুনে বুঝেছিলাম সেই আত্মীয়াকে সোনা দেওয়ায় তাঁরা খুব খুশি।ব্যাস আর যায় কোথা।ফট করে স্যারকে বলে দেওয়া হলো “আপনার বিয়েতে আমরা অনেককটা সোনা দেব।” স্যার তো পারলে মৌ’র হাতে পায়ে ধরে বাবা বাছা করে অনেক request করেন, এসব যেন মৌ সত্যি করে মা বাবাকে গিয়ে না বলে।স্যারের বিয়ে চার্চে ছিল।শুধুমাত্র ছাত্র ছাত্রী আর কয়েকজন আত্মীয় নিমন্ত্রিত ছিল।পাড়ার একজন বড় দিদি যেও স্যারের ছাত্রী তার সাথে মৌ’র যাওয়ার কথা ছিল।নির্ধারিত দিনে বাবা অফিস যাওয়ার সময় মৌ কে বলে গেলেন যে মার কাছে গিফট চেক রাখা আছে স্যারের জন্য।মা পাড়াতুতো দিদিকে দিয়ে দেবে। মাথায় বজ্রাঘাত মৌ’র।সোনা কোথায় গেল।যেই মার কাছে বুঝলো গিফট চেক আর সোনা আলাদা জিনিষ ব্যাস শুরু হলো কান্না।সোনাই চাই।কিছুক্ষণ পর মা পাত্তা না দেওয়ায় মৌ তার পিঠোপিঠি খুড়তুতো দাদার দ্বারস্থ হলো।দাদাভাই তখন টু এ পড়ে।বিশাল জ্ঞানী।সমস্যার সমাধান করে বলল যে ও শুনেছে রোদ পড়লে বালি সোনার মত চকচক করে।তাহলে নিশ্চয় বালিতে সোনা আছে।সূর্য ডোবার আগে খুঁজে নিলেই হল।মার ওপর ভারী রাগ হলো।এত সহজে সোনা পাওয়া যায় আর..।দুভাইবোন তাড়াতাড়ি করে দুপুরবেলা সোনা খুঁজতে বেড়োলাম।বেশীদূর যেতে হল না।পাশের বাড়ীতে কাজ হচ্ছিল।এত বালি রাখা ছিল।মৌরা প্যাকেটে করে বেছে বেছে চকচকে বালি তুলে আনলো।স্কুলের হাতেরকাজের জন্য রঙীন কাগজ আঠা সবই থাকতো।অপটু হাতে মুড়ে ‘রোদে খুলবে।ইতি মৌ এর বাবা’ লিখে দিলাম।দাদাভাই বলে দিয়েছিল ও এত খাটলো মৌ এর জন্য।মৌ রাতে যা যা খাবে ওর জন্যও যেন নিয়ে আসে।এবার মা কে পটানোর পালা।যাতে গিফট চেক মৌ এর হাতেই পাঠায়।তাতেও সাক্সেসফুল হয়ে গেলো।
সন্ধ্যেবেলা সেজেগুজে মৌ তার তৈরী গিফটের প্যাকেট নিয়ে চললো।মা কে বললো ওর মধ্যে আঁকা আছে।স্যারের জন্য এঁকেছে।ওটাও দেবে।মা খুশিই হলো।ব্যাস তারপর বেড়োবার আগে টুক করে গিফট্ চেক ঠাকুমার ঝুলির পাতার ফাঁকে ঢুকিয়ে শুধু নিজের তৈরী গিফট্ নিয়ে রওনা দেওয়া কি আর এমন ব্যাপার।দুটো গিফট দিলে স্যার পাক্কা সন্দেহ করবে।
বিয়েবাড়ী পৌঁছে গিফট্ দিয়ে স্যার আর স্যারনীর কোলে চেপে আদর খেয়ে বলেও দিলো “দাদাভাই গিফট্ প্যাক করতে অনেক হেল্প করেছে।ওর জন্যও খাবার দিয়ে দেবেন।” বেড়োবার সময় কোথাথেকে কে জানে মৌ আর পাড়াতুতো দিদিকে আলাদা ডেকে স্যার দুটো প্যাকেট ধরিয়ে দেয়।
পরেরবার আঁকাতে এসে স্যার বলেছিলেন মৌ’র গিফটটা সবচেয়ে পছন্দ হয়েছে।তারপর স্যার বোলপুরে চাকরী নিয়ে চলে গেলেন।আর কখনো যোগাযোগ হয়নি মৌ এর সাথে।
কয়েকদিন আগে বাপের বাড়ী গিয়ে পুরোনো বই ঘাঁটতে ঘাঁটতে গিফট চেকটা বেড়িয়ে আসে মৌ এর হাতে।সব মনে এসে যায়।খাবার টেবিলে মা’র হাতে তৈরী ডিম পোস্ত খেতে খেতে, এত দিন পর বাড়ীতে ছোটবেলার সেই সোনালী ঘটনাটা বলে ফেলে মৌ।হাসির রোল ওঠে। যদিও তখন জানতে পারলে মৌ’র সূর্পনখার দশা হতো।
পোস্তদানা গুলোও আজ সোনার মতো চিক্ চিক্ করছে।মা’র হাতে তৈরী বলে কথা।হৈ হুল্লোড়ের মধ্যে মৌএর চোখের কোণটাও কেন জানিনা চিক্ চিক্ করে উঠল।হয়তো বা সোনালী আলোর ছটা লেগে।