Maitreyee Banerjee

Drama Others

2.6  

Maitreyee Banerjee

Drama Others

জঙ্গলে মঙ্গল

জঙ্গলে মঙ্গল

6 mins
22.6K


ভিতরকণিকা গেছেন কখনো? উহুঁ শুধু গেলে হবে না, রাতে থাকতে হবে।নর্ম্যালি টুরিস্টরা দিনমানে গিয়ে ফিরে আসে।রাতে অভয়ারণ্যর ভেতরে থাকার জন্য বনদপ্তর থেকে special permission নিতে হয়।শুধু দিনে গেলে ফোক্কা।আর রাতে ছক্কা।খাদ্য খাদকের এতটা চরম সম্পর্ক এর আগে শুধু বইএর পাতায় পড়েছিলাম।

৪-৫ বছর আগের ঘটনা।ভূবনেশ্বরে, অফিসে আমাদের মেয়ে ডাকাতের গ্যাং মিলে ঠিক করলাম আমরা শুধু মেয়েরা জঙ্গল অভিযানে যাব।৫ জন ছিলাম দলে।আমাদেরই একজনের আত্মীয় বন দপ্তর বিভাগে ছিল, তাই অনুমতি পত্রও হয়ে গেল।কিন্তু বাধ সাধল সবার বাড়ী( সরকারের এককাঠি ওপরে তো)।বাড়ীর লোকেরা কিছুতেই ‘অবলা’ মেয়েদের একা ছাড়বে না।দলে ছেলে থাকলে তবেই ছাড়বে।আমাদের জঙ্গল প্ল্যান যখন সবাই চিপটে্ দেবার চেষ্টায় almost successful, তখন আমাদের মধ্যে তিনজন তাদের স্কুল-কলেজ পরিহিত বীরপুরুষ তিনটে ভাইকে সঙ্গে নেবার বুদ্ধি দিল।বাচ্চাদের নেওয়া যেতেই পারে সাথে।সেই বাচ্চাদের নাম ভাঙিয়ে, চক্রান্ত করে তাদের মধ্যবয়স্ক আখ্যা দিয়ে সবাই বাড়ী থেকে ছাড় পেলাম।

ব্রাক্ষ্মণী আর বৈতরণী নদীর মিলনস্থল পেড়িয়ে প্রায় এক ঘন্টা ভটভটি নৌকা করে গেলে তবে অভয়ারণ্যয় পৌঁছানো যায়।নদী ভর্তি কুমীর,- ছোট বড় হরেক রকমের কুমীর।আমাদের এক ঝুড়ি ছোট মাছ দেওয়া হয়েছিল ছুঁড়ে ছুঁড়ে কুমীরদের খাওয়ানোর জন্য।ভটভটির আওয়াজে কুমীররা কাছে আসে না।তাই নিরাপদেই নৌকা থেকে মাছ দেওয়া যায়।হঠাৎ নৌকা প্রচন্ড জোর দুলে ওঠে।আর একটা আবলুষ কাঠের মত কালো কুচকুচে দাঁতাল বিশাল মাথা নৌকার একেবারে কাছে হাঁ করে ওঠে।আমরা ভয়ে চেঁচিয়ে উঠি।ভয়ের চোটে মাছের পুরো ঝুড়ি হাত থেকে জলে।সাথে সাথে সেই মাথাও ভ্যানিস।কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে পুরো ব্যাপারটা ঘটে যায়।নৌকার মাঝি দেখি হাত জোড় করে প্রণাম করছে।তারপর হেসে আমাদের বলে “বিটিয়া আপলোগোকা কিসমত্ বহত আচ্ছা হ্যায়।রাজাসাব কা দরশন মিল গয়া।নহী তো কিসি অর কা হিম্মত নহী হোতা হ্যায় নাও কে ইতনা পাস আনা।রাজাসাব কা নাম কালিয়া আছে।সবসে বড়া মাগুর মছলি।ডরিয়ে মাত্।রাজাসাব বুরা নহী করতা হ্যায় কিসিকা।সেলাম কর লিজিয়ে উনকো।কিসমত্ সে উনকা দরশন মিলতা হ্যায়।উয়ো আপলোগোকা গেনিচ কিতাব মে নাম হ্যায় উনকা।”আমরা সবাই একলাফে নৌকার চালে উঠে বসলাম।কি জানি বাবা, রাজা না করুক রাণী মন্ত্রী সেনাপতি রাজপুত্র কার আবার খাজনা চাওয়ার ইচ্ছা হবে।আর ভাগ্যদেবতা হয়তো আরও সুপ্রসন্ন হবেন আমাদের ওপর।সূর্যদেব মধ্যগগনে।রোদের তেজে মাথা ফাটার মত অবস্থা, তাও আমাদের কাছে নৌকার চালই ভালো।তবে সত্যি এত বড় Handsome কুমীর জীবনে দেখিনি।পরে রিসার্চ করে দেখেছিলাম সত্যিই কালিয়ার নাম ২০০৬ থেকে Guinness বুক এ রয়েছে।২৩ফুট ৪ ইন্চি লম্বা ২০০০ কেজি ওজন।

দুধারে ম্যানগ্রোভ অরণ্য।বিভিন্ন প্রকার নোনাজলের গাছ।দুপাড়ে যেদিকে চোখ যায়, কাঠের গুঁড়ির মত কুমীর রোদ পোহাচ্ছে।মনে হচ্ছিল অ্যানাকোন্ডা মুভীর টলিউড ভারসান বার করতে চলেছি আমরা।নদী পেড়িয়ে অভয়ারণ্যে পৌঁছে দেখলাম চারদিকে একটা অদ্ভুত শান্তি বিরাজমান।স্হানীয় অধিবাসীরা কাজ করে ওখানে।অসাধারণ আতিথেয়তা তাদের।থাকার জায়গা দেখানো হল আমাদের।মাটির দেওয়াল আর টি নের সিলিং দেওয়া পাশাপাশি ছোট্ট দুটো বাড়ী।একটা করে ঘর আর বাথরুম দুটোতেই।সামনে একটা দোতলা পাকা বাড়ী আছে কিন্তু সেটা শুধু মন্ত্রী স্থানীয় লেকেদের জন্য খোলা হয়।আর পাখি ওয়াচের জন্য কতগুলো ট্রি হাউস আছে।বলা হল পাওয়ার কাট প্রায় প্রতি ঘন্টাতেই হয়ে থাকে।BSNL এর ক্ষীণ নেটওয়ার্ক ছাড়া কোন নেটওয়ার্কই নেই।সব মিলিয়ে জঙ্গলে থাকার আদর্শ পরিবেশ।লাগেজ রেখে আমরা মধ্যাহ্নভোজনে গেলাম।ছোট কাকড়ার ঝোল আর গলদা চিংড়ি।সব সকালেই ধরা।একদম টাটকা আর অসাধারণ রান্না।যে ধরেছিল সে, রাঁধুনে কাকু সবাই মিলে দাঁড়িয়ে থেকে যত্ন করে খাওয়াচ্ছিল।যত চাও খাও।ট্যুরিস্টরা তো কস্মিনকালে পারমিশন পায় আর তারওপর মাওবাদীদের দাপটে প্রায় ছয়মাস কেউ পারমিশন পায়নি।তাই আমরা যত না তৃপ্তি করে খেলাম ওরা আমাদের খাইয়ে তার থেকেও বেশী খুশি।রাতে বলল রাজ কাঁকড়া আর গুগলি খাওয়াবে।

খেয়ে দেয়ে আমরা অভয়ারণ্য দর্শনে বেড়োলাম।একটা স্থানীয় লোক দেওয়া হয়েছিল আমাদের সাথে।সেই সব ঘুরিয়ে দেখাচ্ছিল।দুধারে সারি দেওয়া বড় বড় ঘন গাছ।তার মাঝে মাঝে দুহাত অন্তর অন্তর ছোট বড় ডোবা।নদীর সাথে যুক্ত।এগুলো এক একটা কুমীরদের পার্সোনাল ঘর।সারাদিনের কাজ কর্ম সেরে রাতে যে যার ঘরে ফেরে।ভীষণ অবাক হয়ে জিগ্যেস করলাম “কিন্তু ঘেরা নেই যে!!”হেসে উত্তর দেয় “অভয়ারণ্য যে।ওরা যেখানে খুশী যেতে পারে।কিন্তু মনে রাখবেন আপনারা পারেন না।সন্ধ্যার পর থেকে কেউ একা বেড়োবেন না।যখনই দরকার ল্যান্ড ফোন থেকে আমাদের ফোন করবেন।টর্চ রাখবেন সাথে।সব সময় ধুপধাপ করে আওয়াজ করে পা ফেলবেন।কুমীর থাকলেও সরে যাবে।”শুনে আমাদের আত্মারাম খাঁচা ছেড়ে সরে যাবে কিনা ভাবছিল।”চলেন আপনাদের একটা দারুণ জিনিষ দেখাই।কিন্তু কেউ ফটো তুলতে পারবেন না।সরকারি আদেশে ফটো তোলা নিষেধ।”একটা বড় উঁচু দেওয়াল আর কাঁটাতার ঘেরা জায়গায় নিয়ে যাওয়া হল।গাইড কাকু আর দুটি ছেল প্রায় দশ বালতি কাঁকড়া নিয়ে ভেতরে ঢুকল।আমরা দরজার বাইরে থেকে দেখতে লাগলাম।একটা বিশাল বড় পেট ঝোলা, অনেকটা চাঁদের পাহাড় মুভির বুনিপের মত দেখতে সাদা কুমীর।এতই মোটা নড়তে পারছে না ভালো করে।তার দিকে কাঁকড়া ছুঁড়ে দেওয়া হচ্ছে আর সে অদ্ভুত ভঙ্গিতে থপথপ্ করে এগিয়ে এসে লুফে খাচ্ছে।বিরলতম দৃশ্য।এই প্রজাতির সাদা কুমীর নাকি পৃথিবীতে দুটোই আছে।তাই এত কড়াকড়ি।একটা এখানে আর একটা নেপালে।প্রতি বছর হেলিকপ্টারে করে এখান থেকে নেপালে ওকে ওর সঙ্গিনীর সাথে দেখা করাতে নিয়ে যাওয়া হয়।৬টা বাচ্চা হয়েছে।৩টে এখানে আছে ৩ টে নেপালে।ওরা বাঁচলে বড় হলে তবে বাইরে জানানো হবে।নাহলে বাইরের বিভিন্ন দেশ থেকে নিয়ে যেতে চেয়ে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে।

গরমকাল।পাখী তেমন চোখে পড়েনি।বলা হল সাতটায় রেডি থাকতে।হরিণ দেখাতে নিয়ে যাওয়া হবে।জঙ্গলে পাঁচটায় সন্ধ্যে নেমে গেল।ঠিক সাতটায় গাইড কাকু নিতে এল।টর্চ এখন নেওয়া বারণ।চারিদিকে কোন আলো নেই।ঘুটঘুট্টি অন্ধকারে খানিক চলার পর একটা বিশাল বড় ঘাসওলা ফাঁকা জায়গায় হাজির হলাম।বিশ্বাস করুন কয়েকশো হরিণ সেখানে।আরও সব পালে পালে আসছে সামনের জলাশয়ে জল খেতে।মিনিট পনেরো চাঁদের আলোয় এই মোহময়ী দৃশ্য দেখে আমরা নিঃশব্দে ঘরে ফিরে এলাম। ঘরে ফিরে দেখলাম আবার কারেন্ট অফ।মনে হল ঘরের পিছনের জলাশয়েও হরিণ আসতে পারে।মহা উৎসাহে সবাই লবি থেকে টর্চ মারতে গিয়ে দেখি লবির নীচে একটা বড় কুমীর।ভয়ের চোটে আমাদের মনে পড়েনি যে কুমীর রেলিং বেয়ে উঠতে পারবে না।পড়িমরি করে ঘরের ল্যান্ডফোন থেকে ফোন করা হল।ওরাও তাড়াতাড়ি করে ছোট ছোট ক্যানেস্তরা নিয়ে এসে বাজাতে লাগল।কুমীরও সড়াৎ করে আবার জলে।কিন্তু আবার তো আসতেই পারে।ওটা না এলে ওর ভাই বোন প্রতিবেশী যে কেউ আসতেই পারে।আর আমাদের খেতে যেতে হবে প্রায় এক কিলোমিটার জঙ্গল পথে অন্ধকারে হেঁটে।খেতে যাবার আগে নিজেরাই যদি খাবার হয়ে যাই।আমরা যাব না বলে বেঁকে বসলাম।আমাদের না শুনে গাইড এ্যান্ড কোং রীতিমতো কান্না জুড়ে দিল।তারা বেচারা অনেক ভালোবেসে অনেক কিছু রান্না করেছে।শেষমেষ গাইড কাকু নিজে এসে নিয়ে যাবে বললেন।রাত ৯টায় সে এক দারুণ অভিজ্ঞতা ।আমরা দল বেঁধে square হয়ে চলেছি।সামনে পেছনে বাঁয়ে ডানে দুজন করে লক্ষ্য রাখছি।ধাতিন নাতিন করে বড় বড় পা ফেলছি।হঠাৎ গাইড কাকু বলে “কেউ যদি কোনদিকে উঁচুতে জ্বলজ্বলে চোখ দেখতে পাও তো চেঁচাবে।সবাই মিলে এঁকেবেঁকে দৌড়াবে।”

“কেন??কুমীরের চোখ উঁচুতে কি করে উঠবে???”

“কুমীর নয়।কুমীরে অত ভয় নেই।বন্য বরাহ।দাঁত একবার ঢোকালে দফারফা।আগের বছর লেপার্ডও নেমে এসেছিল একটা।”

খুব জল তেষ্টা পাচ্ছিল।চোখের জলই চেঁটে নিলাম।অবশেষে খাবার জায়গার আলো দেখা গেল।আমাদের সমবেত দৌড় দেখে জনগন ভীষণ খুশি।ভাবলো ওদের রান্না খেতে দৌড়ে দৌড়ে আসছি।গিয়ে দেখি টেবিলে হাতে গড়া রুটি, ঘি ভাত,ডাল,গেঁড়ে গুগলি,কষা কষা ব্যাঙের ছাতার তরকারি,আর প্রত্যেকের জন্য এক একটা রাজ কাঁকড়া।আহা এখাবারের জন্য বরাহের তাড়াও খাওয়া যায়,কুমীরের পিঠ চুলকানোও যায়।যেমন রঙ তেমন রান্না।

ফেরার সময় সবাই মিলে আমাদের দিয়ে গেল।বলল একটা দুটোর সময় আওয়াজ শুনতে পেলে জানলা খুলে যেন দেখি।পাল পাল বরাহ দেখতে পাব।ওরা ফিরে যাবার পর আমরা সবাই মিলে গল্প করতে বসলাম।কারেন্ট নেই যথারিতী।হঠাৎ কি মনে হতে আমরা আর একবার লবিতে গেলাম।যাক বাবা এবার আর কুমীর নেই।কিন্তু টর্চের আলোয় ঘরের ভেতরই যা দেখলাম তাতে পূর্বজন্মও স্মরণ হয়ে গেল।টিনের সিলিং এর নীচে রড দেওয়া, সেখানে একটা পায়রা বাসা করে ডিম পেড়েছে।একটা বড় গোখরো সাপ সেই ডিম খেতে উঠছিল, কোনোভাবে রডে আটকে গেছে,এগোতে পারছে না।সামনে মা পায়রাটা করুণ চোখে ডিম আগলে বসে আছে।অনেক সাহস করে ফোনের কাছে গিয়ে খবর দেওয়া হল।কয়েক মিনিটেই ওরা সাপ ধরার লাঠি নিয়ে চলে এল।শুধু লাঠি দিয়ে গোখরো সাপ ধরার রুদ্ধশ্বাস দৃশ্য আমরা ভিডিও করে ফেলেছি।”রাতে পালা করে টর্চ মেরে সিলিং মেঝে ভালো করে দেখে নেবেন।জোড়ায় থাকে কিনা তাই বলছি।”ভাবছিলাম গুপী বাঘা কে প্ল্যানচেট করে ডাকলে আসবে কিনা।তাহলে এখুনি বাড়ী যেতাম।সারা রাত সবাই টর্চ জ্বেলে একইঘরে জড়োসড়ো হয়ে বসে রইলাম।১২.৩০ টা নাগাদ বাইরে সাইকেলের বেল শুনে বুঝলাম গাইড কাকু ডিউটি অনুসারে টহল দিচ্ছে।১ টা নাগাদ শরীর মন যখন বিদ্রোহ ঘোষণা করছে তখন হঠাৎ বাইরে শব্দ শুরু হল।ল্যান্ড ফোনে আমাদের জানানো হল জানলা খুললে আমরা বরাহর পাল দেখতে পাব।শব্দ ক্রমশ ভয়াবহ আকার ধারণ করল।ঘরের দরজা রীতিমতো থড়হরি কম্পমান।আমরা সমুদ্র মন্থন করেও সাহস খুঁজে পেলাম না জানলা খুলে দেখার।যদি আমাদের দেখতে পেয়ে জানলা দরজা ভেঙে ঢুকে পড়ে।ভোর রাতে আওয়াজ ধীরে ধীরে কমে গেল।

সকাল ৭ টার মধ্যে সবাই রেডি হয়ে ভয়ে ভয়ে বাইরে বেড়িয়ে দেখি আলো ঝলমলে সকাল।কোথাও কালকের বিভীষিকাময় রাতের লেশমাত্র নেই।কিন্তু চারদিকে শ্মশানের শান্তি বিরাজমান।গাইড কাকু এদিক ওদিকে পড়ে থাকা কাল রাতের কীর্তির ছাপ পরিষ্কার করছে।আমাদের দেখে বলল “পেটের দায় বড় দায়।”শুধু মনে হল সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত এদের মতই কারুর জন্য লিখেছেন

“বাঘের সাথে যুদ্ধ করিয়া আমরা বাঁচিয়া আছি,

আমরা হেলায় নাগেরে খেলাই, নাগেরই মাথায় নাচি।”

সদ্য চাক ভাঙা মধু আর ছোট কাঁকড়া নিয়ে আমরা বাড়ীর পথ ধরলাম।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama