সংশোধনাতীত
সংশোধনাতীত
'আরে ভবানীদা যে ! কোথায় চললেন?’
'এই তো ক'টা ওষুধ কিনে ফিরছি। তোমার কি খবর হরিহর?’
'ভালো না। এলেনই যখন, এখানেই দু-দন্ড জিরিয়ে নিন। চপ খাবেন?’
'আরে না ভাই আমার তো পেটের জন্যেই ওষুধ কিনতে যাওয়া। লিভারের সমস্যা। ব্যাঙ্গালোরের বেশ বড়ো একজন ডাক্তার দিলেন। তা ওষুধ খেয়ে এখন বেশ ভালোই আছি।‘
'এই সেরেছে! ব্যাঙ্গালোর থেকে করোনা নিয়ে ফেরেননি তো?’
'আরে ওখানে যেতে হবে কেন? অনলাইনে দেখালাম। দুরারোগ্য ব্যাধি কিনা তাই দূর থেকেই চিকিৎসা, হেঁঃ হেঁঃ! তা তোমার বিসনেস কেমন চলছে হে হরিহর?’
'বন্ধ। গত দশ দিনে একটা পেঁয়াজিও বেচিনি। ‘
‘বলো কি? সব খাবারের দোকানেই তো লোকজন মুখোশ পরে জটলা করে প্যাকেট কিনে নিয়ে যাচ্ছে। দু-একজন যে মরছে না তা নয়, কিন্তু এটাকেই তো ওরা বলছে নিউ নর্মাল!’
'সে হবে'খন। আমার দোকানে কোনো ভিড় হয় না। আমার কপালটাই খারাপ।‘
‘কেন বলোতো? তোমার ভাজাগুলো কি খেতে ভালো না?’
'আপনি কি বলতে চান আমার ফুলুরি খারাপ? আমার পকোড়া খারাপ?’
‘আহাহা চটছ কেন? আমি তো আর কোনোদিন তোমার বানানো তেলেভাজা খাইনি! নিশ্চয় ভালো। তা হরিহর, এরকম একটা কুপি জ্বালিয়ে বসেছ কেন? একটা বাল্ব অন্ততঃ লাগাও, তবে না লোকে তোমায় দেখতে পাবে!’
‘বললেই হল? খরচা আছে!’
‘আর দোকানের তো কোনো নামও দাওনি দেখছি। একটা ভালো দেখে বড়োসড়ো সাইনবোর্ড লাগাও না! দেখবে পিল পিল করে লোক ঢুকছে ।‘
‘ভবানীদা, আলো, সাইনবোর্ড সব ঠিক আছে। কিন্তু আপনি তো জানেন, এ চত্বরে প্রথম তেলেভাজার দোকান আমারই দেওয়া। হরিহরের তেলেভাজা খেয়েই একটা প্রজন্ম বেড়ে উঠেছে। ব্র্যান্ড ভ্যালু বলেও তো একটা কথা আছে নাকি?’
‘তা আছে, কিন্তু সব ব্র্যান্ডেরই তো একটা নামও থাকে। যাক গে, সেসব কথা থাক। তোমার ছেলেটার খবর কি?’
‘ওর কথা আর বলবেন না। কি পাপ করেছিলাম গতজন্মে কে জানে! ছেলে আমার...আরে! কানাই না?’
হেলমেট দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলার আগে তড়িৎস্ফুলিঙ্গের মতো একপাটি দাঁত বের করে যে যুবকটি হাসল, সম্ভবতঃ সেইই কানাই।
‘বাকির টাকাটা এখনো দিলি না যে?’
‘দিয়ে দোবো হরিহরকা! আমি তো আর চলে যাচ্ছি না কোথাও!’
‘বলা তো যায়না! সকলেই তো এক এক করে চলে যাবে বলে শোনা যাচ্ছে। গত পাঁচমাস ধরে কেবলই শুনছি দিয়ে দেব! বাকিতে বড়া খেলে নরকেও ঠাঁই হয় না জানিস?’
কানাইয়ের বাইকের ধোঁয়া ততক্ষণে একটু একটু করে মিলিয়ে যাচ্ছে।
'তা ছেলের কথা কি বলছিলে হরিহর?’
'আর বলবেন না! ইতিহাসে এম এ করছে। গোপনে ওর মাকে বলেছে এরপর নাকি ডক্টরেট করবে। কলেজে পড়াবার শখ। ‘
‘বলো কি হে! এ তো হীরের টুকরো ছেলে!’
‘দুরছাই! এসব বলেই তো ওর টিচাররা ওর বারোটা বাজিয়েছে! গরীবের ছেলে গ্র্যাজুয়েট করে কোনোভাবে একটা চাকরি জোটাবে, এটাই লোকে চায়। সে বন্দোবস্তও হয়েছিল। ভজদাই বলেছিলেন ওনার দোকানে একটা ব্যবস্থা করে দেবেন। আহা ভজদা বড়ো ভালো লোক। পুরো খনি! তো এরকম একটা সুযোগ সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে ব্যাটা গোঁ ধরেছে উচ্চশিক্ষিত হবে। আরে গরীবের আবার অত শখ আহ্লাদ কিসের বাপু? এই আমিই তো সেই ছোট্ট বয়স থেকে তেলেভাজা বেচছি। আমার কি উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল না?’
‘উচ্চ কিনা জানি না, তবে আকাঙ্ক্ষা যে প্রবল তা বেশ টের পাচ্ছি। যাই হোক, আজ তবে উঠি। তোমার বৌদি আবার দুশ্চিন্তা করবে।‘
‘আহা আরেকটু বসেই যান না! কতদিন পর কারুর সাথে দুটো সুখ-দুঃখের কথা বলছি...আরে ওটা বৈকুন্ঠবাবু না?’
পাতলা একটা সুতির চাদর গায়ে জড়িয়ে ব্লাড সুগার কমাতে হনহন করে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্যের মতো হেঁটে যাচ্ছে যে লোকটা, সেটা বৈকুণ্ঠবাবুই বটে।
'ও বৈকুণ্ঠবাবু! আসুন না, দুটো স্পেশাল বেগুনি খেয়ে যান।‘
বৈকুন্ঠবাবু ব্রেক চাপলেন। বেগুনির আহ্বান অগ্রাহ্য করা তাঁর মতো ভোজনরসিকের পক্ষে সহজ কাজ নয়। 'বেগুনি ভাজছ নাকি? হেঁঃ হেঁঃ। দুটো লাগাও দেখি জলদি, একটু তাড়া আছে। আরে ভবানীবাবু যে! খবর কি?’
‘এই চলছে। আপনার সুগার কি এখন কন্ট্রোলে?’
'বলবেন না মশাই বলবেন না। দিনে দু ক্রোশ করে হেঁটে হাঁটু ক্ষয়ে গেল, তবু প্রতি হপ্তায় ডাক্তারের চোখ রাঙানি লেগেই আছে। কৈ গো হরিহর, বেগুনি চাপালে কৈ?’
‘এই তো এক্ষুনি হয়ে যাবে।‘
‘একটু তাড়াতাড়ি কর দিকি! তো ভবানীবাবু, আপনার ছেলে তো পুরোপুরি ইউ এস এর সিটিজেন। ওখানে তো শুনছি প্রতি তিনজনে একজন করোনা আক্রান্ত। ভয় পাচ্ছে না আপনার ছেলে?’
'বিশদে কথা হয়নি, তবে হ্যাঁ, অবস্থা শোচনীয়। ওদের অবশ্য বাইরে বেরোতে হয় না, ঐ ওয়ার্ক ফ্রম হোম আরকি...’
‘ ও হরিহর! তোমার বেগুন গাছে কি মুকুল ধরলো? ওকি, তেলই গরম করোনি? নাহ্, আর তো বসে থাকা যায়না। আজ চলি, আরেকদিন এসে খাব নাহয়। আসি ভবানীবাবু।‘ হনহন করে বেরিয়ে গেলেন বৈকুণ্ঠ।
‘দেখলেন তো! কিভাবে কথা শুনিয়ে গেল? এই হয়েছে আজকালকার লোকেদের সমস্যা। একফোঁটা ধৈর্য নেই। সব তক্ষুনি চাই। আরে টাটকা বেগুন গরম গরম ভেজে দেব, একটু সময় লাগবে না?’
'তোমার বেগুন ধোয়া নেই, কাটা নেই – তুমি বেগুনি হেঁকে রাস্তা থেকে খদ্দের আনছ কেন?’
'না হলে কি করব? আগে থেকে ভেজে রাখব? তাহলেও তো লোকে বলবে ঠান্ডা হয়ে গেছে। আর দেখলেন তো সন্ধে থেকে কটা কাস্টমার এল? ভেজে রাখলে সবকটা বেগুনিই নষ্ট হত। ‘
‘ আচ্ছা! তুমিই বুঝবে ভালো। তুমিই তো ব্যাবসায়ী। আজ তাহলে উঠি। আসলে বৌদির গতকাল থেকে একটু জ্বর জ্বর, নিঃশ্বাসেরও কষ্ট আছে। এখানে বৌদিরও ওষুধ নিয়েছি। আর বসা ঠিক হবে না। ‘
‘ দেখবেন ভবানীদা, দিনকাল কিন্তু ভালো না।‘
‘ সে আর বলতে। আসলে আমার লিভার সিরোসিসটাও বেশ ভোগাচ্ছে। ওদিকে পেনশনের টাকাটাও – যা হোক সামান্য যা টাকা আছে তা দিয়ে বুড়োবুড়ির চলে যাচ্ছে বেশ। তবে তোমার ছেলেটার কথা শুনে বেশ ভালো লাগলো। ওকে পাঠিয়ে দিও মাঝে মাঝে, একাই তো থাকি! আমার কাছে প্রচুর ইতিহাসের বই আছে। ‘
‘ আচ্ছা আসুন। শুভরাত্রি। ‘
ভবানীবাবু চলে গেলেন। হরিহর ফাঁকা দোকানে বসে ভাবত লাগল - 'সত্যি! বলিহারি দাবিদাওয়া বটে বড়লোকগুলোর। টাকা পয়সা বাড়ি গাড়ি সব আছে শুধু নালিশের অন্ত নেই। আবার কি সব গালভরা অসুখের নাম! একটা গোটা দিন এই দোকানটা চালাতে দিলেই না সব দেমাক বেরিয়ে যেত। আবার ব্যাবসা শেখাতে এসেছে। যত্তসব!’