Barun Biswas

Inspirational Others

4.8  

Barun Biswas

Inspirational Others

স্মৃতির উড়ান

স্মৃতির উড়ান

4 mins
403


কমল সমাদ্দার রিটায়ার করেছেন গ্রামের স্কুল শিক্ষকতা থেকে। এখন হাতে অফুরন্ত সময়। বাড়িতে তিনি আর তার স্ত্রী। ছেলে চাকরির সুবাদে ফ্ল্যাটে থাকে। বৌমাও স্কুলের শিক্ষিকা। একটা নাতি আছে বছর পাঁচেক বয়স। ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ে। এখনকার যা যুগ বেশিরভাগ শিক্ষিত ফ্যামিলি এ রকম চলছে। ঘরে বাইরে দুজন কাজ করছে আর ছেলে মেয়ে দেখার জন্য লোক রাখা আছে।

কিছুদিন ধরে ছেলের ফ্ল্যাটে যাওয়ার চিন্তাভাবনা করছিলেন কমলবাবু। তার স্ত্রীকে সে কথা জানিয়েছেনও। তিনিও তাতে সায় দিয়েছেন। ঠিক হলো পরশুদিন যাবেন। সেইভাবে ছেলেকে ফোন করলেন। এতদিন একরকম ভাবে জীবন যাপন করতে করতে বাবা-মায়ের আসা না আসার কোনো প্রভাব ফেলল না ছেলের কন্ঠে। সেই যান্ত্রিক নির্লিপ্ত স্বরে উত্তর দিলো।

কমলবাবু বুঝতে পারলেন ব্যাপারটা। আসলে ছেলেকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। সবার জীবন এখন পরিবর্তিত হচ্ছে। সেই পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে সবাই চলছে। আগেকার মতো জয়েন্ট ফ্যামিলি, বড় ফ্যামিলি দেখাই যায় না। দু তিনজনের সংসার বেশিরভাগ। তাই কমল বাবু সেটা মেনে নিয়েছেন।

ছেলে অবশ্য তাদেরকে তার ফ্ল্যাটে গিয়ে থাকতে বলেছে। কিন্তু শহরের পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পারার ভয়ে অমল বাবু আর তার স্ত্রী সেখানে যেতে চান না। জীবনের শেষ যে কয়দিন আছে গ্রামের বাড়িতেই থাকতে চান। তবে মাঝে মাঝে ছেলের কাছে বেড়াতে যান। আজ যেমন ইচ্ছা হল।

কলকাতা যাবার জন্য ট্রেনে চাপলেন কমল বাবু আর তার স্ত্রী। ঘন্টা দুয়েক লাগবে পৌঁছাতে। বসার জায়গা পেতে তেমন অসুবিধা হলো না। ছুটির দিন বলে ট্রেন ফাঁকাই আছে। আর ছেলের বাড়িতে পৌঁছে আজকে সবাইকে একসঙ্গে পাওয়া যাবে। কলকাতা পৌঁছাতে তেমন ঝামেলা পোহাতে হলো না তাদের। সেখান থেকে অটো ধরে চলে গেলেন ছেলের ফ্ল্যাটে।

দরজা খুলে দিল কমলবাবুর বৌমা। তাদের দেখে খুশি হল সে। ভেতরে ঢুকে তারা দুজন বসল ব্যাগ পত্র রেখে। তাদের দুজনকে বসিয়ে রেখে তাদের বৌমা ঢুকলো রান্নাঘরে। তারা আসবে বলে এখনো রান্নাবান্না চলছে। একটু পরেই সে বেরিয়ে এলো। তারপর তাদের দুজনকে থাকার ঘরে নিয়ে গেল। নিজেদের থাকার ঘর ছাড়াও একটা এক্সট্রা ঘর রয়েছে যদি কোন আত্মীয় স্বজন আসে তাদের থাকার জন্য।

ছেলে আর নাতির কথা জিজ্ঞাসা করলেন কমলবাবু। বৌমা বলল, 'ছুটির দিন পেয়েছে বলে সেলুনে গেছে দুজনে। আপনারা ততক্ষনে স্নান করে ফ্রেশ হয়ে নিন।'

একথা বলে সেখানে তাদের রেখে সে আবার ছুটল রান্নাঘরে।

ঘন্টা খানেক বাদে দরজায় কলিং বেল বাজল। কমলবাবু আর তার স্ত্রী সোফায় বসে ছিলেন। টেবিলে খাবার সাজাচ্ছিল বৌমা। সে গিয়ে দরজা খুললো। কমলবাবুর ছেলে আর নাতি বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। নাতিকে দেখে দাদু দিদার মুখে হাসি ফুটলো। কিন্তু সেলুন থেকে আসায় তাদেরকে আগে বাথরুমে যেতে হল। সারা গায়ে মাথায় চুল লেগে আছে।

ওরা স্নান করে আসার পর সবাই একসঙ্গে খেতে বসলো। অনেকদিন পর একসঙ্গে হল সবাই। তাই খেতে বসে গল্প শেষ হচ্ছিল না। শ্বশুর শাশুড়ির আসা উপলক্ষে অনেক কিছুই রান্না বান্না করেছে তাদের বৌমা। খাওয়া-দাওয়া শেষ হতে বিকাল গড়িয়ে গেল। তারপর সবাই যে যার মতো বিশ্রাম নিতে গেল।

কিন্তু বেশিক্ষণ বিশ্রাম নেওয়া গেল না। ঘন্টা খানেক বাদে কামাল বাবু দেখলেন বাইরে বেলা প্রায় পড়ে এসেছে। গ্রামের বাড়ি হলে এই সময় বাইরে বেরিয়ে ঘুরে বেড়ানো যায়। কিন্তু এখানে এরকম জায়গা নেই। প্রকৃতির মধ্যে কৃত্রিম পরিবেশ।

কমলবাবু ভাবলেন ছাদে যাওয়া যাক। সূর্য ডোবাটা উপভোগ করা যাবে। তিনি বাইরে বেরিয়ে এলেন ঘর থেকে। তিন চার তলা সিঁড়ি ভাঙতে হবে ছাদে যেতে। টেবিলে খবরের কাগজটা পড়েছিল। তিনি সেটা তুলে নিলেন। তারপর ছাদে ওঠার জন্য বেরিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু কি মনে হল আবার দাঁড়ালেন।

ছেলের ঘরের সামনে গিয়ে দরজায় টোকা দিয়ে ডাকলেন। দরজা খুলে বেরিয়ে এল তার বৌমা।

কমল বাবু বললেন,' তোমার ছেলে কোথায়? ওকে নিয়ে একটু ছাদে যাই। একসঙ্গে সময়টা কাটানো যাবে।'

'ও কি যাবে? তবু দেখছি।' তার বৌমা বলল। তারপর ভিতরে গিয়ে পাঠিয়ে দিলো তার ছেলেকে। ওইটুকু ছেলের হাতে একটা বড় মোবাইল। দেখে অবাক হলেন কমলবাবু।

তার চোখ মুখ দেখে বুঝতে পারল বৌমা। সে বলল,' মোবাইলে গেম না খেলে থাকতেই পারে না।'

কমলবাবু মৃদু হেসে নাতির হাতধরে নিয়ে যেতে লাগলেন উপরে। সে তখনো দুই হাত দিয়ে মোবাইল ধরে গেম খেলায় ব্যস্ত। এভাবেই দুজনে উঠে এলেন ছাদের উপরে।

সূর্য পশ্চিমাকাশে ঢলে পড়েছে। প্রায় লাল রঙের হয়ে গেছে। আর আশেপাশে ছড়িয়ে দিয়েছে সেই লাল রং। তিনি তার নাতিকে আঙ্গুল তুলে সেদিকে দেখালেন। তারপর নাতির দিকে তাকিয়ে দেখলেন সে মোবাইলে গেম খেলেই চলেছে। তার কথার দিকে কোন খেয়াল নেই।

কমলবাবু খবরের কাগজটা দিয়ে ছাদের কিছু অংশ পরিষ্কার করে নিলেন। তারপর বসে পড়লেন সেখানে আর নাতিকেও বসালেন তার পাশে। তখন এসে মোবাইলে মত্ত। সূর্য ততক্ষণে একটা হালকা গোলাপী রঙের গোলকে পরিণত হয়েছে।

কমলবাবু খবরের কাগজটির একটা পাতা তুলে নিলেন। তারপর নাতিকে ডাকলেন কিছু বলতে। কিন্তু শোনার মতো সময় তার নেই। সে খেলাতে ডুবে আছে। তিনি আশাহত হয়ে কাগজ ভাঁজ করতে শুরু করলেন। নানাভাবে ভাঁজের কায়দায় তৈরী কর ফেললেন কাগজের বিমান। তারপর উঠে দাঁড়ালেন ছাদে। উল্টে পাল্টে দেখলেন তার তৈরী বিমান। এরকম কত জিনিস তিনি বানাতেন কাগজ দিয়ে আর তাই নিয়ে মেতে উঠতেন সববন্ধুরা মিলে। কিন্তু এসব আর এখন কেউ চায়না।

কমলবাবু বেদনার হাসি হেসে কাগজের তৈরী বিমানটাকে ছুঁড়ে দিলেন আকাশে। লাল আকাশে কিছুটা পাক খেয়ে সেটি ভেসে যেতে লাগল হাওয়ায়। সঙ্গে ভাসিয়ে নিয়ে গেল তার ছেলেবেলার স্মৃতি। কমলবাবু খেয়াল করেননি তার নাতি তখনও ব্যস্ত মোবাইলে।



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Inspirational