স্মৃতির মানুষটি
স্মৃতির মানুষটি
এখনও মোটামুটি শীতের প্রভাব রয়ে গেছে, সকালে হঠাৎ ঘুম ভাঙলে মনে হয় একটা পাতলা চাদর গায়ে দিলে ভালো লাগতো। আর একটু বয়স্ক লোক হলে তো কথাই নেই।অনেকদিন পর আজ তামসী বিছানা ছেড়ে বারান্দায় এসে বসেছে। আজ পয়লা ফাল্গুন। শীতের আমেজ এখনো রয়ে গেছে। একটা শিরশিরে অনুভব পাতলা চামড়ার নীচে। শালটা আরো একবার ভালো করে জড়িয়ে নিয়ে সামনের দিকে তাকালেন। আম গাছে কচি পাতায় ভরে গেছে। মুকুল দেখা যাচ্ছে। দুরে পলাশ গাছটা লাল ফুলে ভরে গেছে। সকাল বেলাটা একটু অন্যরকম থাকে। একটু ব্যস্ততা, একটু কথাবার্তা, একটু চঞ্চলতা। বেলা বাড়ার সাথে সাথে সব ঝিম মেরে যায়। দুপুরে হাওয়ায় তালগাছের শন শন আওয়াজ শোনা যায়। তারপর….তারপরে আর কিছু নেই! নিঃস্তব্ধতার কালো কাপড়ে মুড়ে ঘুমিয়ে পড়ে এই বাড়িটা।
প্রথম প্রথম অস্বস্তি হলেও মানিয়ে নিয়েছিলো তামসী । এখন তো শুধু আপসের বয়স, মানিয়ে নেবার বয়স। ভোরবেলায় চা পানের অভ্যাস কবেই ভুলে গেছে। এখানে তো চা দেয় সাড়ে ন’টায়। জীবনে কোনদিন পাউরুটি খেতেন না, আর এখন রোজ পাউরুটি চিবুতে হয়, তাও মাত্র দুটো দাঁত দিয়ে। রাগ হয়, কিন্তু মানিয়ে নিয়েছে। আর কার কাছে নিজের রাগের কথা বলবে?সেই কপাল করে জন্মেছিলেন কি? দুপুরে গরম ভাত ছাড়া কোনদিন খেতেন না। আর এখন প্রতিদিন মর্গের ঠান্ডা শরীরের মতো আড়ষ্ট ভাতগুলো শিরা ওঠা হাতে যতোই চটকানো হোক না কেন, ওদের চেহারার পরিবর্তন হয় না। পাতলা ডাল আর একটা তরকারি। আশ্চর্য, সব তরকারির এক স্বাদ। রাতে মুড়ি তরকারি। ব্যস, সারাদিনের রোজ নামচা শেষ। এরপর ওই কম্বলের নীচে প্রতিমুহূর্তে মৃত্যুর অপেক্ষা। আজ তো বাঁচলাম, কাল যেন আর উঠতে না হয়। কাল যেন কপালে চন্দনের ফোঁটা, একটা রজনীগন্ধার মালা আর একটা লাল টুকটুকে শাড়ীতে জড়িয়ে নিথর দেহটা এই ঘর ছেড়ে বের হবে চিরদিনের জন্য।
নাহ্!!! এই এক বিষয় নিয়ে ভাবতে ভাবতেই কেমন যেন মুখের ভিতর তিক্ত স্বাদ অনুভূত হয়। থাক না!! মৃত্যু তো আসবেই। কিন্তু ফেলে যাওয়া ভালোবাসার কথা যদি এই ফাল্গুনী সকালে না বলেন তো আর কোনদিনই বলা হবে না। সকালের রোদ গালে পড়ে বোধহয় গালটা রাঙা হয়ে গেল।
তখন বয়স কতো হবে? ষোল অথবা সতেরো!! পড়াশোনার চাপে কোনদিকে তাকাবার জো নেই। বাবা, দাদা, মা সবাই নজরবন্দী করে রেখেছে, মেয়ে যেন বিপথগামী না হয়। দম নেবার ফুসরত নেই। একমাত্র শ্বাস নেবার ফুরফুরে বাতাস মাষ্টারমশাই। এলোমেলো চুল, খোঁচা খোঁচা দাড়ি, পায়জামা পাঞ্জাবি আর একটা ঝোলা ব্যাগ আর চশমার আড়ালে একজোড়া ঝকঝকে চোখ। ওই চোখের দিকে তাকানোর মতো সৎসাহস তামসীর ছিল না। ভীষণ রকমের গম্ভীর মানুষটা। প্রতিদিন সময় মেনে পড়াতে আসতেন, মাথা নীচু করে পড়িয়ে চলে যেতেন। তামসী ওই সময়ে কতটুকু পড়তো তা ওই জানে। সমস্ত মন জুড়ে তখন এলোমেলো প্রাণ । প্রাণ পড়াশোনায় তুখোড়। ঝোলা ব্যাগটা কোলের উপর এমনভাবে রাখতেন, যেন গুপ্তধন লুকিয়ে আছে ওর মধ্যে। আর তামসীর নজর থাকতো ওই ব্যাগে। একদিন অসাবধানতাবশত ওই ব্যাগের থেকে নজরুল কাব্য সমগ্র উঁকি মারতেই তামসী চেপে ধরলো, প্রাণদা তুমি কবিতা জানো? একটা আবৃত্তি করে শোনাও না। প্রাণ এরজন্য প্রস্তুত ছিল না। বারবার জোরাজুরি করার জন্য প্রাণ বাধ্য হয়ে বিদ্রোহী কবিতাটা আবৃত্তি করেছিল। আর ব্যস্, তামসীর জীবনে প্রাণ উঁকিঝুঁকি দিতে শুরু করলো। ওই ছন্নছাড়া, এলোমেলো মানুষটাকে ভালো লাগতে শুরু করল। না, প্রেম নয়, শুধু ভালো লাগা। পড়তে পড়তে যেন আরো নিবিড়ভাবে ঢুকে গেল তামসী, শুধুমাত্র মানুষটিকে খুশী করার জন্য।
চারটে বছর পার হয়ে গেল ঝড়ের বেগে। তামসী হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষা শেষ করেই প্রাণদার সাথে দেখা করতে চেয়েছিল। কিন্তু প্রাণদা বেশ কিছু দিন ওদের বাড়ি আসেনি। পরীক্ষা কেমন হোল সেটা তো জিজ্ঞেস করবে? প্রতিদিন ওনার জন্য অপেক্ষা আর অপেক্ষা। কট্টর বামপন্থায় বিশ্বাসী প্রাণকে কেমন যেন অচেনা মনে হত তামসীর। ওই গভীর চোখে যেন আগুন ঝরতো। কি যে পরিবর্তন আনবে সেটা ওই জানতো। কথায় কথায় বলতো শুধু আমরাই পারি পরিবর্তন আনতে। শুধু সময়ের অপেক্ষা।
“-বলো না, কিসের পরিবর্তন? আর ওই ব্যাগের মধ্যে কি আছে, এখন তো বলো” “
-ও তুমি বুঝবে না। যদি কোনদিন আমি না থাকি তখন তুমি এই ব্যাগটা খুলে দেখো..”
তামসী প্রাণের পাতলা ঠোঁটের উপর হাত চাপা দিয়ে রাগত স্বরে বলেছিল, “এরপর এরকম কথা বললে তোমার সাথে আর কথা বলবো না”..”
- তামসী , হয়ত এমন দিন আসবে যখন হাজার ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও তুমি সত্যি আমার সাথে কথা বলতে পারবে না…”
আমরা স্বাধীন দেশের নাগরিক হয়েও পরাধীন। আমরা এক নতুন সূর্যোদয়ের অপেক্ষায় আছি। আমরা ধীরে ধীরে সংঘবদ্ধ হচ্ছি। একদিন হঠাৎ করেই ঝাঁপিয়ে পড়বো বুর্জোয়া দলের ওপর। আমার আত্মবিশ্বাস আছে আমরা পারবোই পারবো। যদি জিতে যাই, তবে তুমিও একটা লাল টুকটুকে শাড়ী পড়ে, আলতা পড়া পায়ে আমার ঘরে আসবে। এই স্বপ্নটা আমি বুকের মাঝে রেখে দিয়েছি। তুমি শুধু আমার পাশে থেকো।
সেদিনটা ছিল ২৯শে মাঘ। তামসী বিছানার উপর উবু হয়ে শুয়ে প্রাণকে চিঠি লিখছিলো একবারটি দেখা করবার জন্য। খোলা চুল ঢলে এসে হাতের কলম আর কাগজকে আড়াল করে দিয়েছে। কেউ দেখতে না পেলেও এই শীতে তামসীর নাকের ডগায় বিন্দু বিন্দু ঘাম। ও এখন উত্তেজনায় ছটফট করছে। প্রাণদাকে জানাতেই হবে যে বাড়ি থেকে বিয়ের জন্য তোড়জোড় শুরু হয়েছে। চিঠি লেখা প্রায় শেষ, শুধু ভালোবাসা জানানো বাকি। হঠাৎ ভেজানো দরজাটা দড়াম করে খুলে গেলো আর উদভ্রান্তের মতো প্রাণ ঢুকেই ঝোলা ব্যাগটা বিছানার উপর পর ছুঁড়ে দিয়ে চাপা স্বরে বলল, “ওরা আমার পিছু নিয়েছে। তুমি জীবন থাকতে এই ব্যাগ কাউকে দিও না। আমি চললাম। আর হ্যাঁ, তুমি কি পড়া শুরু করেছো…”
-“না, এখনো শুরু করিনি, আগামী মাস থেকে শুরু করবো।”
-” কি লিখছিলে?”
-“চিঠি, তোমাকে..”
-“ওটা আমাকে হাতে হাতে দিয়ে দাও, আমি পড়ে নেবো” বলেই প্রাণ হাত বাড়ালো।
তামসী ঘটনার পরম্পরায় হতভম্ব হয়ে কাগজটা ছিঁড়ে ভাঁজ করে প্রাণের হাতে তুলে দিতেই প্রাণ চিতাবাঘের মতো ছুটে বেড়িয়ে গেল। তামসীর মন অজানা এক আশঙ্কায় বুকটা কেঁপে উঠলো। বেশ কিছুক্ষণ বাদে নজরে আসলো একটা ভাঁজ করা কাগজ চৌকাঠের ওপারে।
তামসী কাগজটা তুলে ধীর পায়ে বিছানায় এসে বসলো। ভাঁজ খুলে দেখলো ওকেই লেখা একটা চিঠি।
সুচরিতাসু,
আর দু’দিন বাদেই পয়লা ফাল্গুন। আর ফাল্গুন মাস মানেই লাল পলাশের আগুন ঝরানো শোভা। আমার মন চাইছে এই ফাল্গুনী পূর্ণিমা রাতে তোমাকে লাল আবীরে রাঙিয়ে দেই। তোমার কপাল, সিঁথি লাল রঙে রক্তিম হয়ে উঠুক। আমাদের রক্তেও লালের ছোঁয়া। আমি দলের জন্য নিবেদিত প্রাণ হলেও প্রেমকে উপেক্ষা করি কিভাবে? প্রেম এসেছিল গোপনে। তা, সেই প্রেম গোপনই থাকুক না। দলের নির্দেশে কাল আমাকে এনকাউন্টারে যেতেই হবে।যদি আমি ফিরে না আসি, তাহলে তুমি প্রতি পয়লা ফাল্গুনে পলাশ ফুলের মাঝে আমাকে খুঁজে নিও। তুমি জানবে এই বাংলার প্রতিটা ধুলিকণায় আমি মিশে থাকবো। যেখানেই লাল রঙ দেখবে, জানবে সেখানেই আমি আছি। আমার ব্যাগটা তোমাকে দিলাম। ওর মধ্যে আমার দলের ব্লু প্রিন্ট আছে। বিপদ বুঝলে পুড়িয়ে দিও।
আজ বড়ো ইচ্ছে করছে তোমাকে একবার ছুঁয়ে দেখতে। তোমার ওই এক ঢাল কালো চুলের ঘ্রান নিতে মন ব্যাকুল হয়ে উঠেছে। জানতে ইচ্ছে করছে তোমার আঙুল গুলো কতোটা নরম।
জানি, এসব আমাদের জন্য নয়। আমাদের একটাই ভবিতব্য, মৃত্যু। তবুও, একবার বলি, প্রিয়তমা তোমাকে আমি ভালোবাসি, ভালোবাসি ভালোবাসি…..
সংগ্রামী অভিনন্দন সহ
ছন্নছাড়া প্রাণ ।
পয়লা ফাল্গুন খবরের কাগজে প্রথম পাতায় খবরটা বেড়িয়েছিল…পুলিশের গুলিতে নিহত……।
তার সঙ্গেই ভেঙে চুরমার হয়ে গেল প্রাণ আর তামসীর জীবনের স্বপ্ন, তামসীর জন্য পড়ে রইলো বাকী কাজ এগিয়ে নিয়ে যাবার কঠিন দায়িত্ব।
