Sayandipa সায়নদীপা

Drama Romance Tragedy

3  

Sayandipa সায়নদীপা

Drama Romance Tragedy

সখী

সখী

6 mins
556


হাঁটতে হাঁটতে একবার আকাশের দিকে তাকাল লক্ষণ--- চাঁদহীন আকাশ, তারাগুলোও যেন উধাও হয়েছে আজ। মেঘ করেছে নাকি আজ অমাবস্যা! উঁহু… মনে পড়ছে না কিছু। অন্ধকার রাস্তায় হঠাৎ কিসে যেন একটা ধাক্কা খেল সে। সামনে তাকিয়ে দেখলো একটা ল্যাম্পপোস্ট। ধুত্তোর… ল্যাম্পপোস্টটার গায়ে একটা লাথি কষিয়ে সরে এলো লক্ষণ। আজ ওটা জ্বলছে না কেন! কারেন্ট নেই নাকি আলোটা কেটে গেছে! বুঝতে পারছে না সে, মাথাটা ঝিমঝিম করছে। চুলের ফাঁক গলে একটা ফোঁটা ঘাম গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল রাস্তায়। আজ গুমোটটা ভালোই আছে, তার ওপর অনেকদিন পর দু'বোতল গলায় পড়েছে বলে হয়তো গরমটা আরও বেশি লাগছে। অন্ধকারের মধ্যে টলতে টলতে যতক্ষণে বাড়ি পৌঁছালো লক্ষণ ততক্ষণে বার কয়েক এখানে সেখানে ধাক্কা খাওয়া হয়ে গেছে তার। লোকের গালিও শুনেছে বেশ কিছু। শেষবারে বোল্ডারে ধাক্কা খেয়ে পায়ের নুনছাল উঠে গেছে অনেকটা। রাস্তার একটা লোক তাকে মেদো মাতাল বলল। লক্ষণ মাতাল! হুঁহ, বেশ হয়েছে ও মাতাল। মদ লক্ষণ মাঝে মাঝে খেতো ঠিকই কিন্তু কোনোদিনও মাত্রা ছাড়ায়নি তা, আর তারপর যবে থেকে তার বিয়ে হয়েছে তবে থেকে এক ফোঁটা মদ ছোঁয়েনি লক্ষণ। সে কোনোদিনও চায়নি তার বাবা যেভাবে মদ খেয়ে এসে তার মাকে পেটাতো, সেইরকম ব্যবহার সে করে রাজেশ্বরীর সঙ্গে। রাজেশ্বরীকে বড্ড ভালোবাসে লক্ষণ।


"রাজেশ্বরী খাবার দাও তাড়াতাড়ি। বড্ড খিদে পেয়ে গেছে।" 


ভেজিয়ে রাখা দরজা খুলে ঘরে ঢুকেই কাঁপা কাঁপা গলায় কথাগুলো বলল লক্ষণ। দরজার ফাঁক দিয়ে দেখতে পেল একটা লাল শাড়ীর আঁচল। মনটা খুশি খুশি হয়ে গেল লক্ষণের। এই সোনালী পাড় বসানো লাল শাড়ীটা ক'দিন আগেই সে কিনে এনেছিল রাজেশ্বরীর জন্য। তার ফর্সা টুকটুকে বৌটাকে লাল রঙে বেশ মানায়। রাজেশ্বরীর শাড়িগুলো সব পুরোনো হয়ে গিয়েছিল। তাই এই শাড়িটা দোকানে দেখে একটু বেশি দাম দিয়েই কিনেছিল লক্ষণ। আজকে অবশেষে রাজেশ্বরী শাড়িটা পরেছে। রাজেশ্বরীর মুখটা ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করে, দেখতে ইচ্ছে করছে তাকে কেমন মানিয়েছে এই শাড়িটা। কিন্তু নাহ, লক্ষণ ঠিক করল হাত মুখ ধুয়ে এসে সে একবারে যাবে রাজেশ্বরীর কাছে, তাকে জড়িয়ে ধরে খুব কষে আদর করবে। লক্ষণ টলোমলো পায়ে চলে গেল বাড়ির পেছনের দিকে কুঁয়াতলায়। চাঁদের আলোয় বালতিটা ফেলে দিল জলে, ঝপ করে একটা আওয়াজ উঠল সেখানে, অনেক গভীরে। দড়ি ধরে বালতিটাকে এবার তুলতে যেতেই বুকের ভেতর একটা ধাক্কা খেলো লক্ষণ। হাতের দড়িটা আবার সরসর করে নেমে যেতে লাগলো কুঁয়ার অন্ধকারে। আবার ঘুরে একটা ঝপ করে শব্দ উঠল সেখানে, আগের বারের চেয়ে খানিক ভারী।


  একটা দামী লাল রঙের বেনারসি, দু'জোড়া সোনার ঝুমকো আর একগাছি সরু সোনার চুড়ি… এটাই চেয়েছিল রাজেশ্বরী। আজ নয়, অনেকদিন ধরেই চাইতো বেনারসি শাড়ি, একজোড়া ঝুমকো আর চুড়ি গাছা। লক্ষণ হচ্ছে হবে করে কাটিয়ে দিত এতদিন। তবে সামনাসামনি কাটিয়ে দিলেও গোপনে একটু একটু করে টাকা জমাচ্ছিল সে শাড়ি আর গয়নার জন্য। বিয়ের পর একটা সোনার নাকছাবি গড়িয়ে দিয়েছিল বউকে, এবার ভেবেছিল পুরো টাকাটা জমে যাওয়ার পর একদিন আচমকা দোকানে নিয়ে গিয়ে চমকে দেবে তার আদরের রাজেশ্বরীকে, কিনে দেবে তার বহু কাঙ্খিত ঝুমকো আর চুড়ি। কিন্তু তার আগেই আচমকা সব কেমন যেন ওলট পালট হয়ে গেল…

রাজেশ্বরীর বোনের বেশ বড় ঘরে বিয়ে হয়েছে, রাজেশ্বরীরও হতে পারত যদি না সে লক্ষণের সঙ্গে বাড়ি থেকে পালাতো। ওর বোনের বিয়ের ঠিক হওয়ার সাথে সাথেই গন্ডগোলের সূত্রপাতটা হয়েছিল। নিজের শখের লাল বেনারসি, একগাছি চুড়ি আর ঝুমকোর সঙ্গে এবার যোগ হয়েছিল বোনকে উপহার দেওয়ার জন্য আরেক জোড়া দুল আর একটা দামি সিল্ক শাড়ি। দামি শাড়ি আর সোনা না দিলে বোনের শ্বশুরবাড়িতে নাকি মান থাকে না। লক্ষণ ভেবেছিল যেটুকু জমানো টাকা আছে তা দিয়ে রাজেশ্বরীর বোনের জন্য উপহারটা কিনে ফেলবে। পরে নাহয় আবার টাকা জমাবে রাজেশ্বরীর জন্য। কিন্তু রাজেশ্বরী রাজি হতে পারেনি এহেন সমাধানে। বোনের বিয়েতে হা-ভাতের মত শুধু একটা সস্তার শাড়ি পরে যাবে সে! একটাও সোনার অলংকার থাকবে না গায়ে, তা হয় নাকি! কিন্তু লক্ষণ পারেনি অতো শাড়ি আর গহনা কেনার টাকা জোগাড় করতে। রাগে অভিমানে রাজেশ্বরীও আর বোনের বিয়েতে যায়নি। কিন্তু সেই থেকে যে আগুন জ্বলেছিল সে আগুন আর নেভাতে পারেনি লক্ষণ। সেই সময় থেকে তুমুল অশান্তি চলত নিত্যদিন। কথায় কথায় লক্ষণকে খোঁটা দিতে শুরু করেছিল রাজেশ্বরী। 


  রাজেশ্বরী লক্ষণের সঙ্গে ঘর ছেড়েছিল কিন্তু কোনোদিনও বোঝার চেষ্টা করেনি তাকে, লক্ষণও বোঝানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে বারবার। লক্ষণের যা পেশা তার আজকাল বিশেষ কদর নেই আর, গ্রামের দিকে কিছু মানুষের এখনও উৎসাহ থাকলেও শহরের দিকে কেউ আর দেখতে চায় না এসব। এদিকে নিজের পূর্ব পুরুষের পেশাটা ছাড়া আর তো কিছুই শেখেনি লক্ষণ। শুধু তাই নয় আর কোনো কাজ করতে গেলেও মন পড়ে থাকতো নিজের প্রিয় কাজটার দিকে। তবুও রাজেশ্বরীর মুখ চেয়ে ও চেষ্টা করছিল এখান সেখানে কাজ করে রোজগার করার, কিন্তু তাতেও রাজেশ্বরীকে সন্তুষ্ট করতে পারল কই! একদিন নিজের বাপ মায়ের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে লক্ষণের হাত ধরে চলে এসেছিল রাজেশ্বরী, কাল রাতে লক্ষণের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে অন্য একজনের হাত ধরে সে চলে গেল আবার। লক্ষণ জানে না লোকটার সঙ্গে রাজেশ্বরীর সম্পর্কটা ঠিক কবে তৈরি হল, জানে না ওর পেছনে পেছনে কতদিন চলছিল এই পরকীয়া। জানতেও ইচ্ছে করে না আর। এই লোকে লোকারণ্য শহরের বুকে লক্ষণ আজ একা, কেউ নেই তার, কেউ নেই… এটাই সত্যি। ভালো থেকো রাজেশ্বরী---


  হাতের দড়িটা শেষ। কুঁয়ার ভেতরের জমাট বাঁধা অন্ধকারটাকে বড় মোহময় লাগছে আজ। মনে হচ্ছে যেন দুই বাহু উন্মুক্ত করে লক্ষণকে ডাকছে সে। লক্ষণের তো আর কোনো পিছুটান নেই…

ঘরের ভেতর থেকে চুড়ির রিনরিন শব্দ ভেসে আসতেই চমকে উঠলো সে। ঘামে ভেজা শরীরটা নিয়ে উদ্ভ্রান্তের মত ছুটলো ভেতরে, চিৎকার করে ডেকে উঠল, "রাজেশ্বরী… তুমি এসেছো!" হাঁফাচ্ছে লক্ষণ। লাল শাড়িটার আঁচলটা লুটোচ্ছে মাটিতে। ছুটে লক্ষণ ধরতে গেল আঁচলটা কিন্তু কাছে যেতেই থমকে গেল সহসা। নাহ, এ তো রাজেশ্বরী নয়! হ্যারিকেনের আলোয় লক্ষণ দেখলো এক কাঁসি মুড়ি নিয়ে দরজার দিকে কুতকুতে চোখে তাকিয়ে আছে সখী। ওর পরনে রাজেশ্বরীর জন্য আনা সেই সোনালী পাড় লাল শাড়ী আর হাতে একগাছি লাল কাঁচের চুড়ি। ক’দিন আগে চড়কের মেলা থেকে এই শাড়িটা আর চুড়িগুলোই তো উপহার হিসেবে লক্ষণ কিনে এনেছিল রাজেশ্বরীর জন্য। বলেছিল, “বেনারসি শাড়ি আর সোনার চুড়ি তো আনতে পারিনি, এগুলো আনলাম তোমার জন্য। এই লাল শাড়িটায় তোমাকে একেবারে রাণীর মত দেখাবে দেখো। আর আমার রাণীকে কথা দিচ্ছি খুব শিগগির…”

  “আর কতদিন এভাবে শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা করে যাবে শুনি?” 

লক্ষণের কথা শেষ হওয়ার আগেই গর্জে উঠেছিল রাজেশ্বরী, “চাই না তোমার এই সস্তা লাল শাড়ি আর কাঁচের চুড়ি। এগুলো দিয়ে বরং তোমার ওই সাধের মেনিকেই সাজিও, আর একসাথে নেচো দুজনে। হাভাতে লোক কোথাকার!” 

এই বলে শাড়িটা আর চুড়িগুলো তুলে সখীর দিকে ছুঁড়ে ফেলেছিল রাজেশ্বরী। সঙ্গে সঙ্গে ভেঙে গিয়েছিল লক্ষণের সাধের ভালোবাসার কয়েকটা টুকরো, শাড়িটা গিয়ে সোজা লেগেছিল জ্বলন্ত হ্যারিকেনে। চড়চড় শব্দে সোনালী পাড়টা কুঁকড়ে যেতে শুরু করেছিল। শাড়িটা তাহলে এর পরেও অক্ষত ছিল, জ্বলে যায়নি পুরোটা! আর চুড়ি গাছাও…! কয়েকটা এর পরেও অক্ষত ছিল! হয়তো লক্ষণের ভালোবাসাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যই এত আঘাত বুকে নিয়েও ভাঙেনি তারা। আজকে সেগুলোই পরেছে সখী। ওর কুতকুতে দুটো চোখ নিয়ে তাকিয়ে আছে লক্ষণের দিকে। লক্ষণ ওর চোখের ভাষা পড়তে জানে, সখী ওকে খেতে বসতে বলছে।


  কাঠের দরজায় পিঠটা এলিয়ে দিলো লক্ষণ, একটা জোরে নিশ্বাস নিয়ে চোখ দুটো বন্ধ করে ফেললো ক্ষণিকের জন্য। বুকের ভেতর কেমন যেন একটা হুলুস্থুলুস হচ্ছে তার ---- মানুষের পিছুটান হয়তো কোনোদিনও শেষ হয় না, ঠিক যেমন সব ভালোবাসার মূল্য অর্থ দিয়ে মাপা যায় না। একটু একটু করে সখীর দিকে এগিয়ে এলো লক্ষণ, তারপর দু'হাত দিয়ে জড়িয়ে বুকে চেপে ধরল ওকে। হুহু করে জলের স্রোত এসে ভরিয়ে দিল লক্ষণের চোখ। মেনিটা কি বুঝলো কে জানে… আস্তে আস্তে হাতদুটো বাড়িয়ে জড়িয়ে আগলে ধরল ওর ভালোবাসার মানুষটাকে।


শেষ।



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama