সিঁড়ি
সিঁড়ি
![](https://cdn.storymirror.com/static/1pximage.jpeg)
![](https://cdn.storymirror.com/static/1pximage.jpeg)
সিঁড়িটা দিয়ে উঠে আসলেই ছোট্ট চিলেকোঠা, আর বেশ সুন্দর ফুল দিয়ে সাজানো ছাদ। মন খারাপ হলেই স্মাহি এখানে চলে আসে। এই ফুল, লতা, পাতা, বড় কাঠগোলাপ গাছটা ওর মন মুহূর্তে ভালো করে দেয়।
আজ সকালে বাবিয়ার কথায় খুব দুঃখ পেয়েছে স্মাহি। ভগবান বোধহয় স্মাহির কপালে দুঃখটা একটু বেশিই ভরে দিয়েছে। আকাশের দিকে তাকিয়ে বিষন্ন স্মাহি মনকে শক্ত করে। বলে -' দেখো, তোমরা যতই চেষ্টা করো না কেনো আমায় আটকাতে পারবে না, রাস্তা আমি খুঁজে নেবোই। '
ছোটবেলায় মা যখন দাদা বা দিদিয়ার থেকে ওকে একটু বেশি ভালো বাসত বেশ গর্ব হত স্মাহির। দাদা আর দিদিয়া কি তাতে হিংসা করত !! চোখ বুঝে স্মাহি ফিরে যেতে চায় সিঁড়িটার প্রথম ধাপে, ওর ছোটবেলা। মিষ্টি ছোটবেলা। তিন বছরের বড় দাদা আর দেড় বছরের বড় দিদিয়াকে যখন মা বকে বকে পড়াতো স্মাহির জন্য ছিলো শুধুই আদর। ওদের খাবার টেবিলে দিয়ে স্মাহিকে যখন মা দোলনায় বসিয়ে নিজে হাতে খাওয়াত ওর নিজেকে রূপকথার রাজকন্যা মনে হত। কিন্তু একটু বড় হয়েই ও বুঝেছিল ও আলাদা, তাই একটু বেশি ভালোবাসা পায়। আসলে ওর জীবনে না পাওয়ার দিকটাই একটু বেশি ভারি। মা আর বাবিয়া ভালোবাসা দিয়ে সেটা ভুলিয়ে রাখতে চায়। ছ বছর বয়সে প্রথম বার স্মাহি বুঝেছিল হাত দুটো না থাকার দুঃখ। কনুইয়ের একটু নিচে এসে ওর হাত দুটো আর তৈরি হয়নি। তাই ও জীবনে হয়তো কিছুই করতে পারবে না ভেবেছিলো সবাই। এই রোগের কোনো চিকিৎসা নেই। ওকে স্কুলেও ভর্তি করা হয়নি তাই। ছোটবেলায় মা কে লুকিয়ে বহুবার চোখের জল মুছতে দেখেছে স্মাহি, হাত না থাকায় ও দেরিতে হেঁটেছিল। বহুদিন অবধি মা খাইয়ে দিত। দাদা আর দিদিয়া ওকে কোনো খেলায় নিত না। এমনকি এই সিঁড়িটাও ও একা হেঁটে উঠতে পারত না।
কিন্তু ছাদ থেকে যখন দিদিয়া আর দাদার খেলার আওয়াজ ভেসে আসত স্মাহি টলমল পায়ে সিঁড়িটার দিকে ছুটে যেত। এভাবেই একদিন বারোটা ধাপ পার করে ও ছাদে উঠে এসেছিল।
মুখে মুখেই দিদিয়ার বড় বড় পড়া গুলো শিখে ফেলেছিল ও। পড়তে ওর খুব ভালো লাগত। আর ভালো লাগত ছবি আঁকতে। দিদিয়া বা দাদা যখন আঁকতে বসত চুপ করে এক মনে দেখতো ও। একদিন চুপি
চুপি দাদার রঙিন পেনসিল গুলো ঐ কনুই দিয়ে নেড়েচেড়ে দেখতে দেখতে মুখে তুলে নিয়েছিল ও। আর ঠোঁট দিয়ে ধরে কনুই দিয়ে চেপে এঁকে ফেলেছিল একটা ছবি।
না, সিঁড়ির পরের ধাপ গুলোর মতই টপাটপ টপকে গেছিল পরবর্তী বাঁধা গুলো। মুখ দিয়ে লিখতে শিখেই স্কুলে ভর্তি হয়েছিল ও। ক্লাসে সবাইকে টপকে প্রথম হয়ে এসেছে বরাবর। করুণা নয় লোকের চোখে বিস্ময় দেখতেই ভালোবাসত স্মাহি। কলেজে ওর পেছনে লাগত যারা তারাও একদিন হার মেনেছিল ওর জেদের কাছে।
কিন্তু সরকারি চাকরীর পরীক্ষায় ও বসেছিল জেনারেল ক্যান্ডিডেট হিসাবে। বাবিয়ার শত অনুরোধেও ও প্রতিবন্ধী কোটায় চাকরী নেয়নি।
প্রথম দুটোয় প্রিলি পাশ করেও যখন হল না, বাবিয়া বলেছিল ওকে প্রতিবন্ধী কোটায় চাকরীর দরখাস্ত দিতে। ও বাবিয়াকে বোঝাতে পারেনি ও করুণা চায় না। ভাইবাতেও ওকে এই কথাই বলেছিল বোর্ডের লোকেরা। কিন্তু ও যে স্পেশাল নয় জেনারেল থাকতে চায় ও বোঝাতে পারেনি কাউকে।
আজ সিভিল সার্ভিসের রেজাল্ট। সিঁঁড়ির শেষ ধাপটা পার হতে পারবে কি না এই নিয়ে সকলের দুশ্চিন্তা। মাধ্যমিক উচ্চমাধ্যমিকে ও কখনো রাইটার নেয়নি। নিজেই মেঝেতে বসে পরীক্ষা দিয়েছে। রেজাল্ট ও করেছে চোখে পড়ার মত। আজও ও আশাবাদী। কিন্তু মা আর বাবিয়া মুখ কালো করে বসে রয়েছে। আসলে দাদা আর দিদিয়া সুস্থ হয়েও সরকারী চাকরি পায়নি। তাই সবাই ভেবেছিল ও পাবে প্রতিবন্ধী কোটায়। কিন্তু ওর হাত না থাকলেও ও নিজেকে প্রতিবন্ধী মনে করে না কখনো।
হঠাৎ দাদার চিৎকারে সম্বিত ফেরে স্মাহির। দাদা ডাকছে নিচে। স্মাহি পাশ করেছে। সব কটা সিঁড়ি টপকে স্মাহি সিভিল সার্ভিসে সুযোগ পেয়েছে। সবার চোখে আনন্দর রেশ। দাদা ওর মুখে মিষ্টিটা গুঁজে ওকে জড়িয়ে ধরে। সবার চোখে আজ খুশির ছোঁওয়া। না করুণা নয়,কারন হাত ছাড়া জেনারেল কোটায় এই লড়াই জিতেছে স্মাহি।
সিঁড়িটার দিকে তাকিয়ে মনে মনে ধন্যবাদ দেয় স্মাহি। ওকে প্রথম লড়াই করে জিততে শিখিয়েছিল ঐ সিঁড়িটা। আজ জীবনের সিঁড়ির সব চেয়ে উঁচু ধাপটি ও পার করেছে নিজের চেষ্টায়। জীবন যুদ্ধে ও জিতে গেছে একার প্রচেষ্টায়।