সিংহ রাশি
সিংহ রাশি


আমার নাম মানিক।কদিন ধরে বেজায় টেনশেনে ভুগছি।না,না চাকরীর জন্য না।সে যা হোক একটা টেনেটুনে জুটে গেছে।
পোষ্ট অফিসে।চিঠি বাছার চাকরী।
সরকারি কাজ তো!
টেনশেনটা হচ্ছে। বিয়ের জন্য।ভবিষ্যতের চিন্তায় এত চিন্তিত ছিলাম যে কলেজ লাইফটা ঘাড় নিচু করেই পার করে দিয়েছি।
আত্বীয়, স্বজন থেকে মা,বাবাই বেশি করে সাবধান করে দিয়েছিল।
কোন মেয়ের চক্করে যেন না পড়ি।না হলে ফিউচার বলে কিছু থাকবে না।
গাছ তলায়,বাস স্টপে আর পার্কের বেঞ্চিতে আড় চোখে ছেলে,মেয়ের অন্তরঙ্গ মুহূর্তগুলো দেখেছি।
তবু সোজাভাবে তাকায়নি কোনদিন।
কী জানি যদি রং বল এসে ঠুকে দিয়ে পালায়।তবে তো একেবারেই ক্লিন বোল্ড!!তাই আমার কোন বান্ধবী নেই।
দু,চারজন বন্ধু যদি বা ছিল।তারাও এখন কোনরকম যোগাযোগ রাখেনি।বলতে গেলে আমিই রাখিনি।
বয়সটা তিরিশ পার হতেই আমি একরকম পাগল হয়ে উঠেছিলাম।কোনরকমভাবে একটা চাকরী জোটানোর জন্য।
কোনদিন যে পোষ্ট অফিসে চাকরী করব,ভাবিনি।
মানিক তো সিংহ রাশি পড়ে।
আজ সকালের কাগজটা হাতে নিয়ে একবার রাশি ফলটার দিকে চোখটা ঘুরে গেল।লেখা ছিল।
হঠাৎ খুশির খবর।
তেত্রিশে পা দিলাম। মা,বাবা এখন আমাকে সংসারী করার জন্য উঠে,পড়ে লেগেছে।
এই অবস্থায় খুশির খবর বলতে ওই একটাই আছে।
আয় বুড়োর নাম ঘোচান।এই বয়েসে মেয়ে জোটা কষ্টসাধ্য ব্যাপার ।তার উপর সামান্য মাইনের একটা চাকরী।আজকাল মেয়েদের সামনে শুধু চয়েশ না মাল্টিপল চয়েশ রাখা থাকে।সঠিকটা বেঁচে নিলেই হল।আমাকে যে কেউ টিক মার্ক দেবে না, সেটা একরকম জেনে গেছি।
ওদিকে আজকাল আবার মায়ের শরীর টাও ভাল যাচ্ছে না। বাতের ঔষুধ খাচ্ছে।তাই রবিবারে নিজেই ধোপা হলাম।
রান্নাটাও উঠে গিয়ে দুবার ঘাটাঘাটি করতে হল।বিপদ যে আসন্ন সে আর বলার জো রাখে না। তাড়াতাড়ি করে একটি মেয়ে জোটাতে না পারলে।ঘর এবং বাহির দুটোই সামলাতে হবে।
আমাদের অফিসে একটা মেয়ে আছে। অবিবাহিতা।বয়সটা বড় জোর তেইশ,চব্বিশ হবে।দেখতে মোটামুটি।চোখে একটা চশ্মা পরে।পাতলা গড়ন।গায়ের রঙটা বড্ড কালো।সেইজন্যই বোধ হয় তার মোবাইলটা সেরকম বাজে না।
সে যায় হোক।আমিও কোন রাজপুত্তর না। চাকরীটা না জুটলে সারাটা জীবন আলু,বেগুনের খেত আর ওই হেসেল ঠেলেই কাটাতে হত।
ভাবলাম একবার চান্স লাগিয়ে দেখি ।তারউপর রাশিটাও প্রসন্ন আছে।
টিফিন টাইমে ওর পাশে গিয়ে বসলাম।দেখলাম দুটো রুটি আর আলু ভাজা খাচ্ছে।আমার আবার দুপুরে ভাত না হলে চলে না।
বললাম,আপনার নাম কি যেন?
--মালা মুর্মু।
নামটা শোনা মাত্রই আমার আশাসুদ্ধ বেলুনটা ডুম করে ফেটে গেল।
অবশ্য এসব আওয়াজের গুণ হল যার ভেতরে ফাটে সে ছাড়া কেউ শুনতে পায় না।
মনে,মনে ভাবলাম।একজন আদিবাসি মেয়েকে বিয়ে করব!
মায়ের মুখটা একবার ভেসে উঠল।আর বাবার চালে রাখা শাল কাঠের লাঠিটা।আগে গাঁয়ে বাদ,বিবাদ হলেই বাবা লাঠিটা নিয়ে দৌঁড়ে যেত।
অনেকেই সেই ঘা খেয়েছে।আমি বাদে।এখনো প্রতি শনিবার তেল ঘষতে ভুলে না।
মনে করেই গলার কাছটা শুকিয়ে গেল।
দুদিন পরের খবর।
কী করে যেন মেয়েটির পে স্লিপটা চেয়ারের নিচে পড়ে যায়।দেখলাম নামের জায়গায় লেখা আছে মালবিকা সরকার।ভাবলাম অন্য কারু হবে হয়ত ।যদিও দ্বিতীয় কোন মেয়ে এই সেকসেনে কাজ করে না।তাই ওকেই বললাম,এটা কার বলুন তো?
মেয়েটি স্লিপটা লুফে নিয়ে বলে উঠল,...এটা আপনার হাতে!...আর আমি গোটাই খুঁজে বেড়াচ্ছি।
আমি সাথে, সাথেই বলে উঠলাম,কিন্তু নামটা তো আপনার নয়?
----কেন নয়?
---সেদিন আপনি বললেন আপনার নাম মালা মুর্মু।
মেয়েটি এক গাল হেসে বলে উঠল,আসলে প্রাকটিশ করছি। বিয়ের পর তো মুর্মু হয়ে যাব তাই।
---মানে?
---এত সহয মানেটাও বোঝেন না তাহলে?..ঘুষ দিয়ে চাকরীটা হয়েছে নাকি?মেয়েদের পদবী কখন পাল্টে যায় জানেন না বুঝি?
----আপনি আদিবাসি ছেলেকে বিয়ে করবেন?
----অবাক হচ্ছেন নাকি?...ওরা কী মানুষ নয়?...না ওরা পা দিয়ে খায়?যত্তসব গোঁড়া সেলুকাস!!...চলুন.অনেক তর্ক হল।এবার ব্যাগগুলো এক,একটা ধরান।এন্ট্রি করতে হবে।
সেদিন রাতে মা আমাকে বলে উঠল,আমি তো এদিক,ওদিক করতে পারছি না মানিক।একটা মেয়ে তুই দেখে,টেখে নে।
আমি তো বেজায় খচে গেলাম,এত দিনে বলছ প্রেম করতে!...যখন ওসব করার সময় ছিল।তখন দিন,রাত ভয় দেখিয়ে ছিলে।
---সে তো বাবা তোর ভালর জন্যই বলতাম।
---সেই ভালর ফল আজ হাতেনাতে পাচ্ছি।চাকরীও জুটল তো শেষে পোষ্ট অফিসে সামান্য কেরাণীর আর তো আর এবার বিয়ের জন্য কোন মেয়েও জুটছে না।
---আমি বলে দিলাম ।এবার তুই যা ভাল বুঝিস কর।
---আর বাবার কী মত শুনি?
---তোর বাবা আমি মিলেই সিদ্ধান্তটা নিয়েছি।আমাকে জানিয়ে দিত বলল ।
আমার মাথায় তো দাবানল জ্বলে উঠল।জ্বলন্ত অবস্থাতেই বলে উঠলাম।
---ঢুকিয়ে দেব কোন সাঁওতাল মেয়ে..তখন না করো না যেন।
মা যেতে,যেতে বলে উঠল,তোর পছন্দই আমাদের পছন্দ।
আমি তো অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে থাকলাম।ভালভাবে বুঝে গেলাম।আমার এখন শিরে সংক্রান্তি!!
দিন কয়েক পর মালবিকা এক গাল হেসে আমার দিকে চেয়ে বলে উঠল,ও মানিকদা...বলছি মুখখানা দিন,দিন শুকিয়ে যাচ্ছে কেন?গোড়ায় জলটল দেন না নাকি?...চলুন আমার সঙ্গে আজ ফুচকা খাওয়াব।
আমি বাপের কালেও কোনদিন ফুচকা খায়নি।ওর স্বাদ যে কেমন তাও জানি না। টক জল থাকে এতটুকুই জানি।
মাথাটা এখন আমার সব সময় চটেই থাকে।তবু ঠান্ডা ভাবেই বললাম,বিলটা আমি দেব।
মালা সেইভাবেই বলে উঠল,তাই নাকি!..গ্রেট!..তাই হবে।চলুন।
মালবিকা ফুচকা কম খাচ্ছে তার থেকে বেশি ডানদিকে ঘুরে,ঘুরে তাকাচ্ছে।ও পাশে দু,তিনটে মোটা চাকার স্টাইলিশ বাইক দাঁড় করানো আছে।
আর তার পাশেই মোটা,মোটা গাছের গুড়ির উপর কয়েক জোড়া ছেলে,মেয়ে বসে আছে।
তারা যে প্রেম করছে,তা সবাই জানে।মালবিকার সেদিকে এত তাকাবার কারণ খুঁজে পেলাম না। ওর তো বাগদত্তা পর্যন্ত ঠিক হয়ে আছে।
একটা খাওয়ার পর আমি আর ফুচকা নামক অবাধ্য জিনিসটাকে মুখেও তুলিনি।মালবিকা খাওয়া শেষে হাসতে,হাসতে আমার সঙ্গে রোমান্টিক মুডে হাঁটতে লাগল। নিজেকে একজন প্রেমিকের মতই মনে হল।ইস!..সত্যি যদি মালবিকাকে এভাবে সারা জীবনের জন্য পেতাম!
আমার ভাবাও শেষ হয়নি।মালবিকা বলে উঠল,আমাকে কোলের উপর তুলতো পারবেন?
আমি তো রীতিমত অবাক!
মালবিকা আবার বলে উঠল,আরে বাবা এতবড় শরীরটা কী দেখতেই!..মাত্র পয়তাল্লিশ কিলো ওজন ওঠাতে পারেন না?...আপনার ভাগ্য ভাল ট্রাক ম্যানে চাকরীটা পড়েনি।না হলে বুঝতেন।মাল তোলা কাকে বলে!
আমি বলে উঠলাম,কিন্তু কেন?
---আগে তুলে ওই রাস্তা অব্দি নিয়ে চলুন।পরে বলছি।
আমি তুললাম।
ইস!...এ যে কী সুখের অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা যায়.না। মনে হল আমি আর পৃথিবীতে নেয়। হাঁটছি কোন অচিনপুরির স্বপ্ন গলিতে!
এত গরমেও আমার মনে ফাগুনের তাজা হাওয়া বইছে।প্রতিটা পদক্ষেপ মনে হচ্ছে যেন এক,এক বছরে শেষ হয়।
এক সময় কানের গোড়ায় কে যেন বলে উঠল,আই লাভ ইউ।
আমার মনে হল স্বপ্ন দেখছি।
মালবিকাই লাফ দিয়ে নেমে বলে উঠল,যা শুনলেন মনে রাখবেন না যেন।
ওই যে গাড়ির পাশে ছেলে,মেয়েটা এদিকে আগুন চোখে তাকিয়ে আছে।
ওই ছেলেটা দুদিন আগে পর্যন্ত আমার লাভার ছিল।দু বছর প্রেম করেছি।আর ওই মেয়েটা আমার প্রিয় বান্ধবী।দুদিন আগে পর্যন্ত ছিল।
আমার কাছ থেকে চালাকি করে নাম্বারটা নিয়ে ছেলেটাকে তলে,তলে নিজের দিকে টেনে নিয়েছে।
এতটা বলার পর মালবিকার উচ্ছ্বল হাসি,খুশি ভাবটা নিমেষে উধাও হয়ে গেল। চোখ,মুখটা লুকিয়ে বলে উঠল,আসলে ছেলে জাতটা এমনই।যেই সামনে ভাল অন্য মেয়ে জুটে যাবে।.. সব ভুলে ওদিকেই দৌঁড়ে চলে যাবে।অবশ্য আমি তো আর ওর মত ফর্সা বা রূপসী কোনটাই নই।সবাই তো ভালটাই চাইবে।তা বলে প্রেমের কোন মূল্যই নেই?...আপনি বলুন তো এটা কী ঠিক?
...সেইজন্যই আমি আজ ওদের অন্তরে আগুনটা জ্বালিয়ে দিলাম। তুই পারিস তো আমিও পারি।...আপনি ওর থেকে যথেষ্ঠ দেখতে ভাল।তাইতো ওদের পাশ দিয়ে আশার সময় এতজোরে আই লাভ ইউ কথাটা উচ্চারণ করলাম।ওদিকে তাকান একবার ।দুজনের মুখগুলো দেখুন।কেমন কালো হয়ে গেছে।... দ্যাখ কেমন লাগে জানু!
মালবিকা এবার আমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল,আপনি যে আমার কী উপকার করলেন,বলে বোঝাতে পারব না।
আমি অবাক হয়ে বলে উঠলাম,আর আপনার বাগদত্তা রাগ করবেন না?
---ধুর মশায়!...আপনি তো দেখছি খুব বোকা!...জীবনে কোন মেয়ের পাল্লায় পড়েননি মনে হয়?...সোজা বিয়ে করেছেন নাকি?...আমি আপনার সঙ্গে ইয়ার্কি মারছিলাম।আসলে বিয়ে হওয়া হ্যান্ডু ছেলেদের আমি একটু এড়িয়েই চলি।সে অনেক কারণ আছে।তাই ওসব কথা আপনাকে বানিয়ে বলেছিলাম।আর হ্যাঁ.. ভুলেও বউদিকে এসব কথা জানাবেন না যেন।না হলে বিপদ!...আপনি একটু বেশিই সরল।তাই সাবধান করে দিলাম।
আমি আজ চলি।বাই।
পরের দিন আমি আবার একই রকম কায়দায় একই শর্তে মালবিকাকে ফুচকা খাওয়ার নেমন্ত্রণ করলাম।
শর্ত অনুযায়ি আবার কোলে তুলে রাস্তা অব্দি নিয়ে গিয়ে দাঁড় করিয়ে বললাম,আই লাভ ইউ।
মালবিকা এদিক,ওদিক তাকিয়ে বলে উঠল,এটা কী হল?
ভাগ্যিস কেউ শোনেনি!
আমি বলে উঠলাম, যা সত্যি তাই বলছি। যে পারে শুনুক।আই লাভ ইউ।
তারপর পকেট থেকে যত্ন সহকারে রাখা গোলাপটা ওর হাতে দিয়ে একটু ঝুঁকে বলে উঠলাম,ইউ মেরি মী?
মালবিকা অবাক হওয়া মুখে একরাশ আনন্দ মিশিয়ে বলে উঠল,..হয়াট?..আর ইউ ম্যাড?
আমি ওর হাতদুটো ধরে বলে উঠলাম,হ্যাঁ আমি পাগল তোমার ক্ষণিকের চেনা প্রেমে।কেন জানি না আমার মনে হচ্ছে। তোমাকে ঈশ্বর আমার জন্যই পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন।না হলে আপনিই বলুন ।একজন ফার্স্ট ক্লাস পাওয়া গ্র্যাজুয়েট ছেলে শেষে কিনা একটা পোষ্ট অফিসে সামান্য ক্লার্কের চাকরী করে?
....সব ওই ঈশ্বর নামক মহাপুরুষটির বানানো ছক!...তোমার সাথে আমার দেখা করানোর।
মালবিকা এখনো ঘোরের মধ্যে আছে।আমি সিরিয়াস হয়ে বলে উঠলাম, আমি অবিবাহিত ।আজ পর্যন্ত ক্যারিয়ারের পিছনে দৌঁড়তে গিয়ে কাউকেই ভালবাসতে পারিনি। তোমাকে দেখার পর একবার আসার চেষ্টা করেছিলাম। তুমি ফিরিয়ে দিয়েছিলে।ঈশ্বর আবার মিলিয়ে দিলেন।...এটা কীসের ইঙ্গিত তুমিই বল?
মালবিকা নিজের ঠোঁটদুটো কামড়ে চোখের জলটা লুকোনোর চেষ্টা করে ঘুরে দাঁড়াল।
আমি আস্তে করে ওর মাথাটা বুকের মধ্যে ভরে নিলাম।