Aparna Chaudhuri

Drama

3  

Aparna Chaudhuri

Drama

সিঁদুর খেলা

সিঁদুর খেলা

5 mins
1.8K


যদি কোন বিবাহিত মহিলা কে জিজ্ঞাসা করা হয়, দুর্গা পুজোয় তার সবচাইতে প্রিয় অনুষ্ঠান কোনটা তবে বেশিরভাগ মহিলাই বলবে, সিঁদুর খেলা। দশমীর দিন যখন মায়ের ঘট বিসর্জন হয়ে যায় আর ধীরে ধীরে প্যান্ড্যাল খোলা শুরু হয়ে যায়, মনটা বড় খারাপ হয়ে যায়। মনে হয় আর একটুক্ষণ যদি মা থাকতেন। পুজোর শেষ রেশটা ধরে রাখার তাগিদেই বোধহয় আমরা সিঁদুর খেলায় মেতে উঠি।

প্রত্যেকবার সিঁদুর খেলার জন্য দিয়া আর নির্ঝর আমাকে আর শান্তনু কে ওদের গাড়িতে করে তুলে নিয়ে যায়। আর সিঁদুর খেলার জন্য যে সব জিনিষ পত্র লাগে, মানে পান, সুপুরি, সিঁদুর, সন্দেশ ইত্যাদি তা ওই কিনে কেটে নিয়ে আসে আমার জন্যেও। এটা সত্যি যে মানুষের বয়স যত বাড়ে তার আবদার করার লোকের সংখ্যাও তত কমতে থাকে। কিন্তু আমার মত কিছু সৌভাগ্যবান মানুষও পৃথিবী থাকে যাদের বন্ধুরা তাদের সব আবদার বলার সঙ্গে সঙ্গে বা বলার আগেই পূর্ণ করে। প্রতি বছর দশমীর দিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই আমি দিয়া কে ফোন করি আর ওপার থেকে শুনতে পাই দিয়া এক নিঃশ্বাসে বলে যাচ্ছে ,” গুড মর্নিং, নির্ঝর কে বলে দিয়েছি দুসেট জিনিষ কেনার জন্য। বিকাল সাড়ে পাঁচটায় তৈরি থাকিস। ঠিক সাতটায় ঠাকুর বেরোবে কিন্তু, দেরি করলে মুশকিল।“ আমি আদুরী গোবুরির মত একগাল হেসে আড়মোড়া ভেঙ্গে বলি ,”থ্যাঙ্ক ইউ।“ ওদিক থেকে দিয়া র সহাস্য উত্তর শুনতে পাই,” ঠিক আছে মা জননী আর থ্যাঙ্ক ইউ বলতে হবে না।“


বিকাল ঠিক সাড়ে পাঁচটার সময় হাতে একটা থালা নিয়ে দিয়ার গাড়িতে উঠতেই দিয়া জিনিষগুলো আমার হাতে দিয়ে বলে ওঠে ,”টাকাটা দিয়ে দিবি। পুজোর জিনিষের টাকা দিয়ে দিতে হয়।“ তারপর আমি গাড়িতে বসেই, পানের খিলি বানিয়ে তাতে সুপুরি পোরার ভীষণ দুরূহ কাজটা শুরু করে দিই। আমার পানের খিলি গুলো ছোলা ভাজার ঠোঙ্গার মত দেখতে হয়। দিয়া অনেক চেষ্টা করেও আমাকে ওটা আর শেখাতে পারে নি।

মণ্ডপে পৌঁছে দেখি অরুণা, অনিন্দ্য, মিতা, শমিক, শ্রুতি, বরুণদা , দীপা, প্রদীপ আর বিপাশা, অনুপম সবাই এসে গেছে। শুধু অরিজিত আর কল্পনারা আমাদের চেয়ে দেরিতে এসে পৌঁছায় প্রতিবার, কারণ অরিজিত র সাজতে খুবসময় লাগে। হ্যাঁ আপনারা ঠিকই পড়ছেন অরিজিত , তার সাজের গল্প আরেক দিন হবে।

আমাদের মধ্যে যে সবচেয়ে আগে পৌঁছায় সে লাইনে দাঁড়িয়ে পড়ে, সাধারণত সেটা হয় বিপাশা বা অরুণা। আমরা যারা পরে পৌঁছোই তারা টুকটাক বিপাশা বা অরুণার সাথে লাইনে ঢুকে পড়ি। আমাদের বন্ধুদের সবাই চেনে তাই তারা খুব একটা আপত্তি করে না। তারপর শুরু হয় বালান্সিং অ্যাক্ট । মায়ের সামনে একটা সিঁড়ির মত বানানো হয় যার উপর চড়ে মাকে সিঁদুর লাগাতে হয়। অত জন মহিলার ভারে মা দুর্গার স্টেজ টা নড়ে, তার উপর রাখা সিঁড়িটাও নড়ে তার উপর দাঁড়িয়ে আমরা কাঁপতে কাঁপতে মা দুর্গা কে সিঁদুর লাগাই। একবার তো এক ভদ্রমহিলা ব্যাল্যান্স রাখতে না পেরে মা লক্ষ্মীর হাত টা ধরলেন আর সঙ্গে সঙ্গে হাতটা মট করে ভেঙ্গে ওনার হাতে চলে এলো। ব্যস বিশাল চেঁচামিচি, ভাঙ্গা ঠাকুর বিসর্জন দেওয়া যায় না। আগে সে হাত সারানো হল তারপর ঠাকুর বিসর্জন হল। সেইবার মা লক্ষ্মী হাতে প্লাস্টার বেঁধে কৈলাসে ফিরলেন।

সিঁদুর খেলার পর ঠাকুর ওঠানো অবধি আমরা মণ্ডপের সামনে বসে আড্ডা মারি। তারপর ছেলেরা সবাই মিলে যখন ঠাকুর কে লরির উপর উঠিয়ে দেয়, ঢাকি রা ঢাক বাজায় আর মাইকে বাংলা গান বাজে। আমরা গোল হয়ে ঘুরে ঘুরে নাচি (মানে যে যেমন পারি, বাইরের লোকেদের সেটা দেখে নাচ মনে নাও হতে পারে)। তারপর ঠাকুর বেরোয় বিসর্জনের জন্য। মায়ের মুখটা দেখে মনটা কেমন হু হু করে ওঠে। সজল চোখে হাতজোড় করে মাথায় ঠেকাই আর মনে মনে বলি আসচে বছর আবার এসো মা। 


আমরা সবাই লরির পিছন পিছন বেশ খানিকটা রাস্তা যাই। পথে একটি বাঙালি মিষ্টির দোকান পড়ে, প্রতি বছর তারা সমস্ত লোক, যারা বিসর্জনে যাচ্ছে, তাদের গরম জিলিপি আর নিমকি খাওয়ায়। ওদের দোকানের সামনে পৌঁছান মাত্র ওদের দোকানের কর্মচারীরা থালা থালা জিলিপি, নিমকি নিয়ে রাস্তায় নেমে আসে। বেশ গুপি গাইন বাঘা বাইন টাইপের এর একটা ফিলিং হয়। সেই নিমকি আর জিলিপি খেয়ে আমরা বেশির ভাগ লোক যে যার গাড়িতে চড়ে বাড়ী চলে আসি। আর অল্প কিছু লোক লরিতে মায়ের মূর্তির সাথে চলে যায় লেকের উদ্দেশ্যে।

দশমীর দিন নাগপুরে বৌদ্ধদের ধম্মচক্র প্রবর্তন দিন পালিত হয়। সেই উপলক্ষে নাগপুরে ছ থেকে দশ লাখ লোক আসে। তাদের জন্য ট্রেন ও বাসের টিকেট ফ্রি করে দেওয়া হয় সরকারের তরফ থেকে। আর নাগপুরের লোকেরা রাস্তায় রাস্তায় স্টল লাগিয়ে বিনামূল্যে খাবার ও জল বিতরণ করে। গ্রাম গ্রামান্তর থেকে যে সব লোকেরা আসে তাদের বেশিরভাগই জীবন যাপন করে দারিদ্র সীমার নিচে। তারা নাগপুরের সব দর্শনীয় স্থান দেখতে যায়। এরকমই একটি দল যার বেশীরভাগই মহিলা ও বাচ্চা, সেবার আমাদের দুর্গা পুজো দেখতে এসেছিল। দলের বেশির ভাগ লোকের পায়ে জুতো বা চটি নেই। জামাকাপড় ধুলো মাখা আর সবার মুখই পথশ্রমে ক্লান্ত। ওরা সবাই জড়সড় হয়ে প্যান্ড্যাল এর একটা কোনে দাঁড়িয়ে ছিল। আমরা তখন সিঁদুর খেলে গোল হয়ে বসে আড্ডা দিচ্ছি। এইসময় যে মহিলারা আসে ঠাকুর দেখতে আমরা সকলের সঙ্গেই সিঁদুর খেলি। ওদের দেখেই আমরা স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে উঠে, ওদের সাথে সিঁদুর খেলতে শুরু করলাম। ওরা এরকম একটা ওয়েলকাম এর জন্য তৈরি ছিল না। ওদের সকলের মুখ এই অপ্রত্যাশিত সম্মানে হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। কেউ কেউ কুণ্ঠিত ভাবে আমদের থালার থেকেই সিঁদুর নিয়ে আমাদের লাগাল। আমি যে মহিলাকে সিঁদুর লাগাচ্ছিলাম দেখলাম তার কোলের বাচ্চা টা নেতিয়ে পড়েছে। দেখে মনে হল বাচ্চাটার ভীষণ খিদে পেয়েছে। আমি আমার থালার থেকে মিষ্টি নিয়ে বাচ্চা টাকে আর তার মা কে দিলাম। বাচ্চা টা মিষ্টি টা পেয়ে খিলখিলয়ে হেসে উঠলো, আর পরিষ্কার দেখলাম ওর মায়ের চোখের কোনটা চিক চিক করছে জলে। আমায় দেখে আমার সব বন্ধুরা এগিয়ে এলো। বলল “বাঃ এটা তো বেশ করলি তুই! আমরাই বা মিষ্টি গুলো বাড়ী নিয়ে গিয়ে কি করবো?” বলে ওরাও ওদের থালার মিষ্টিগুলো বিলিয়ে দিলো। আমাদের দেখাদেখি বাকি মহিলারাও তাদের মিষ্টি গুলো ওই দলের মধ্যে বিতরণ করে দিলেন। কয়েক মিনিটের মধ্যে ব্যাপারটা একটা মিনি উৎসব এর রূপ নিলো।


মিষ্টি পেয়ে ওরা বেশি আনন্দ পেল না দিতে পেরে আমরা বেশি আনন্দ পেলাম বলতে পারবো না। কিন্তু এটুকু বলতে পারি যে সেবারের সিঁদুর খেলাটা একটা আলাদা মাত্রা পেয়েছিল। 



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama