সিমন্তিনীর সংসার
সিমন্তিনীর সংসার


সংসার বড় জটিল চক্র। এর বূহ্যে যে একবার হারিয়ে যায়, সে শত চেষ্টাতেও মুক্তির পথ পায়না। খাঁচার পাখির মতো সেই চক্রবূহ্যকেই নিজের আকাশ ভেবে নিয়ে মুক্তির নীল খুঁজে পায়।
বিয়ের দুই বছর কেটে যাওয়ার পরেও যখন পলাশ সংসারের কিছুই শিখল না, তখন একদিন সিমন্তিনী ক্ষোভ দেখিয়ে বলেছিল, “কি গো, আজও বাজার করতে শিখলে না? এভাবে কি সংসার চলে?”
পলাশ তার সরল হাসিমাখা মুখখানা তুলে বলেছিল, “তুমিই ভালো পারো। আমার দ্বারা অতো দর কষাকষি হয় না গো।” সিমন্তিনী চোখ কপালে তুলে বলেছিল, “আমি ঘর দেখব, আবার আমিই বার দেখব। তুমি কেমন পুরুষমানুষ গো! তুমি কি করবে শুনি?” পলাশ হেসে উত্তর দেয়, “ঐ যে মুলধনটুকু এনে দিতে পারি।”
বাইরে রাগ দেখালেও মনে মনে খুশিই হয়েছিল সিমন্তিনী। তার দু'কামরার ভাড়া বাড়িতে বসন্ত খেলা করতো রোজ। জানলার পর্দা, রান্নার তেল, ঘরের ফিনাইল সব কিছু যেন সিমন্তিনীর অনুগত।
এই টালির চালের ঘরটি তার সৃষ্ট জগৎ। শুধু পলাশ যখন দামাল হয়ে ওঠে তখন সম্রাজ্ঞী সমর্পন করে সখীর রূপ ধারণ করে।
তারপর একদিন খোকা এলো কোল আলো করে। সিমন্তিনীর জগৎ আরো বৃহৎ হলো। পলাশের দিকে নজর দেওয়ার সময় কোথায়? আপন ভোলা লোকটা তবু সেই কম সেবাতেই খুশী। কখনো সিমন্তিনীর অকারণ মুখ ঝামটাও সহ্য করে অবলীলাক্রমে। অভিমানী সিমন্তিনী ভাবে লোকটা কোন ধাতু দিয়ে তৈরি। এতোটা উদাসীন সংসার নিয়ে! আদৌ কি কোনোদিন ভালোবেসেছিল মানুষটা?
তারই মধ্যে চলছিল সিমন্তিনীর সংসার। কিন্তু কিছুদিন পর গ্রাম থেকে চিঠি এলো, শশুর মশায়ের শরীর খারাপ, তাই শাশুড়ি মাকে নিয়ে আসছেন কলকাতায়। এখানে থেকে চিকিৎসা করাতে। পলাশ শশব্যস্ত। বিয়ের পর বাবা-মা এই প্রথম আসছেন তার কলকাতার বাড়িতে। তাদের যেন কোন অসুবিধা না হয়। সিমন্তিনী যেন কোনো প্রকার গৌরব না হারায়।
এদিকে সিমন্তিনী আঁধার দেখল। তাদের আসা মানেই তো তার সাম্রাজ্যে দখল। শাশুড়ি মায়ের অভিজ্ঞ চোখে ধরা পড়বে তার অনভিজ্ঞ সংসার-যাপন। হলোও ঠিক তাই,
“একি বৌমা, ছেলেটাকে উত্তর দিকে মাথা দিয়ে শুইয়েছো? শরীর খারাপ করবে যে!”
“আহ আলুবাজায় আবার পেঁয়াজ দেওয়ার কি দরকার?”
“কলতলায় যে শ্যাওলা জমেছে। ঘষে দিতে পারতে তো?”
“খোকা আমার ঝাল খেতে পারে না বৌমা। কাল থেকে ঝাল কম দিও।”
সিমন্তিনী ধীরে ধীরে সংকুচিত হতে থাকে। খোকার জগতে ভাগ বসলো। তার কানে উড়ে এলো, “ছেলে তো ঠাম্মা বলতে পাগল। মায়ের কাছে যেতেই চায়না।” গলায় বাষ্প জমে ওঠে। তার সহজাত অধিকারটুকুতে যেন কোথায় ফাঁকি পড়ছে। আপন ভোলা লোকটাও কেমন ভাবে তাকাতে শুরু করলো তার দিকে।
সিমন্তিনী দিন গুনতে লাগলো ওদের গ্রামের বাড়ি ফিরে যাওয়ার। কিন্তু ভাগ্য সহায় হলো না। মাস তিনেকের মধ্যে শশুর মশাই চলে গেলেন।
শ্রাদ্ধ-শান্তি মিটলে মেজ আর ছোট ছেলে টাকা দিয়েই হাত উঠিয়ে নিল। মায়ের দায়িত্ব তারা নিতে নারাজ। মন্দার বাজারে বাড়তি একটা মানুষকে টানার ক্ষমতা তাদের নেই। অতএব বড়ছেলে, পলাশের ওপর পড়লো সমস্ত কর্তব্যের ভার। সিমন্তিনীর সংসারে তার সৃষ্টিরা ধীরে ধীরে ডানা গুটিয়ে নির্জন কোষ খুঁজে নিল। তবু স্বপ্ন দেখতে তো মানা নেই। এক বর্ষার রাতে পলাশের বুকে মুখ গুঁজে সে আব্দার করলো, “আমাদের নিজেদের বাড়ি হবে না?”
পলাশ চমকে উঠে বলে, “বাড়ি? সে তো অনেক খরচ!” সিমন্তিনী উঠে বসে বলে, “হোক না। একটু একটু করে জমাবো। নাও না গো খোঁজ একটা জমির।”
― কিন্তু বাবার অসুখে এতো টাকা চলে গেল। এখন বাড়ি...তার ওপর মা।
সিমন্তিনী রাগ দেখিয়ে বলে, “মায়ের দায়িত্ব তো তোমার ভাইদেরও নেওয়া উচিৎ। আমার খোকার কি কোনো ভবিষ্যৎ নেই?”
পলাশ থমকে যায়। কথাটা সত্যি বটে। শুরু হলো খোঁজ। তারপর আরো পাঁচবছর। সিমন্তিনী পেল তার নিজের বাড়ি। কিন্তু এদিকে শাশুড়ি মায়ের শরীর ভালো নেই। সিমন্তিনী খোকার অজুহাতে তাকে পাঠিয়ে দিল গ্রামের বাড়ি। পলাশ আহত হলো স্ত্রীর এমন ব্যবহারে। নতুন বাড়িতে মায়ের পায়ের ধূলো পড়লো না। সিমন্তিনী বুঝল স্বামীর মনের কথা। পলাশ কি তাকে স্বার্থপর ভাবলো? ভাবুক।
এ সংসারে কতটা মাথা ঘামিয়েছে সে। এ সংসার তার। সে এই সংসারের সৃষ্টিকর্তা। সুতরাং তার সিদ্ধান্তই শেষ কথা।
দিন যায়, মাস যায়। খোকা বড় হলো। চাকরি পেল। তারও একদিন বিয়ে হলো। সিমন্তিনীকে একা করে পলাশ চলে গেল অমৃতলোকে। কিন্তু সিমন্তিনীর মুক্তি নেই। সে আরো বাধা পড়লো তার সৃষ্টির খাঁচায়। নতুন বৌমা কতটা সংসার সামলাতে পারবে তা নিয়ে দুশ্চিন্তা বেড়ে গেল।মাঝে মাঝে মনে হয় সব জিনের লাগাম আলগা করে দিতে, কিন্তু মন সায় দেয়না।
তুলসী মঞ্চের জল পড়ল কিনা, কাজের মাসি সময়মতো এলো কি না, রান্নার মেয়ে কতোটা তেল খরচ করলো, নাতিটাকে বৌমা ভিটামিনটা দিল তো?, মেনিটা পোয়াতি, কাঁটা গুলো খেয়েছে? সিমন্তিনীর কপালে শতেক চিন্তার ভাঁজ।
কিন্তু কোথায় যেন আজকাল ছন্দ কেটে যাচ্ছে। বড় বিস্বাদ, নুন কম লাগছে। কি যেন হারিয়ে যাচ্ছে অতি ধীরে, সন্তর্পনে। ইলেক্ট্রিকের বিল হাতে সিমন্তিনী একদিন খোকাকে বলল, “খোকা লাইটের বিলটা দিলি না?” খোকা অফিসের ব্যাগ গোছাতে গোছাতে হেসে বলল, “ কাল রাতেই দিয়ে দিয়েছি মা।”
― রাতে? অফিস খোলা ছিল?
― না, না। অনলাইন। ঘরে বসেই দেওয়া যায়।
― ওহ, তাও হয় বুঝি?
― হম, তুমি এসব নিয়ে আর চিন্তা করো না। আসি।
সিমন্তিনী দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তার কপালের একটি ভাঁজ কমলো। কিন্তু মুখটা বড় বিস্বাদ, বড্ড নুন কম।
অতএব, বাজার হাট, নাতির পড়াশুনা, ছেলের মন খারাপের কোণ, ঘরের রং, পর্দার নকশা, রাতের খাবার― সব চিন্তার ভাঁজ কমতে লাগলো।
সিমন্তিনী চিন্তা মুক্ত হয়েও কি যেন হারিয়ে ফেলল। তার শরীর ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছে। সারাদিন সে কাজ করে না তেমন। তবু কি এক ক্লান্তি গ্রাস করছে তাকে।
খোকা এসে বলে যায়, “মা বিশ্রাম নাও।” বৌমা এসে বলে যায়, “মা বেশি কাজ করো না। আমি আছি তো।” সিমন্তিনীর ভাঁজহীন কপাল। চির বিশ্রাম যেন তাকে ডাকছে।
ডাক্তারের কথায় খোকা অফিস থেকে কদিন ছুটি নিয়ে মাকে নিয়ে চলে এলো পুরী। ছাদে বসে সিমন্তিনী দেখছিল বিশাল তপনের সমুদ্রাভিযান। নাতিটা অনতিদূরে খেলছে, সঙ্গে আরো দুটি বাচ্চা। ঘুরতে এসেছে। সিমন্তিনীর কানে এলো দূর থেকে ভেসে আসে খোল করতালে মুখরিত হরিধ্বনী। সমুদ্রের ধার ঘেঁষে চলেছেন একদল বৈষ্ণব বৈষ্ণবী। সব হারিয়েও তাদের কতো আনন্দ। সিমন্তিনীর চোখ চলে গেল ছাদের এক কোণে। ভাঙা, শুষ্ক কিছু টবের ধ্বংসাবশেষের গা ঘেঁষে ফুটে উঠেছে একটা বেগুনী রঙের ফুল। কচিপাতাগুলো বিকেলের বাতাসে ভীরুর মতো তিরতির করে কাঁপছে। সিমন্তিনী দৌঁড়ে গিয়ে কোথা থেকে একমগ জল আনলো।
সাবধানে ঢালল গাছের গোড়ায়। টবগুলোকে সোজা করে বসলো। শরীরটা বেশ ভালো লাগছে এবার। মনে পড়ে যাচ্ছে পাড়ার আশ্রমের কথা, উঠোনে পরে থাকা অবহেলিত বাগানের কথা, স্বামীর রেখে যাওয়া আলমারি ভর্তি বইয়ের কথা। মুখের বিস্বাদ ভাবটা কেটে যেতে লাগল।
চারিদিক আবার স্পষ্ট হয়ে এলো। সিমন্তিনী আবার ফুলটার দিকে তাকালো। যেন মাথা নেড়ে তাকে বলছে, “দেখো, সৃষ্টির আরো কিছু আছে বাকি।”