শ্যাওলার দাগ
শ্যাওলার দাগ


কথায় আছে না, 'যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই সন্ধ্যে হয়,' কপালে দুর্ভোগ থাকলে কে খন্ডাবে বলুন! সামনে পুজো আসছে। রাঁচি শহরে সরকারি চাকরির উচ্চপদস্থ কর্মী অভিষেক চেয়েছিল গাড়ি চালিয়ে ফিরতে কলকাতায়। ট্রেনে যেতে পারত, কিন্তু ড্রাইভিং ওর শখ। মহালয়ার আগের দিন দুপুরে লম্বা ছুটি নিয়ে বেরিয়ে যাবার কথা ছিল ওর। কিন্তু হঠাৎ আসা কিছু কাজের ভারে ওর ছুটিটা কিছুটা দেরিতে কার্যকর হল। যেহেতু বাড়িতে বলা আছে তাই সন্ধেবেলা হলেও বেরিয়ে পড়েছিল ও। কাল ভোরের আগেই বাড়ি পৌঁছে যাবে ভেবেছিল। কিন্তু মানুষ ভাবে এক আর হয় আর এক। এইমুহূর্তে যেমন ওর গাড়িটা খারাপ হয়ে গেছে মাঝরাস্তায়। কিছুতেই স্টার্ট নিচ্ছে না। বনেটটা খুলতেই বেরিয়ে এল একরাশ গরম ধোঁয়া। কিসের সমস্যা ঠিক বুঝতে না পারলেও এটা বুঝতে পারল অভিষেক যে তাড়াতাড়ি গাড়িটা ঠিক হবার সম্ভাবনা নেই।
এখন যেখানে গাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে সেই জায়গাটা রাঁচি শহর থেকে বেশ কিছুটা দূরে। পাহাড়ি এলাকা, রাস্তার দুপাশে ঘন জঙ্গল। তার মধ্যে দিয়ে দুএকটা পায়েচলা পথ মাঝে মাঝে শাখানদীর মত হারিয়ে গেছে দিগন্তে। আপাতত গাড়ি এখানে থাক, এই পাণ্ডববর্জিত জায়গায় চুরি হবার ভয় নেই অন্তত, একটু এগিয়ে দেখা যাক, একটা না একটা বসতি তো অন্তত পাওয়া যাবে। সেখানে রাতটা কাটিয়ে দিতে পারলে সকালে মেকানিক জোগাড় করে শক্ত হবে না। এই মনে করে পিঠের ব্যাকপ্যাকটা নিয়ে গাড়ির দরজা লক করে রাস্তার ডানধারের জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে একটা সরু পায়েচলা পথ ধরে এগিয়ে গেল অভিষেক। হাতে একটা বড় পাঁচ সেলের টর্চ। দরকারে হাতিয়ার হিসাবেও ওটা প্রয়োগ করা চলবে। এগিয়ে গেল ও, জঙ্গলের আরো আরো গভীরে।
একঘন্টা ধরে খুঁজে মরছে অভিষেক। একটা লোকালয় তো দূর, একটা আলোর উৎসও কোথাও চোখে পড়ছে না। হতোদ্যম হয়ে ও যখন প্রায় ফেরার কথা ভাবছে, তখন সামনের ঝোপ ঠেলে এক বৃদ্ধ বেরিয়ে এলেন। হাতে লণ্ঠন। বয়সে যে বেশ প্রাচীন সেটা মুখের বলিরেখা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। অভিষেকের বিপদের কথা শুনে উনি বললেন উনি কাছেই এক মন্দিরের পুরোহিত। অভিষেক রাতটা সেখানে কাটাতে পারে। তাঁর সঙ্গে অভিষেক মন্দিরের উদ্দেশ্যে রওনা দিল।
মন্দিরে পৌঁছে কিছুক্ষণ গল্প করে বৃদ্ধ চলে গেলেন ওর রাতের খাবারের যোগাড় করতে। একা মন্দিরের দালানে বসে কেমন গাটা ছমছম করে উঠল অভিষেকের। সম্পূর্ণ নগ্ন এক কালীমূর্তি মন্দিরে। চোখ দুটি যেন রক্তপিপাসু, জীবন্ত। সেদিকে তাকালেই ওর গাটা ছমছম করে উঠছে। অনেকদিন হয়ে গেল, সেই রাতটার। ওর অফিসের এক জুনিয়র এমপ্লয়ি। মেয়েটা ছিল খুব হাসিখুশি, মিশুকে। ওর মায়ের একটা কঠিন অসুখ হয়। ওর কাছে কিছু টাকা ধার চাইতে আসে মেয়েটি। সেই টাকা দেওয়ার অজুহাতে মেয়েটির উপর অত্যাচার করে ও এক রাতে, ওর রাঁচির বাংলোয়। দুঃখে আর লজ্জায় মেয়েটা আত্মহত্যা করে। না ও কিছু বলেনি কাউকে, বা কেউ কিছু সন্দেহও করেনি। কিন্তু এখনো অভিষেকের মনে একটা উদ্বেগ রয়েই গিয়েছে। একবার ধরা পড়লে কি যে হবে সেটা আর ভাবতে চায় না ও। যদিও ওকে ধরতে পারবে না কেউ। মেয়েটার ওই মা ছাড়া আর কেউ ছিল না, তা সেও তো মেয়ের শোকে আর বাঁচেনি।
নাঃ, এখনো তো পুরোহিতমশাই আসছেন না, একটু এগিয়ে দেখা যাক। এই ভেবে খানিকটা এগোতেই অভিষেক দেখতে পায় একটা পুকুর। একি, এই পুকুরটা তো চোখে পড়েনি আগে! হবে হয়ত অন্ধকারে ঠিক ঠাহর করতে পারেনি। পুকুরের অতল কালো জল যেন ওকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। ও সম্মোহিতের মত এগিয়ে যায়.....
পুকুরপাড়ের ভেজা শ্যাওলার উপর বুটজুতোর পিছলে যাওয়ার দাগ। জলের উপরের স্তরে কয়েকটা বুরবুড়ি কাটে। তারপর মিলিয়ে যায়। মায়ের মূর্তির হাতে ধরা খাঁড়ায় একবিন্দু রক্ত লেগে আছে। চোখদুটো অনেক শান্ত লাগছে এখন, প্রসন্ন দৃষ্টি করালবদনা চামুন্ডার। পুরোহিত এগিয়ে আসে। 'খেয়েছিস মা?' সে প্রশ্ন করে। এরপর ওই পুকুরঘাট, মন্দির, পুরোহিত সব ঢাকা পড়ে যায় এক অসময়ের কুয়াশায়। কুয়াশা সরে গেলে দেখা যায় শুধু আগাছার ঝোপ, আর কিচ্ছু নেই। বছরে একবার এই মহালয়ার আগের রাতে জেগে ওঠেন দেবী এখানে। মনুষ্যরূপী শয়তান রক্তবীজের রক্ত পান করে মা তৃপ্ত হন। রক্তবীজেরও বিরাম নেই, মায়েরও অবকাশ নেই।
'ওঁ হ্লীং ক্লীং চামুন্ডায়ৈ বিচ্চে'। দেবীপক্ষের প্রথম ঊষার আলো তখন সব গ্লানি মুছিয়ে দিচ্ছে ধরিত্রীর কোল থেকে।