সমর্পণ
সমর্পণ
বিদৰ্ভের রাজপ্রাসাদ। রাজকুমারী রুক্মিণী বসে আছেন অলিন্দে। রাত্রিকাল, মৃদুমন্দ বাতাস বইছে। মৃদু জ্যোৎস্নায় স্বল্পালোকিত পরিবেশ। দাসী চুল বেঁধে দিচ্ছে। স্নান সেরে প্রসাধন সমাপ্ত করেছেন রাজকুমারী। হঠাৎ তাঁর কানে ভেসে এল সুমধুর বংশীধ্বনি। তাঁর অন্তরাত্মায় যেন আলোড়ন তুলে দিল এই অপূর্ব বাঁশি। দাসীকে বিদায় দিয়ে অলিন্দ থেকে ঝুঁকে নীচে দেখলেন তিনি। সেখানকার প্রশস্ত চাতালে বসে বংশীধ্বনি করে এক অপূর্ব সুরের মূর্ছনা সৃষ্টি করছেন যিনি, তাঁর অবয়বে একইসাথে কোমলতা ও বীর্যের সমাবেশ। যোদ্ধা আবার শিল্পী। উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ তিনি, পরনে পীতবাস, মুখে একইসাথে প্রজ্ঞা এবং সারল্যের এক অভিনব মেলবন্ধন। রাজকুমারী তাঁর দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে যেন সৎবিৎ ফিরল তাঁর। চোখ খুলে উপরের দিকে চেয়ে মৃদু হাসলেন চকিত কটাক্ষে, আর তা বিদ্ধ হল রুক্মিণীর হৃদয়ে। লাজবনতা হরিণীর মত অক্ষিপল্লব নামিয়ে নিলেন তিনি। পুনরায় চোখ খুলতে দেখলেন সেই রহস্যময় পুরুষ দৃপ্ত ভঙ্গিতে হেঁটে যাচ্ছেন অতিথিশালার দিকে। সেখানে প্রবেশ করতে আর তাঁকে দেখা গেল না। কে এই পুরুষ? রুক্মিণীকে জানতেই হবে।
পরদিন সকাল। বিদৰ্ভের রাজসভায় সাজোসাজো রব। মহারাজ ভীষ্মক এবং মহারাণী সপরিবারে স্বয়ং রাজসভার দরজায় দন্ডায়মান, অতিথিদের স্বাগত জানাতে। যাদবকুলশিরোমণি দুই রাজকুমার এসেছেন বিদৰ্ভের অতিথি হয়ে। সমস্ত আর্যাবর্তের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বীর এই দুই ভ্রাতা। কিছুদিন আগেই মথুরার অত্যাচারী শাসক কংসকে পরাজিত ও বধ করেছেন তাঁরা। কৃষ্ণ ও বলরাম, কেবল মহাবীর নন তাঁরা, মহাজ্ঞানীও বটে। বিদৰ্ভে এসেছেন মৈত্রীর প্রস্তাব নিয়ে। মগধরাজ জরাসন্ধের সামন্তরাজ্য বিদৰ্ভ। এই জরাসন্ধ আরেক পরাক্রমী শাসক ও মহাবীর। তিনি ছিলেন কংসের মিত্র। এই দুই ভ্রাতার সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা সম্ভবত জরাসন্ধের বিনাশ, একথা বুঝেছিলেন ভীষ্মক। তিনি জরাসন্ধের হাতে অনেক লাঞ্ছিত হয়েছেন। মগধের সামন্তরাজ্য হিসাবে বছরে একটি মোটা অঙ্কের রাজস্ব দিতে হয়। তবে তিনি বুদ্ধিমান, সরাসরি মগধের বিরোধিতা করবেন না। কিন্তু কৃষ্ণ ও বলরামের সাথে মিত্রতা বজায় রাখবেন। ওই ওঁরা এসে পড়েছেন অতিথিশালা থেকে। ভীষ্মক এগিয়ে গেলেন।
অচিরেই রুক্মিণী জানতে পারলেন সেই রহস্যময় বংশীবাদকের পরিচয়। তিনি আর কেউ নন, স্বয়ং দ্বারকাধিপতি শ্রীকৃষ্ণ। সভাগৃহে প্রবেশ করার সময় তাঁর দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকালেন যশোদানন্দন। দৃষ্টিতে কৌতুকের আভাস, হাসলেন তিনি। রুক্মিণীও হাসলেন, তাঁর মনপ্রাণ ভরে গেল এক অদ্ভুত ভালোলাগায়। বিষয়টা নজর এড়ালো না মহারাজ ভীষ্মকের। তিনি খুশি হলেন মনে মনে। কন্যার জন্য এঁর চেয়ে উপযুক্ত পাত্র তিনি কোথায় পাবেন?
এরপর সময় এগিয়ে চলল। দ্বারকার সাথে বিদৰ্ভের মৈত্রী স্থাপিত হয়েছে। কৃষ্ণ ও রুক্মিণী তাঁদের হৃদয় পরস্পরকে অর্পণ করেছেন। পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান তাঁদের প্রেমের মূল ভিত্তি। কিন্তু কিছু ব্যক্তি এই ঘটনা ভালোভাবে নিতে পারেনি। রুক্মিণীর ভ্রাতা এবং বিদৰ্ভের জ্যেষ্ঠ রাজকুমার রুক্মি এদের মধ্যে অন্যতম। সে ছিল ধূর্ত ও সুযোগসন্ধানী। চেদিরাজ শিশুপাল, যিনি আবার কৃষ্ণের দূরসম্পর্কের ভ্রাতা, তার সাথে মিত্রতা ছিল রুক্মির। শিশুপাল ছিল নৃশংস, দুরাচারী এবং কৃষ্ণের প্রতি প্রবল শত্রুভাবাপন্ন। কৃষ্ণের বিরুদ্ধে অনেকবার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে সে, যদিও তা সফল হয়নি। স্বাভাবিকভাবেই শিশুপাল ও রুক্মি, জরাসন্ধ ও কংসের মিত্র ছিল। রুক্মি তাই চেদিরাজ শিশুপালের সাথে ভগিনীর বিবাহ দিতে চাইল। এতে মহারাজ ভীষ্মকের মত ছিল না। তিনি চেয়েছিলেন শ্রীকৃষ্ণকে জামাতা রূপে পেতে। কিন্তু তিনি প্রকাশ্যে কিছু বলতে পারছিলেন না, কারণ জরাসন্ধ রুক্মির পক্ষে ছিলেন। ফলে তিনি একপ্রকার বাধ্য হয়েই শিশুপালের সাথে কন্যার বিবাহে রাজি হন।
এদিকে একথা জানতে পেরে রুক্মিণীর দুঃখের সীমা-পরিসীমা রইল না। শিশুপালকে বিবাহ করবার চাইতে তাঁর মৃত্যুবরণ করা ভালো। তিনি শ্রীকৃষ্ণকে পত্র লিখতে বসলেন। তিনি লিখলেন,
( শ্রীকৃষ্ণকে লেখা রুক্মিণীর এই পত্রটি ভারতীয় পুরাণের অন্যতম সেরা এক প্রেমপত্র। এটি ভাগবতপুরাণের ৫২ তম অধ্যায়ের দশম কান্ডে বর্ণিত। মূল সংস্কৃত থেকে ইংরেজিতে তর্জমা করা পত্র থেকে পুনরায় বাংলায় তর্জমা করেছেন লেখক। লেখকের সংস্কৃত জ্ঞানের সীমাবদ্ধতাই এর কারণ। কোনো ভুলত্রুটি থাকলে লেখক ক্ষমাপ্রার্থী। )
হে সর্বজগতের সৌন্দর্য্য,
তোমার গুণাবলী, যা কর্ণ দ্বারা প্রবেশ করে,
দেহের যাতনা জুড়ায়, তা শ্রবণ করে, এবং
তোমার সৌন্দর্যের কথা অবগত হয়ে, যা
সুন্দর দৃশ্যাবলী দেখার বাসনা পরিতৃপ্ত করে,
আমি আমার লজ্জাত্যাগ করে তোমার
শরণ নিয়েছি, হে কৃষ্ণ।
হে মুকুন্দ, বংশ, চরিত্র, সৌন্দর্য্য,
জ্ঞান, যৌবন, সম্পদ ও প্রতিপত্তি
এসবে তোমার তুলনা তুমিই।
হে নৃসিংহ, তুমি সকলকে আনন্দ প্রদান করো।
কোন সুপরিবারের, সুস্থ মস্তিষ্কের, এবং উচ্চকুলজাত রমণী তোমাকে স্বামীরূপে বরণ করবেনা, সঠিক সময় এলে?
তাই হে প্রভু, আমি তোমাকে আমার স্বামীরূপে
স্বীকার করেছি, এবং নিজেকে
তোমার কাছে অর্পণ করেছি।
কৃপা কর, দ্রুত এসো হে সর্বশক্তিমান,
এবং আমাকে তোমার স্ত্রী রূপে গ্রহণ করো।
আমার প্রিয় পদ্মলোচন, শিশুপালকে বিরত করো, তোমার অংশ দখল করা থেকে,
সে এক শৃগাল হয়ে সিংহের সম্পদ
হরণ করতে উদ্যত।
যদি আমি তোমার পূজা করে থাকি,
যদি ধর্মাচরণ, ত্যাগ, দান, আচার এবং
শপথগ্রহণ, এছাড়াও উপদেবতা, ব্রাহ্মণ এবং
গুরুগণের উপাসনা করে কিছু পুণ্যার্জন করে থাকি, তাহলে হে গদাধর, আমার পাণিগ্রহণ করো, দামাঘোষার পুত্র শিশুপাল বা অন্য কেউ
যেন তা করতে না পারে।
আমি যেহেতু প্রাসাদের অভ্যন্তরে থাকব,
তুমি ভাবতে পারো, "তোমার স্বজনদের রক্তপাত না করে তোমায় হরণ করব কিভাবে?" কিন্তু আমি তোমায় উপায় বলছি শোনো:
বিবাহের একদিন পূর্বে রাজবংশের কুলদেবীর
অর্চনার জন্য এক বিরাট শোভাযাত্রা রয়েছে।
এই শোভাযাত্রায় ভাবী বিবাহের পাত্রী শহরের বাইরে গিরিজা দেবীর দর্শনে যান।
হে পদ্মলোচন, ভগবান শিবের মত মহাত্মা তোমার পদ্মের ন্যায় পদযুগলের
চরণধূলি লাভের প্রত্যাশী,
যা অজ্ঞানতা নাশ করে।
যদি আমি তোমার দয়া না পাই,
তবে আমি নিজের জীবনীশক্তি ক্ষীণ করব,
অবিরাম প্রায়শ্চিত্তের মাধ্যমে।
তারপর, হয়ত একশত জন্মের প্রচেষ্টার পর,
তোমার করুণা লাভ করে ধন্য হতে পারি।।
এই পত্র লিখে সুনন্দ নামক এক বিশ্বস্ত ব্রাহ্মণকে ডেকে পাঠালেন রুক্মিণী। তাকে দায়িত্ব দিলেন এই পত্র গোপনে দ্বারকায় শ্রীকৃষ্ণের কাছে পৌঁছে দেবার। এদিকে মহারাজ ভীষ্মক একথা জানতে পারলেন। কিন্তু তিনি চুপ করে থাকার সিদ্ধান্ত নিলেন, কারণ তিনি কৃষ্ণকেই তাঁর জামাতারূপে চাইছিলেন। সুনন্দ যথাসময়ে এই পত্র শ্রীকৃষ্ণকে পৌঁছে দিলেন। পত্রপাঠ শ্রীকৃষ্ণ ও বলরাম বাছাই করা কিছু সৈন্য নিয়ে বিদৰ্ভের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন।
ওদিকে রুক্মিণীর বিবাহ নিকট। শিশুপাল এসে গেছেন বিদৰ্ভে। বিবাহের পূর্বে মন্দিরে পূজার সময় আগত। রুক্মিণী পূজার অর্ঘ্য নিয়ে চলেছেন। তাঁকে একলাই যেতে হবে মন্দিরে, পূজা দিতে। এটিই রীতি। পূজা দেবার সময় তাঁর হাত কাঁপছে, চোখের জল আর বাঁধ মানতে চায় না। কৃষ্ণ কি তবে এলেন না? এমন সময় পূজারী অভয় প্রদান করলেন তাঁকে, রুক্মিণী চমকে উঠে চেয়ে দেখলেন, একী, পূজারী স্বয়ং বলরাম! আর বিগ্রহের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসছেন বাসুদেব কৃষ্ণ। মুখে সেই মনোহর হাসি। গতরাত্রেই তাঁরা এখানে পৌঁছেছেন। গোপনে মন্দিরের পুরোহিতকে অর্থ দ্বারা বশ করে বলরাম তাঁর স্থান দখল করেছেন। তাঁরা মন্দিরেই আত্মগোপন করে রুক্মিণীর অপেক্ষা করছিলেন। দ্রুত বলরাম রুক্মিণীর হাত ভ্রাতা কৃষ্ণের হাতে সমর্পণ করলেন। তারপর মন্দিরের পিছনের দরজা দিয়ে বার হয়ে রথে চড়লেন তাঁরা। সাথে অশ্বারোহী রক্ষীর দল।
দীর্ঘসময় পার হয়ে যেতে রাজকুমারী রুক্মিণীর খোঁজ পড়ল। তাঁর ভ্রাতা রুক্মি মন্দিরের পিছনে রথের চাকার দাগ দেখে সবই বুঝলেন। শিশুপালও জানতে পারলেন এই ঘটনার কথা। রুক্মি বিদৰ্ভের বাছাই করা সেনাদল এবং শিশুপাল জরাসন্ধের পাঠানো সৈন্য নিয়ে তাঁদের পশ্চাদ্ধাবন করলেন। জরাসন্ধ বুঝেছিলেন যে কৃষ্ণ রুক্মিণীকে হরণ করার প্রচেষ্টা করবেন, তাই শিশুপালের সাথে একদল দক্ষ সৈন্য পাঠিয়েছিলেন। প্রথমে শিশুপাল কৃষ্ণ ও বলরামের গতিরোধ করলেন। বলরাম কিছু সৈন্য নিয়ে তাদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হলেন, কৃষ্ণ আর রুক্মিণীকে এগিয়ে যেতে বললেন। কিছুদূর যাওয়ার পর রুক্মি তাঁদের পথ আটকালেন। তাঁর সাথেও একদল দক্ষ সৈন্য। এবার কৃষ্ণ হাতে তুলে নিলেন তাঁর ভয়ংকর শার্ঙ্গ ধনুক। এটি বিষ্ণুর এক দিব্যাস্ত্র, যা বিশ্বকর্মা নির্মাণ করেছিলেন। খাণ্ডবদাহনের সময় অগ্নিদেব কৃষ্ণকে এই ধনুক, সুদর্শন চক্র ও আরো নানা দিব্যাস্ত্র দান করেন। এই শক্তিশালী অস্ত্রের দ্বারা কিছুক্ষণের মধ্যেই রুক্মির সৈন্যদের বিনষ্ট করলেন কৃষ্ণ। কিন্তু রুক্মি তাঁকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান করলেন এবার। অসি নিয়ে এগোলেন তাঁর দিকে। কৃষ্ণ এবার তাঁর নন্দক অসি কোষমুক্ত করে রথ থেকে নেমে অগ্রসর হলেন। এটিও কৃষ্ণের আরেকটি দিব্যাস্ত্র। শুরু হল এক ভয়ংকর অসিযুদ্ধ। দুজনেই দক্ষ অসিযোদ্ধা। কিন্তু কৃষ্ণের অসি এক দিব্যাস্ত্র, যা সাধারণ অসির চেয়ে অনেকগুণ বেশি শক্তিধর। দীর্ঘ যুদ্ধের পর রুক্মিকে পরাজিত করলেন কৃষ্ণ। তাঁর অসি ছিটকে পড়ল দূরে। তিনি পড়লেন ভূমিতে। তাঁকে বধ করতে নন্দক তুললেন কৃষ্ণ, এমন সময় রথ থেকে নেমে এসে, তাঁর হাত চেপে ধরলেন রুক্মিণী। "স্তব্ধ হোন আর্য, নিরস্ত্রকে বধ করবেন না।" রুক্মিণীর এই অনুরোধে সেযাত্রা প্রাণরক্ষা হল রুক্মির, নন্দক অসি কোষবদ্ধ করলেন কৃষ্ণ। ওদিকে শিশুপালকে পরাজিত করে বলরামও এসে পড়েছেন ততক্ষণে। দুই ভ্রাতা মিলিত হয়ে রওনা দিলেন দ্বারকার দিকে, রুক্মিণীকে সাথে নিয়ে। দ্বারকায় পৌঁছে চমৎকার অভ্যর্থনা পেলেন তাঁরা। কৃষ্ণের সাথে রুক্মিণীর বিবাহ সম্পন্ন হল ধুমধামের মাধ্যমে। এভাবে রুক্মিণী হলেন কৃষ্ণের প্রথমা স্ত্রী। ভাগবতপুরাণ অনুযায়ী তিনি আসলে ছিলেন দেবী লক্ষ্মীর অংশজাত। আর কৃষ্ণ, স্বয়ং ভগবান বিষ্ণুর অবতার, তাই তাঁদের প্রেমের জুড়ি মেলা ভার, স্বর্গে কিংবা পৃথিবীতে।
।। তুলাভরম পর্ব ।।
এই পর্যায়ের কাহিনীটি বেশ কয়েকবছর পরে। কৃষ্ণ তখন তাঁর আট পত্নীসহ দ্বারকায় রাজত্ব করছেন। রুক্মিণী তাঁর প্রথমা পত্নী, তাঁর প্রতি কৃষ্ণের প্রেম সর্বাধিক, কিন্তু তাঁর অন্য এক পত্নী সত্যভামা দাবি করতেন যে তিনিই তাঁর স্বামীর সর্বাধিক ভালোবাসার পাত্রী। এইসময় একদিন দেবর্ষি নারদ এলেন দ্বারকায়। তিনি সত্যভামার মনের ভাব বুঝলেন এবং তাঁকে শিক্ষা দিতে চাইলেন। তিনি সত্যভামাকে বললেন উনি ভুল করছেন, শ্রীকৃষ্ণ রুক্মিণীকেই অধিক ভালোবাসেন। সত্যভামা এর তীব্র বিরোধিতা করলেন। তখন নারদ তাঁকে এক ব্রত করে কৃষ্ণের প্রতি তাঁর ভালোবাসার প্রমাণ দিতে বললেন। এই ব্রতই তুলাভরম ব্রত নামে পরিচিত। এই ব্রত অনুসারে, কৃষ্ণকে বাজি রাখবেন সত্যভামা, নারদের কাছে। কৃষ্ণ হবেন তাঁর ক্রীতদাস। তাঁকে মুক্ত করতে হলে সত্যভামাকে তাঁর সমান ওজনের সম্পদ দেবর্ষিকে দিতে হবে। সত্যভামা সহজেই রাজি হলেন। তাঁর যা সম্পদ তাতে তিনি অনায়াসেই তাঁর স্বামীর সমান ওজনের সোনা দিতে পারেন। কৃষ্ণকে জানানো হলে, কৃষ্ণ আনন্দের সঙ্গে এই ব্রতে অংশগ্রহণ করতে রাজি হলেন, সম্ভবত এটির পরিকল্পনা তাঁরই মস্তিষ্কপ্রসূত। কারণ তিনি স্বভাবচপল, এবং চিরন্তন বালকস্বভাব। যাইহোক, যথাসময়ে সত্যভামা একটি প্রমাণ আকারের তুলাযন্ত্রের ব্যবস্থা করলেন। তার একদিকের পাল্লায় শ্রীকৃষ্ণ উঠে বসলেন। অন্য দিকের পাল্লায় সত্যভামা একে একে তাঁর সমস্ত গয়না চাপাতে লাগলেন, কিন্তু কৃষ্ণের দিকেই সেই পাল্লা ক্রমাগত ঝুঁকে রইল। তাঁর সমস্ত গয়না চাপিয়েও পাল্লা একচুলও নড়ল না। কৃষ্ণ যেন খুব আমোদ পেয়েছেন, মৃদু মৃদু হাসছেন। এবার নারদ মুনি সত্যভামাকে ভয় দেখালেন, এক্ষুণি কৃষ্ণের সমান ওজনের সম্পদ না দিলে তিনি কৃষ্ণকে দাস করে নিয়ে যাবেন। সন্ত্রস্ত হয়ে সত্যভামা রুক্মিণী বাদে কৃষ্ণের অন্যান্য স্ত্রীদের কাছে ছুটে গেলেন, তাঁরা সবাই তাঁদের গয়না দিলেন। সেগুলির সম্মিলিত ওজনও কৃষ্ণের ওজনের কাছে যেন পালকের ন্যায় হালকা বোধ হতে লাগল। পাল্লা কৃষ্ণের দিকেই ঝুঁকে রইল। এবার নারদ সত্যভামাকে বললেন গর্ব ত্যাগ করে রুক্মিণীর কাছে যেতে, একমাত্র তিনিই পারেন কৃষ্ণের সমান ওজনের সম্পদ দিতে। ফলে সত্যভামা রুক্মিণীর কাছে গেলেন নিরুপায় হয়ে। গর্ব ত্যাগ করে তাঁর কাছে প্রার্থনা করলেন। তখন রুক্মিণী এলেন। তিনি এসে প্রথমেই গয়নাগুলি নামিয়ে রাখলেন। তারপর স্বামীর উদ্দেশ্যে প্রার্থনা করে তুলার বিপরীত প্রান্তে একটিমাত্র তুলসীর পত্র রাখলেন। আশ্চর্য! মুহূর্তের মধ্যে তুলার সেইদিক এত ভারী হয়ে গেল, যে তা কৃষ্ণ যেদিকে বসে আছেন তার থেকেও অধিক নুয়ে পড়ল। ফলে কৃষ্ণ পণমুক্ত হলেন।
এই গল্পটি রূপক। এর মাধ্যমে এটাই বোঝানো হয়েছে যে সমর্পণ ও নিঃশর্ত প্রেম যেকোনো পার্থিব সম্পদের চেয়ে অধিক মূল্যবান, এমনকি তার গুরুত্ব স্বয়ং ঈশ্বরের চেয়েও বেশি। সেই মহান শক্তির কাছে আমাদের মাথা নত করতেই হয়, যখন দেখি তিনি কত বৃহৎ, সমগ্র মহাবিশ্বে তাঁর প্রকাশ, আবার তিনি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র, পরমাণুর অভ্যন্তরেও নিত্য তাঁর লীলা। সেই বিরাট মহাশক্তিকে প্রণাম, যিনি একইসাথে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র রূপ ধারণ করেছেন, সর্বব্যাপী তাঁর উপস্থিতি।
" নভোস্পৃশং দীপ্তমনেকবর্ণং
ব্যাত্তাননং দীপ্তবিশালনেত্রম্।
দৃষ্ট্বা হি তাং প্রব্যথিতান্তরাত্মা
ধৃতিং ন বিন্দামি শমং চ বিষ্ণো।।"
( হে বিষ্ণু, তোমার আকাশষ্পর্শী, তেজোময়, বিবিধ বর্ণযুক্ত, বিস্তৃত মুখমন্ডল ও উজ্জ্বল আয়ত চক্ষুবিশিষ্ট তোমাকে দেখে আমার হৃদয় ব্যথিত হচ্ছে এবং আমি ধৈর্য্য ও শান্তি অবলম্বন করতে পারছি না। )
--------- গীতা, বিশ্বরূপ দর্শন করে অর্জুনের উক্তি।
।। শ্রী শ্রী হরি সহায়।।
তথ্যসূত্র: মূল গল্প- উইকিপিডিয়া ও রাজশেখর বসুর মহাভারত।
রুক্মিণীর কৃষ্ণকে লেখা পত্রের ইংরেজি তর্জমা, যা লেখক পুনরায় বাংলায় তর্জমা করেছেন, তার উৎস- vedicfeed.com