শুধু তোমারই জন্য
শুধু তোমারই জন্য
ফোনটা আবার বেজে ওঠায় এবারে বেশ বিরক্তই হল রক্তিমা, একেই ব্যস্ত দিন। হেড অফিস থেকে লোকজন আসবে বলে সকলে খুব ব্যস্ত। কতো আর বসের নজর এড়িয়ে কথা বলা যায়। এই নিয়ে বেশ কয়েকবার ফোন এলো বাড়ি থেকে।।
উত্তর কোলকাতার রক্ষণশীল বাড়ির বড়ো মেয়ে রক্তিমা। তাই নজরদারি বরাবরই ছিল। তায় আবার এখন পাত্র দেখার প্রস্তুতি চলছে জোর কদমে। বিশাল সোনার দোকানের মালিক তার পিতা বুঝেই উঠতে পারেননা যে, সব কিছু থাকা সত্ত্বেও তার কাজ করার কি দরকার? মাঝে মাঝে এতো বড়ো বাড়িতে নিজেকে অন্য গ্রহের প্রাণী মনে হয় রক্তিমার।চার ভাইবোনের মধ্যে একমাত্র সবথেকে ছোট ভাইটাই বোধহয় তাকে একটু বোঝে।
নিজের খেয়ালে ডুবে গিয়েছিল হঠাৎ বসের ডাকে নিজের ছন্দ ফিরে পায় রক্তিমা।
''কি হল?আজ যেন তোমায় কেমন অন্যরকম লাগছে৷ শরীর ভাল তো?'' অপ্রস্তুত রক্তিমা৷
''হ্যাঁ হ্যাঁ স্যার, একদম ঠিক আছি আমি,আসলে মাথাটা একটু ধরেছে তো তাই।''বস নিজের ঘরের দিকে ফেরাতে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো সে।।
মুখুজ্যেবাড়ির বড়ো কন্যা রক্তিমা মুখার্জীর সাথে বিদেশফেরত ডক্টর ঋদ্ধিমান ব্যানার্জীর শুভ পরিণয় ঘটানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন তার পিতা, তাই এতো ফোনের ঘনঘটা। রক্ষণশীল বাড়ির কন্যা হওয়া সত্ত্বেও কোথাও ছোটবেলা থেকেই রক্তিমা একটু প্রতিবাদী ধরণের। তাই বাবার গাড়িতে যাতায়াতের প্রস্তাবকে বাতিল করার সাথে সাথেই যাকে দেখেনি শোনেনি তার সাথে বিয়ে,এটা মেনে নিতেও তার খুব অসুবিধা হয়। ছোট ভাই আয়ুষ দিদিকে আরো চটিয়ে দিয়ে বলে,''ভালোই হয়েছে একদিকে,তোর মাথার ব্যামোটাও উনি একবারেই দেখে নেবেন খন৷''
নিজের ভাবনায় ডুবে গিয়ে রক্তিমা দেখতেই পায়নি কখন হেড অফিসের লোকজন এসে গেছে। তাই পাশের কেবিনের আঁখির কথায় চমকে উঠল।''কিরে,কোন জগতে আছিস তুই? প্রেজেন্টেশনটা রেডি তো? বসের ঘরে এখুনি ডাক পড়বে যে।''
ঠিকই তো। মনে মনে ডক্টরবাবুকে দুটো গাল পেড়ে নিজেকে চটপট গুছিয়ে নেয় রক্তিমা।
কাজ শেষ হতে হতে সেদিন বেশ রাত হল। টানা বাসটা পেয়ে যাওয়াতে বেশ সুবিধাই হল তার। প্রায় পাড়ার কাছাকাছি এসে পড়েছে;হঠাৎ এক জায়গায় মস্ত এক জটলা দেখতে পেল। কিছু না বুঝতে পেরে ভিড় ঠেলে সামনে এগোতেই....
একি!! এ তো আয়ুষ, তার ছোট্ট ভাই। রক্তে লতপত দেহটা রাস্তায় অচেতন অবস্থায় পড়ে আছে।ধুকপুক করে সাড়া দিচ্ছে তার হৃদয়,আর বাকি মানুষগুলো যেন মজা দেখছে।
না না, সকলে না,শুধু একজন বছর বত্রিশের এক সুঠাম সুপুরুষ মানুষ অস্থির চিৎকার করছেন আয়ুষকে টেনে তোলার চেষ্টা করতে করতে....
''প্লিজ কেউ একটু দয়া করে আমার সাথে ধরুন,সাহায্য করুন আমায়,ওকে যে এখুনি হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।''
রক্তিমা যেন প্রস্তরমূর্তি। নিজের চোখকে নিজেই বিশ্বাস করতে পারছেনা। দুজন লোকের সাহায্যে ভদ্রলোক আয়ুষকে ধরে নিয়ে গেলেন তাঁর গাড়ির দিকে৷আর থাকতে পারলোনা রক্তিমা,ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল৷
''ও আমার ভাই,আমিও যাব আপনার সাথে৷''
হতভম্ব ডক্টর ঋদ্ধিমান ব্যানার্জি অবাক নয়নে তাকান তার দিকে। তারপর আর কালক্ষেপ না করে গাড়িতে উঠে রওনা হয়ে পড়েন তাঁরা।
কিছুক্ষণেই হাসপাতালে হাজির হয় রক্তিমার বাড়ির সকলে। রাস্তা পার হওয়ার সময় ট্রাক ধাক্কা মারে আয়ুষকে। ঠিক সময়ে ব্রেক কষতে পেরেছিল ড্রাইভার,নয়তো তাকে বাঁচানোই যেতোনা।
বাবাকে দেখতেই রক্তিমা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। অংশুমানবাবুর চোখ কিন্তু অন্যদিকে৷
''সেকি!ঋদ্ধিমান তুমি এখানে?'' ঋদ্ধিমানও স্তম্ভিত৷
''ও আপনার ছেলে? আমি আসছিলাম,হঠাৎ দেখলাম এই অবস্থায় পড়ে আছে। ভাবতেই পারিনি এভাবে আপনাদের সাথে দেখা হবে।''
রক্তিমার মনে পড়ে গেল ঋদ্ধিমানের বাবা মা তাকে দেখতে এসেছিলেন যাদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরে যারপরনাই বিরক্ত হয়েছিল সে। কিন্তু তার চোখে তখন যে এক অন্য আলো,সামনে একজন ছাড়া আর সবকিছুই ঝাপসা। শুধু একটাই স্বর কানে ভাসছে..''ওকে যে এখনি হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে,আপনারা কেউ দয়া করে ধরুন৷''
এরপর আর কিছু ভাবতে পারেনা সে। চোখের জলে ঝাপসা হয়ে যায় সবকিছু।।
#positiveindia