Aayan Das

Drama Crime

2.2  

Aayan Das

Drama Crime

শেষ অঙ্ক

শেষ অঙ্ক

5 mins
9.8K


বাড়িতে ঢোকার মুখে লাল রঙের অল্টো ৮০০ টা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেই থমকে গেল সুকোমল।তার বুক থেকে বড় একটা দীর্ঘশ্বাস হাহাকারের মত বেরিয়ে এল।আর সেই সঙ্গে একটা তীব্র অসহায় রাগ তাকে আপাদমস্তক ঝাঁকিয়ে দিল।সুকোমল বাড়িতে না ঢুকে মোড়ের চায়ের দোকানে বসে ঝিমোতে লাগল।

সুকোমল জানে এই গাড়িটি রাহুলের।রাহুল সুকোমলের স্ত্রী তানিয়ার নতুন প্রেমিক।এর আগেও তানিয়ার একজন প্রেমিক ছিল।শেষকালে ভদ্রলোকের স্ত্রী ব্যাপারটা জেনে যাওয়ায় সম্পর্কটা কেঁচে যায়।মাঝখানে তানিয়া অত্যন্ত মনমরা হয়ে ছিল।তারপর সম্প্রতি সে এই সুদর্শন ব্যাবসায়ী পুরুষটিকে পাকড়েছে।এছাড়াও তার ছুটকো ছাটকা বেশ কয়েকজন পুরুষ বন্ধু আছে।তানিয়া এখন সারাদিন বেশ টগবগে মুডে থাকে।

সুকোমলের সেই দিনটার কথা আজও মনে আছে।সেদিন তার যাওয়ার কথা ছিল উলুবেড়িয়া।কিন্তু তুমুল বৃষ্টিতে জল জমে রাস্তা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সে দুপুরে বাড়ি ফিরে এসেছিল।তাকে দেখে তানিয়া আঁতকে উঠে বলেছিল,''-তু..তুমি..এখন?''

সুকোমল দেখেছিল তাদের সোফার উপর জিনস্, টি সার্ট পরে বসে সিগারেট ধরিয়েছে এক বছর পঁয়ত্রিশের সুদর্শন যুবক।

তাকে দেখেও লোকটির ভয় পাওয়ার কোনো লক্ষন দেখা গেল না।কিছু পুরুষের নেশা থাকে অন্যের স্ত্রী র সঙ্গে প্রেম করা।এও হয়তো সেরকম।

তানিয়া গলায় অতিরিক্ত উচ্ছাস এনে বলল,''-চিনতে পারলে না? ফুলদা গো,রাঙামাসির সেজোছেলে,মনে নেই বিয়ের সময় পিঁড়ি ধরেছিল!কতদিন পরে ফেসবুকে খুঁজে পেলাম।''

লোকটি উঠে দাঁড়িয়ে সুকোমলের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করে বলল,''-হাই,আমি রাহুল।''

সুকোমলের স্মৃতিশক্তি অত্যন্ত প্রখর।যারা পিঁড়ি ধরেছিল তাদের মুখগুলো এখনও স্পষ্ট মনে আছে।না,এই লোকটি ছিলনা।

সে তবুও বোকা সেজে বলল,''-ও, হ্যাঁ হ্যাঁ, মনে পড়েছে।''

সুকোমলের এই এক দোষ।সে কিছুতেই মুখের উপর স্পষ্ট কথা বলতে পারেনা।

কিছু কিছু মানুষ কে গড়ার সময় ভগবান বড্ড খারাপ মুডে থাকেন।সুকোমল ও নিজেকে সেই দলে ফেলে।সুকোমলের হাইট মাত্র পাঁচফুট চার,মাথার পিছনদিকে সামান্য কয়েকগাছা চুল।সে অতি ক্ষীনজীবী।বছরের বেশির ভাগ সময় সে পেটের অসুখে ভোগে।তার একটুতেই ঠান্ডা লেগে যায়।সে একসময় মেসে থাকতো।সেইসময় স্নান করে উঠে সে যখন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াতো তখন তার থেকে লম্বা কোনো ছেলে ঠিক তার পিছনে দাঁড়িয়ে চুল ঠিক করত,শুধুমাত্র এইটা বোঝানোর জন্য যে সুকোমল অত্যন্ত বেঁটে।সে যে অন্য সকলের চেয়ে কম শক্তিশালী এইটা বোঝানোই ছিল সবার উদ্দেশ্য।অথচ এই ছোটো হাইট নিয়েই পৃথিবী কাঁপিয়ে দিয়েছেন শচীন তেন্ডুলকর বা গাভাসকার,মারাদোনা বা জ্যোতি বসু।

ছোটোবেলা থেকে অন্যের উপহাসের পাত্র হতে হতে সুকোমলের ব্যক্তিত্ত্বটাই নষ্ট হয়ে গেছে।

মা বলতেন চেহারা কী কারো হাতে আছে রে বাবা,তুই ওসব নিয়ে ভাবিসনা।কিন্তু সুকোমলের বড় কষ্ট হয়,সে যদি আরো একটু লম্বা হত,আরো একটু মেধাবি হত,আরো একটু শক্তিশালী হত তাহলে,...

সুকোমলের অনেককিছু না পাওয়া জীবনে একটাই অহঙ্কারের জায়গা।তার স্ত্রী তানিয়া একেবারে মারকাটারি সুন্দরী।সে এমন সুন্দরী মেয়েকে বউ হিসেবে পাবে-এ ভাবতেই পারেনি।কিন্তু কোনো সুন্দরী মেয়ে যদি মুখরা আর দুশ্চরিত্রা হয়, তাহলে তাকে নিয়ে ঘর করা যে নরক যন্ত্রনার থেকেও দুঃসহ তা এতদিনে সুকোমলের বোঝা হয়ে গেছে।তানিয়ার বিরূদ্ধে সামান্য আওয়াজ তুললেই তানিয়া একেবারে ছেলেদের ভাষায় গালাগাল দিতে শুরু করে।ঝগড়ার মুহূর্তে তানিয়া অত্যন্ত নোংরা ভাষায় সুকোমলের পুরুষত্বকে কটাক্ষ করে।সুকোমল স্ত্রী কে যমের মত ভয় পায়।অথচ এখন তাদের ছেলে ছোটো।ডিভোর্স করলে লোক হাসাহাসি হবে,ছেলেটাও বড্ড কষ্ট পাবে।তাছাড়া তানিয়ার বাপেরবাড়ি যথেষ্ট ইনফ্লুয়েন্সিয়াল।ওরা সুকোমলকে পথে বসিয়ে দিতে পারে।সব ভেবেচিন্তে সুকোমল মুখ বুজে সব কিছু সহ্য করে।

চায়ের দোকানে বসে বেশ কয়েক কাপ চা আর সিগারেটের শ্রাদ্ধ করে সুকোমল বাড়ির দিকে রওনা দিল।শরীর আর চলছেনা।এই কী বেঁচে থাকা!ঠিক যেন একটা জিন্দা লাশ হয়ে সে বেঁচে রয়েছে।সমস্ত জায়গাতেই সে যেন একটা ফালতু,একটা এলেবেলে।তাদের অফিসের বড়বাবুর নাম সুকমল।তার সাংঘাতিক হাঁকডাক।তার ভয়ে সবাই তটস্থ হয়ে থাকে।শুধুমাত্র সেই লোকটির জন্য অফিসে সবাই তাকে ডাকে সুকমল নাম্বার টু,আস্তে আস্তে অপভ্রংশ হতে হতে সে হয়ে গেছে নাম্বার টু।প্রায় একই নাম হওয়ায় বড়সাহেবের যেন তার উপর জাতক্রোধ।কথায় কথায় তাকে হেনস্থা করে লোকটা এক বিকৃত আনন্দ পায়।

সুকোমল কলিং বেল টিপল।তার ফিরতে ফিরতে রাত হয়।আজ শরীরটা আর দিচ্ছিলনা বলে সে দুপুরে ফিরেছে।তানিয়া আলুথালু চুলে দরজা খুলে খানিকটা চমকে উঠল।যদিও সে জানে সুকোমল কোন প্রশ্ন করবেনা।তানিয়া বেশ ঘেমে নেয়ে গেছে।খালিগায়ে সোফায় বসে সিগারেট ধরিয়েছে রাহুল।বোঝাই যাচ্ছে একটু আগেই তারা ঘনিষ্ট হয়েছিল।

সুকোমলের হঠাৎ ইচ্ছা হল সামনে বসে থাকা পুরুষটির গলা টিপে ধরে।সেইসঙ্গে তানিয়ারও।

''কী মশায়,গঙ্গাবক্ষে নৌকা বিহার কেমন লাগছে?'' জড়ানো গলায় বলল রাহুল।রাহুল, তানিয়া, সুকোমল আর তাদের ছেলে একটা বড় নৌকা ভাড়া করে বেড়াতে বেরিয়েছে গঙ্গার বুকে।আজ সারাদিন তারা ভেসে বেড়াবে গঙ্গায়।তানিয়ার বহুদিনের শখ ছিল গঙ্গার বুকে ভেসে বেড়ানোর।প্রচুর টাকা ভাড়া বলে সুকোমলের সামর্থে কুলোয়নি।অবশেষে রাহুল প্রেমিকের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করেছে।সুকোমলকে নিয়ে আসার ব্যাপারে তানিয়ার প্রথমে আপত্তি ছিল।হাজার হলেও সুকোমল তার বিয়ে করা বর।সব শুনে রাহুল ই বলল,''-চলুক না,ও তো কোনো ডিসটার্ব করেনা বরং সঙ্গে থাকলে ফাইফরমাস খাটতে পারবে,ছেলেটাকেও দেখতে পারবে।নিয়ে চলো,নিয়ে চলো।''

শীত পড়েছে জাঁকিয়ে।তুমুল বেগে বইছে উত্তরে হাওয়া।রাহুল নৌকায় ওঠার পর থেকে বোতল খুলে বসেছে।তানিয়াও রাহুলের অনুরোধে মাঝে মাঝে দু এক চুমুক দিচ্ছে।সুকোমল মদ খায়না।একবার অফিস পিকনিকে কলিগরা তাকে জোর করে অনেকখানি মদ খাইয়ে চূড়ান্ত নাকাল করেছিল।তারপর থেকে মদে তার ভয় ধরে গেছে।

রাহুলের বেশ নেশা হয়ে গেছে।নেশার ঘোরে সে মাঝিদের গালাগাল দিতে শুরু করেছে।

তানিয়ার মনে আজ বড় আনন্দ।বহুদিন বাদে তার স্বপ্ন সফল হয়েছে।তানিয়া মনের আনন্দে গান শুরু করল-'হামে তুমসে প্যার কিতনা ও হাম নেহি জানতে,মগর জি নেহি সকতি তুমহারে বিনা'...তানিয়া রাহুলের দিকে তাকিয়েই গানটি করছিল,দুজনেই দুজনের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছিল ।একটু দুরে ছেলেকে কোলে নিয়ে বসেছিল সুকোমল হঠাৎ রাহুলের কি মনে হল সে তানিয়াকে এক ঝটকায় নিজের কোলের মধ্যে টেনে নিয়ে জাপটে ধরল৷

তানিয়া খানিকটা লজ্জা পেয়ে বলল,'-আ আ আ..ছাআআআড়ো, কী হচ্ছে কী?অসভ্য কোথাকার!''

ঘটনার আকস্মিকতায় সুকোমল ও বেশ চমকে গেছে,প্রবীন মাঝি ও তার দশ বছরের ছেলেটিও হাসতে শুরু করেছে৷

রাহুল জড়ানো গলায় বলল,''-না না, ছাড়বোনা,আজ কিছুতেই ছাড়বনা,এই নৌকাতেই তোমাকে খাব৷''

তারপর সুকোমলের দিকে তাকিয়ে বিরক্তির সঙ্গে বলল,''-আঃ!আপনিতো মশায় বড় বেরসিক,দেখছেন আমি ওকে আদর করছি তাও ড্যাবড্যাব করে এদিকে তাকিয়ে আছেন?যান ওদিকে গিয়ে অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে বসুন!''

কোন কথা যে কার মনের তন্ত্রীতে কখন আগুন জ্বালিয়ে দেয় তা কেউ বলতে পারেনা।রাহুল যে তানিয়ার প্রেমিক এবং তাদের মধ্যে যে শারীরিক সম্পর্ক আছে তা সুকোমল বিলক্ষন জানে।অথচ স্ত্রীর প্রেমিকের এই হুকুম সুকোমলের সমস্ত শরীরে দাবানলের আগুন জ্বালিয়ে দিল।

সুকোমলের হঠাৎ মনে হল সে যেন আর জীবিত নেই,বহুদিন আগেই তার মৃত্যু হয়ে গেছে।এই রক্তমাংসের শরীরটা আসলে একটা জ্যান্ত লাশ।কী লাভ এই লাশ কে বয়ে বেড়ানোর? একটি বদ্ধ ঘরে নিরীহ কোনো বেড়াল কে তাড়া করলে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে বেড়ালটি যেমন দাঁত নখ বের করে তার চেয়ে দশগুন শক্তিশালী কোনো মানুষের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে ছিন্নভিন্ন করে দেয়, ঠিক সেইরকমভাবে সুকোমল ঝাঁপিয়ে পড়ল রাহুলের উপর।সুকোমলের দুই হাত আষ্টেপৃষ্ঠে চেপে ধরেছে রাহুলের গলা।নেশার ঘোরে রাহুলের শরীর এখন অবসন্ন।তানিয়া প্রাণপনে তার স্বামীকে সরানোর চেষ্টা করছে।সুকোমলের মনে পড়ল তার এক মেডিকেল রিপ্রেসেন্টেটিভ বন্ধু তাকে বলেছিল মানুষের গলার উঁচু হয়ে থাকা হাড়টার নাম অ্যাডামস অ্যাপল,ওখানে একটু জোরে চাপ দিলেই...

সুকোমল তার ডানহাতের বুড়ো আঙুল দিয়ে সজোরে চাপ দিল নেশাগ্রস্ত বলশালী পুরুষটির গলায়।তার শরীরে এখন একশো পশুর শক্তি।মাত্র কয়েকটা সেকেন্ড,তারপর নিথর হয়ে গেল রাহুলের শরীরটা।

রাহুলকে খুন করে সুকোমল এবার তানিয়ার দিকে ফিরল।তার দুচোখ দিয়ে আগুনের হলকা বেরোচ্ছে।তার চোখ এখন অনেকগুলো মুখ কে খুঁজছে,সেই লম্বা ছেলেগুলো,তাদের অফিসের বড়সাহেব,তাকে অপদস্থ করা কলিগরা,তানিয়ার আগের প্রেমিক,আর..আর..তানিয়া,

সুকোমল জেনে গেছে মানুষ কে খুন করা বড্ড সোজা কাজ।

সুকোমলের হাত তানিয়ার দিকে এগিয়ে আসতেই তানিয়া সুকোমলের পা জড়িয়ে ধরে কাকুতি মিনতি করতে লাগল-''আমাকে মেরোনা,প্লিজ আমাকে মেরোনা.....''

সুকোমলের হঠাৎ এক অদ্ভুত আনন্দ হল।জীবনে এই প্রথম কেউ তাকে ভয় পাচ্ছে,

সুকোমল অট্টহাস্য করে উঠল।সে বুঝে গেছে জীবনের সারসত্য।

এইবার সে নতুন ভাবে বাঁচবে,এইবার তার বেঁচে থাকা শুরু হবে।

অয়ন দাস।৪/৪/১৭


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama