Sandipa Sarkar

Drama

3  

Sandipa Sarkar

Drama

শৈশবের সে দিন

শৈশবের সে দিন

5 mins
1.5K


"কি হল ঝিলমিল উঠে এসো,পুকুরের জলে পা ডুবিয়ে বসে আছো।আর মা আপনিও দেখছেন না কিভাবে নোংরা পুকুরের জলে পা ডুবিয়ে বসে আছে"!

"আরে বৌমা কিচ্ছু হবে না।ছোটবেলায় আমরা কত এই পুকুরে স্নান করেছি।খেলা করেছি।মাছ ধরেছি,পানিফল,পদ্ম তুলেছি,কই আমাদের তো কিছু হয়নি?আমার দিদিভাইয়েরও কিছু হবে না"।


আপনাদের সময় ভুলে যান।তখন কিছু হয়নি বলে আজও হবে না,এটা ভাবার কারন নেই,সে যুগ আর এ যুগ"!

বলে মেয়েকে নিয়ে চলে যেতে বনলতাদেবী বৌমার উক্তি শুনে মনে মনে ভাবলেন "সত্যি তাই সে যুগ আর এই যুগ।আকাশ পাতাল তফাৎ।আমাদের যুগে ছিলো আসল বন্ধুত্ব,আর এই যুগে বন্ধু বন্ধুকে খুন করে ফেলছে"


(২)


"এই দেখ সাপ ছুটি"

"ওরে বাবারে ফেল না এটাকে" বলে ভ্যাঁ-এ-এ করে কেঁদে ফেলল ছুটি।

"এই ছুটি চোখ খোল,কাঁদছিস কেন?দেখ তো টেঁপি, কি ভীতু মেয়ে দেখ শোলমাছটাকে সাপ বলেছি তাই কাঁদছে।আর কাঁদিস না,চল চল সাঁতার কাটি"।


"কিরে বনলতা পুকুরে পা ডুবিয়ে বসে,আজ ইস্কুলে যাবি না"?

"যাবো রে টেঁপি,এই নে দুখান পেয়ারা ইস্কুলে গিয়ে খাস"।

"তুই রোজ আমাকে পেয়ারা দিয়ে অভ্যাসটা খারাপ করে দিচ্ছিস রে,তোর জন্য তাও টিফিনটা রোজ জোটে"।

"বাঃরে, আমি খাবো আর তুই খাবিনা এ আবার হয় নাকি রে?চল চল এবার ইস্কুল যাওয়া যাক"।

"এতোক্ষনে দুজনের বেণী দুলিয়ে ইস্কুলে আসা হলো"?

"এই নে ছুটি পেয়ারা,টিফিনে আজ এই খেয়ে থাক তোরা দুজন"।

ঢং ঢং ঢং...."ছু-টি-ই কি মজা একমাস গরমের ছুটি আমাদের।শোন বনলতা এবার তোর পুতুল ছেলের সাথে আমার পুতুল মেয়ের বিয়েটা দিতে হবে"।

"দেবোরে,দেবো,মাকে বলে ভালো দিনক্ষন দেখে বিয়ে দেবো"।

কদিন পর ওদের ছেলে- মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়ে গেলো।২৮ জৈষ্ঠ বিকেল চার ঘটিকায়।

"উলু-উলু-উলু......লাজে রাঙা হলো কনে বৌ গো,মালা বদল হবে এই রাতে".....না পুতুলের বিয়ে ছিলো না সেদিন,বিয়ে ছিলো ছুটির।ছোট্ট মেয়েটা শ্বশুড়বাড়ি যাওয়ার সময় ছেলে পুতুলটাকে আঁকড়ে ধরে রেখেছে কিছুতেই দেবেনা কাউকে।সবাই রেখে দিতে বলছে হাতের পুতুলটা এমন সময় ছুটির সাথে থাকা একজন বয়স্ক মত লোক ওর হাত থেকে পুতুলটা কেড়ে নিয়ে ছুড়ে ফেলে দিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়া ছুটিকে টেনে নিয়ে চলে গেলো ছেলে পুতুলটাকে মারিয়ে।ছেলে পুতুলটা প্যাঁক প্যাঁক শব্দে যতটা প্রতিবাদ করলো বাকীরা তার এক কণাও কথাবলা মানুষগুলো করলো না।বনলতা দৌড়ে গিয়ে ছেলে পুতুলটাকে কোলে তুলে নিয়ে বাড়ি গিয়ে ওর মায়ের কাছে সব বলতে ওর মাও বনলতাকে বললেন "ছিঃ,এমন বলে না।উনি ছুটির গুরুজন,স্বামী হন,ওঁর কথা অমান্য করলে ভগবান পাপ দেবেন।স্বামী যে মেয়েদের কাছে দেবতা হন"! কথাটা বলেই বনলতা দেখছে ওঁর মা নিজের হাতের শাঁখা-পলা-নোয়াটা মাথায় ঠেকিয়ে প্রনাম করে নিলেন।বনলতা ভাবছে এ আবার কি পাষন্ড দেবতা?দেবতা বুঝি এমন হন?দিয়ে খেলনা বাক্স থেকে মেয়ে পুতুলটাকে বের করে বলতে লাগলো "তোকে আমি কখনই এখন বিয়ে দেবো না,আগে ইস্কুল পাশ করবি তারপর বিয়ে,বুঝলি"?

 ছুটির বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর এখন বনলতার অন্তরঙ্গ বন্ধু বলতে টেঁপি।গাছে ওঠা,সাঁতার কাটা সব একবছরের মধ্যে বনলতার বন্ধ হয়ে গেল ঋতুমতি হওয়ার পর।টেঁপিও একদিন বিয়ে হয়ে চলে গেলো।বনলতা এখন একা স্কুলে যায়।মনমরা হয়ে গেছে সে।মনের কথা বলার মত এই দুই বান্ধবীই ছিলো ওর।ক্লাস নাইনে উঠলো বনলতা।একদিন স্কুল যাচ্ছে সেদিন ওর মা বললেন আজ আর স্কুল যেতে হবে না।আজ ছেলের বাড়ি ওকে দেখতে আসবে।বিয়ের কথা শুনেই মনটা ওর ধরাস করে উঠলো।ওর কপালেও বুড়ো বর জুটবে এবার ভেবে।কিন্তু না!যখন পাত্র দেখলো ওর দেখে রাজপুত্র মনে হচ্ছিল।ছেলে কলকাতার ব্যারিস্টার।ওর ও বিয়ে হয়ে গেলো।সব ঠিক থাকলেও বই গুলো ওকে খুব টানে।বনলতার ব্ন্ধু ওর মেয়ে পুতুলটা এখন।ওকে চুপিচুপি ব্যাগে করে নিয়ে এসেছে শ্বশুড়বাড়ি।বর যখন ঘরে থাকে না সেটাকে ব্যাগ থেকে বের করে মনের কথা বলে।এমনই একদিন মনের কথা বলছিলো পেছন থেকে বর সব শুনে হাতটা ধরে বললো "আমি তোমার বন্ধু হতে পারি?এতো শুধু শোনে কিছু করতে বা বলতে তো পারে না।আমাকে মনের কথাগুলো বলো দেখি কতদূর কি করতে পারি"!

"আমাকে পড়াবেন? ইস্কুল ফাইনাল পাশ দেওয়ার খুব শখ"।


বনলতার শুরু হলো নতুন জীবন সে ধাপে ধাপে অনেক দূর গিয়ে গ্র‍্যাজুয়েট হলো,বরের সাহায্যে।তার জন্য অবশ্য অনেক কাঠ খর পোড়াতে হয়েছিলো ওর বরকে।বাড়ির বিরুদ্ধে গিয়ে সব করেছিলো।তারপর ছেলে-মেয়ে হলো।নতুন অধ্যায় জীবনের।দেখতে দেখতে তারাও বড় হলো ওদেরও বিয়ে হলো।একদিন বনলতার সবচেয়ে কাছের বন্ধুটিও ফাঁকি দিয়ে চলে গেলেন।ভাবনার পাখায় ভর দিয়ে বনলতা চলে গেছিলো নিজের ছোটবেলায়।না জানে ছুটির কথা না টেঁপির কথা।এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ বনলতার চোখটা কে পেছন থেকে চেপে ধরলো।মনে ভাবলো এ নাতনীটারই দুষ্টুমি।

"দিদিভাই ছাড়ো,চল আমরা বাড়ি গিয়ে স্নান করি"।

শুনতে পেল চেনা একটা কন্ঠস্বর "বলতো আমি কে"?


খুব চেনা গলা হলেও ও ঠাহর করতে পারছে না কার গলা?তবে বড় চেনা এ গলা।চোখ ছেড়ে সামনে আসতেই দেখলো চেনা মুখ।সেই ঢল ঢলে মুখখানি।ওর ছুটি,সাথে আরো একটা চেনা মুখ টেঁপি।দুজনের ওরই মত বৈধব্যবেশ।সীমাহীন আনন্দে আত্মহারা তিনজনে।এত বছর পর সবাই সবার সুখ-দুঃখের কথা বলতে লাগলেন।ছুটি বিয়ের পাঁচবছরের মাথায় বরকে হারান।শ্বশুড়বাড়ি থেকে সম্পত্তির ভাগ দেওয়ার ভয়ে তারিয়ে দেয়।তারপর থেকেই এই গ্রামেই চলে আসেন।এসেই শুনেছিল সেই বছরই বনলতার বিয়ে হয়ে গেছে।এরপর টেঁপি শুরু করলেন নিজের বিয়ের পরের জীবনী।বাচ্চা হয়নি বলে বিয়ের সাতবছর পর ওকে ত্যাগ দিয়ে ওর বর আবার বিয়ে করেন।তখন থেকেই সেও এই গ্রামে বাপের বাড়িতেই থাকে।বনলতার বিয়ের খবর সেও শোনে গ্রামে এসে।এরপর ছুটি আর টেঁপি বললো "তুই আর গ্রামে কেন আসিস নি রে বনলতা"?

"আমার বর আমাকে পড়ার জন্য স্কুলে ভর্তি করলেন শ্বশুড়বাড়ির শত আপত্তি সত্বেও।তারপর বাবা-মা সবাই চলে গেলেন।দাদাদের মধ্যে সম্পত্তি ভাগাভাগি নিয়ে বচসা।আমার সাথে কেউ আর যোগাযোগ রাখেন নি বলে ও বাড়ি থেকে সবাই কড়া ভাবে বলে দিলেন আর আমাকেও আসতে দেবেন না।আর আসা হলো না।তারপর পড়া শেষ করে ছেলে-মেয়ে হলো।ওদের মানুষ করে দাঁড় করিয়ে বিয়ে দিতে দিতে জীবনের অর্ধেকের বেশী সময় চলে গেলো।উনিও দেহ রাখলেন।এখানে ছেলের একটা প্রজেক্টের কাজ হচ্ছে।আমিও আর আসার লোভ সামলাতে পারলাম না।বৌমা-নাতনী কোনদিন গ্রাম দেখেনি ওরাও আসতে রাজি হয়ে গেলো।ভাগ্যিস এলাম, তাইতো তোদের সাথে দেখা হলো"।


তিনজনে ঠিক শৈশবের মত একে অপরকে জড়িয়ে ধরলেন।পুকুরের জলে কাঁধে হাত দিয়ে ঠিক আগের মত বসলেন।কিছুক্ষনপর বনলতা জলে ঝাঁপ মেরে টেঁপি আর ছুটির পা ধরে জলে টেনে নামালেন।পুকুরের জলে তিনজনের হাসির ফোয়ারা উঠলো।হঠাৎ বনলতা চুপটি করে শোল মাছ তুলে ছুটির সামনে দেখিয়ে বললো "এই ছুটি এই দেখ সাপ".....

ছুটি চোখে হাত দিয়ে ছোটবেলার মতো কেঁদে উঠলেন ভ্যাঁ-এ-এ করে। বনলতা আগের মতো ওকে সামলাচ্ছেন।চোখ থেকে হাত সরিয়ে হেসে উঠলেন।ওকে দেখে টেঁপি-বনলতাও হেসে উঠলেন। তিনজনে মিলে হাসছেন আর জলের মধ্যে ছপাৎ ছপাৎ করে একে অপরের গায়ে জল ছেটাতে ছেটাতে হারিয়ে গেলেন শৈশবে ।পুকুরপাড়ে মায়ের হাত ধরে ঠাম্মিকে ডাকতে এসে এইসব কান্ড দেখে হাততালি দিয়ে নাচছে পরবর্তী প্রজন্ম।যারা জানতেই পারবে না কোনদিন এ আনন্দের মানে।।


       সমাপ্ত

       *****


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama