সে এসেছে...
সে এসেছে...
উত্তপ্ত দুপুর, শুনশান রাস্তার ওপর দিয়ে একমনে হেঁটে চলেছেন করবী দেবী। মাথা থেকে ঘাম চুঁইয়ে পড়ছে অবিরত, শাড়ির ভাঁজে ভাঁজে উপলব্ধি করছেন অস্বস্তি। গলাটা শুকিয়ে কাঠ, ব্যাগ থেকে রুমাল বের করে মুখটা মুছলেন তিনি। আর তৎক্ষণাৎ কানের সামনে কে যেন সজোরে হাততালি দিয়ে উঠল, "এ মাইজি পয়সা নিকাল।"
ধড়ফড় করে বিছানায় উঠে বসলেন করবী দেবী। সারা শরীর ঘামে ভিজে সপসপ করছে। বাইরে জানালার সার্শীতে বসে কোনো একটা পাখি ঠোঁট দিয়ে ঠুকঠুক করে শব্দ করে চলেছে অবিরত। শাড়ির আঁচল দিয়ে এবার সত্যিকারের মুখটা মুছলেন তিনি। এতক্ষণ তবে স্বপ্ন দেখছিলেন! এ আর নতুন কি কথা, এখন তো রাত দিন এই দুঃস্বপ্নটা তাঁকে তাড়া করে বেড়ায়। খাট থেকে নামতে যেতেই জানালার গায়ে আবার ঠকঠক শব্দ শুনতে পেলেন তিনি। এ শব্দ তো পাখির নয়, এতো মনে হচ্ছে কোনো মানুষ যেন জানালায় ঠকঠক করছে, সে ডাকছে করবী দেবীকে। গলাটা শুকিয়ে এলো তাঁর। পায়ে পায়ে জানালার কাছে এগিয়ে গেলেন তিনি, "কে?"
সাড়া দিলো না কেউ; অধৈর্য করবী দেবী আবার জিজ্ঞেস করলেন, "কে?"
ওপ্রান্তে থাকা মানুষটা এখনও নিরুত্তর রইল। কাঁপাকাঁপা হাতে জানালার ছিটকিনিটা তুলে ফেললেন করবী দেবী, দমকা হাওয়ার দাপটে পাল্লাটা গেল খুলে। ওপ্রান্তে দাঁড়িয়ে 'সে'; মুখে সেই রহস্যময় হাসি, "কি ভাবলে তবে?"
"ক্ক… কি ভাববো! সবটা কি আর আমার হাতে আছে?"
"নেই? কি বলছোটা কি! এই সংসার তোমার নিজের হাতে গড়া, তিলতিল করে কত কৃচ্ছসাধনা করে এই সংসার গড়ে তুলেছো, তোমার পাঁজরের টুকরো তোমার বাবুকে মানুষ করেছো। তুমি এভাবে পারবে তোমার পরিবারের সম্মান ধুলোয় মিশিয়ে দিতে?"
ডিং ডং
"শুনছো কলিংবেলের শব্দ, পাড়ার মিত্র গিন্নি এসেছে তোমার বাড়ি, কাল তো স্যান্যালদের এটা সেটা বলে ফিরিয়ে দিলে, আজকেও মিত্র গিন্নিকে ফেরাবে হয়তো। কিন্তু এভাবে কতদিন চলবে করবী! কতদিন লুকোবে সত্যিটা? সত্যি তো একদিন প্রকাশ পাবেই, আর সেদিন তোমার পরিবার তোমার বাবুকে সমাজের লোক কি বলবে ভেবে দেখেছো!"
★★★★★
বাবু আর বৌমাকে অনেক বুঝিয়েসুজিয়ে একটু বাজারে পাঠিয়েছেন করবী দেবী, বলেছেন একটু ঘুরে এলে মনটা ভালো লাগবে। বাড়িটা এখন ফাঁকা। সন্ধ্যাবেলায় আশেপাশের বাড়িগুলো থেকে ভেসে আসা শাঁখের শব্দগুলো একটু আগেই থেমেছে, রাস্তাটাও এখন নির্জন, কোনো শব্দ আসছে না কানে। গুটিগুটি পায়ে নিজের রুমে এলেন করবী দেবী। আর তাঁর পেছন পেছন ঘরে ঢুকলো 'সে', "কাম অন করবী, তুমি পারবে।" করবী দেবীর কাঁধে হাত রেখে আশ্বস্ত করল সে। এসির রিমোটটা তুলে নিলেন করবী দেবী; টেম্পারেচার কমছে… ষোলো...আট...চার… করবী দেবীর বুকটা দ্রুত ওঠানামা করছে,
"আর কি কমানোর প্রয়োজন আছে?"
মাথা নেড়ে না বললো 'সে'। করবী দেবী জানেননা কেন তার দু'চোখের পাতা ভিজতে শুরু করেছে। ডাক্তার বলেছিলেন বাচ্চাটা খুব দুর্বল, ভুলেও যেন এসির মধ্যে না রাখা হয় ওকে...
গুটিগুটি পায়ে রুম থেকে বেরিয়ে আসতে গেলেন করবী দেবী, আর দেখলেন 'সে' গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে ঘুমন্ত বাচ্চাটার দিকে। তার ঠোঁটের দু'পাশ থেকে বেরিয়ে পড়েছে একজোড়া শ্বদন্ত। গা'টা শিরশির করে উঠল করবী দেবীর।
আর তখনই হঠাৎ বাচ্চাটা কেঁদে উঠল আচমকা। করবী দেবী দেখলেন 'সে' তার ক্রুর হাতটা বাড়িয়ে ধরেছে বাচ্চাটার দিকে।
নানআআআ….
চিৎকার করে বাচ্চাটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন করবী দেবী, ছোঁ মেরে কোলে তুলে নিলেন তাকে। পরিচিত স্পর্শে বাচ্চাটাও মুখ ডুবিয়ে দিলো করবী দেবীর বুকে।
"একি করছো করবী!" চিৎকার করে উঠল 'সে'।
"ঠিকই করছি আমি। পিচকু আমার দাদুভাই, আমার… সে বৃহন্নলাই বা হল তবুও সে আমার রক্ত। আমি ভয় পাইনা সমাজের, আমার দাদুভাইকে আমি মানুষ করবো আমি। ছেলে বা মেয়ে এই দুটো লিঙ্গের বাইরে জন্মালে কি মানুষ হয়না? নাহ, সবাই মানুষ। আমার পিচকুও আর পাঁচটা মানুষের মতোই লেখাপড়া শিখবে, খেলাধুলা গান বাজনা শিখবে। হ্যাঁ, সে আর পাঁচটা মানুষের মতোই বেড়ে উঠবে।" চিৎকার করে কথাগুলো বলে উঠলেন করবী দেবী।
'সে'ও প্রত্যুত্তরে চিৎকার করে উঠল, "করবী…!"
কিন্তু আজ আর কারুর ভয় পেলেন না করবী দেবী, " তিনি জোর গলায় ঘোষণা করলেন, এই পৃথিবীতে সব মানুষের সমান ভাবে সুস্থ ভাবে বাঁচার অধিকার আছে। সে অধিকার না আমি কাড়িয়ে নিতে পারি না তুমি। আমার পিচকুও বাঁচবে মানুষের মত, তার নিজের মতন করে।"
"কিন্তু সমাজ কি তা করতে দেবে করবী?"
"এই সমাজ তৈরি হয় পরিবার নিয়ে, আর পরিবারেই পরিবর্তন না করতে পারলে সমাজে পরিবর্তন হবে কি কিরে?"
"কিন্তু করবী…" হিসহিস করে উঠল 'সে'।
করবী দেবীও জ্বলন্ত দৃষ্টি নিয়ে তাকালেন তার দিকে, "তুমি যাও, চলে যাও। তোমার কোনো ফাঁদেই আর পা দেবোনা আমি।"
এই বলে নিজের দ্বিতীয় প্রজন্মকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে হাতের কাছে রাখা একটা ফুলদানি তুলে সজোরে ছুঁড়ে মারলেন আয়নাটার দিকে। কাঁচটার সঙ্গে খানখান হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল করবী দেবীর আঁধারের প্রতিবিম্ব।