Sayandipa সায়নদীপা

Drama

5.0  

Sayandipa সায়নদীপা

Drama

স্বর্গের সিঁড়ি

স্বর্গের সিঁড়ি

10 mins
2.0K


কানের কাছে কিসের যেন একটা সুড়সুড়ি লাগতে চোখ বন্ধ অবস্থাতেই কানটা একবার চুলকে নিলেন মলয় সেন। কিন্তু পরক্ষণেই আবার সুড়সুড়িটা লাগাতে এবার অগত্যা চোখ খুললেন, আর চোখ খুলেই তো ভিরমি খাওয়ার জোগাড়; এ কোথায় শুয়ে আছেন তিনি! এটা কোন জায়গা! ধড়ফড় করে উঠে বসলেন মলয় বাবু, তাঁর চাপে ঘাস গুলো শুয়ে পড়লেও দলে গেলো না। আশেপাশে তাকালেন তিনি, যতদূর চোখ যায় শুধু সবুজ ঘাস আর ঘাস আর কিচ্ছুটি নেই। আশ্চর্য যতদূর মনে পড়ছে তিনি তো নিজের বাড়ির বিছানায় শুয়েছিলেন, এখানে এসে পড়লেন কিভাবে! হতভম্ব অবস্থাতেই উঠে দাঁড়াতে যেতেই মোক্ষম চমকটা পেলেন তিনি। বুঝলেন তাঁর শরীরে এক কণা কাপড় অবধি অবশিষ্ট নেই, আঁতকে উঠলেন মলয় বাবু। প্রতিবর্ত ক্রিয়ার বশে দুই হাত দিতে লজ্জা নিবারণে উদ্যত হলেন, কিন্তু এভাবে কতক্ষণ! এই অবস্থায় কোথায় যাবেন পোশাকের সন্ধানে! যতদূর দেখা যাচ্ছে শুধু ঘাস আর ঘাস একটাও বড় মায় ছোটো গাছ অবধি নেই যার পেছনে আশ্রয় নিতে পারেন তিনি। এসব কি হচ্ছে… কেন হচ্ছে? আচ্ছা এটা কোনো স্বপ্ন নয়তো! নিজের শরীরে চিমটি কাটালেন তিনি, ব্যাথা লাগলো না। উফফ তারমানে স্বপ্ন, বাঁচা গেল। কিন্তু এমন বিতিকিচ্ছিরি স্বপ্ন তিনি দেখছেনই বা কেন, আর যদিবা দেখছেন তা এটা ভাঙবে কখন! চোখ দুটো বন্ধ করে দাঁত মুখ খিঁচিয়ে অনেক চেষ্টা করলেন মলয় বাবু যাতে স্বপ্নটা ভাঙে কিন্তু কোনো লাভ হলো না। আর স্বপ্নটা এতটাই জীবন্ত যে মনে হচ্ছে যেন সত্যিই এসব ঘটছে। আবার হতবুদ্ধি হয়ে আশেপাশে তাকালেন মলয় বাবু, আর তখনই কানে ভেসে এলো সরসর একটা শব্দ। শব্দের উৎস আন্দাজ করে পাশ ফিরতেই দেখলেন তিনজন লোক ছুটে যাচ্ছে উদ্ভ্রান্তের মত। এবং বলাই বাহুল্য মলয় বাবুর মত ওদের শরীরেও এককণা কাপড় নেই। বিস্ফারিত দৃষ্টিতে ওদেরকে যতদূর দেখা যায় চোখ দিয়ে অনুসরণ করলেন মলয় বাবু। তারপর তাঁর সম্বিৎ ফিরল আরেকজনের আগমনে, সেও নগ্ন, সেও ছুটছে একই ভাবে… কিন্তু মলয় বাবু এতক্ষণে খানিক সামলেছেন নিজেকে, ওদের দেখে লজ্জা ভাবটা খানিক হলেও কেটে গেছে। তাই এবার তিনি লোকটাকে লক্ষ্য করে ছুটে গেলেন, “দাঁড়ান দাঁড়ান।” 

আশ্চর্যজনকভাবে লোকটা মলয় বাবুকে দেখলো কিন্তু ছোটা থামালো না; পরিবর্তে ছুটতে ছুটতেই বলল, “দাঁড়ানো চলবেনা, দাঁড়ালেই শাস্তি।”

“কিসের শাস্তি?” অবাক গলায় জানতে চাইলেন মলয় বাবু।

লোকটা জবাব দিলো, “অতো আমি বোঝাতে পারবো না। আগে পৌঁছাতে চান তো ছুটুন।” এই বলে ছোটার গতি আরও বাড়িয়ে দিলো লোকটা। অগত্যা নিরুপায় হয়ে তাকে অনুসরণ করবেন বলে মনস্থির করলেন মলয় বাবু।


  লোকটার সঙ্গে ছুটতে ছুটতে যেখানে এসে পৌঁছালেন মলয় বাবু সেখানে ভীড় তো ভীড়, গিজগিজ করছে লোক। হরেক রকম চেহারা তাদের, কেউ দেশি কেউ বিদেশি, কেউ রোগা তো কেউ মোটা, কেউ কালো তো আবার কেউ ফর্সা। কিন্তু এতো লোকের মধ্যে যেটা একমাত্র মিল সেটা হল ওদের কারুর শরীরে কাপড় বলে কিছু নেই, সবাই নগ্ন। মলয় বাবুর মনে হল উনি বুঝি কোনোভাবে প্রাগৈতিহাসিক যুগে এসে পড়েছেন। তবে সে যাই হোক একটা অবাক করা জিনিস খেয়াল করলেন মলয় বাবু, দেখলেন এতো লোকের ভীড় কিন্তু কেউ কোনো চেঁচামেচি করছে না, সবাই কেমন দু তিনটে লাইন করে এগিয়ে যাচ্ছে কোথাও। লাইনগুলো এতোই লম্বা যে শুরুটা চোখেই পড়ছে না। তাই অগত্যা মলয় বাবু এগিয়ে গিয়ে একজন সোনালী চুল ওয়ালা সাহেবকে জিজ্ঞেস করলেন, “লাইন করে কোথায় যাচ্ছেন আপনারা?”

সোনালী চুল সাহেব হতাশ গলায় জবাব দিলো, “আমাকে তিন নম্বর নরকে যেতে হবে।”

“কোথায় নরওয়ে! তা তিন নম্বরের ব্যাপারটা তো ঠিক বুঝলাম না।”

“আরে মশাই নরওয়ে নয়, নরওয়ে নয়, নরক।” বোঝানোর চেষ্টা করলেন সাহেব।

“নরক!” আঁতকে উঠলেন মলয় বাবু, “কিসব বলছেন আপনি? ইয়ার্কি করছেন আমার সাথে?”

মলয় বাবুর কথা শুনে সাহেব কিছুক্ষণ কুতকুতে চোখে ওনাকে পর্যবেক্ষণ করলেন। তারপর বললেন, “হুমম বুঝেছি। আপনাকে এখনও কোথায় পাঠানো হবে স্থির হয়নি না? তবে নরকে যে যাচ্ছেন তা নিশ্চিত। আজকাল কটা লোকই বা আর স্বর্গে যাওয়ার সুযোগ পায়।”

“আরে মশাই কি সব বলছেন আপনি? আপনার কি মাথা টাথা খারাপ হল নাকি?” অধৈর্য্য হয়ে পড়লেন মলয় বাবু।

সাহেব একটুও বিরক্ত না হয়ে বললেন, “আমার মাথা একদম ঠিক আছে। আমি আপনার অবস্থাটা বুঝতে পারছি। আপনি এক কাজ করুন ওই ঐ দিকটায় চলে যান, ওখানে সহায়তা কেন্দ্র আর তথ্য কেন্দ্র আছে। ওরাই আপনাকে সাহায্য করবে। আমি লাইন ছাড়তে পারবো না নয়তো আপনাকে নিয়ে যেতাম।” এই বলে সাহেব আঙ্গুল তুলে দূরের দিকে দেখালো। লোকটার মস্তিষ্কের সুস্থতা নিয়ে যদিও যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে মলয় বাবুর তাও যা সব ঘটছে তাতে করে নিজের মাথাটার ওপরেও ঠিক যেন ভরসা হচ্ছে না, তাই অগত্যা নিরুপায় হয়ে সাহেবের নির্দেশিত পথে গুটিগুটি পায়ে এগোতে লাগলেন মলয় বাবু। অনেকটা হাঁটার পর তিনি দেখতে পেলেন একটা জায়গায় আবার কিছু মানুষের জটলা, তবে এরা কেউই নগ্ন নয়, এদের শরীরে এক অদ্ভুত রকমের ঢোলা পোশাক রয়েছে। যদিও পোশাকের রংটা সাদা, তবুও থি যেন সাদা নয়, কেমন যেন রুপোলি দ্যুতি ছড়াচ্ছে ওটার থেকে। এদের দেখে আবার লজ্জার অনুভূতিটা ফিরে এলো মলয় বাবুর। ভাবলেন পেছন ফিরে দৌড় লাগাবেন কিন্তু তার আগেই ওদের মধ্য থেকে একজন ওনাকে দেখতে পেয়ে বলে উঠল, “আরে ইনি তো একজন নরকের যাত্রী, কিন্তু উনি এখানে কি করছেন?”

পাশ থেকে আরেকজন জবাব দিলেন, “নিশ্চয় কোনো সাহায্যের জন্য এসেছেন।” 

অপর আরেকজন বললেন, “দিগভ্রান্তও হতে পারে। মিতু দাকে খবর দাও।”

লোকটার কথাটা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ম্যাজিকের মত ওদের সামনে আবির্ভূত হলেন একজন লোক। মলয় বাবু দেখলেন এই লোকটার পোশাকটা অন্যদের থেকে আরও বেশি উজ্জ্বল, আর সবচেয়ে অবাক কথা হল লোকটার পা দুটো মাটিতে ঠেকছে না, হাওয়ায় ভাসছে লোকটা। মলয় বাবুর বিস্ময়ের ঘোর কাটতে না কাটতেই লোকটা ভেসে ভেসে হাজির হয়ে গেল ওনার সামনে। তারপর একটা ভুবন ভোলানো হাসি ছড়িয়ে দিয়ে বলল, “বলুন কি সাহায্য করতে পারি আপনাকে? আমার নাম মিত্রগুপ্ত, সবাই ভালোবেসে ডাকে মিতু দা বলে। আপনিও তাই বলবেন।”


“কিন্তু আপনি তো আমার চেয়ে বয়েসে অনেক ছোটো, দাদা বলবো কিভাবে!”


“তাই বুঝি? আসলে আমি যখন মারা যাই তখন আপনার চেয়ে অনেক কম বয়সীই ছিলো বটে আমার। তবে এখানে আমি এসেছি আপনার আসার অনেক অনেক আগে সেই হিসেবে আমি আপনার সিনিয়র তাই না?”


“কি বললেন! মারা যান যখন? মানে?”


“আহা ঘাবড়াবেন না, মনকে শক্ত করুন। আসলে গতকাল রাতে ঘুমের ঘোরে আপনি আপনার পার্থিব দেহ ত্যাগ করেছেন।”


“কি সব বলছেন আপনি! উফফ… কিসব হচ্ছে এখানে আমি কি পাগলাগারদে এলাম নাকি?”


“নাহ মশাই এটা পাগলাগারদ নয়, এটা পার্গেটরি। আর এই যে এনাদের দেখছেন এনারা সব স্বর্গের যাত্রী।”


“আর আমি?”


“আপনি তো নরকের।”


“নরক! কেন আমি কেন নরকে যাবো?”


“কর্মফল মশাই কর্মফল। ওটাই তো সব নির্ধারণ করে কে কোথায় যাবে। আগে বুঝলেন আমি যখন এখানে এসেছিলাম তখন এখানের পরিস্থিতি এতো উন্নত ছিলো না। সময়ের সাথে সবই বদলেছে বুঝলেন। আগে এখানে শুধু মৃত আত্মারা পার্থিব মোহ কাটানোর জন্য আসতো কিন্তু এখন এখান থেকেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় সে স্বর্গে যাবে না নরকে। নরকে গেলে কত নম্বর নরকে যাবে চিত্ত শুদ্ধি করতে। এইসব এখানেই স্থির হয়।”


“নরকের নম্বর…!”


“হ্যাঁ মশাই, যে যেমন পাপ করেছে সে তেমন শাস্তি পাবে তার জন্য নরকেরও ভাগ আছে।”


“উফফ… আপনার কথা এখনও ঠিক বিশ্বাস করতে পারছিনা, সব কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে।” মাথার চুলগুলো মুঠো করে ধরতে গেলেন মলয় বাবু কিন্তু টের পেলেন তার মাথায় একটাও চুল নেই।

মলয় বাবুর অবস্থা দেখে মুচকি হাসল মিত্রগুপ্ত, কিন্তু কিছু বলল না মুখে। একটা ঢোঁক গিলে নিয়ে মলয় বাবু বললেন, “আপনার কথা যদি বিশ্বাসও করে নিই কিন্তু আমার তো নরকে যাওয়ার কথা নয়।”


“তাই?”


“হ্যাঁ। আমি কে আপনি জানেন? আমি ছিলাম আই. পি.এস অফিসার মলয় সেন। কত অপরাধীকে ঘায়েল করেছি এ জীবনে তার ইয়ত্তা নেই। আর তারপরেও আপনি বলতে চান আমি নরকে যাবো? দেশ মায়ের সেবা করার কি কোনো মূল্য নেই!”


“বটে বটে… কিন্তু মশাই লৌকিক জীবনের পেশা দিয়ে কি আর কর্মফল যাচাই হয়! আপনি দেশ মায়ের সেবা করেছেন কর্মজীবনে এতো খুব ভালো জিনিস কিন্তু তার জন্য যে আপনার দম্ভ সেটাও কি খুব ভালো?”


“কি বলতে চান কি আপনি?”


“কিছু বলছি না, তবে চলুন আপনাকে একটা জিনিস দেখাই। আগে এখানে এসবের ব্যবস্থা ছিলো না, তবে এখন চাইলেই সকলকে তাদের পার্থিব জীবনের দোষ ত্রুটি গুলো দেখানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে যাতে পরের জন্ম কিছুটা হলেও দোষমুক্ত হয়…” মিত্রগুপ্ত আরও অনেক কিছু বলে যাচ্ছিল কিন্তু সেদিকে মন ছিলো না মলয় বাবুর। তিনি এখন সামনে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলেন মলয় সেনকে, ঊনত্রিশ বছরের মলয় সেনকে যে কিছুদিন আগেই আই. পি.এস অফিসার পদে যোগ দিয়েছেন। মলয় বাবু দেখলেন যুবক মলয় একটা দামী বাইক নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে রাস্তায়, পেছন থেকে একটি ছেলে তাকে ডাকল। যুবক মলয় শুনতে পেলো কিন্তু ফিরে তাকাল না কারণ সে জানতো তার ওই সহপাঠীটি তার চেয়েও মেধাবী হওয়া সত্ত্বেও ভাগ্যের ফেরে এখন এক সরকারি অফিসের সামান্য কেরানি। ছেলেটি বরাবর পড়াশুনায় ভালো ছিল বলে ওকে হিংসা করতেন মলয় বাবু, ছেলেটির বাবা মারা যেতে ওর পড়াশুনো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মনে মনে বেশ খুশি হয়েছিলেন তিনি। আজ সুযোগ পেয়ে ওর ডাকে সাড়া না দিয়ে নিজের বুকের ঈর্ষার জ্বালাটাকে কিছুটা জুড়োলেন তিনি। 

  দৃশ্যপট পরিবর্তন হল আবার। মলয় বাবু দেখলেন এক ভিখারিনী তাঁর শিশু সন্তানটিকে নিয়ে হাত পাতছেন যুবক মলয়ের কাছে, সে উপেক্ষা করে চলে গেল। পেছনে পড়ে রইল ক্ষুধার্ত শিশুটির কাতর দৃষ্টি আর এক অসহায় মায়ের দীর্ঘশ্বাস। 

  আবার দৃশ্যপটের পরিবর্তন… যুবক মলয় অস্বীকার করল এক দরিদ্র আত্মীয়ের সাথে দেখা করতে।


অতীতের দৃশ্যপট উধাও হল এবার। মিত্রগুপ্ত নরম গলায় বললেন, “দেখলেন?”

উত্তর দিতে পারলেন না মলয় বাবু, চুপ করে রইলেন। আজ ওই ঘটনাগুলোর এতো বছর পর বুকটা কেমন চিনচিন করে উঠল। মিত্রগুপ্ত আবার বললেন, “আপনার দম্ভের আরও অনেক নিদর্শন রয়েছে তবে আশা করছি সেগুলো আর দেখানোর প্রয়োজন হবে না। আপনার স্মরণে আসছে সব এক এক করে। 

এবার আসুন অন্য একটা জিনিস দেখাই।”


সামনে আবার এক দৃশ্যপট ভেসে উঠল। তবে এবার আর যুবক মলয় নয়, কিশোর মলয়। সুনিপুণ হাতে সে এক সহপাঠীর ব্যাগ থেকে একটা পেন বের করে নিলো সবার অলক্ষ্যে তারপর সেটা ঢুকিয়ে দিলো আরেকজনের ব্যাগে।

দৃশ্যটা দেখামাত্রই মলয় বাবুর স্মৃতিতে ঝলসে উঠল দুটো নাম, সুভাষ আর রথী। দুই হরিহর আত্মা। মলয় বাবুর কাছে সুভাষ ছিল তার প্রিয় বন্ধু কিন্তু তিনি বেশ বুঝতেন সুভাষ রথীকে মলয় বাবুর থেকে অনেক বেশি ভালোবাসে। শুধু এটুকুই নয় সুভাষ ছিল ক্লাসের সেরা ছাত্র, তার সাহায্যে রথীও পড়াশুনোয় বেশ উন্নতি করেছিল। ওদের দুজনের থেকেই ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছিলেন মলয় বাবু। তাই ওদের দুজনকে আলাদা করতে এই চক্রান্তটা করেন তিনি।

  পরের দৃশ্যপটে কিশোর মলয় রাতের অন্ধকারে চুপিসারে ওদের পাড়ার রামু পাগলার পাশে লঙ্কা পটকা রেখে দিলো। অঘোরে ঘুমোচ্ছিল রামু, আচমকা পটকা ফাটতেই চমকে জেগে উঠল আর চমকের চোটে জ্বলন্ত পটকায় হাতটা লেগে গেল তার। বীভৎস ভাবে পুড়ে গেল হাতটা।

মলয় বাবুর মনে পড়ল রামু পাগলার হাতটা পুড়ে দগদগে ঘা হয়ে গিয়েছিল অনেকটা। তাতে নোংরা লেগে কিছুদিনের মধ্যেই বিষিয়ে উঠেছিল ঘা’টা; তারপর আচমকা একদিন ওদের পাড়ার থেকে উধাও হয়ে যায় লোকটা।


  অতীতের দৃশ্যপট আবার উধাও হল। মিত্রগুপ্ত বলল, “লোকটা বাঁচেনি এরপর। যন্ত্রনায় কাতর অবস্থাতেই আপনাদের পাড়া ছেড়েছিল সে, আপনাদের খুব আঘাত পেয়েছিল কিনা তাই। তারপর…

আচ্ছা চলুন কৈশোরের বাকি ঘটনা থাক আপাতত, এখন সবচেয়ে মজার জিনিসটা দেখাই আপনাকে।


  এবার আর যুবক বা কিশোর নয়, শিশু মলয়। হামাগুড়ি দিচ্ছে, হাসছে, খেলছে, খাচ্ছে, ঘুমোচ্ছে। মা যত্ন করে তাকে খাইয়ে দিচ্ছেন, ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছেন। সারাদিন সংসারের কাজ করে রাতের বেলাও জেগে ছোট্ট মলয়কে ভোলাচ্ছেন। জ্বর হতে ঠাঁয় ওর কাছে বসে ওর সেবা করছেন মা।


  ছোটো বেলার স্মৃতি সত্যই সুখের, এসব দৃশ্য পুনরায় দেখতে আনন্দে কান্না পেয়ে গেল মলয় বাবুর কিন্তু তিনি বুঝতে পারলেন না শিশু অবস্থায় আবার কোন পাপটা করে বসেছেন তিনি। এ কথা মিত্রগুপ্তকে জিজ্ঞেস করতেই সে আবার তার বিখ্যাত ভুবন ভোলানো হাসিটা হাসল কিন্তু মুখে কিচ্ছুটি বলল না। সামনে তাকাতেই মলয় বাবু এবার দেখতে পেলেন মধ্য বয়সী মলয় বাবুকে। একটা পার্টির শেষে বেডরুমে বসে গায়ের সব গয়না খুলতে খুলতে ওনার স্ত্রী বলছেন, “হল তো আজ সব সম্মানের দফারফা! আমি জানতাম তোমার মা এরকম কিছুটা কান্ড বাধাবেন। উফফ বুঝিনা বাবা বুড়ো মানুষ নিজের ঘরে থাকলেই তো পারেন, তা না…”


  দৃশ্যটা দেখামাত্রই মলয় বাবুর মনে পড়ে গেল এর পরের কথা। চাকরিতে পদোন্নতির সাথে সাথে মাকে বড়ই ব্যাকডেটেড মনে হত তাঁর। মায়ের সব কিছুতেই বিরক্তি লাগত। বিয়ের পর তো আরও বেশি করে বোঝা মনে হত মাকে। তারপর সেদিনের পার্টির ঘটনার পর দেবযানীর পরামর্শে মাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে এসেছিলেন তিনি। মা মাঝে মাঝে সেখান থেকে ফোন করে দেখা করতে চাইতেন, কোনোভাবে কাটিয়ে দিতেন মলয় বাবু। তারপর তো বৃদ্ধাশ্রম থেকে ফোন এলে ধরাই ছেড়ে দিয়েছিলেন তিনি… আর তাই তো মা যেদিন চলে গেলেন সেদিনও উনি যথারীতি ফোন কেটে দিয়েছিলেন মায়ের ফোন ভেবে। কিন্তু…

বুকটা হঠাৎ মুচড়ে উঠল মলয় বাবুর, “মা… মা গো…” বলে মুখ ঢেকে মাটিতে বসে পড়লেন তিনি। কত কথাই না মনে পড়ে গেল এক লহমায়। আজ এতো বছর পর হঠাৎ মনে হল সেই সময় মা কত কষ্টই না পেয়েছেন ওনার অবহেলায়, মা যখন অসুস্থ হয়ে পড়েছিল বিছানায় তখনও একদিন দেখতে যাওয়ার সময় হয়নি তাঁর। তারপর তো মা চলেই গেলেন--- “মা… মা গো… আমায় ক্ষমা করো মা।” ডুকরে কেঁদে উঠলেন মলয় বাবু। যে মানুষটার অধ্যবসায়ে তিনি যাবতীয় শিক্ষা, সম্মান, অর্থ অর্জন করেছিলেন সেই মানুষটাকেই একসময় এভাবে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন! সেই সাথে মলয় বাবুর হঠাৎ মনে হল এই বৃদ্ধ বয়সে তাঁর স্থান বৃদ্ধাশ্রমে হয়নি ঠিকই কিন্তু তাঁরও একমাত্র ছেলেও তো নিজের স্ত্রী, মেয়েকে নিয়ে আলাদা থাকে। তাঁর প্রাসাদপ্রতিম বাড়িতে তিনি আর দেবযানী একলা। সময় হয়তো এভাবেই সব ফিরিয়ে দেয়।


  আস্তে আস্তে মলয় বাবুর কাঁধে হাত রাখলেন মিত্রগুপ্ত। তারপর নরম স্বরে বললেন, “শান্ত হোন। এ শুধু আপনার গল্প নয় মশাই, এ তো এখনের সবার গল্প। মানুষ এখন শৈশব থেকেই বড় অসংযমী, অসহিষ্ণু হয়ে পড়ছে আর ফলস্বরূপ একটার পর একটা পাপ। শৈশব থেকে বার্ধক্য পর্যন্ত জীবনের প্রতিটা অধ্যায়কে এখন মানুষ ষড়রিপুর তুলি দিয়ে আঁকছে। তাই তো এখন নরকে এতো বেশি সংখ্যক মানুষ যাচ্ছে আর স্বর্গে গুটিকতক। 

উঠে বসুন মশাই। ভয় পাবেন না। বলিষ্ঠ চিত্তে আপনার জন্য যে বিধান স্থির হয়েছে তাকে গ্রহণ করুন। দেখবেন ওখানে গিয়ে আপনার আত্মশুদ্ধি হবে। হ্যাঁ নরক শুধু শাস্তিই দেয়না, মানুষকে আত্মশুদ্ধিতেও সাহায্য করে। আশা করি পরের বার যখন জন্মাবেন তখন জীবনের প্রতিটা অধ্যায়কে ভালো কাজের মাধ্যমেই মাহাত্ম্যপূর্ণ করে তুলবেন যাতে মৃত্যু পরবর্তীকালের জন্য স্বর্গের সিঁড়ি আপনার অপেক্ষায় থাকে…”


শেষ।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama