স্বপ মধুর মোহে
স্বপ মধুর মোহে


“ সেদিন রেস্টুরেন্টে আমাদের বিল কত হল গো?” সায়নদীপা জিজ্ঞাসা করলো অর্জুনকে। চোখে চশমা এঁটে ডায়েরি পেন নিয়ে ও বসেছে হিসাব লিখতে।
“বোধহয় ১২০০, বা ...... ঠিক মনে নেই। কেন বলত?” অর্জুন অফিস থেকে ফিরে চা নিয়ে টিভির সামনে বসেছে।
সায়নদীপা আর অর্জুন দুজনেই চাকরি করে। সায়নদীপার স্কুল একটু তাড়াতাড়ি ছুটি হয় তাই ও একটু তাড়াতাড়ি ফেরে।
ওদের এই মাস দুয়েক হল বিয়ে হয়েছে। প্রায় দু বছর প্রেম করার পর ওরা বিয়ে করে সংসার পাতলো।
দুই বাড়ী থেকেই নিমরাজি হয়ে সম্পর্কটা মেনে নিয়েছে, বলা যায় দুজনের জেদের কাছে তারা মাথা নত করেছে। কারণটা সায়নদীপা সেরকম সুন্দরী না, আইআইটি ইঞ্জিনিয়ার ছেলের জন্য ওর বাবা মা চেয়েছিল সুশ্রী পাত্রী। আর মেয়ের বাড়ী নারাজ কারণ ছেলে স্বজাতি নয়।
ওদের আলাপ হয় সায়নদীপার বেস্ট ফ্রেন্ড সুল্গনার জন্মদিনের পার্টিতে। অর্জুন এসেছিল সুলগ্নার বয়ফ্রেন্ড অরিজিতের বন্ধু হিসাবে।
বাড়ীতে ঢুকেই অরিজিত বলে উঠেছিল,” ইউ আর লুকিং গরজাস ডিয়ার।“
প্রশংসা শুনে সুলগ্নার মুখে হাজার ওয়াটের আলো জ্বলে উঠেছিল। এতো গদগদ মুহূর্তে অর্জুন বলে উঠেছিল,”যাক! সাজ সার্থক হল। যতই হোক মেয়েরা তো ছেলেদের জন্যেই সাজে!”
সঙ্গে সঙ্গে সুলগ্নার পাশ থেকে সায়নদীপা বলে উঠেছিল,” একটু ভুল হল। ‘ছেলেদের জন্যেই’ নয়, ‘ছেলেদের জন্যেও’ হবে কথাটা।“
সঙ্গে সঙ্গে হইহই করে উঠেছিল অরিজিত,” যাক এতদিনে পাওয়া গেছে।?কে তুমি নন্দিনী? কোথায় ছিলি এতদিন? আমার এই বন্ধুটির সাথে কথায় পেরে ওঠে এমন মেয়ে যে কোনদিন পাওয়া যাবে তা আমরা ভাবিনি।“
সবাই হোহো করে হেসে উঠেছিল।
সেই শুরু।
তারপর অনেক পথ ওরা পেরিয়ে এসেছে। এখন পাড়ি জমিয়েছে সংসার সমুদ্রে। কর্মসূত্রে ওরা থাকে মুম্বাইতে। নতুন সংসার। তাই একটু হিসেব করে চলতে হয় বৈকি।
“না মানে একটা হিসাব তো রাখা দরকার। মানে মাসের শেষে দেখতে হবে না তুমি আমায় যে টাকাগুলো দিয়েছিলে সেগুলো......” কথাটা শেষ করতে পারলো না সায়নদীপা।
“ আমি তোমায় যে টাকাগুলো দিয়েছি মানে? টাকা তো তুমি গিয়ে তুলে নিয়ে এসেছ ব্যাংক থেকে। আর টাকা তো তোমার আমার দুজনের। আমি তোমার বস নাকি যে হিসেব নেব? সংসারে মানুষ তো আমরা দুজন। শুধু দুজনে মিলে এতটুকু খেয়াল রাখলেই হল যে বাজেটের মধ্যে মাস চলে যাচ্ছে।“
সায়নদীপা একটু চুপ করে গেল। চিরকাল ও নিজের বাবা মাকে এভাবেই সংসার করতে দেখেছে। ও বহুবার শুনেছে বাবা, মাকে বলছেন,” কই গো দেখি কি খরচ খরচা করলে।“ মাও নির্বিবাদে নিজের সংসারের হিসেবের খাতাটা নিয়ে গিয়ে বসেছেন। কখনো মাকে এই নিয়ে রাগ বা অভিমান করতে দেখেনি। তাই ওর কাছে ওটাই স্বাভাবিক মনে হয়েছে। মাসের শেষে যেবার কিছু টাকা বাঁচতো সেবার বাবা বলতেন,” বাঃ! তুমি আমার লক্ষ্মী। সামনের মাসে তাহলে কিছু কম টাকা তুললেও চলবে কি বল?”
সেই সময়ে মায়ের মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠতো গর্বে। যেন বিরাট কিছু পেয়েছেন। সায়নদীপাও ভেবেছিল মাসের শেষে ওকেও অর্জুন ঐভাবেই প্রশংসা করবে।
” জানো আগের মাসে আমি পাঁচশো টাকা বাঁচিয়েছি।“ সগর্বে বলে উঠলো সায়নদীপা।
“এ বাবা বাঁচালে কেন? যাক বাঁচিয়েছ ভালো হয়েছে, চল এখনই বাজারে গিয়ে কিছু কিনে আনি তোমার জন্য। আফটার অল তুমি বাঁচিয়েছ। তাই তোমার একটা প্রাইজ তো পাওয়া উচিৎ তাই না?” সায়নদীপাকে অবাক করে দিয়ে লাফিয়ে উঠলো অর্জুন।
তারপর হতভম্ভ সায়নদীপাকে কাছে টেনে ওর কপালে একটা চুমু খেয়ে হেসে বলল,” যা জমানোর তা তো আমরা জমাচ্ছি। ভবিষ্যতের কথা ভাবতে ভাবতে আজটা ভুলে গেলে চলবে? এই তো কি মজা মাসের শেষে তুমি আমি বেড়াতে গেলাম, তুমি আবদার করে আমার কাছে একটা নেলপলিশ চাইলে। আমি তোমায় কিনে দিলাম। এটাও কি কম আনন্দের?”
একটা ভীষণ মিষ্টি ভালোলাগা, ঢেউ তুলে গেলো সায়নদীপার মনে। তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নিল মাসের শেষে শপিং করতে যাবার জন্য।
শুনল অর্জুন গুনগুন করছে, “ এই তো হেথায় কুঞ্জ ছায়ায় স্বপ্ন মধুর মোহে, এই জীবনে যে ক’টি দিন পাব ......”
সায়নদীপাও গলা মেলাল, “ তোমায় আমায় হেসে খেলে কাটিয়ে যাব দোহে, স্বপ্ন মধুর মোহে.........”