সায়াহ্নে
সায়াহ্নে


শিঞ্জিনী নিজের হাতের মোবাইল ফোনটা আর একবার দেখে নামিয়ে রেখে দিল। নাঃ, কোনও মিস্ড কল বা মেসেজ নেই। সন্ধ্যা হয়ে এলো প্রায়। ওর বিছানার সামনের জানালাটা দিয়ে সামনের একটা নির্মীয়মাণ বাড়ী দেখা যায়। ও অসুস্থ হয়ে পড়ার পর এই বাড়ীটার কাজ শুরু হয়েছিল। প্রথমে ভিত কাটা হল, তারপর পিলার আর ছাদ ঢালাই হল, তারপর দেয়াল উঠলো, জানালা দরজা লাগলো, এখন প্লাস্টারিংএর কাজ চলছে। সকাল থেকে সন্ধ্যা ও বিছানায় শুয়ে শুয়ে ওই বাড়ীটার কাজ দেখে। মেয়েরা মাথায় করে ইট, বালি বয়ে এনে দেয়। ছেলেরা দেয়াল গাঁথে, প্লাস্টার করে। ওদের বাচ্চাগুলো সামনে বালির ঢিপির ওপর খেলে। কখনও কাঁদলে মায়েরা কোলে করে ভোলায়। ক্লান্ত হয়ে গেলে ছায়ায় গোল হয়ে বসে ওরা গল্প করে। দুপুর বেলায় টিফিন বাক্স খুলে খাবার খায়। কি খায়? খুব জানতে ইচ্ছা করে শিঞ্জিনীর।
ওদের খাবার সময়েই নার্স ওর জন্যেও খাবার নিয়ে আসে। নুনছাড়া, মিষ্টিছাড়া, ট্যালট্যালে সুপ, খিচুড়ি, আর সেদ্ধ সব্জি। ওর খাটের সামনে টেবিল লাগিয়ে ওর গলায় একটা তোয়ালে জড়িয়ে দেয় নার্স। তারপর পরম যত্ন সহকারে ওই অখাদ্যগুলো ওর মুখে এক চামচ এক চামচ করে ঢেলে দেয়। অসহ্য লাগে ওর। ও তাকিয়ে তাকিয়ে ওই মজুর মেয়েদের খাওয়া দেখে। কি সুন্দর লঙ্কা চিবিয়ে চিবিয়ে খাচ্ছে। আঃ কতদিন খায় নি একটু আলুসেদ্ধ, ঘি আর কাঁচা লঙ্কা দিয়ে গরম ভাত। অনেক দিন নার্সের কাছে কাকুতি মিনতি করেছে, লঙ্কা না দাও একটু আচারই দাও, প্লিস! নার্স দেয়নি। অবশ্য নার্সকেও দোষ দেওয়া যায় না। ঘরে লাগানো আছে সিসি টিভি ক্যামেরা। তাই দিয়ে নজর রাখছে মিঃ অধিকারী। মানে শিঞ্জিনীর স্বামী।
মিঃ নীলাম্বর অধিকারী, এক নামী এম এন সির হর্তাকর্তা, তার ভয়ে সারা অফিস থরহরিকম্প। বাড়ীতে যতই অসুবিধা থাক, সে কাঁটায় কাঁটায় অফিস পৌঁছয়। সবদিকেই তার নজর। ঠিক সকাল সাড়ে আটটায়, নিজের টাইটা ঠিক করতে করতে ও শিঞ্জিনীর ঘরে ঢোকে। ওর আফটার শেভ আর পারফিউমের গন্ধে সারা ঘরটা ম-ম করে। কয়েক মিনিটের জন্য ঘরের ওষুধ আর হ্যান্ড-স্যানিটাইসারের গন্ধগুলো কোথায় হারিয়ে যায়।
“ আজ কেমন আছ?” ওর মাথায় হাত বুলিয়ে মিষ্টি করে জিজ্ঞাসা করে নীলাম্বর।
“ ভালো।“ রোজকার মত ঘাড় নেড়ে উত্তর দেয় শিঞ্জিনী। ও জানে এর বেশী শোনবার সময় হবে না নীলের। হ্যাঁ, ওই নামেই ওকে চিরকাল ডেকে এসেছে শিঞ্জিনী। আর ও ভালবেসে ডাকত নুপুর বলে।
“ শিঞ্জিনী খুব শক্ত নাম। নুপুর কি সুন্দর ! শুনলেই মনে হয় রিনরিন করে বেজে উঠবে।“ বলেছিল বিয়ের পরে।
ওরা হানিমুন করতে গিয়েছিল, মহাবালেশ্বর। তখন জুলাই মাস। বর্ষার জলে তখন পাহাড় আর ঝর্ণার নবযৌবনা রূপ। বর্ষায় সাধারণত কেউ পাহাড়ে আসেনা। ধ্বসে রাস্তা বন্ধ হবার ভয় থাকে।
“ আমরা তো আর পাহাড় এক্সপ্লোর করব না! আমরা তো অন্য কিছু এক্সপ্লোর করতে যাচ্ছি, কি বল? “ দুষ্টু হাসি খেলে গিয়েছিল নীলের চোখে।
ফ্রেডরিক্স লজ, পাহাড়ের কোলে ব্রিটিশ আমলের বাংলোর ধাঁচে তৈরি । কাঠের মেঝে, তেরছা ছাদ আর কেয়ারি করা বাগান। ঘরের জানালার সামনে গভীর খাদ। সব মিলিয়ে মধুচন্দ্রিমা যাপনের জন্য আইডিয়াল। লজে ওরা ছাড়া আর কোনও গেস্ট ছিলনা। ওদের মনে হচ্ছিল পুরো লজটাই ওদের। বিকালবেলায় বাগানে ওদের ঘনিষ্ঠভাবে বসে থাকতে দেখলে লজের বৃদ্ধা মালকিন মুচকি হেসে নিজের ঘরে চলে যেতেন। নিজের কর্মচারীদের নির্দেশ দিতেন, ওদের কেউ যেন বিরক্ত না করে। ওই কটা দিনের কথা মনে পড়লে এখনও বুকের মধ্যে শিহরন জাগে শিঞ্জিনীর।
দেখে শুনেই বিয়ে হয়েছিল ওদের। কিন্তু ফুলশয্যার রাতেই বন্ধুত্ব হয়ে যায় নীলের সঙ্গে। সেই বন্ধুত্ব প্রেমে পরিণত হয় হানিমুনে। একজন পুরো মানুষকে নিজের করে পাওয়ার এই নতুন অনুভূতিতে ওরা দুজনেই মগ্ন ছিল। দুজনের দুজনকে কিছুই অদেয় ছিলনা।
“ একটু হাঁ করুন তো, ক্যাপস্যুলটা খেয়ে নিন।“ নার্সের কোথায় হুঁশ ফেরে শিঞ্জিনীর। নার্সের হাত থেকে জলের গ্লাসটা নিয়ে ওষুধটা খেয়ে নেয় ও।
“ কটা বাজলো?”
“ এগারোটা।“
“ একবার বিমলাকে ডেকে দাও তো।“
তিন বছর আগে যখন বিমলা এসেছিল, তখন শিঞ্জিনীই ওকে হাতে ধরে সমস্ত কাজ শিখিয়েছিল। কিন্তু এখন বিমলাই শিঞ্জিনীর গৃহকর্ত্রী। রান্নাবান্না, ঘর পরিষ্কার করা, নীলের ফাইফরমাস সব ওই সামলায়।
নার্স বিমলাকে ডেকে নিয়ে এলো।
“ আজ কি রাঁধছ গো বিমলা?”
“ আম্নার জন্যি খিচুড়ি, গাজর, আলু , পেঁপে সিদ্ধ আর ...”
“ আর তোমাদের জন্য কি রাঁধছো?”
“ সে আর আম্নি জেনি কি করবেন। আম্নি তো আর খেতি পারবেন না।“
“ তবুও বলনা শুনি।“
“ শুক্তুনি, মুসুরির ডাল, লাউএর তরকারি আর মাছের ঝাল।“
“ তা লাউয়ে কি ফোড়ন দেবে শুনি?”
“ কেন কালজিরে, কাঁচালঙ্কা।“
“ আবার কালজিরে, বলি আজ একটু জিরে তেজপাতা, নারকোল দিয়ে ঘণ্ট বানাও না। তোমার দাদা খুব ভালোবাসে।“
“ পরের দিন করব’খন। আজ ঘরে নারকেল নেই। “
বিমলা রান্নাঘরের দিকে চলে যেতে শিঞ্জিনী আবার জানালার বাইরের দিকে তাকালো।
“ নার্স! আমাদের বারান্দায় ওই বাচ্ছা মেয়েটা কে গো?”
“ ও বিমলার ভাইয়ের মেয়ে।“
“ বিমলার ভাই তো সেই সুন্দরবনের কাছে কোথায় থাকে না?”
“ হ্যাঁ। এখান থেকে প্রায় তিন-চার ঘণ্টার রাস্তা। কাল এসেছে। কদিন থাকবে বলছিল।“
“ কৈ আমাকে তো কিছু...। বিমলাকে একবার ডাকো তো!“
মিনিট দশেক বাদে আঁচলে হাত মুছতে মুছতে বেশ বিরক্ত বিমলা এসে ঘরের দরজার সামনে দাঁড়াল,“ আমারে ডাকতি ছিলেন?”
“ হ্যাঁ ...... তোমার ভাইয়ের মেয়ে এসেছে, বলনি তো!”
“ হ্যাঁ... কাল এয়েচে। আমনাকে আর বলা হয়নিকো। কাল ভাই এয়েচিল দ্যাকা করতে, মেয়েটা বায়না ধরল, পিসি তোমার কাচে থাকব। তাই...... আমার ঘরেই শুচ্চে...।“
এই বাড়ীতে সারভেন্টস কোয়ার্টার নেই আলাদা করে। তাই বাড়ীর কোনের একটা ঘর বরাদ্দ করা হয়েছে বিমলার জন্য।
“ হুম...”
“ আমি যাই বৌদি রান্না বইসে এইচি।“
“ যাও।“
এই ঘটনার পর দু সপ্তাহ কেটে গেছে। আজকাল বিমলা আর শিঞ্জিনীর ঘরে খুব একটা আসে না।
আজ ফিসিওথেরাপিস্ট খুব খুশী শিঞ্জিনীর উন্নতিতে। বেশ কয়েক মাস ধরে উনি চেষ্টা চালাচ্ছেন যাতে শিঞ্জিনী নিজের পাটা ঠিক মত নাড়তে পারে। আজ ওয়াকার নিয়ে ও ঘরের বাইরে অবধি যেতে পেরেছে।
“ ম্যাডাম, খুব ভালো। আর কয়েক মাসের মধ্যেই ইউ উইল বি আউট অফ হুইল চেয়ার।“
ফিসিওথেরাপিস্টের প্রসংসা খুব একটা কানে গেলনা শিঞ্জিনীর, মুখে একটা কাষ্ঠ হাসি হেসে ওনাকে বিদায় করলো ও। বিছানায় গাটা এলিয়ে দিয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগলো । মনটা খুব অশান্ত লাগছে।
“ নার্স! বাইরের ঘরে সোফায় বসে টিভি দেখছিল যে মেয়েটা সে বিমলার ভাইয়ের মেয়ে না?”
“ হ্যাঁ ম্যাডাম । রোজই টিভি দেখে আওয়াজ কমিয়ে। স্যার ফিরলে, ও বিমলার ঘরে চলে যায়। আপনি ঘর থেকে বেরোন না তো তাই দেখতে পাননা। “
“ একটু জল দাও তো!“
“ এখন একটু আপেল সেদ্ধ খান। অনেকক্ষণ তো কিছু খাননি!” জলের গ্লাসটা এগিয়ে দিতে দিতে বলে নার্স।
“ দাও। বিমলাকে বল দিয়ে যেতে এ ঘরে। “
নার্স একটু ভয়ে ভয়ে তাকালো ওর দিকে, তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। নার্সের এই প্রতিক্রিয়ার কারণ জানে শিঞ্জিনী। শিঞ্জিনী অসুস্থ হয়ে পড়ার পর থেকে বাড়ীর বাকি কাজের লোকেরা, মানে মালী, ড্রাইভার, ঝাড়ুদার মায় নার্সেরা পর্যন্ত বিমলার কথা মতই চলে। খাবার দাবার নার্সেরাই নিয়ে আসে রান্নাঘর থেকে।
মিনিট পাঁচেক পরে আপেল সেদ্ধর বাটিটা নিয়ে এসে ঠক করে টেবিল এর ওপর রেখে বিমলা বলল, “ এই নিন আম্নার আপেল সেদ্ধ, দিয়ে গেলাম।“
“ আজকাল তো আমার ঘরে আসই না আর।“
“ পাঁচ কাজে থাকি বৌদি, আমার কি আর বসে শুয়ে থাকলি চলে ! সেরম ভাগ্য করে তো আর আসিনি...”
ওর কথা বলার ধরনে ধৈর্য হারায় শিঞ্জিনী, তীক্ষ্ণ গলায় বলে ওঠে, “ মানে? কি বলতে চাইছ তুমি?”
“ কিচু না। কি করতে হবে বলুন।“
“ বলি তোমার ভাইয়ের মেয়ে আর কতদিন থাকবে শুনি?” কথাটা হঠাৎ মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল ওর।
“ চলে যাবে, চলে যাবে... থাকবে বলে তো আর আসেনিকো।“ মুখে আঁচল চাপা দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে গেল বিমলা।
“ দেখেছ দেখেছ কথাবার্তার ধরন!” প্রচণ্ড রাগে কাঁপতে থাকে শিঞ্জিনী।
“ ম্যাডাম আপনি শান্ত হন। আপনার শরীর খারাপ হয়ে যাবে।“ নাইট নার্স ওর মাথায় হাত বোলাতে লাগলো।
ঝামেলা কিন্তু মিটলো না। সেদিন রাত্রে নীলাম্বরের একটা মিটিং সেরে ফিরতে ফিরতে প্রায় রাত সাড়ে দশটা হল।
“ আমি রাত্রে কিছু খাবো না বিমলা। মিটিংএ অনেক খাওয়া হয়েছে। তুমি বরং এক গ্লাস দুধ আমার ঘরে দিয়ে দিও।“ জুতো খুলতে খুলতে বলল নীলাম্বর।
“ ঠিক আছে। দাদা...... আম্নার সঙ্গে একটা কতা ছিল...।“
“ বল...।“ ক্লান্ত ভাবে বলল নীলাম্বর।
“ আম্নি আর কাউকে দেকে নিন। আমি পরের মাসে বাড়ী চলেযাব।“
“ হঠাৎ! কি হল!”
“ কিচু না।“ আঁচল দিয়ে নিজের চোখ মুছতে শুরু করলো বিমলা।
“ আরে কি মুশকিল! কেউ কিছু বলেছে তোমায়?”
“ আমি হলুম গিয়ে কাজের নোক......”
“ আহা তোমাকে কি কখনও সেই চোখে দেখেছি আমরা ?”
“ না... আম্নি কক্কনো...... আমার ভাইয়ের মেয়ে কদিন থাকবে আমি আম্নাকে বলেচিলুম। আম্নি বলেচিলেন ঠিক আচে। কিন্তু... বউদির পচন্দ না ...” বিমলার কান্না আর থামেনা।
“ আচ্ছা! আচ্ছা! আমি দেখছি। তুমি তো জানো ও অসুস্থ! “ বিব্রতভাবে বলেন নীলাম্বর।
“ সেই জন্যই তো আমি আম্নাকে কখনও কিচ্চুটি বলিনাকো...” ফোঁপাতে থাকে বিমলা।
“ বললাম তো দেখছি। তুমি নিজের ঘরে যাও!”
কপালে ভাঁজ দেখা দিল নীলাম্বরের, বাড়ীর দিকটা বেশ সামলে নিয়েছিল বিমলা, আবার কি ঝামেলা বাধল, কে জানে?
রোজ শুতে যাবার আগে একবার নিজের নুপুরকে দেখতে যায় নীলাম্বর। ঘরের দরজাটা আসতে আসতে খুলতেই, নাইট নার্স উঠে দাঁড়াল।
“ আজ কেমন আছে?” ফিসফিস করে জিজ্ঞাসা করলো নীলাম্বর।
“ ভালো। আজ ঘরের বাইরে অবধি হেঁটেছেন।“
“ কখন ঘুমিয়েছে?”
“ একটু আগে। অনেকক্ষণ আপনার জন্য জেগে ছিলেন। ডেকে দেবো স্যার?“
“ না...ঘুমোক! কাল কথা হবে।“
দরজাটা নিঃশব্দে বন্ধ করে দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো ও।
বিছানায় শুয়ে ঘুম আসতে অনেক সময় লাগলো। আজকে একটুও কথা হলনা। মনটা খুঁতখুঁত করছে। মিটিংটা এতো লম্বা চলল! কাল খুব অভিমান করবে নিশ্চয়ই নুপুর। বড্ড ছেলেমানুষ! অসুস্থ হবার পর থেকে অভিমানটা আরও বেড়েছে। একদম বুঝতে চায়না। আগে তো কত ট্যুরে যেতে হত। এখন তো ও সব বন্ধ করে দিয়েছে। কোথাও যায়না , ভিডিও কনফেরেন্সিং করে নেয় নাহলে কোনও জুনিয়রকে পাঠিয়ে দেয়।
ভাবতে ভাবতে পাশবালিশটা নিয়ে পাশ ফিরল নীলাম্বর। নীল! কি মিষ্টি করে ডাকতো নুপুর। ওই ডাকটা শুনলেই তো সব রাগ জল হয়ে যেত।
ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল নীলাম্বর ওর মনে নেই। ঘুম ভাঙ্গল ঠিক সকাল ছটায়। হাতমুখ ধুয়ে ট্র্যাক স্যুট পরে এবার ও হাঁটতে বেরবে। আগে নুপুর যেত ওর সঙ্গে রোজ মর্নিংওয়াকে । পার্কটাকে দু চক্কর দিয়ে ওরা বসত একটু। কত কথা বলতো নুপুর। উফ! টপিকও খুঁজে পায় বটে। এখন বড্ড একা লাগে। ওর বকবক গুলো বড্ড মিস করে। নাহ্ আর দেরী করলে চলবে না। উঠে পড়ে নীলাম্বর।
সাড়ে আটটার সময়ে অফিসে যাবার জন্য তৈরি হয়ে রোজকার মত শিঞ্জিনীর ঘরে ঢুকলো নীলাম্বর,” আজ কেমন আছ?”
“ তোমার সঙ্গে আমার কথা আছে। নার্স একটু বাইরে যাও তো!”
“ বল।“ বিছানার কোনটায় বসলো নীলাম্বর।
“ কি চলছে বাড়ীতে এসব? “
“ কি চলছে?”
“ বিমলা নিজের সব আত্মীয় স্বজনদের নিয়ে এসে উঠবে নাকি এবার?”
“ কি পাগলামি করছো নুপুর? বিমলার ভাইঝি এসে আছে...একটা ছোটো মেয়ে...চলে যাবে কিছুদিন পর... ও আমাকে বলেছিল। ছাড়ো না। “
“ ওঃ ! তোমাকে বলেছিল। আমাকে বুঝি আর...। “
“ তুমি এখন অসুস্থ সোনা... আর এতো ছোটো ব্যাপার...।“
“ বুঝেছি ! তুমি এগিয়ে পড়। তোমার দেরী হয়ে যাবে।“ বালিশে মাথাটা এলিয়ে দিল শিঞ্জিনী।
নীলাম্বর বুঝলো এখন আর কথা বলে লাভ নেই। আজ অনেক কাজ। ফরেন থেকে কয়েকজন ডেলিগেটস আসছে।
“হ্যালো! মিসেস চন্দ্র একটু মার্কেটিংএর মিঃ বক্সিকে দিনতো!” গাড়ীতে বসেই অফিসে ফোন লাগাল নীলাম্বর।
“ উনি আসেননি স্যার।”
“ সেকি! আজ যে ফরেন ডেলিগেসন আসবে, আজই লেট?”
“ লেট নয় স্যার! উনি আজ ছুটি নিয়েছেন।“
“ মানে? কে ওর ছুটি স্যাঙ্কসন করেছে?”
“ মার্কেটিং হেড মিঃ চ্যাটার্জি স্যার।“
“ আশ্চর্য ! মিঃ চ্যাটার্জিকে কানেক্ট করুন।“
“ চ্যাটার্জি বলছি স্যার! গুড মর্নিং!”
“ গুড মর্নিং! চ্যাটার্জি, আপনি মিঃ বক্সিকে আজ ছুটি দিয়েছে? আপনি জানেন তো ওর আজ ডেলিগেটসদের রিসিভ করতে যাবার কথা ছিল এয়ারপোর্টে।“
“ আপনি চিন্তা করবেননা স্যার, আমি অন্য কাউকে পাঠিয়ে দেবো। আসলে আজ ওর ছেলের পাঁচ বছরের জন্মদিন। তাই ছুটির জন্য খুব রিকোয়েস্ট করলো। আমিও ভাবলাম এই দিনটা তো বারবার...”
কথাটা শুনে হঠাৎ নীলাম্বরের মনে পড়ে গেল, নিজের ছেলের পাঁচ বছরের জন্মদিনে ও থাকতে পারেনি। অফিসের কাজে ট্যুরে গিয়েছিল কলকাতার বাইরে। শিঞ্জিনী একাই ম্যানেজ করেছিল। একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে নেয় ও। তারপরই মনকে শক্ত করে , জন্মদিন তো কোনও এমারজেন্সি নয়!
“ হ্যালো স্যার!” নীলাম্বরের দিক থেকে কোনও উত্তর না পেয়ে মিঃ চ্যাটার্জি বলে ওঠে।
“ তা যাকে পাঠাচ্ছেন সে চাইনিজ ভাষা জানে তো?” অন্যমনস্কভাবে বলে নীলাম্বর।
“ কেন স্যার?”
“ডেলিগেটসরা ইংরাজি বা অন্য কোনও ভাষা জানেনা, সেইজন্যই আমি বিশেষ করে মিঃ বক্সির কথা বলেছিলাম। আর আপনি আমাকে না জিজ্ঞাসা করে...।“ বিরক্ত হয়ে ফোনটা কেটে দিল নীলাম্বর।
আজ একটু অন্যরকম মেজাজ নীলাম্বরের। অন্য কোনও দিন হলে এইরকমের ভুলে সারা অফিস মাথায় তুলে নিতো ও। কিন্তু আজ কেন জানিনা ভাল লাগছে না কিছু। আজকাল শিঞ্জিনী বড্ড চুপচাপ হয়ে গেছে। আগে রাগ করতো, অভিমান করতো, আবার আলোচনাও করতো। কি করবে , কেমন ভাবে করবে। আজকাল আর কিছুই বলে না। ওদের মধ্যে একটা অদ্ভুত দূরত্ব এসে যাচ্ছে। ও যা বলে তাতেই ঘাড় নেড়ে ‘হ্যাঁ’ বলে শিঞ্জিনী। আজ অনেকদিন বাদে ও বলল, “কথা আছে।“
কিন্তু কথাটা কি খুব তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেল না? এই নতুন শিঞ্জিনীকে বড্ড অচেনা লাগে নীলাম্বরের।
চিকেন স্টুতে চামচ নাড়তে নাড়তে মর্নিং নার্স কমলিকা শিঞ্জিনীর পাশে এসে দাঁড়াল,” এটুকু খেয়ে নিন।“
“ আমার ইচ্ছা করছে না।“
কমলিকা কয়েক মাস ধরে শিঞ্জিনীকে দেখছে তাই ওকে খুব ভালো করে চেনে।
“ কি হয়েছে?”
“ কিছুই না... আসলে জানো তো মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়লে সে বেকার হয়ে যায়। “
“ তা কেন?”
“ তুমি বুঝবে না।“ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল শিঞ্জিনী।
“ হুম! মালী বলছিল বাগানে যে চন্দ্রমল্লিকার চারাগুলো আপনি লাগাতে বলেছিলেন, সেগুলোতে কুঁড়ি এসেছে।“
“ তাই?” শিঞ্জিনীর মুখ হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো।
কমলিকা জানে শিঞ্জিনীর বাগানপ্রীতি। মুচকি হেসে ওর মুখে এক চামচ চিকেন স্যুপ ঢেলে দিয়ে বলল,” আপনি নাকি কি সব অর্গানিক সারের কথা বলেছেন। বলছিল তাতে বাগানের চেহারাই নাকি বদলে গেছে।“
নার্সের কথা শুনতে শুনতে শিঞ্জিনীর মন ভেসে গেছে অনেক দূরে। নীলের অফিস থেকে হাউস বিল্ডিং লোন দিচ্ছিল।
“ বুঝলে, যা টাকা দিচ্ছে তাতে সাউথ ক্যালকাটায় রাস্তার ওপর একটা থ্রী বি এইচ কে হয়ে যাবে। কি বল নুপুর?”
“ ধ্যুর! ফ্ল্যাট বাড়ী আমার ভাল্লাগে না। ছাদ নেই, একটু বাগান নেই!” বলেছিল শিঞ্জিনী।
তাই পাঁচ কাঠা জমি কিনে এই বাড়ীটা করেছিল নীলাম্বর। মালী রেখেছিল। যাতে শিঞ্জিনীর বাগানের শখ পূর্ণ হয়। খুব সুন্দর বাগান করেছিল ও। সবাই এসে বলতো শিঞ্জিনীর হাতের গুণ আছে।
“ আজকে বিকালে কি জলখাবার করছ গো বিমলা?” বিমলাকে ঘরের সামনে দিয়ে যেতে দেখে জিজ্ঞাসা করল শিঞ্জিনী।
“ ঠিক করিনি। কেন?” যেন খুব অনিচ্ছা সত্ত্বেও এসে দাঁড়ালো বিমলা।
“ আজ একটু মুড়ি ভাজো না!”
“ দেখি।“
“ ঘরে কি মুড়ি নেই?”
“ আছে......”
“ তো বানাও না। বেশ লাগবে। একটু ঝিরি ঝিরি করে কাঁচা লঙ্কা দেবে।“
“ সব আম্নার ইচ্ছে মত হবে নাকি?” ঝাঁঝিয়ে উঠলো বিমলা।
“ হ্যাঁ তাই হবে।“ নীলাম্বরের গম্ভীর গলা শুনে চমকে সরে দাঁড়ালো বিমলা। ওরা কেউ লক্ষ্য করেনি কখন নিঃশব্দে ও পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে।
“ বৌদির ইচ্ছা মতই হবে। শিগগির যাও বানিয়ে নিয়ে এসো। আমরা দুজনে খাব। আর হ্যাঁ, লঙ্কাটা আলাদা দিও। “
“ তুমি এতো তাড়াতাড়ি? এখন তো সবে চারটে বাজে!” শিঞ্জিনী অবাক।
“ হ্যাঁ , একটু তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এলাম। নার্স আপনি ম্যাডামকে রেডি করে দিন । খাবার পর আমরা দুজন বাগানে বেড়াতে যাবো।“
“ কিন্তু স্যার ডাক্তারবাবু তো...।“
“ রাখুন। একটু এদিক ওদিক হলে কিচ্ছু হবে না। “ ঘর থেকে বেরিয়ে গেল নীলাম্বর।
শিঞ্জিনীর চোখটা জলে ভিজে উঠলো।
বাগানে চন্দ্রমল্লিকা গুলোর সামনে দুটো চেয়ার লাগিয়ে দিয়েছে বিমলা। নার্সের সাথে ওয়াকার নিয়ে হেঁটে এসেছে শিঞ্জিনী বাগান অবধি। সবাই অবাক, ও কি করে পারলো! ও নিজেও বুঝতে পারছে না ও কি করে পারলো। চেয়ারে বসে হাত বাড়িয়ে চন্দ্রমল্লিকার কুঁড়িগুলো ছুঁয়ে দেখতে লাগলো শিঞ্জিনী। নীলাম্বর নার্সকে বাড়ীর ভিতরে পাঠিয়ে দিয়ে ওর পাশের চেয়ারটায় এসে বসলো।
“ আজ প্রায় ছ-মাস পরে তুমি বাড়ীর বাইরে এলে কি বল নুপুর?” ওর হাতের আঙ্গুলগুলো নিয়ে খেলা করতে করতে বলল নীলাম্বর।
“ কি ব্যাপার বলত? আজ যে হঠাৎ মিঃ অধিকারীর বাড়ীর কথা মনে পড়ে গেল?”
“ নীল...... নীল বলেই ডাকো না নুপুর! “
“ কেন?”
“ কেন তুমি বোঝো না? আজও যে তোমার সঙ্গই আমাকে বেঁচে থাকার অক্সিজেন দেয়!“
নীলাম্বরের কাঁধে মাথা রেখে ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলল শিঞ্জিনী, “ নীল! আমার নীল!”
“ জানো... আজ হঠাৎ... বুঝতে পারলাম, জীবনের সায়াহ্নে... প্রেম আর সাহচর্য সমার্থক। “ কথাগুলো বলতে বলতে শিঞ্জিনীর হাতটা শক্ত করে চেপে ধরল নীল।