Sanghamitra Roychowdhury

Classics

2.1  

Sanghamitra Roychowdhury

Classics

সারোগেট মাদার

সারোগেট মাদার

10 mins
1.4K


সিজারিয়ান অপারেশন করে শীলার সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়েছে। বাচ্চাটা কী সুন্দর, ফুটফুটে, একমাথা কালো কুচকুচে চুল! কয়েকহাত দূরের ছোট্ট বেবিকটে পাতলা কম্বল মুড়ে শোয়ানো। ছোট্ট ছোট্ট হাত দুটো বেরিয়ে আছে কম্বলের বাইরে। ঘুমোচ্ছে। ঘুমের মধ্যেই মাঝেমাঝে চোখ পিটপিট করছে, আর হাত দুটোকে নাড়ছে। দেখলেই কোলে তুলে বুকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে হয়।


শীলার মাকে এই কেবিনে প্রথমে ঢুকতে দিচ্ছিল না এই নার্সিংহোমের স্টাফেরা। বলছিল মানা আছে নাকি। আরে বাবা, শীলার মা এসেছে। শীলার নিজের মা... পরিচয় দিয়ে অনেক অনুরোধ উপরোধ করতে, তবে কেবিনে ঢুকতে দিয়েছিল। তখনও শীলার জ্ঞান ফেরেনি। বাচ্চাটাকে তখনও পর্যন্ত এই কেবিনের বেবিকটে শুইয়ে রাখা আছে, কেবলমাত্র একবার বাচ্চাটাকে শীলার বুকের দুধ খাওয়ানোর জন্য। ডাক্তারবাবু বলেছেন যে বাচ্চার শরীরে মায়ের বুকের দুধ অমৃতসমান। মায়ের দুধ বাচ্চার মৃতসঞ্জীবনী সুধা।


শীলার মা কেবিনের একপাশে একটা টুলে বসে অপেক্ষা করছে। কতক্ষণে শীলার জ্ঞান ফেরে তার অপেক্ষায় বসে আছে বেবিকটে শোয়ানো বাচ্চাটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে। দূর থেকে একঝলক দেখতে দিয়েছে নার্সটা। শীলার মা অনেক কাকুতি মিনতি করেছিল। তবে কোলে নেওয়া তো দূরের কথা, একবার ছোঁওয়ার অনুমতি অবধি দেয়নি। শীলার মা ভাগ্যের কথা ভাবছিল। এভাবেই সারাটা দিন প্রায় পেরিয়ে গেল।


জ্ঞান যখন ফিরল শীলার তখন সে আর স্বাভাবিক নেই। বুকে অসহ্য টনটনে ব্যথা। টপটপ করে স্তন দিয়ে বেরিয়ে আসা দুধ গড়িয়ে ভিজে যাচ্ছে শীলার জামাকাপড়, বিছানার চাদর সবকিছু জবজবে হয়ে। চোখ থেকে গড়ানো জলে ভিজে ন্যাতা তার বালিশ। শীলার মা মেয়ের মাথায় হাত বুলোচ্ছে আর আঁচলের খুঁটে নিজের চোখ মুছছে। 


বাচ্চাটাকে শেষপর্যন্ত আর শীলার বুকের দুধ আর খাওয়ানো হল না। দেরি হয়ে যাচ্ছিল। সবকিছুই তো নির্দিষ্ট ছকে বাঁধা নিয়মে চলছিল। বাচ্চাটাকে নার্স বেবিকট থেকে তুলে নিয়ে চলে গেল। একটুখানি কেঁদে উঠল বাচ্চাটা। আহা গো, মায়ের বুকের দুধ পায়নি একফোঁটাও। বাচ্চাটার গলা বোধহয় শুকিয়ে উঠেছে।


এদিকে আর সময় নেই। টাকাপয়সা সব মিটিয়ে দিয়ে দম্পতি তাদের সন্তানকে বুকে করে ফ্লাইটে উঠেছে, রওনা হয়েছে নিজেদের শহরের উদ্দেশ্যে। তারা ফিরছে তাদের খুশি‌ ও সুখ কিনে নিয়ে। তাদের দু'জনের ধারণা, তারা তো উপযুক্ত দামেই তাদের হারানো হাসি, খুশি, সুখ সব কিনেছে... সারোগেট মাদারের কাজ করতে সম্মত হওয়া এক মেয়ের কাছ থেকে। একটি তো গর্ভই কেবল ভাড়া নিয়েছে তারা, তাও পর্যাপ্ত বিনিময়মূল্যের মাধ্যমে। শীলার গর্ভ।


শীলার গর্ভযন্ত্র ভাড়া নিয়ে সারোগেসি করা সন্তান এখন এক পরিবারের খুশির মূল হয়ে রয়েছে। কে জানে কোথায়। নিশ্চয়ই কোনও এক সম্পন্ন বিত্তবানদের শহরে। শীলা তার সারোগেট সন্তানের মুখখানি অবধি একবার দেখেনি। সে কেমন আছে জানে না শীলা। ভালো থাকে যেন। শীলার কাজ তো শেষ। অত মায়া বাড়িয়ে কী লাভ? অন্যের ভ্রূণ সে তার গর্ভে নয়টি মাসের জন্য রেখেছিল মাত্র। শীলার পেট কেটে সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়া অবধি। দাম বুঝে নিয়ে তার দায়িত্ব শেষ হয়েছে। কিন্তু কী আশ্চর্য! শীলার মুক্তি হয়নি গর্ভের ও গর্ভফুলের সংযোগ-নাড়ির মায়া থেকে। হোক না সে সারোগেট মাদার... তবুও গর্ভধারিণী জন্মদাত্রী মা তো বটে!


পাম্প করে করে শীলার মা শান্তি শীলার স্তন্যদুগ্ধ বের করে দিচ্ছে। শীলার স্তন্যদুগ্ধের অঝোর ধারা তার কাপড়চোপড়, বিছানা ভিজিয়ে ঘরের মেঝেয় গড়িয়ে পড়ে বয়ে চলেছে যেন দেশ থেকে দেশান্তরে। যেমন নদী বয়ে চলে এক দেশ থেকে আরেক দেশে, বিনা বাধায়। শীলার বুকের ওঠাপড়াটা ধীরে ধীরে থেমে গেল। শান্তির মানে শীলার মায়ের আর্তনাদ শীলার সারোগেসি করে রোজগার করা দু'কামরার ফ্ল্যাটের দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে খেয়ে, পাক খেতে লাগল অগুরুর ধোঁয়ার মতো! 


শান্তির মেয়ে শীলা যাত্রা করেছে চির শান্তির খোঁজে। 


--------------------------------

(বিষয়: জন্ম মৃত্যু)


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics