সাঙ্গীকরণ
সাঙ্গীকরণ
কোন এক রবিবারের মেঘমুক্ত শীতের সকাল।নীল আকাশ।আর ফুরফুরে ঠান্ডা বাতাস বয়ে চলেছে ।শীতটা সবে পড়তে শুরু করেছে ।বেশ ঝকঝকে একটা দিন।এই দূরদেশে তার দেখা মেলা অবশ্যি ভার।হাতে গরম চায়ের কাপ আর মোবাইলটা সাথে নিয়ে বাগানে চেয়ার পেতে বসলেন বিমলবাবু।হঠাৎই তার চোখে পড়ল সবুজ ঘাসের উপর পড়ে থাকা শিশির বিন্দুর উপর।তার মধ্যে পড়ন্ত সূর্যকিরণ যেন মুক্তসম।হাল্কা সূর্য্যর তাপে গরম ভাবটা মনকে বেশ একটা প্রশান্তি দিচ্ছিল।চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে তিনি মোবাইলটা খুলে আজকের খবরগুলোতে চোখ বোলাতে লাগলেন।হঠাৎ এক শীতল দমকা বাতাস বয়ে গেল।জাগিয়ে দিল তাঁর বাল্য স্মৃতি ।
মায়ের ডাকে সকালে উঠে দেখলেন বাবা খবরের কাগজ আর চায়ের কাপ হাতে তাঁর কাকুর সাথে কি যেন বিষয় নিয়ে আলোচনায় নিমগ্ন।মা,কাকীমা ,ঠাকুমা সকলেই রান্নার কাজে রান্নাঘরে ব্যস্ত ।দাদু চললেন থলি হাতে বাজারে।সকাল সকাল টাটকা সবজি ,মাছ কেনা আর দু-একজন বন্ধুর সাথে প্রাণ খুলে দু-চারটে কথা হল তাঁর নিত্য সঙ্গী।কানে ভেসে এল “শীতের হাওয়ার লাগল নাচন আমলকীর এই ডালে ডালে”—- ঠাকুমার আবার সকাল সকাল রবীন্দ্র-সংগীত না শুনলে কাজে মনই বসে না।
শীত সবে পড়েছে। তাই সবাই যেন একটু অলস প্রকৃতির হয়ে উঠেছে। কাজে যেন ছাড়া ছাড়া ভাব। তার উপর রবিবারের সকাল। তাড়াতাড়ি কাজ সেরে রোদ পোহাতে পারলেই যেন শান্তি।যাই-হোক বিমল বাবুর মনটা আজ বেশ খুশি; রবিবার ------ নেই কোনো কাজের তাড়া ,নেই কোনো স্কুল যাওয়ার প্রস্তুতি। জলখাবারে লুচি আলুর দমটা বেশ জমিয়ে সকলে মিলে খাওয়া সেরে ভাইকে সাথে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন পাড়া ঘুরতে। কত যে বন্ধু-বান্ধব ,কত আলোচনা ,কত গোপন গল্প ,কত আনন্দ মিশ্রিত ঝগড়া ,কত প্ল্যান যে আছে। ছুটির দিনেই তা শেষ করতে হবে। সাইকেল নিয়ে পাড়ার মোড়ে পৌঁছতেই চোখে পড়লো পাঁচু কাকুর চায়ের দোকানে বড্ড বেশি ভিড় আজ। সোয়েটার আর মাফ্লারের আবরণে সকলকে ঠিকমতো বোঝা না গেলেও গলার স্বর প্রত্যেকেরই চেনা। হবে নাই বা কেন ?প্রত্যেকেই যে প্রত্যেকের সাথী। পাশাপাশি বাড়ি। দীর্ঘ সময় ধরে একই জায়গায় বসবাস করার সূত্রে প্রত্যেকেই একে অপরের সাথে মধুর সম্পর্কে আবদ্ধ। যেন এক সুতোয় বাঁধা। এক সুন্দর আত্মীয়তা। আর এই চায়ের দোকানে এক ভাঁড় চায়ের চুমুকের সাথে যে কত অনুভূতি ভাগাভাগি হচ্ছে তা ভাষায় অপ্রকাশ্য। কত তর্ক- বিতর্ক ,কত ভালোবাসার গল্প,কত সুখ দুঃখের অভিজ্ঞতা সকলেই সকলের সাথে খুব সুন্দরভাবে ভাগ করে নিচ্ছে সহজেই।
বিমলবাবু অপলক দৃষ্টিতে চেয়েছিলেন মানুষগুলোর দিকে ।এক অদ্ভুত প্রশান্তির ছায়া মানুষগুলোর মুখে।নেই কোনো বাড়ি যাওয়ার তাড়া ,নেই কোনো যান্ত্রিকতার ছাপ।
বিমলবাবু এক শান্তি খুঁজে পাচ্ছিলেন। যেন অনেক বছর ধরে এই শান্তির খোঁজেই তিনি ছিলেন। পাশে থেকে বন্ধুদের ডাকে যেন মোহ থেকে বেরিয়ে এলেন। আজ তো আবার আর এক বন্ধুর বাড়ি নিমন্ত্রন। সকলে মিলে এক জায়গায় মিলিত হয়ে হৈহৈ করে যাওয়া হলো বন্ধুর বাড়ি। সে এক ভালোবাসায় ভরা আপ্যায়ন।মুড়ি মুড়কি নাড়ুর সেই স্বাদ মুখ থেকে সোজা অন্তরে স্থান করে নেয়। এ এক অদ্ভুত নেশা। তারপর যাওয়া হলো ছাদে। দুপুর সবে হবো হবো। ছাদে ঠাকুমা বড়ি দিয়ে পা ছড়িয়ে বসে তা পাহারা দিচ্ছে। কাক পক্ষী এসে যেন তা নষ্ট করে দিতে না পারে। নাতির সাথে একগুচ্ছ ছেলেমেয়ে দেখে অশীতিপর সেই বুড়ি তো বেজায় খুশি। সকলকে ডেকে গল্পের আসর জমিয়ে ফেললেন। পুরনো সে সব কত মন জুড়ানো গল্প। তাদের গ্রাম ,গ্রামের সৌন্দর্য্য ,বেড়ে ওঠা ,আত্মীয়তা ,পরিবার ,বিয়ে ,প্রেমের গল্প যেন এক সুন্দর ছবির মতো ভেসে উঠছিলো চোখের সামনে। আর গল্পের মধ্যে ঠাকুমার সেই ছোট্ট মিষ্টি ছড়া আরো মিষ্টি মধুর বার্তা বয়ে আনল।
'' উই ইঁদুর কুজন
ভালো ভাঙে তিনজন
সূঁচ সোহাগা সুজন
ভালো করে তিনজন।''
অপেক্ষা চলছিল দাদুর। কখন এসে ভূতের গল্প শোনাবে।দুপুরে ভাত কচি পাঁঠার সাথে রসগোল্লা মিষ্টি দই খেয়ে দুপুর গড়িয়ে প্রায় বিকেল হওয়ার পথে। তখনই যেন ভূতের বাড়িতে হানা দেওয়ার সঠিক সময়। শীতের দিনে একটু তাড়াতাড়ি যেন সন্ধ্যে ঘনিয়ে আসে। দাদুর সাথে রোমাঞ্চকর ভূতের আড্ডা শেষ হয়ে যাওয়ার পর এবার বাড়ি ফেরার পালা। পাড়ার গলিতে তখন আলো জ্বলে উঠেছে। রাস্তা ফাঁকাই। সন্ধ্যেবেলা শীতটা যেন একটু জাঁকিয়ে বসেছে। ভূতের গল্প শোনার পর গা-টা একটু ছমছমে ভাব থাকলেও সেই ভয় নিয়ে দৌড়ে বাড়ি পৌঁছানোর মজাই আলাদা।
বাড়িতে তখন সবাই অলস। কেউ টিভিতে মন দিয়েছে কেউ রামায়ণ পাঠে ,কেউ বা নিজের পছন্দের বইখানি হাতে নিয়ে মনোযোগ সহকারে পড়ছে। বিমলবাবুও পছন্দের প্রিয় বইখানি হাতে নিয়ে লেপমুড়ি দিয়ে পড়তে লাগলেন।
হঠাৎই এক আওয়াজে চোখটা তুলে দেখলেন মোবাইল টা সজোরে বাজছে। স্ক্রিন -এ ছেলের নাম দেখে ফোন টা তুলতেই ওপার থেকে আওয়াজ এল '' hurry up ...we need to go for the breakfast ..''
এক পলকে সব কোথায় যেন হারিয়ে গেলো। তিনি উপলব্ধি করলেন সেই দিন আর নেই। এখন জলখাবারের জন্য বাইরে যেতে হয় অথবা নিজের মতো করে সময় করে নিজেরা করে নেয়। কেউ কারোর জন্য অপেক্ষা করে না। সাথে বসে গল্প করার মতো লোকও এখন কমে গেছে। সবাই যান্ত্রিক হয়ে উঠেছে। মোবাইল নামক ছোট্ট যন্ত্রটি আজ সকলকে কাছে রেখেও দূর করে দিয়েছে। হাতের মুঠোয় দুনিয়া এলেও বড় এক ব্যবধান তৈরি হয়েছে মানুষের মধ্যে। আজ পাশাপাশি বাড়ির মানুষগুলো অচেনা। কেউ পাশে থাকে না। করে না সুখ দুঃখের আদান-প্রদান। নিজের ভাষায় ভাব আদান-প্রদানের সুখ তো এ দেশে আসার পর থেকে প্রায় চলেই গেছে। মূহুর্তগুলো আগে স্মৃতির পাতায় ধরে রাখার মতো কাটতো। এখন তা যেন বড় কঠিন। এমনকি বাড়ির মধ্যে থাকাও মানুষগুলোও কেমন যেন অচেনা ঠেকে। দূরে থাকা মানুষের সাথে কথা বললেও পাশে যে আছে তাকে আমরা ভুলে যাই। একা না থেকেও একাকীত্ব গ্রাস করে।
মনে করলেন সেই দিনের কথা। কলেজ পাস করে বিলেতে একটি ভালো চাকরি পেয়েছিলেন। আনন্দ ও হয়েছিল বটে। কিন্তু সেই সহজ সরল চেনা জীবনটাকে ছেড়ে আসতেও কষ্ট হয়েছিল। ভেবেছিলেন নতুনভাবে সাজিয়ে নেবেন নিজেকে ,সুন্দর করে গড়ে তুলবেন আরো। কাজের ফাঁকে নিজেকে তৈরি করেছেন ঠিকই ই কিন্তু আর দেশে ফেরা হয়ে ওঠেনি। পরিবারের সকলেই ধীরে ধীরে দূরে চলে গেছে। এখন স্ত্রী আর ছেলেকে নিয়ে বিলেতেই সংসার করেন। আজ পঁয়ষট্টি বছরে এসে তিনি ভাবেন দিনগুলো যেন এক গল্প ছিল। গল্পের পাতা উল্টিয়ে দেখতে বা পড়তে বেশ ভালোই লাগে এখন। ছেলেকে বলতে গেলে সেই আগ্রহ যেন তার মধ্যে ফুটে ওঠে না। সে এখন x box ,mobile ,computer যুগের এক যান্ত্রিক মানুষ।
বৃষ্টির পর মাটির সোঁদা গন্ধ ,নতুন বইয়ের পাতার গন্ধ ,গ্রীষ্মের দাবদাহ দুপুরের পর হঠাৎ কালবৈশাখী ,শীতের দুপুরে ছাদে বা উঠোনে বসে রোদ পোহানো ,পাড়ার মোড়ে ধোঁয়া ওঠা চা বা পাড়ার মুদির দোকানে লাইন সবই এখন অতীত।
শীতের দুপুরে কমলালেবু খেয়ে যে খোসা র দিকে আমরা তাকিয়ে দেখি না এখন কার দিনগুলো ঠিক যেন কমলালেবুর ছাড়িয়ে ফেলা আবরণ।
এক কালে এই সব স্বাদ অনেক পাওয়া যেত। গ্রীষ্মের সন্ধ্যেবেলা লোডশেডিং হলে হ্যারিক্যান নিয়ে ,পাখা হাতে বসে কতই যে সমস্যার সমাধান হয়ে যেত সেই সবের অনেক সাক্ষী সেই রাত । তারপর একসাথে খেতে বসার আনন্দ যেন সারাদিনের সব দুঃখ কষ্ট এক নিমেষে কোথায় উড়িয়ে দিত।
সেই সব দেশের বাড়ি ,উনুন ,পুকুরধারে ঠাকুমা জেঠীমাদের আলোচনা কোথায় যেন এই কংক্রিটের বাড়ির নিচে চাপা পড়ে গেলো। মাটি খুঁড়ে গেলেও তার দেখা আর পাওয়া যায় না। আর বিদেশ-বিভুঁয়ে তো সব কিছুই যন্ত্রের দ্বারা চালিত। সবাই সদা ব্যস্ত। জানালায় দাঁড়িয়ে একটু হাওয়া খাওয়ার সময়টুকুও মানুষ পায় না। আকাশ দেখতেও আগে থেকে লাগে প্রস্তুতি।
বিমলবাবুর সদা ব্যস্ত জীবনের এ পর্য্যায়ে এসে প্রায় ক্লান্ত লাগে। তাই মাঝে মাঝে মন ফিরে যায় নিজের দেশে নিজের শহরে। পরক্ষণেই মনকে বুঝিয়ে তোলে এই তাঁর একমাত্র ভবিতব্য। সেই সব মানুষগুলো আজ শুধু গল্পের পাতাতেই। হয়তো একদিন ধুলো পরে যাবে। এখনও যে কটা দিন খুলে দেখা হচ্ছে পরবর্তী প্রজন্ম তো তার ঠিকানাও পাবে না। এতটাই যন্ত্রে তারা মেতে উঠেছে। সামান্য পাতা উল্টে দেখার আগ্রহ টুকুও তারা দেখায় না। ইচ্ছেও হয় না। আসলে তাদের ইচ্ছেটাও সম্পূর্ণ আলাদা ছন্দের। এই ছন্দ মেলানো ভার।
আজকের দিনে কাকা কাকিমা পিসিমারা হারানোর পথে। হারানোর পথে নবান্ন ভাই- দ্বিতীয়ার মতো উৎসবও। তিনি আত্মসমালোচনা করেও হিসেব মেলাতে পারলেন না সত্যিই কি এটা তাদের দোষ ? না কি যুগের সাথে মেলবন্ধন ঘটাতে পারাটাই --তার সাথে সাঙ্গিকতা বজায় রাখাটাই জীবনের সার্থকতা !আমরা যে পুরোনোকে ভুলিয়ে ফেলে নতুনকে গ্রহণ করছি তা কি আমাদের অপরাধ না কি এটা হওয়াটাই যুক্তিযুক্ত ?পুরোনো দেখেই তো আমরা নতুনকে চিনতে শিখি কিন্তু এত দুঃখ এত ব্যবধান কোথায়?আজকের দিনে দাঁড়িয়ে এই অঙ্কের হিসাব মেলানো সত্যিই কঠিন।শুধু বিমলবাবু কেন আজকের দিনে এই প্রশ্নের সম্মুখীন অনেকেই।উত্তর মেলেনি কারোর।
জীবনে উন্নতির প্রয়োজন আছে ঠিকই ই কিন্তু নিজেকে হারিয়ে ,স্বাচ্ছন্দবোধ হারিয়ে যন্ত্রের সাথে তাল মিলিয়ে চলাই যদি যুগের সাথে সাঙ্গিকতা বজায় রাখা হয় তাহলে এভাবেই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। পাতাতে ধুলো যতদিন না পড়ছে থাক না তোলা মনের কুলুঙ্গিতে --সযত্নে। যখন সম্পূর্ণ ধুলোয় ভরে যাবে --থাকবে না ধুলো সরানোর জন্য কেউ তখন না হয় ভেবে নেবো আর এক নতুন যুগের সূচনা হল। তারাও হয়তো এই বয়সে এসে তাদের কিছু হারিয়ে যাওয়া মূহুর্তকে এভাবেই খুঁজবে।
ভাবতে ভাবতেই বিমলবাবু উঠে গেলেন ; নিজেকে মিশিয়ে দিলেন যান্ত্রিকতার সেই রাজ্যে ----যে জীবনপথে বাকিটা পথ হাঁটতে হবে।