Elika Sarkar

Tragedy Others

3.9  

Elika Sarkar

Tragedy Others

।। আধুনিকতা ।।

।। আধুনিকতা ।।

4 mins
298



 দূরের এক ছোট্ট শহরের মেয়ে দীপালিকা।কালী পুজোর দিন এই আলো প্রজ্জ্বলিত হওয়ায় বাবা-মা বড় আদর করে নাম রেখেছিল দীপালিকা।এক সম্ভ্রান্ত পরিবার। বাবা বিনোদ চাটুজ্জ্যে সরকারী দপ্তরে কর্মরত।মা অনিতা দেবী গৃহ কর্মেই নিযুক্ত ।মেয়েকে বড় আধুনিক বানাতে চেয়েছিলেন।সেই সময়ে কলেজ পাস করে চাটুজ্জ্যে সংসারের হাল ধরেছিল এখনও

তিনি তা নিপূণভাবে পালন করে যাচ্ছেন।তার সুরেলা কন্ঠ সকলকে আজও মুগ্ধ করে।যখন গান করেন মন যেন পুলকিত হয়ে ওঠে ।কিন্তু মন ও সংসার - সমাজের দ্বন্দ্বে তা কোথায় হারিয়ে যায়।কিন্তু স্বপ্ন ?তা কখনও হারিয়ে যায় না।যখন এই আলো প্রজ্জ্বলিত তা যেন কখনও নিভে না যায় উদ্দীপ্ত হয়ে সারাজীবন জ্বলতে থাকে তার প্রচেষ্টায় তিনি সজাগ আজীবনকাল।সঙ্গ দিয়েছেন বিনোদবাবুও।

   এখন সেই উদ্দীপ্ত সদা প্রজ্জ্বলিত মেয়েটি আঠারো।নামের সাথে চোখেও তার সেই দীপ্ততা ফুটে ওঠে ।চেহারায় এক অদ্ভুত প্রজ্জ্বলন ।সদা অন্যায়ের প্রতিবাদী দীপালিকার আজ প্রথম স্কুল পেরিয়ে কলেজে পদার্পন ।কৈশর থেকে যৌবনের অধিকারীনী সে এখন খুব কম দিনেই সে সকলের মন জয় করে ফেলে।হবে নাই বা কেন ?গান নাচ বাদ্যযন্ত্র লেখা আর্ট সবেতেই যে সে পারদর্শী।সে যে স্বপ্নের মই বেয়ে উপরে উঠছে তাতে অনেক সুযোগ না পাওয়া প্রতিভা — সমাজের সামনে এসে দাঁড়াবে । ”স্বপ্নপূরণ” নামে সেই প্রতিষ্ঠান খোলার জন্য সে নিজে কঠোর পরিশ্রম করে চলেছে।অপ্রীতিকর মানুষদের প্রীতিকর করে তোলার স্বপ্ন পূরণে পদে পদে সে লড়ে চলেছে সমাজের সাথে।পড়াশোনার সাথে সাথে অবহেলিত মেয়েদের পাশে দাঁড়াতে চায় সে।যারা সুযোগের বা অবহেলার কারণে পিছিয়ে আছে তাদের জন্য কিছু করতে চায় সে | আমাদের সমাজ বাধা হয়ে দাঁড়ায় প্রতিক্ষন , প্রতি পদক্ষেপে।হার মানে না সে।প্রথমে নিজের শহরের সেই অবহেলিত মেয়েদের খুঁজে বের করে সে তাদের মধ্যে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে শেখায়।কিছু তার সঙ্গ দেয়। আর কিছু সেই পথ ছেড়ে জটিলতা কাটিয়ে ফিরে যায় জটিলতর পথে ।

‘মেয়েরা পুরুষদের সমান নয়’- এই শিক্ষা পেয়ে আসা মেয়েদের সে নিজেকে প্রকাশ করার মন্ত্রে আমন্ত্রণ জানায় ।কিন্ত সে পথ বড় দুর্গম।এই কাজের সূত্রেই তার আলাপ হয় আর এক প্রতিবাদী চরিত্রের মানুষ কমলের সাথে। দুজনের আলাপচারিতা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে।পূর্নতা পায় প্রেমে।

কমলের বাস কৃষ্ণনগরে।পড়াশোনার জন্য দুজনে এখন কোলকাতাবাসী।শহরের আধুনিকতার সাথে তারাও এখন বেশ পরিচিত।একদিন কমল দীপালিকাকে তার পরিবারের সাথে আলাপ করাতে কৃষ্ণনগর নিয়ে আসে।পরিবেশ বেশ আকৃষ্ট করে দীপালিকাকে।কমলের মা কে তার সেকেলে লাগলেও তা নিয়ে চিন্তিত বোধ করে না।যুগের সাথে সাঙ্গীকতা গড়তে শেখানোয় তার একমাত্র কাজ।এনাকেও যে সে তার যথাযথ করে তুলতে পারবে সে বিষয়ে তার আর কোনো সন্দেহ থাকে না।

পড়াশোনা শেষে দুই পরিবারের মতানুযায়ী দুজনে আবদ্ধ হল বিবাহ-বন্ধনে।বলা বাহুল্য দীপালিকার পরিবারের কিঞ্চিৎ অমত থাকলেও আধুনিক চিন্তাধারায় বেড়ে ওঠা মায়ের মতকে ফেলে দিতে না পারায় তারা কোন দ্বিমত করেনি। এই বন্ধনকে সঙ্গী করে দুজনের প্রচেষ্টায় তার কাজ যে এগিয়ে চলবে সেই ভাবনায় পোষন করে সে।

কমল এখন কৃষ্ণনগরের এক বিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠিত শিক্ষক।কলেজ জীবনের মত এখনও সে শিক্ষা দিয়ে চলে নিজের চিন্তা ভাবনাকে সম্মান দিয়ে বেঁচে থাকার লড়াই ।অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে নারী স্বাধীনতা নিয়ে যুক্তিপপূর্ন ব্ক্তব্য সকলের মনকে খুব সহজেই আকৃষ্ট করে তোলে।

আর দীপালিকা আজ চার দেওয়ালের মধ্যে বন্দী ।হ্যাঁ যেখান থেকে এক টুকরো আকাশ দেখা যায় সেখানেও তার যাতায়াত খুব কম।যে ব্যক্তির মুখে নারী স্বাধীনতার কথা শুনে আকৃষ্ট হয়ে বাবা মায়ের অমত থাকা সত্ত্বেও নিজের চিন্তাকে প্রাধান্য দিয়েছিল তার কাছে আজ আকাশ দেখতেও লাগে অনুমতি।কি না বাড়ির মেয়েদের নাকি বাইরে যাওয়া ভালো দেখায় না।এ কোন যুগে আমরা বাস করছি? একুশ শতকে দাঁড়িয়েও এমন পরিস্তিতির শিকার সমাজের অনেক মেয়েকেই সম্মুখীন হতে হয়।প্রথমত তার চাকরী বন্ধ করে দেওয়া হয় কেন না তাদের ছোট্ট রূপসার দেখাশোনা করার জন্য।মেয়ের মুখ চেয়ে দীপালিকা তাই করে।পাঁচ বছর অতিক্রম করে গেছে।কমল তার প্রতিবাদী আচরণে এখনও চিৎকার করে ওঠে।মায়ের অবাধ্যপনাকে প্রশয় না দেওয়া, পুরূষ জাতির উপর কথা বলা , কথায় কথায় যুক্তি দিয়ে তর্ক করাকে অলক্ষী আখ্যা দেওয়া কোন কিছুতেই সে পিছ পা হয় না।দীপালিকা এখনও তার লড়াই চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে তার সেই মূল মন্ত্রকে আঁকড়ে রেখে, তার সেই স্বপ্নপূরণের টানে।কিন্ত কোথাও যেন তার শক্তি ধীরে ধীরে লোপ পাচ্ছে।দিন দিন মানষিক অত্যাচারে সে ক্লান্ত।সংসারও আজ তার গলা টিপে ধরতে চাইছে।যে কমলকে সঙ্গী করে সে স্বপ্নপূরণ করার স্বপ্ন দেখেছিল আজ তা চূর্ণ বিচূর্ণ।সব বোঝাই আজ ব্যর্থ।সব বোঝানোও আজ ভিত্তিহীন।সে সমস্ত বাধাকে অতিক্রম করে ঘরের গন্ডির বাইরে যেতে চাইছে শুধু একটু মুক্ত বাতাসের আশায়।এই মুখোশধারী মানুষের সংস্পর্শ আজ তাকে সেই অবদমিত মেয়েদের পর্যায়ে এনে ফেলেছে। যাদের সে একদিন ঘুরে দাঁড়ানোর মন্ত্র শোনাতো আজ তার নিজের ক্ষমতার বাইরে।শিক্ষা , স্বচ্ছলতা থাকলেই যে একজন মেয়ে কতটা পরাধীন তার ঠিকানা পাওয়া যায় সহজেই।

মানুষ ও পরিবেশ একে অপরের পরিপূরক।দুই বস্তুর সামঞ্জ্যস্য না থাকলে তা বড়ই ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে।রাতের আকাশ দীপালিকার একমাত্র সঙ্গী ।এই একটি সময় শুধু সে নিজেকে নিজের মত করে পেতে পারে।পরিবারের সাথেও তার দেখা প্রায় বন্ধ বললেই চলে।কারন অবাধ্য মেয়েকে বাধ্য করতে নতুন পরিবার সবরকম পদক্ষেপই নিয়েছে।

       

ধীরে ধীরে প্রজ্জ্বলিত আলো নিভে যেতে থাকে।প্রদীপের আলো যেমন চারপাশকে আলো দিলেও নিজে অন্ধকারে নিমজ্জিত ।দীপালিকাও একদিন অন্ধকারে আশ্রয় নিল।আলোর       মধ্যে অন্ধকার দেখাই হলো প্রকৃত অন্ধকার |

     এটাই কি তার প্রাপ্য ছিল ? এই কি আধুনিকতা? কমলের বাইরের আর ভিতরের জগতের এত পার্থক্য যে সে আর নিয়ে উঠতে পারেনি।

    আমাদের সমাজের অনেক ঘরে ঘরে এখনও নিরূপমা-রা এইভাবেই হারিয়ে যায়।যার খোঁজ কেউ পায় না। নীরবেই তারা শেষ হয়ে যায় ।তবে এর শেষ কোথায় জানা নেই কারোর.........

 ইলিকা      


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy