রুটি আর আমি
রুটি আর আমি


প্রিয় বন্ধুরা-
আজকের দিনটা ভয়ংকর গেল। আজ আমি জীবনের সবচেয়ে বড় শিক্ষা টা পেলাম।
আসলে সেই মার্চ মাস থেকেই আমাদের জন্য সময়ের কাঁটাটা অতি দ্রুত ঘুরছে। এই দুমাস পৃথিবীর জন্য সময় যেমন থমকে গেছে, আমাদের জন্য ঠিক তার উল্টোটা। বারো এমনকি চোদ্দ ঘন্টা পর্যন্ত ডিউটি করছি। গত আটবছরের কেরিয়ারে এতটা স্ট্রেস আগে কখনো নিতে হয়নি। যদিও সেই ছোট্ট থেকেই আমি খুব খাটতে পারি, খুব খেটেও ছিলাম শুধুমাত্র এই একটা স্টেথোস্কোপ পাবার স্বপ্নটার জন্য। আজো মনে আছে সতেরো বছর আগে মাত্র ষোলো বছরের আমি বাড়ি ছেড়েছিলাম কেবলমাত্র এই স্বপ্ন টা পূরণের খিদায়। CBSC 10th এ যখন টেন পয়েন্ট পেলাম তখন বুঝলাম আর এই উত্তর প্রদেশের ছোট গ্রামে থেকে খুব একটা আশা নেই, আব্বু বললেন, এলাহাবাদ বা লক্ষ্ণৌয় চাচার বাড়িতে থেকে ইলেভেন টুয়েলভ পড়তে, আমিই বলে ছিলাম, কোটায় পড়ব। খুব ভালো করে মনে আছে, এরকমই এক রমজান মাসে ইফতারে বসে কথাটা পেড়েছিলাম আমি, আর আব্বু ভয়ংকর বিষম খেয়েছিলেন। আম্মু বকাঝকা করা শুরু করে দিলেন, বলে কি, একটা মেয়ে অতদূর পড়তে যাবে। শুরু হলো চিৎকার, কনজারভেটিভ বাড়ির একটা মেয়ে এত কম বয়সে অতদূর একা কেন যাবে, "নিশ্চয়ই তোর কোন চক্কর আছে, এজন্যই আমি তোমাকে বলেছিলাম ইংরেজি স্কুলে পাঠিয়ো না"- কেঁদে বলেছিলেন আম্মু আব্বাকে। কিন্তু কিছু দিন ধরে টানা বোঝানোর পর দুজনেই এক সময় বুঝলেন যে আমার সত্যিই কোন চক্কর নেই, আসলে চক্করে পড়তে গেলেও যে সময় টা লাগে, আমার তো সেই সময়টাই কখনো ছিল না, আমার সারা দিন রাত কেটে যেত বইয়ের পৃষ্ঠায় সিঁদ কাটতে কাটতে। আমি যেন খুঁজে বেরাতাম সারা ক্ষণই কিছু। সেই কিছুটা আর কিছুই নয়, কেবল একটা স্টেথোস্কোপ। একটা রুটি ছাড়াও আমার দিন চলত, কিন্তু সারা দিন রাত না পড়ে আমি ভাবতেই পারতাম না জীবনটা, কোথা থেকে ঈদ আসত যেত টেরই পেতাম না। আমার কোন কিচ্ছু দরকার ছিল না এই পৃথিবীতে শুধু বই আর বই ছাড়া। পরীক্ষা দিয়েছিলাম সবার অলক্ষ্যে অনলাইনে, কোয়ালিফাই করলাম, স্কলারশিপ পেলাম কোটার এক নামকরা স্কুলে, সারা দেশ থেকে মাত্র দশজন সিলেক্টেড, আমি তাদের মধ্যে একজন, এরপর আর আব্বু আম্মু কিছু বলেননি, পৌঁছে দিয়ে এলেন আমায়, রেখে এলেন হস্টেলে। আর ভর্তি হলাম এক প্রসিদ্ধ মেডিকেল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট এ। এটা তখন দেশের অন্যতম প্রাচীন আর ততোধিক প্রসিদ্ধ মেডিকেল স্টুডেন্ট ট্রেনিং ইন্সস্টিটিউড। তারপর আমি চান্স পাই মতিলাল নেহেরু মেডিক্যাল কলেজ, এলাহাবাদ। আমাদের মহল্লায় প্রথম মেয়ে আমিই যে মেডিক্যালে চান্স পাই। উৎসব শুরু হয়ে গেছিল, মনে আছে মঞ্চ বেঁধে আমাকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়, আব্বু ভাষণে বলেছিলেন-" ছেলে আর মেয়ে, সবাই সমান। সবাইকেই যদি সমানভাবে আপনারা স্বপ্ন দেখতে ছেড়ে দেন, তো ঘরে ঘরে অনেক আয়েশা তৈরি হবে। আর আজ থেকে আমার আয়েশা ইয়াসমিন আপনাদের সবার। " এরপর MBBS ও শেষ হয়ে গেল একসময়, আমি AIIMS এ মেডিসিন নিয়ে MD তে ভর্তি হই, এইপর্বে আমার জীবনে আসে সাইলুর। সাইলুর আলমগীর হাজারি।
মুর্শিদাবাদ এর বেলডাঙার। আপনাদের পশ্চিমবঙ্গের। ক্যান্টিনে আলাপ হয়েছিল হঠাৎই আমার আর সাইলুর এর। সাইলুর পেডিয়াট্রিক কার্ডিওলজি নিয়ে পড়ছিল, আমার একবছরের সিনিয়র। আমাদের বন্ধুত্ব ধীরে ধীরে অন্য মাত্রা পেল, ওর কাছেই আমার বাংলা শেখা। পুরোপুরি MD কমপ্লিট হবার পর বিয়ে হয় আমাদের। ততদিনে আমি বাংলা লিখতেও পারি। পড়ে ফেলেছি রবীন্দ্রনাথ, নজরুল। কোরান শরিফের সঙ্গে ঠাঁই পায় নজরুল সমগ্র, সঞ্চয়িতা, গীতবিতান। নজরুল আমার প্রিয় কবি। কাণ্ডারী হুঁশিয়ার আমার সবচেয়ে ভালো লাগে। যাইহোক তারপর জীবন কেটে যাচ্ছিল সুপার ফাস্ট ট্রেনের মতোই। আটমাস আগে মা হয়েছি আমি, ফুটফুটে একটা মেয়ের জন্ম দিয়েছি, আয়েশা সাইলুর ইয়াসমিন এখন এক মা, কিন্তু ভীষণ অভাগা মা। এই গত দশদিন ধরে আমি বাড়ি যাবার সময় টুকুও পাচ্ছি না, এত ওয়ার্ক লোড। কিন্তু নেচার তো মানেনা, তাই কামিজ ভিজে যায় আমার সন্তানের খিদের দুধে ডিউটি দিতে দিতেই। চোখ জ্বালা করে ওঠে, কল দিই আম্মুকে, আমার ছোট্ট শাকিনা খেল কিনা ল্যাকটোজেন জানতে। সাইলুর ও বিজি, ও এখন টাটা মেমোরিয়াল, মুম্বাই এর HOD. আর আমি ঔরঙ্গাবাদ হসপিটালে, দূরত্ব যতই হোক, মনের দূরত্ব বিন্দুমাত্র নেই। তবে আজ মনটা ভেঙে গেল আমার।
এবার আমি ছেড়ে দেব এই আমার এত সাধের আজন্ম স্বপ্নের স্টেথোস্কোপ টা। হ্যাঁ আমি আজ রেসিগনেশন লেটার লিখেছি, এই গল্পটা টাইপ করেই সেটা ডিনকে সাবমিট করে আসব, মানলে ভালো, নইলেও থাকব না। আর ওয়েট না করে বেরিয়ে যাব গাড়ি নিয়ে। তার আগে শেষবারের মত একবার মর্গে যাব। ঠাণ্ডা ঘরে দেখব কিছু সদ্য পোস্ট মর্টেম সারা লাশের গায়ে লেগে আছে রাষ্ট্রের খিদা, যেমন নিউজ চ্যানেলে দেখলাম ছড়িয়ে আছে রেললাইনে রুটির টুকরো। আর চলন্ত মালগাড়িটা...
এটুকু আপনারা সবাই দেখেছেন, কিন্তু আমার মত অভাগা নন আপনারা, দেখেননি এই ঔরঙ্গাবাদ হসপিটালে নিয়ে আসা সেই অভুক্ত হতদরিদ্র ক্ষুধার্ত পরিযায়ী শ্রমিক ভাইদের লাশ। আমি দেখেছি, পোস্ট মর্টেম টা আমাকেই করতে হলো। আর ওদের রক্তে, ওদের পেটে একটা জিনিস কমন পেলাম তা হলো খিদে। আমার সন্তানের মতোই ওরাও ক্ষুধার্ত। ভয়ংকর ক্ষুধার্ত। চারিদিকে এই ভয়াবহ সিচুয়েশনে ও চলছে রাজনীতির তরজা, জাতের নামে বজ্জাতি। আর ওদের খিদের জ্বালার তীব্রতা দেখে আমার মর্গে মনে পড়ছিল আমরা এক ডুবন্ত নৌকার সওয়ারী। নজরুল কে আজ আমাদের ভীষণ প্রয়োজন। আমার কান্নাভেজা গ্লাসে ঢাকা চোখ শুধু আওড়াতে চায়-
"বলো কাণ্ডারী ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মার"...
ভালো থাকবেন সকলে, আর আপনাদের সঙ্গে আমার কখনো দেখা হবেনা। কারণ ঔরঙ্গাবাদ হসপিটালের আপনাদের এই ডাক্তার আপারও আজ খিদের কাছে, যন্ত্রণার কাছে মৃত্যু হয়ে গেল, এবার শুধু শাকিনার সাধারণ একটা হাউজওয়াইফ মা বেঁচে থাকবে। এটা আমার এক নতুন শুরুয়াত।
"আসি অলক্ষ্যে দাঁড়ায়েছে তারা, দিবে কোন বলিদান?
আজি পরীক্ষা, জাতির অথবা জাতের করিবে ত্রাণ..." হ্যাঁ হোক আরো মিডিয়ার প্রচার, হোক আরো রাজনৈতিক দরাদরি, দোষারোপ, পরিযায়ী দের খিদে আরো বাড়ুক, আরো ভাইরাস শেষ করে দিক আমাদের, আসলে আমরা সকলেই তো এক একটা লাশমাত্র। আজ যেমন আমি শুধু এতগুলো খিদের পোস্ট মর্টেম করলাম না, পোস্ট মর্টেম করলাম আমার জীবনটারও। সত্যিই তো এত পরিশ্রমে পাওয়া এই স্টেথোস্কোপ আর ডাক্তার আপা নামটা আমার সব সময়, সব সুখ, সব বেঁচে থাকার রসদ কেড়ে নিচ্ছে, শুধু মৃত্যু আর মৃত্যু মিছিল যন্ত্রণা আর আতঙ্ক এর পসরা ছড়াচ্ছে। অথচ একটা শান্তির রুটিই তো যথেষ্ট, তাই বিদায়, সকলে ভালো থাকবেন, আল্লাহাফেজ।
- আপনাদের হতভাগ্য ডাক্তার আপা, আয়েশা সাইলুর ইয়াসমিন