রুষ্ট উইকেন্ড
রুষ্ট উইকেন্ড
![](https://cdn.storymirror.com/static/1pximage.jpeg)
![](https://cdn.storymirror.com/static/1pximage.jpeg)
অন্য দিনের মত আজও বেরোতে নটা পঁচিশ হয়ে গেলো। লিফট্ লবি থেকে ছুটতে ছুটতে সাড়ে নটার শেষ অফিস বাস- ধরতেই হবে। মিস্ হলে যে অনেক দেরি! তার ওপর আবার উইকেন্ড,শুক্রবার। কোনোমতে আজও বাসটা পেয়ে গেলো বিতান। আর লাস্ট রো তে জানলার ধারে সিটও জুটে গেলো। মনটা একটু খিঁচ্রে আছে, অনেক চাপ গেছে আজ সকাল থেকে। তারপর টার্গেট টাও মিট্ হলো না। ইউনিটেক ছাড়িয়ে বাসটা ঘুরতেই কি একটা দেখতে চেষ্টা করলো বিতান। না, পেলো না দেখতে। অ্যাক্সিডেন্টের কোন চিহ্ন নেই। পরক্ষণেই মন আর সাথে চোখটা ঘুরিয়ে নিলো। নাহ্, আর ভাববে না। এই করে সকাল থেকে কাজে অনেক ব্যাঘাত ঘটেছে। কাল পরশু ছুটি, বরঞ্চ ভালো ভালো কথা ভাবা যাক। কাজ নিয়েও আর ভাববে না ঠিক করল। যা হবে সোমবার দেখা যাবে। সারা সপ্তাহের এই এত চাপ, স্ট্রেস্ আর নেওয়া যাচ্ছেনা। বরং শনি রবির কাজের শিডিউলটা করা যাক। বিতান তাকিয়ে দেখল বাসটা নারকেল বাগান অব্দি এসে ঘুরছে, এবার টানবে সাঁই সাঁই। হলও তাই। অফিস বাসের লাস্ট সিটে জানলার ধারে হু হু হাওয়ায় মনটা ভরে যেতে থাকে মধ্যবিত্ত বিপিও চাকুরে বিতানের। বাস ছুটে চলে রাজারহাটের ব্যাস্ত রাস্তা ধরে। ব্যাস্ত বলা ভুল, সপ্তাহান্তের রাত, একটু ফাঁকাই। গতিবেগ বাড়ে বাসের। আলো ঝলমলে ইকো পার্কের পাশ দিয়ে বেরিয়ে যায় বাস। বিতান একটু আকাশের দিকে তাকালো। রাত হোক বা দিন, ও যে আকাশ দেখতে বড় ভালোবাসে। হালকা হালকা মেঘ জমেছে। কি একটা ভালো ভাবতে গিয়ে ও টের পেলো ওর মনেও একটু মেঘ জমেছে। বিতান কি ইমোশনাল হয়ে পড়ছে! সারা সপ্তাহে একবারও ওর বেস্ট ফ্রেন্ড তোড়া হোয়াটস্অ্যাপ এ কথা বলেনি- ওই গুড মর্নিং আর গুড নাইট ছাড়া। ওর ও তো অফিস, শনি কি রবিবার বলেছিল দেখা করবে। অনেক দিন আড্ডা দেওয়া হয় না তোড়ার সাথে। তোড়ার বয়ফ্রেন্ড এর সাথে সেদিনই কত কথা হল। বিতান বোঝে সবাই ব্যাস্ত। ছুটির দিনে বিতান নিজেও ব্যাস্ত থাকে কত! পিসিমনির কাছে এই নিয়ে বকাও খেলো আগের সপ্তাহে। এসব ভেবে একটু যেন হাসিই পেয়ে গেলো মনে মনে।
আচমকা বিকট আওয়াজ করে একটা ব্রেক! মনটা একশ আশি ডিগ্রি ঘুরে গেলো যেন। একটু ভয়ই পেলো বিতান। সকালের ঘটনাটা শোনার পর থেকে একটা ভয় কাজ করছে বিতানের, বেশ বুঝতে পারলো। এমনি তে বাসে করে যখন যায় তখন রাজারহাটের নির্মিয়মান মেট্রোর ব্রিজের নিচ দিয়ে যাওয়ার সময় একবার করে ব্রিজের দিকে মুখ তুলে তাকায় বিতান, সেও এক অজানা ভয়ে। গণেশ টকিস্ এর দুর্ঘটনাটা ঘটার পর থেকে একটা হালকা আতঙ্ক চেপে বসে ওর ওই মেট্রো ব্রিজের নিচ দিয়ে যাওয়ার সময়। ব্রিজ ভাঙার ভিডিও টা ফেসবুকে শেয়ার হয়েছিল, ফেসবুক স্ক্রল করতে করতে অনেক বার এসেছে কিন্তু বিতান একবারও ভিডিও টা চালিয়ে দেখেনি, ইচ্ছা করেই! দেখতে ইচ্ছা করেনি একদম। হয়ত নিজের শহরের, কোলকাতার একটা দুঃখজনক মুহুর্ত বলেই দেখতে পারেনি! লোকের মুখে শুনেই খুব কষ্ট হয়েছিলো ওর। বিতান দিন কে দিন ইমোশনাল হয়ে পড়ছে বোধহয়! ও মুখটা বাড়ালো জানলা দিয়ে। না, তেমন কিছুনা। হঠাৎ সিগনালটা জ্বলেছে। বাস চলতে শুরু করলো। বিতান একটু আনমনা! কিছু একটা ভাবছে। যেতে যেতে বেশ কিছু সময় পর কোত্থেকে ছয়চাকার ভারী একটা লরি যেন খুব জোরে বাসটাকে ওভারটেক করছে, বাসটাও গতি বাড়িয়েছে। লরিটা আরও জোরে স্পীড নিয়ে এগিয়ে গেলো। কোত্থেকে একটা স্কুটি এসে পড়লো, সেটা আবার লরিটাকে পেরিয়ে যেতে চাইছে। চালক একটু বয়স্ক – বাবার মত। বাবাও তো স্কুটি চালায়! এক নিমেষে মনে পড়ে গেলো দু বছর আগে বাবাকে নিয়ে সেই হসপিটাল আর বাড়ি করার দিন গুলো, আয়াদের দুর্ব্যবহারের দিন গুলো, বাবাকে হসপিটালে ভর্তি করে নিজের একলা ঘর ছেড়ে খাটে মা এর সাথে চিন্তায় ঘুমো
বার রাত গুলো। বিতানের চীৎকার করে বলতে ইচ্ছে করলো- কি দরকার এত তাড়াহুড়োর ? আস্তে যাও না! লরিটা হঠাৎ বাসের কাছাকাছি এসে আবারও দ্রুত গতিতে এগিয়ে যেতে থাকলো। স্কুটিটা আর দেখা যাচ্ছে না, চলে গেছে। বিতান আবারও মনের মধ্যে একটা চাপা উৎকণ্ঠা অনুভব করলো। লরির পেছনের চাকা গুলোর দিকে চোখ গেলো। পেছনে আসা অন্য গাড়ির আলোয় ভেজা রাস্তার জলে চাকা গুলো চকচক করছে। বিতান যেন দেখতে পেলো ঘুর্ণায়মান চাকায় চাপ চাপ রক্ত। লরিটাকে বলতে ইচ্ছে করলো- প্লিজ আস্তে যাও। কারো প্রাণ নিয়ো না।
মুখ ফিরিয়ে নিলো হঠাৎ সন্ত্রস্ত হয়ে পড়া বিতান। ভ্রূ টা কুঁচকে গেছে টের পেলো। বিরক্তিতে। বাসটা আস্তে আস্তে থামলো। লরিটাও ঘর ঘর করে চলে গেলো। বাসটা যেখানে দাঁড়ালো জায়গাটা একটু শান্ত। মনটাও একটু বোধহয় শান্ত হলো। যেন একটা রেস্ চলছিল। উফ্! কেন যে এরকম হচ্ছে সকাল থেকে! বিতান আজ সকাল থেকেই আনমনা। অফিসের গেটের সামনে ঘটা অ্যাকসিডেন্টের কথাটা শোনার পর থেকেই মাঝে মাঝেই অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছে। মানিশ প্রসাদ যখন বলে যে, সে নিজের চোখে একটা আস্ত মানুষকে বাইক সমেত ছয় চাকার লরির নিচে ঘষটাতে ঘষটাতে পিশে গিয়ে একটা চিকেনের দলা হয়ে যেতে দেখেছে আর সারা রাস্তা নাকি রক্তে ভেসে যেতে দেখেছে তখন বিতানের আর কাজে মন বসে না। মনে মনে বলে ওঠে- যার গেলো তার তো গেলো! আর উৎকণ্ঠা টা আরও বাড়ে যখন শুনল সাদাব আলম নামাজ পড়তে গেছে ঠিক ওই অ্যাকসিডেন্টের সময়ই। পল্লব দার বার বার ফোন করা সত্ত্বেও সাদাবের ফোন না তোলাতে টেনশানের পারদ শুধু বিতানের না, শুচিস্মিতা, কৌশানি, সৌম্য দা, শতরূপা দি দেরও বেড়েছে। শেষ পর্যন্ত্য বেসমেন্টে গাড়ি রাখার সময় সাদাব ফোনটা তোলায় সবার উদ্বেগ কাটে। ফ্লোরে ঢুকে সাদাব, তাকে নিয়ে চিন্তার কথা শুনে শুধু হাসে, আর একটাই কথা বলে- “আরে, ইতনা জালদি হাম মারেঙ্গে নেহি!” কে জানে কি হলো, বিতান আর বসে থাকে নি। তৎক্ষণাত উঠে গিয়ে সাদাব কে জরিয়ে ধরে। বিতান কি সত্যি ইমোশনাল হয়ে পড়লো?
লরির চাকার থেকে চোখ সরিয়ে আবার সেই কথা গুলো মনে পড়ে গেলো। যত ভাবছিলো মনে করবেনা সেই মনে পড়ে গেলো। ততক্ষণে বাস চলতে শুরু করে অনেকটা দূর এসে গেছে। এবার প্রায় নামার সময় হয়ে এলো। বিতান ভাবতে থাকে সেই নাম না জানা ছেলেটা কি জানতো, আজ আর তার বাড়ি ফেরা হবে না, তার মা, তার বাবা, কতই না অসহায় এখন! সন্তান হারা! অস্ফুটে বিতান আবারও বলে ওঠে- যার গেলো তার তো গেলো! আচ্ছা, ছেলেটার কতটা তীব্র কষ্ট, যন্ত্রণা হয়েছে ওই কয়েক মিনিট, ওই কয়েক মুহূর্ত! বাইক সমেত লরির নিচে পিষ্ট হয়ে দলা হয়ে গেলো একটা ফুটফুটে জল জ্যান্ত তাজা প্রান! ভগবান, তুমি এত নির্দয়! নাহ্, নাহ্, নাহ্, আর না। আর ভাবতে পারছে না বিতান। যেন চোখ টা ভিজে আসছে, বুকের কাছটা ভারী হয়ে গেলো। বাস থেকে নেমে পড়ল। এবার হাঁটা, বাড়ির পথে। দশটা পাঁচ বাজে। আরও কুড়ি মিনিট। মা রোজ বিস্কিট দিয়ে দেয়। আজও ছিল ব্যাগে। আজ আর খেতে ইচ্ছে করলোনা। ক্লান্ত শরীরে হাঁটতে লাগলো বাড়ির পথে। নাহ, আর দুঃখের কথা ভাবছেনা। উইকেন্ডের প্ল্যানিং করতে হবে, প্র্যাকটিস আছে, তোড়াকে বলতেই হবে একবার তিন মিনিটের জন্য হলেও মিট্ করতে, ক্লান্তিটাও মুছে যাচ্ছে, দুদিন যে ছুটি। নিজের জন্য, নিজের মত করে কাটাবার ছুটি, নিজেকে খুঁজে পাওয়ার ছুটি। আরও একটু ভালো ভাবে বাঁচার ছুটি। হাঁটতে লাগলো বিতান, আরও নতুন নতুন ইচ্ছা, স্বপ্ন নিয়ে। অ্যাক্সিলেটরে চাপ দিয়ে ইনফোস্পেস- বিপি পোদ্দার এর অফিস বাস ছুটে চলল ফ্লাইওভার ধরে। ব্রিজের নিচে পড়ে রইল সপ্তাহের কাজের চাপ, স্ট্রেস, টার্গেট, দুঃখ, কান্না, ছয় চাকার লরি আর...।