মহাষ্টমী
মহাষ্টমী
তখন ঘড়িতে দুপুর তিনটে । বাগবাজার বাটার সামনে বাস টা সিগনালে দাঁড়ালো । একটা মাঝারি হাইটের ছেলে নেমে এলো প্রবল উৎসাহে । ছেলেটার কাঁধে একটা স্লিং ব্যাগ, পরনে ক্রিম চিনোস, কালোর মধ্যে হালকা গোল্ডেন প্রিন্ট ফুল শার্ট - হাতা গোটানো আর পায়ে ব্রাউন হান্টার সু, সানগ্লাসটা বুকের বোতামে ঝোলানো । অনেক দিনের অভ্যাস মত শার্টের একটা বাটন্ খোলা, বলা ভাল এটাই ছেলেটার নিজস্ব স্টাইল স্টেটমেন্ট - দেখে প্রথমটা দাদা মার্কা মনে হলেও পরক্ষণে সে ভুল ভাঙবে । চুলে হালকা স্পাইক আর ক্লিন শেভ্ড মুখে অত্যন্ত ভালোমানুষ গোছের চেহারা । বয়স এই পঁচিশ এর মত হবে । সদ্য কর্পোরেট কোম্পানীতে চাকরি পাওয়া নিপাট ভদ্র ছেলেটার নাম - অগ্নি সেন । সময়টা - মহাষ্টমীর ভরা যানজটের দুপুর, রাস্তা পার হবে ছেলেটা । দেখলো ওপারে তার বহু প্রতিক্ষিত মিষ্টি বান্ধবীটি দাঁড়িয়ে, ইতস্ততঃ ঘড়ি দেখছে । নাহ্, ছেলেটা আজ টাইম মতো এসেছে । সেবার একবার দশমীতে এত দেরী করে ফেলেছিল আসতে যে বেচারী রাগে সেই যে দেখা না করে চলে গেছিল, তারপর কত মাস কথা বলেনি । তাই অগ্নি এবছর আর রিস্ক নেয়নি । এমনিতেই কত সাধ্য সাধনা করে মেয়েকে রাজি করিয়েছে বেরোতে । তাও মেয়েটা আবদারী ভঙ্গিতে কড়া ভাবে বলেছে - লাইনে দাঁড়িয়ে, ভিড় ঠেলে ঠাকুর দেখবো না, এই বলে দিলাম । অগ্নি ও রাজি হয়েছে তার প্রিয় বান্ধবীর শর্তে । হাজার হোক প্রিয় বান্ধবী বলে কথা ! একটু আড়াআড়ি ভাবে রাস্তা পার হল অগ্নি । আস্তে আস্তে পেছনে গিয়ে দাঁড়ালো । তারপর পেছন থেকে দুহাতে মেয়েটার চোখ দুটো ঢেকে দিলো । আচমকা এই ঘটনায় একটু ভয়ই পেয়ে গেছিল অগ্নির প্রিয় বান্ধবী চব্বিশ বছরের মিষ্টি মেয়ে ওলি । অগ্নির হাত বুঝতে পেরে ওলির সেই ভুবন ভোলানো হাসি; আর তা দেখে অগ্নির হাত অটোমেটিকালি ওর চোখ থেকে সরে গেলো ।
প্রাণোচ্ছল ওলি বলে ওঠে - চল্, এবার যাওয়া যাক । অগ্নি একটু তির্যক হেসে বলে - দাঁড়া, আগে তোকে ভালো করে একটু দেখি । বলে হেসে ওঠে । ওলিও ওর পিঠে একটা চাপড় মেরে হাত ধরে অগ্নিকে এগিয়ে নিয়ে যায় ।
ওলিকে এক ঝলক দেখে অগ্নির খুব ভালো লাগছে আজকে - পুরো অন্যরকম লাগছে আজ । ওলি আজ এই প্রথম সাদা স্লিভলেস একটা টপ পরেছে যেটা কদিন আগেই বাজার কোলকাতা থেকে অগ্নির সাথে গিয়ে কিনেছে । সাথে কালো জিন্স আর চোখে মোহময়ী কাজল । সপ্তমীর রাতে যখন ফাইনালি যাওয়াটা ফাইনাল হলো তখন নেক্সট প্রশ্নই অগ্নির এসেছিল - ওই, কি পরবি কাল?
ওলি বলে - যেটা তোর সাথে গিয়ে কিনলাম সেদিন, ওইটা, কিন্তু... ।
- কিন্তু কি?
- না, মানে ওটাতে হাতা লাগানো হয়নি । স্লিভলেস তো!
- তো কি হলো? তাই পর । আর বেসিকালি তোকে কোনদিনও স্লিভলেসে দেখিনি । দেখ, কাল পরে নে, তারপর পুজোর পর হাতা লাগিয়ে নিবি, সিম্পল! - সত্যিই একদম সিম্পল ভাবে অগ্নি কথাগুলো বলে গেল ।
- হুম, খুব "দেখার" সখ্ না? - ওলি কপট রাগ দেখালো ।
এই নিয়ে কিছুক্ষণ দুজনের বেশ খুনসুটি চললো এবং শেষ অবধি ওলি রাজি হলো - কথাটা না মন্দ বলিসনি তুই, ওকে ডান্ ।
দুজনে এগিয়ে চললো অগ্নি আর ছিপছিপে মিষ্টি ওলি । অগ্নি আগেই বলে রেখেছে - কোথাও যেতে হবে না, শুধু বাগবাজারের মা এর সনাতনী মুখ টা একবার দেখতেই হবে ।
কিছুক্ষণের মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে ছেলে মেয়ে দুটো এসে পড়লো বাগবাজার সার্বজনীন এর প্যান্ডেলে । অপরূপ মায়াময় সৌন্দর্য ভরা বিরাট মা দুর্গার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো অগ্নি । হাত দুটো প্রণাম করতে উঠে এল, চোখ বন্ধ করলো অগ্নি ।
ঠাকুর প্রণাম করে দুজনে বেশ কিছু সেলফি তুলে প্যান্ডেল থেকে বেরিয়ে এলো । মুখে দুজনেরই হাসি, অষ্টমীর রোদ গায়ে মেখে হাসি মুখে দুই বন্ধু এগিয়ে চললো বাগবাজার লঞ্চ ঘাটের দিকে । অগ্নির একটু ইচ্ছে করলো ওলির হাতটা ধরে হাঁটতে । এগিয়ে গিয়ে হাত ধরতে গিয়ে ওলির উন্মুক্ত নরম হাতে অগ্নির হাতের সাথে হালকা ঘর্ষণ হলো । বুকের বাঁ দিকটা অগ্নির একটু কম্পন জোরালো হয়ে উঠলো । এত সুন্দর আগে কক্ষনো ওলিকে লাগেনি অগ্নির । ওর ইচ্ছে করলো আর এক বার ওলিকে দেখবে । কয়েক পা হাঁটার পর ওলির খেয়াল হলো অগ্নি ওর দিকে তাকিয়ে হাঁটছে । ওলিকে বাঁ দিকে রেখে অগ্নি ওর ডান হাত ধরে হাঁটছিলো । ওই ভাবে হাঁটতে দেখে অগ্নিকে জিজ্ঞেস করতে যাবে এমন সময় খুব কাছে একটা গাড়ি এসে পড়ায় ওলি বাঁ হাত দিয়ে এক ঝটকায় অগ্নিকে টেনে আনলো, আর একটু হলে ছেলেটা বাজে ভাবে ধাক্কাই খেতো একটা । বুঝতে পেরে অগ্নি ঘার ঘোরায় গাড়িটার দিকে । শুনতে পায় কোলাহলে মিলিয়ে যাওয়া ড্রাইভার টার কিছু চটুল বাক্যবাণ । এ অবশ্যি নতুন না, আগেও বহুবার ওলির সাথে হাঁটার সময় এরকম হয়েছে । তবে সব সময় যে ওলির দিকে তাকিয়ে হাঁটার জন্য এমনটা না ।
হালকা ধমক দিল ওলি - কি হচ্ছে এটা? অগ্নির স্মিত হাসি - দেখছি । ওলির গলায় সন্দেহ - কি দেখছিস? অগ্নির স্পষ্ট জবাব - তোকে । একটু থেমে অগ্নি মুখটা ওলির বেশ কাছে নিয়ে গিয়ে আস্তে করে বললো - তোকে আজ কিন্তু দারুণ লাগছে, মানে একদম অন্যরকম, সত্যি রে, বারবার দেখতে ইচ্ছে করছে । ওলি মুখ ঘুরিয়ে হেসে শুধু বললো - হুম । ও জানে এটাই একমাত্র উপায় অগ্নিকে থামানোর । কারণ এর বেশি অগ্নিকে বলতে দেওয়া যাবে না, ছেলেটা অপ্রস্তুতে ফেলে দেওয়া কথা বলে ফেলে মাঝে মাঝে । বোঝে ওলি যে এই ছেলেটা খুব ভালো কিন্তু ওকে বেশি কাছের করে নিলে, বেশি স্পেস দিলে ছেলেটা আবারও নানা কিছু ভেবে বসবে আর তখন অগ্নিই কষ্টটা পাবে । কারণ তিন বছর আগে যেদিন অগ্নি ওলিকে প্রোপোজ করেছিল সেদিনই দুজনে শুধু ভালো বন্ধুত্বের প্রমিস করেছে একে ওপরের কাছে । ওলি জানে ও কমিটেড, সৌর্যর সাথে রিলেসানে সেই তিন বছর ধরে তাই নিজেকে নিয়ে কোনো সমস্যা হবেনা ওর, আর সৌর্যও সবটা জানে কিন্তু অগ্নি তো এখনো সিঙ্গেল । সমস্যাটা অগ্নিরই হবে না চাইলেও, আর সেটাই ওলির সবচেয়ে খারাপ লাগবে, অগ্নি কষ্ট পেলে - দুজনে যে বড্ড ভালো বন্ধু ।
দেখতে দেখতে দুজনে লঞ্চ ঘাটের কাছে চলে এলো । লঞ্চ ছাড়তে দেরী আছে বলে ওরা গঙ্গার ঘাটে একটু বসলো । ঘাট দুজনেরই বড়ো প্রিয়, কাছের জায়গা । কয়েকটা ভালো ভালো ছবি তুললো অগ্নি ওর মোবাইল ক্যামেরায় । ওলিরও অনেক গুলো তুলে দিল । ওলির ছবি নাকি অগ্নিই ভালো তোলে, এটা ওলির বিশ্বাস । যদিও সৌর্য আস্তে আস্তে প্রফেশনাল ফোটাগ্রাফার হয়ে উঠেছে । কি অসাধারণ ছবি তোলে ছেলেটা । তবুও ওলির অগ্নির তোলা ছবিই বেশি পছন্দের । তাই অগ্নি ছবি তুলতে চাইলে ও বারন করে না । আজও তুললো অনেক গুলো, সাথে নিজেদের কিছু সেলফি । হঠাৎ ওলি উঠে ডাক দিল - চল্, লঞ্চ এসে গেছে । লঞ্চে উঠে ডেকের দিকে গেলো দুজনে । আজ বহু কাল পর ওরা আবার লঞ্চে, একসাথে । তারপর পুজোর আবহে মনটাও খুশি । অগ্নি যখনই ওলির সাথে বেরোয় ওর ভালো লাগে । একটা কিরকম অদ্ভূত তৃপ্তির সাগরে ডুবে যায় অগ্নি এই ছটফটে তন্বী ওলিপ্রিয়া চ্যাটার্জির সান্নিধ্যে এলে । আসলে নিজের মনের নানা কথা যেগুলো অগ্নি কাউকে বলতে পারে না সেই কথা গুলো ওলির কাছে সব পূর্ণতা পায় । প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখান হলেও অগ্নি বরাবর ওলির সাথে ঘুরতে পছন্দ করে, বন্ধুর মতো । আর অগ্নি এই বন্ধুত্বটাই চায়, আর কিছু না ।
লঞ্চ বেশ বেগে চলছে । ঠান্ডা হাওয়া এসে ওলির চুল গুলোকে এলোমেলো করে দিচ্ছে । জল ঠেলে লঞ্চ এগিয়ে চলেছে তীব্র গতিতে, জীবনের মতো । হাত বাড়িয়ে অগ্নি আরও কটা ছবি তুললো ওলির । পড়ন্ত বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে নামছে গঙ্গায়, মহাষ্টমীর সূর্য ধীরে ধীরে অস্তে চলেছে । অগ্নি আর ওলি এতক্ষণ চুপ করে ছিল । প্রকৃতিকে অনুভব করতে দুজনেই এত ভালোবাসে যে এইরকম একটা মন ভালো করা লঞ্চ যাত্রাতে দুজনেই চুপ করে পরিবেশটাকে উপভোগ করে, বুক ভরে ফ্রেশ এয়ার ইনহেল করে । অগ্নি বাঁ হাত দিয়ে ওলির কোমরটা হালকা করে জড়িয়ে ধরে, হালকা করেই । সৌর্যর মুখটা মনে পড়তে একটা অপরাধীর মতো মনে হয় নিজেকে কিন্তু কোন অমোঘ টানে ছেড়ে দিতে পারে না । ওলি জানে পাগলটা একটু পরে ছেড়ে দেবে আর মুখ গম্ভীর করে থাকবে তাই অার কিছু বলে না । অগ্নির ভেতর থেকে একটা আনন্দের স্ফুলিঙ্গ উঠে আসে - থ্যাংক ইউ রে, থ্যাংক ইউ সো মাচ্ । না জানার ভান করে কোমর জড়ানো অবস্থায়ই ওলি প্রশ্ন করে - ফর হোয়াট?
- এই যে তুই আমার কথা রাখলি, বেরোলি ।
- ওহ্, আর কিছু না? - খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে ওলি । এবার নিজেই বলে - না রে, অনেক দিন ধরেই তোর সাথে গল্প হচ্ছে না, তাই আরও বেরোলাম ।
অগ্নি বলে - ভালো করেছিস । তা তোমার মিষ্টার এর কি খবর? তার সাথে বেরোবি না?
- হ্যাঁ, কাল গেছিলাম তো ওর সাথে , বেলুড় মঠ ।
- বাহ্, বেশ ।
এই ভাবে আরো নানা মনের কথা শেয়ার করতে থাকে দুই বেস্ট ফ্রেন্ড ।
অগ্নির থেকে একটু উঁচুতে দাঁড়িয়েছিল ওলি । অগ্নি নিজের অজান্তে নিজের গালটা ওলির লঞ্চের রেলিং ধরা হাতে ঠেকায় । কেন নিজেও জানেনা । শুধু কি প্রথম স্লিভলেস পড়া হাত দেখে ও নিজের বেখেয়ালে ওর খুব কাছাকাছি চলে এসেছে? সামলাতে পারছেনা নিজেকে, নাকি অন্য কোনো কারণে! সম্বিত ফেরে ওলির গলা শুনে । আদুরে গলায় ওলি বলে - হোই, কি করছিস? হুঁশ ফিরতেই ঝটকায় নিজেকে সরিয়ে নেয় অগ্নি । ওলি বোঝে তাই কিছু বলে না, হাসে হালকা ভাবে । অগ্নি একটু দুরে দাঁড়িয়েছে, মুখটা কেমন থমথমে । ওলি ডাকে - ওয়, কি হলো তোর? এদিকে আয় ।
লঞ্চ কয়েক মিনিটে হাওড়ার জেটিতে নোঙর করে । নামলো দুজনে । কি করি ভাবতে ভাবতে ওলির মাথায় বুদ্ধি এল - চল্, আজ হাওড়া ব্রিজে হাঁটতে ইচ্ছে করছে । দুজনে একসাথে হেঁটে একবার ওপারে গেলো আবার ফিরে এলো । মাঝ গঙ্গার ওপর ব্রিজের রেলিংয়ে হাত দিয়ে দুজনে দাঁড়ালো কিছুক্ষণ । ওপর থেকে তাকিয়ে দেখলো কি গতিশীল মা গঙ্গা আর কি তার বিস্তৃতি! ভারী ভারী গাড়ির চাকার ভাইব্রেশানে ব্রিজটা কেমন কাঁপছে । কেমন ভয়ও লাগে আবার অদ্ভূত একটা অনুভূতি নিচে তাকালে । দুজনে প্রাণ ভরে তাকিয়ে রইলো জলের দিকে । ওলি ঘড়ি দেখলো - অ্যাই, এবার বেরোবি? রাস্তায় যা জ্যাম হবে শ্যামবাজার এ, জানিস তো । অগ্নিও সম্মতি জানিয়ে মাথা নারলো । চল - বলে অগ্নি ওলির হাতে টান দিলো ।
ফেরার লঞ্চও তাড়াতাড়ি পেয়ে গেলো । অগ্নির রিকোয়েস্টে শোভাবাজার নামলো । দ্রুত পা চালিয়ে শোভাবাজার রাজবাড়ি পৌছে গেলো দুজনে । অগ্নির আবদার একবার রাজবাড়িতে ঢুঁ মারতে হবে । শোভাবাজার রাজবাড়িতে ঢোকার মুখে ওদের নাকে এলো ঘিয়ে ভাজা মিষ্টি আর নোনতার গন্ধ । এই গন্ধের টানে অগ্নির একবার রাজবাড়িতে যাওয়া চাই ই চাই । শোভাবাজার রাজবাড়ির মেয়ে বৌয়েবা নানা রকম অলঙ্কারে শোভিত হয়ে দালানে ব'সে । দুজনে জুতো ছেড়ে দালানে উঠলো । সন্ধ্যের আরতি চলছে, সাথে ঢাকের বোল । মনটা ভরে উঠলো অগ্নির । ওলির হাত টা আলতো করে ধরে অগ্নি বললো - ওলি, এভাবেই আমার বেস্ট ফ্রেন্ড থাকবি তো? আমার যদি বিয়ে হয়ে যায় তার পরেও? - ব'লে যেন অগ্নির অনেকটা ভার মুক্ত লাগে, আর অপরাধী লাগে না ওর । ওলির প্রাণ খোলা হাসি ঢাকের আওয়াজে আর কেউ শোনেনা, চাপা পরে যায় রাজবাড়ি চত্বরে । শুধু অগ্নি ওই হাসির স্রোতে ভেসে যায় । ওলি বলে - থাকবো রে বাবা থাকবো, এতো ভাবিস না । আর যদি বিয়ে করি মানে? না করার চান্স আছে বুঝি?
অগ্নি আমতা আমতা করে - না, মানে ইয়ে । তোর সাথে কথা বলে, তোর... তোর... তোর কাছে আমি যে কি শান্তি পাই তা তুই জানিস না রে ।
ওলি ব্যাঁকা হেসে বলে - হুম, অবশ্য তোর বউ যদি তোকে আমার সাথে বন্ধুত্ব রাখতে দেয়!
শোভাবাজার রাজবাড়ির ঠাকুর দালান; অষ্টমীর আরতি, ঢাকের বাদ্যিতে গমগমে এক সন্ধ্যে আর দুটো ছেলেমেয়ে হাতে হাত রেখে এক অদূর ভবিষ্যতের, একে অপরের পাশে থাকার অঙ্গীকারে রত, না কোনো ভালোবাসার টানে নয়, নিখাদ বন্ধুত্বের টানে ধরা সেই হাত । মুখে হাসি এক স্থির বিশ্বাসের আর অনেক ভরসার । যেন চোখ জুড়োনো দৃশ্য । এক চোট হেসে দুজনে হাত ছেড়ে ঠাকুর প্রণাম করতে হাত জোড় করলো । চোখ বন্ধ করলো অগ্নি । বাগবাজারের মা এর মুখটাও একবার ভেসে উঠলো মনে ।
* * * * * * * * * * *
চোখ খুলেই অগ্নির চমক লাগলো । আশেপাশে তাকিয়ে ওলিকে খুঁজে পেল না । কোথায় গেলো সে! তার এতদিনের প্রিয় বান্ধবী, সুখ দুঃখ ভাগ করে নেওয়ার একমাত্র সাথি ওলি কি তবে ওর থেকে দুরে চলে গেলো, না বলে কয়ে ? নাকি হারিয়ে গেলো জন সমুদ্রে ? কিন্তু ওলি যে কথা দিয়েছিল সে অগ্নির সাথে কোনদিন থাকতে পারবেনা কিন্তু পাশে থাকবে । আর একটু চোখ মেলে অগ্নি দেখলো কোথায় সেই লোকের ভিড়, কোথায় রাজবাড়ির ঠাকুর দালান আর কোথায়ই বা বাগবাজারের মা এর সেই ভুবন ভোলানো মুখ! ঘোর কাটলো অগ্নি সেনের । মনে পরে গেলো যে সে এখন কোলকাতা তথা বাংলা থেকে বহু দুরে দক্ষিণ ভারতের একটি হোটেলের ছাতে বসে আছে । তার মাথার ওপর ঘন মেঘের আকাশ, সামনে বিরাট বিস্তৃত এক পাহাড় আর চারপাশে প্রবল নিস্তব্ধতা ভরা এও এক মহাষ্টমীর বিকেল যা দেখে কোনো ভাবেই বোঝার উপায় নেই কোলকাতায় কি বিপুল উৎসবের ঢেউ। একবার আকাশের দিকে তাকালো অগ্নি । মুচকি হেসে মাথা নামালো নিচের দিকে । দু বছর আগের সেই অষ্টমীর দিনটায় হারিয়ে গেছিল অগ্নি । বাবার শারীরিক অসুস্থতার কারণে এবছর পুজোটা তাকে পশ্চিমবঙ্গের বাইরেই কাটাতে হচ্ছে । কাটানো বলাটাও বাড়াবাড়ি । হায় রে কপাল! কোলকাতায় এখন কতো আলোর রোশনাই, অঞ্জলি, ঢাক, গোটা বাংলা জুড়ে উৎসবের আমেজ । আর অগ্নি যেখানে রয়েছে তার আশেপাশে পুজোর লেশমাত্র নেই । না আছে কোনো পুজোর গন্ধ, না আছে আলো, আওয়াজ । তাই ভেতর থেকে একটা কষ্ট গলার কাছে দলা পাকিয়ে আসছে মাঝে মাঝেই । চোখ বুঁজে তাই পুরনো সুখের স্মৃতি হাতরে এই বিষাদের মধ্যে একটু ভালো থাকার চেষ্টা করছিল । পারছে না ভালো থাকতে, থাকা যায় না, হাজার হোক বাঙালি তো! আর অগ্নি যে পুজো বড় ভালোবাসে । কিন্তু কিছু করারও নেই, ভাগ্যের কাছে সবাই যে ঠুঁটো জগন্নাথ । সন্ধ্যে হয়ে আসছে দক্ষিণ ভারতে । পাহাড় টা গম্ভীর হয়ে চেয়ে আছে । পশ্চিম আকাশটায় অস্ত সূর্যের আভায় এক অপরূপ রং ধরেছে । অগ্নির মনে হলো না হয় সেই স্মৃতির জাহাজে ভেসেই দুবছর আগের মহাষ্টমীর সন্ধ্যেতে ফেরা যাক । ঠান্ডা ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছে কিন্তু পুজোর সেই হাওয়ার মত নয় । চোখ বুঁজলো অগ্নি ।
ঠাকুর প্রণাম করে বেরিয়ে ওলিকে বাসে তুলে দিল অগ্নি । দিনটা বড়ো ভালো কাটলো । খুশির ডানায় ভর করে মামাবাড়ি পৌঁছে দেখল লুচি তরকারির আয়োজন একদম রেডি । কোনমতে হাত পা ধুয়ে খেতে বসে গেলো । আনন্দ করে খাওয়া দাওয়া হলো, মাসির সাথে একটু গল্পও হলো । শুতে যাওয়ার আগে হোয়াটসঅ্যাপ অন করে ওলি কে পিং করলো - এই একটা কথা বলবো?
ওলির সংক্ষিপ্ত রিপ্লাই - বল ।
- এই সরি হ্যাঁ?
- হুম, কেন?
- ওই যে তখন একটু কাছে চলে গেছিলাম, কেন জানিনা বিশ্বাস কর্ ।
- হাহাহাহা - বলে একটা স্মাইলি ।
- এতে হাসির কি হলো?
- আমি জানতাম তুই এটাই বলবি ।
চোখ খুলে অগ্নি দেখে সন্ধ্যে হয়ে গেছে । অগ্নির মুখে হাসি আসে সেই দিনটা মনে করে । সত্যি কি ভালো কেটেছিলো দিনটা । আর ভাবতে পারে না অগ্নি । সিঁড়ি দিয়ে নামতে পা বাড়ায় । পকেট থেকে মোবাইল টা বার করে । কন্ট্যাক্ট লিস্টে গিয়ে সার্চ করে - ও এল আই । গ্রিন বাটন এ চাপ দেয় । কোলকাতা শহরে তখনে ঢাক কাঁসরের যুগলবন্দিতে সন্ধি পুজোর তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে । অগ্নির এক কানে কলার টিউনে বেজে চলেছে - দুর্গে দুর্গে দুর্গতি নাশিনী মহিষাসুর মর্দিনী জয় মা দুর্গা, আর অন্য কানে পাহাড়ি মন্দিরের তামিল গান আর দুরের মসজিদ থেকে ভেসে আসা সন্ধ্যের আজানের এক মিশ্র ধ্বনি ।