প্রেম বিভ্রাট
প্রেম বিভ্রাট
সম্যক আজ দারুণ খুশি, মনের মধ্যে যেন সকাল থেকেই লাভ সং চড়ে বেড়াচ্ছে, গেয়েও ফেলছে মাঝে মাঝে। পরক্ষণেই কাকিমা মানে ওর মা এর চোখাচোখি হতেই লজ্জায় পাশের ঘরে চলে গেছে। হবে নাই বা কেন। এত দিন, এতগুলো বছর ধরে দেখা একটা স্বপ্ন আজ সত্যি হবে।
আসলে ছেলে মেয়েরা বাবা মা কে একটা ভাবে দেখে আসে ছোট থেকে, তাই বড়ো হয়ে মনের কিছু না বলা ইচ্ছে ব্যক্ত করতে গিয়ে একটু ভয়ই হয়, এই বুঝি সব বিরুদ্ধে চলে গেল! সম্যকের ক্ষেত্রেও তা হয়েছে। পারিবারিক আড্ডায় কাকিমার কিছু কথাবার্তায় ওর ধারণা হয়েছিল মা প্রেম টেম এর বিরোধী, সম্যকের বিয়ে মা এর পছন্দ অনুযায়ী কোন মেয়ের সাথেই হবে, অথচ ততদিনে এক সময়ের "মেয়ে দেখলেই উলটো দিকে" তকমা লাগা সম্যক প্রেমে পড়েছে আর বেশ ভালো ভাবেই চলছে তার অন্তিকার সাথে প্রেমটা। সেই কলেজে পড়ার সময় থেকেই ওদের সম্পর্ক। বন্ধুরা ছাড়া কেউ জানে না। বহু সমস্যা, অশান্তি হয়েছে, আবার মিটেও গেছে - যেমন সব রিলেসনেই হয়ে থাকে আর কি।
সম্যক ভয় করেছিল সেই কথাবার্তা শুনে যে মা আদৌ অন্তিকাকে মেনে নেবে কিনা কারণ সেই ঘরোয়া আলোচনার আগের দিনই সম্যককে কাকিমা ফিসফিসিয়ে কারো সাথে ফোনে কথা বলতে দেখে ফেলেছিল। ব্যাস্, পরের দিন কাকিমার মুখে ওই বিরূপ প্রতিক্রিয়া! এর ওপর আবার দিদার আবদার -"ভাই, চাকরী করা বউ আনিস, সরকারি চাকরি"। "ধুর, কি যে সব বলো!"-বলে কাটিয়ে গেছিল কিন্তু মনে মনে তো চিন্তা রয়েই গেল, অন্তিকা তো এখনো চাকরির জন্য পড়া চালাচ্ছে, না পেলে কি হবে!
রাতে ফোনে একথা বলতে গিয়ে একচোট ঝার জুটলো সম্যকের। -"এত ভিতু কেন রে তুই? চাকরির কি সময় চলে যাচ্ছে?"
-"না, তা নয়, তবে... ।"
-"তবে আবার কি? আমি তো বলেছি পাবো কিছু একটা।"
-"অারে, মা এর মনটা বুঝতে পারছি না, যা সব বলছিল, প্রেম করছি জানলে মেরেই দেবে মনে হচ্ছে।"
-"এই শোন্, তোর দ্বারা না, ওই প্রেম হবেনা। এমনি তেও হয় না! তুমি ওই মামাস্ বয় হয়েই বাকি জীবন কাটিয়ে দাও।"
-"ওই? আবার?.......... শোন না,...... হ্যালো... হ্যালো।"
রেগে মেগে ফোনটা কেটেই দিয়েছে অন্তিকা।
এ অবশ্য ওদের চলতেই থাকে, অনন্তকাল।
সম্যক ইতিমধ্যে একটা কোম্পানী পাল্টেছে। মিষ্টি প্রেমের লুকোচুরি খেলতে খেলতে দেড় বছরের মাথায় অন্তিকাও একটা চাকরি পেয়েছে। তবে না, সরকারি নয়, প্রাইভেট - সেক্টর ফাইভ এর নামকরা একটা কোম্পানীতে। তবে এত ভালো পড়াশোনা করা ডেডিকেটেড্ মেয়েটার খুব ভালো একটা চান্স ছিলো সরকারি চাকরির। কেন যে এই কর্পোরেট দুনিয়ায় চলে এলো! তবে সেখানেও যথেষ্ঠ উজ্জ্বল অন্তিকা। খুব অল্প সময়েই ভালো একটা জায়গায় চলে গেছে।
অনেক দিন ধরেই সম্যককে বলছে - "অ্যাই, বাড়িতে বলেছিস আমাদের কথা?"
সম্যক ও ভাবছে অনেক দিন ধরেই, কিন্তু সাহস পাচ্ছে না মা কি রিঅ্যাক্ট করবে সেটা ভেবে।
এদিকে অন্তিকাও বিরক্ত হচ্ছে, সেই থার্ড ইয়ার থেকে তিন বছরের বেশি হয়ে গেল, সম্যক এখনো বলে উঠতে পারলো না বাড়িতে। এই নিয়ে মাঝে মাঝেই খটামটি দুজনের। শেষমেষ সম্যক সিদ্ধান্ত নিলো যা হবে দেখা যাবে, এবার বলবোই মাকে।
একটা রবিবারের সকাল, ফুরফুরে দিন, মাকেও ভালো মুডে মনে হলো।
-"মা, একটা কথা ছিলো।" সম্যক শুরু করলো ঢোঁক গিলে।
কাকিমা বলে উঠলো আদুরে গলায় -"বাবু শুনছি, তার আগে চাল টা এনে দে বাবা, আর হ্যাঁ, একটু আলু নিবি। ফেরার সময় একটু মেশো কে দেখে আসিস, শরীর টা খারাপ করেছে- মাসি ফোন করেছিল। যা যা, বেলা বাড়ার আগে কাজ গুলো সেরে আয়। ওহ্ আর বাবার ওষুধ গুলো কিন্তু নিতে ভুলিস না বাবু।"
এক নিঃশ্বাসে এতগুলো কাজ শুনে সম্যক আর কিছু বলল না, বেড়িয়ে পরলো।
কাজ গুলো সেরে বাড়ি ঢুকতে যাবে, বেলা ১২ টা বাজে, কুনালের সাথে দেখা।
"কি ভাই, খবর কি? তোর তো দেখাই নেই!" -কুনালের উক্তি।
সম্যক কতক্ষণে বাড়ি ঢুকবে এরকম একটা ভাব নিয়ে কোনোমতে একটা হ্যাঁ, এই চলছে গোছের উত্তর দিলো।
কুনাল গল্প জুড়লো ওর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে। এত বছরের বন্ধু, সবে মাত্র মেডিকেল রিপ্রেসেন্টেটিভের চাকরি জয়েন করেছে, সেই সব কথা। এর মাঝে বেড়িয়েও আসা যায় না। বকলো দুজনে খানিকক্ষণ। কুনাল চলে যেতে সম্যক ঘড়ি দেখল দুপুর দেড়টা। ঢুকেই স্নান করতে গেল, খাওয়ার টেবিলেই কথাটা পারবে, মনে মনে বলল।
খাওয়ার আগে যা যা ভেবে রেখেছিল সেসব আর বলা হলো না। মা বাবা বেড়োবে খেয়ে উঠেই - মাসির বাড়ি।
বিকেল ৫ টায় কাকু কাকিমা বেড়িয়ে যেতে সম্যকও একটু বেড়োলো। অনেক বছর পর দমদম পার্কের পুকুরের ধারে বসলো। মনে মনে বলল মা সব মেনে নিক, আমার মিষ্টিটাকে এই পুকুরের ধারে নিয়ে আসবো একদিন, বেচারীকে তো টাইমই দিতে পারিনা। স্কুল লাইফের বন্ধুদের কথা মনে করিয়ে দেয় এই পুকুর ঘাট। সাইকেল নিয়ে দমদম পার্কের বিভিন্ন পুকুর ঘাটে কুনাল, বিতান, গুড্ডুর সাথে বিকেলের সেই আড্ডা মনে পরে সম্যকের, বড়ো হয়েও অনেক মন খারাপের বিকেলে বিতানের সাথে এসেছে।
বেশ অনেকক্ষণ ভাবতে ভাবতে, উদাস হয়ে জলের দিকে চেয়ে রইলো। হটাৎই হুঁস ফিরলো কাকিমার ফোনে।
-"বাবু আমরা চলে এসেছি বাড়িতে, কোথায় তুই?"
সম্যকের যেন তর সইলো না আর -"এই তো, আসছি" বলেই ফোন কেটে দিয়ে বাড়ির দিকে যাওয়ার জন্য স্কুটিতে স্টার্ট দিলো। মোবাইল বের করে দেখে নিল রাত ৮ টা বাজে।
বাড়ি ফেরার পথে কতগুলো সিঙাড়া নিয়ে ফিরলো। মা তো আজ ভালো মুডেই আছে, সকাল সকাল কাজ করেছে যা যা বলা হয়েছে। এখন গরম গরম সিঙাড়া! ওহ্! কথাটা বলার জন্য একেবারে আদর্শ!
এইসব ভেবে বাড়ি ফেরে সম্যক। দরজা খুলে দেখে আর এক কান্ড! ইউ. এস থেকে দাদা বৌদি এসেছে পুচকেটাকে নিয়ে। সেই পুচকুটার আবার মুখেভাত।
কাকিমা একটু রেগেই এল - "কিরে, ফোনটা কেটে দিলি, কিছু আনতে দেবো ভাবলাম তোকে।" বলেই কাকিমার চোখ পড়লো সম্যকের হাতের প্যাকেটে।
সম্যকও সুযোগের সদ্ব্যবহার করে ফেলল - "এই নাও গরম সিঙাড়া, দাও ওদেরকে।"
কাকিমা বেজায় খুশি - "আমার সোনা ছেলে!"
সম্যক প্রথম ধাক্কায় দাদা দের দেখে একটু বিরক্ত হয়েছিল বটে, তবে মা এর হাসি দেখে ঠাকুরকে একটা থ্যাংকস দিলো। - এতো আরো ভালো হলো, মা বলার আগেই গেষ্টদের জন্য খাবার! কথাটা পারার এর থেকে ভালো দিন হয় না, তবে হ্যাঁ, এরা না গেলে বলবে না - ঠিক করল সম্যক।
রাত ১১টা, দাদারা চলে গেছে অনেকক্ষণ, রাতের খাওয়াও শেষ। সম্যক ভাবতে থাকে - সেই সকাল থেকে ঠিক করেছে বলবে অন্তিকার কথা। এক গাদা কাজের চোটে হলো না, ফিরে এসে কুনালের সাথে কথা বলতে গিয়ে আর একটু দেরি, দুপুরের খাওয়ার পরও মা বেড়িয়ে গেল। যাও বা ফিরে এল, দাদারা হাজির। একটা কত দিন, কত বছরের না বলা কথা কিছুতেই বলে উঠতে পারছেনা। বাধার পর বাধা। ওদিকে অন্তিকাও ঝার দিচ্ছে, এদিকে মা কি বলবে তাও জানা নেই। ভাবতে ভাবতে দেখে গলা টা শুকিয়ে গেছে, একটু জল খেলো।
কাকিমা ঘরে এল। সম্যকের হার্টবিট্ বাড়ছে -"মা একটা কথা ছিলো।"
কাকিমা অন্যমনস্ক -"হ্যাঁ, বল্।"
সম্যক আর একটু অ্যাটেনসান চায় -"সকালে বলবো বলছিলাম না?"
এবার কাকিমা একটু ঘুরে বসলো ওর দিকে -"ও হ্যাঁ, কি যেন বলবি বলছিলি একটা।"
সম্যক আমতা আমতা করে -"ইয়ে, মানে, বলছিলাম কি, ইয়ে...।"
কাকিমা কিছু একটা বলতে যাবে এমন সময়......
টিং টং..... টিং টং.......।
সম্যকের বিরক্তির চরম সীমা -"এত রাতে আবার কে এলো?"
মা উঠে গেল -"দাঁড়া, আসছি।"
উফ্, আবার বাধা! মা আসুক, আর কোন ভনিতা নয়, ডিরেক্ট বলবো মাকে, স্যারের ছেলের অন্নপ্রাশনে তো অন্তিকাকে মা দেখেছে। যা হবে হোক, মা প্রেম টেম ভালোবাসেনা ঠিক কিন্তু এখন আর উপায় নেই। এতবছর পর বলবো অন্তিকার কথা, এত বাধা! এর পরেও বলতে না পারলে কি ছেলে হলাম। - নিজের মনে গজ গজ করতে থাকে সম্যক।
কাকিমা ঘরে ঢোকে -"আরে, পাশের ঘরের জেঠিমা এসছিল, তোর বাবার খোঁজ নিতে। বল কি বলছিলি।"
সম্যক একটু চুপ করে থেকে বলে ওঠে -"মা, তোমার অন্তিকাকে মনে আছে? সেই যে অপূর্বদার ছেলের মুখেভাতে গেছিল আমাদের সাথে? কলেজে পড়তো আমাদের সাথে?
কাকিমা হালকা গম্ভীর মুখে বলে -"হম্, কি হয়েছে?"
সম্যক মাথাটা একটু নিচু করে আস্তে করে বলে - "মা, তোমার ওকে কেমন লাগে?"
-"মানে?" - কাকিমা হয়তো বুঝতে পারে, তাও বলে।
সম্যক কাকিমার ঝার আসন্ন বুঝতে পারে, মাথা টা আর একটু নামিয়ে বলে -"মা, ওকে আমার খুব ভালো লাগে মা, ও খুব ভালো মেয়ে মা, আমরা খুব ভালো বন্ধু। সেই কলেজ থেকে। ও চাকরিও করে মা, সরকারি না, সেক্টর ফাইভ এ। ভালোই করছে, অল্প দিনেই প্রমোশনও পেয়েছে। আমরা একসাথে থাকবো সবাই মা, তোমাদের সাথেও ভালো থাকবে ও। প্লিজ মা, রাগ কোরো না, এতদিন ধরে বলতে পারিনি।" - চুপ করে সম্যক।
মা ও কথা বলে না, বোধহয় আর কিছু বলবে সম্যক।
সম্যক বলে -"মা আমি অন্তিকাকে খুব ভালোবাসি মা, ওও আমাকে ভালোবাসে।"
এই শেষ কথাগুলো শোনারই বোধহয় অপেক্ষা করছিল কাকিমা।
সম্যক তখনও মাথা নামিয়ে, কিছুটা লজ্জায় আর অনেকটা ভয়ে। মনে মনে ভাবছে - এই বুঝি মা রেগে উঠে যাবে।
কাকিমা চুপ, বিছানা থেকে উঠলো। ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে একটু ফিরে তাকাল সম্যকের দিকে। -"তা অন্তিকাকে সামনের রোববার নিয়ে আয় বাড়িতে, হবু বৌমার সাথে আলাপ করাবি না?
সম্যক আশ্চর্য হয়ে তাকাল মা এর মুখের দিকে, আর গলা দিয়ে আওয়াজ বেড়লো -"অ্যাঁ!!"
কাকিমা মুচকি হেসে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
বাকি রাতটা সম্যকের আর ঘুম আসেনি। সকাল হবে আর অন্তিকাকে জানাবে মা মেনে নিয়েছে এই আনন্দে সম্যক সারা রাত জেগেই কাটিয়ে দিয়েছিল।
আজ ও একটা রোববার, আজই সেই দিন, আজ অন্তিকা আসবে সম্যকের বাড়িতে, প্রথমবার। হবু শাশুড়ি মার সাথে আলাপ করতে। তাই আজ সকাল থেকেই তোরজোড়। সম্যকের খুব আনন্দ, কাকিমাও খুশি। সম্যক বোঝে সত্যি মা রা সময়ের সাথে কত মানিয়ে নেয়, বুঝতে পারে ছেলে মেয়েদের ভালো লাগা না লাগাগুলো। মনে মনে বলে - মা, তুমি বেস্ট্। ভেবেছিলাম তুমি মানবে না, কিন্তু আজ বুঝি তুমি আমাকে কতটা বিশ্বাস, ভরসা কর, আমার পছন্দকে মেনে নিয়েছ। থ্যাংক ইউ মা, লাভ ইউ মা।