Arnab Bhattacharya

Drama

2.1  

Arnab Bhattacharya

Drama

থার্ড মার্চ

থার্ড মার্চ

7 mins
10.6K


ঘড়িতে তখন বিকেল সাড়ে ৫ টা, মার্চের ৩ তারিখ । শ্যামবাজার মোড়, ব্যাস্ত না হলেও বেশ ভিড় আছে বলা যায় । ৩ নম্বর বাস টা ভূপেন বোস এভিনিউ এর দিকে ঘুড়তেই নেমে পড়লো অন্তিকা। অন্তিকা চ্যাটার্জি, বয়স ২৪, ছিপছিপে ছোট্টখাট্টো চেহারা, দেখতে ব্যাপক হয়তো নয় কিন্তু একটা আকর্ষণী ব্যাপার আর এক জোড়া কাজল কালো মোহময়ী চোখ - এই সব মিলিয়ে একটা আলগা শ্রী আছে ছটফটে মেয়েটার মধ্যে। এক বছর হলো একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকুরিরতা। আজ উইক অফ্। শ্যামবাজারে নেমে ঠিক করতে পারলো না কোথায় যাবে । আজ অদ্ভূত একটা আবদার করেছে অরণ্য - অন্তিকা কে খুঁজে নিতে হবে ওকে, বলবে না, কোথায় ওয়েট করছে, এই শ্যামবাজার এরিয়ার মধ্যেই । ক্লু - সেই জায়গা গুলো যেখানে ৪ বছর আগের বিভিন্ন স্মৃতি জড়িয়ে আছে । অরণ্য ব্যানার্জি - বয়স ২৫, মোটামুটি চেহারা, একটা নাম করা এম.এন.সি তে কাজ করে আর এই কাজের দৌলতে শরীর খানাও বেশ ভারি হয়ে গেছে, দেখতে একটু বিদঘুটেই লাগে এখন। গায়ের রং টাও চেপে গেছে কাজের চাপে । অরণ্য অন্তিকার বেস্ট ফ্রেন্ড, সেই কলেজ বেলা থেকে । হিসেব করলে হয়তো দেখা যাবে অন্তিকা যত না ওর বয়ফ্রেন্ড সুগত'র সাথে ঘুরে বেড়িয়েছে তার চেয়ে বেশি অরণ্য'র সাথেই ঘুরেছে। এমনি একটা ভালো বন্ধুত্বের টান বা কেমিস্ট্রি ছিলো ওদের । আজ কাল অরণ্য খুব মিস্ করে সেই চার্ম টা, কে জানে অন্তিকা করে কিনা! কত কথা শেয়ার করতো দুজনে । এখন তো ম্যাসেজ, কল্ আর বিশেষ হয়ই না। তবু অরণ্য চেষ্টা করে সম্পর্কটা কে আগের মতো রাখার কিন্তু এক পাক্ষিক কোনো কিছুই যে এই বিশ্বে এক্সিস্ট করে না, সে প্রেম হোক কিংবা বন্ধুত্ব। ভালো বন্ধুত্ব হারাতে চায়না অরণ্য। আজ তাই ও ঠিক করেছে একটা চেষ্টা করবে আবার সেই বন্ধুত্বের টান টা ফেরাবার। কড়া নির্দেশ অন্তিকা কে - "ফোন করবি না যতক্ষণ পারবি, একদম খুঁজে না পেলে তখন করবি, তবে আমার বিশ্বাস তুই আমায় খুঁজে পাবি।" কেমন যেন মন্ত্রমুগ্ধের মতো ও রাজিও হয়েছে এই খেলাটায়।

কোথায় যেতে পারে মনে করে প্রথম ঢুকলো বৃন্দাবন পাল লেনে খানিকটা, মিষ্টি সিঙারার দোকান টা ছাড়িয়ে কিছুদুর গিয়ে মনে হল নাহ্ এখানে হবে না। একবার এই গলির উলটো দিকে ফড়িয়াপুকুর যাওয়ার গলি টায় ঢুকে দেখলে হয় । সেই ডান হাতের গলি যেখানে বাড়ির দরজায় রাস্তা শেষ ওখানে নেই তো? পাগলটাকে বিশ্বাস নেই আবার এক গোছা গোলাপ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে । হনহন করে অন্তিকা চলল ওদিকে । নাহ্, এখানেও নেই । শ্যামবাজারে নেমে এক বার গোল বাড়ির দিকেও দেখেছে দুর থেকে । কোথায় থাকতে পারে! আচ্ছা, শ্যাম পার্কে আছে নির্ঘাত । হাঁটা লাগালো কলেজের দিকে । কলেজ পার হয়ে যেতে যেতে ভাবলো ধুর আর ভালো লাগছেনা। অরণ্যকে একটা ডায়াল করেই দেখা যাক। ফোন করলো অন্তিকা অরণ্যকে । বেশ খানিকটা পর ফোন ধরলো অরণ্য । ধরেই একটা সেই দেখ কেমন লাগে টাইপের গলা করে বলল - "কিরে, পেলি আমাকে?"

অন্তিকা কাতর ভাবে ঘ্যানঘ্যান করে ওঠে - "বলনা, প্লিজ, কোথায় আছিস?"

অরণ্য হাসে - "হাহাহাহা, খোঁজো খোঁজো ।"

হঠাৎই কি মনে করে অন্তিকা বলে ওঠে - "শোন্, আমার না মনে হচ্ছে আমি তোর কাছাকাছিই আছি। বলতো কোথায় আছিস?" - শেষ কথা গুলোয় একটা রাগ রাগ ভাব।

অরণ্য বোধহয় কিছু একটা আন্দাজ করেছিলো, সম্ভবতঃ বাসের ব্রেক কষার শব্দ, যেটা কলেজের দিন গুলোতে ওরা রোজ শুনতো। সেরকমই একটা আওয়াজ অরণ্য যেন শুনতে পেল ফোনের ওপারেও আবার তার কাছাকাছিও কোথাও । মনে মনে ভাবল আর একটু মজা করা যাক। একটু গম্ভীর হওয়ার ভান করা গলায় বলল - "আমি এখন গঙ্গার হাওয়া খাচ্ছি ।" বলেই ফোনটা কেটে দিল ।

এক মুহূর্তের জন্য অন্তিকা থেমে গেল । ভাবলো - তবে কি ও বাগবাজার মা এর ঘাটে? ওটাও তো ছিলো একট দারুণ পছন্দের জায়গা দুজনের । না, ও বলেছে শ্যামবাজারেই থাকবে। হঠাৎ একটা ম্যাজিক খেলল অন্তিকার মাথায় । চার পাঁচ পা ফিরে এলো, কলেজের গেটের সামনে । দৌড়ে ঢুকে পড়লো। হন্তদন্ত হয়ে উঠে গেল কলেজের ৪ তলায়। হাঁপাতে হাঁপাতে এগিয়ে চলেছে এক মাত্র গ্যালারি ঘরটার দিকে । জাল ঘেরা বারান্দা দিয়ে আসছে ঠান্ডা একটা হাওয়া । ভেসে যাচ্ছে অন্তিকা ৪ বছর আগের কলেজের দিন গুলোতে । সেই ৪ বছর আগের গন্ধ ফ্লোর টায়। বাঁদিকে ঘুরে দেখে ফাঁকা ক্লাসরুমে একটা ছেলে বসে আছে, গ্যালারির বেশ খানিকটা ওপরে, যেমন ভাবে থাকতো ২০১৩ এর দিন গুলোতে । এত বছর পরে কলেজে ঢুকে অন্তিকা ভাবছিলো এ আবার কোন নতুন স্টুডেন্ট নয় তো? শার্ট টা চেনা লাগছে । সন্ধ্যে নেমে এসেছে । ঠিক বোঝা যাচ্ছে না, তাও এগিয়ে গেল অন্তিকা ছেলেটার দিকে ।

"কিরে, পেলাম তো?" - ছেলেটার পিঠে হাত দিয়ে বলে ওঠে অন্তিকা ।

হালকা তাকায় অরণ্য - "হ্যাঁ, বলে দেওয়ার পরে!"

অরণ্য'র উলটো দিকে গিয়ে বসে অন্তিকা ।

অরণ্য তাকিয়ে আছে বাইরের বড় কৃষ্ণচূড়া আর রাধাচূড়া টার দিকে । এই সময় কত ফুল হতো, এবারও হয়েছে ।

অন্তিকা বলে - "কি দেখছিস, কথা বলবি না আমার সাথে?"

- "কি বলবো বুঝতে পারছিনা । ফুল গুলো দেখ, একই আছে, ফুটছে, আবার ঝড়ছে। আর আমরা, কত পাল্টে যাচ্ছি তাই না?"

- "কিচ্ছু পাল্টে যাচ্ছে না, সব ঠিক আছে ।"

- "তাই, সত্যিই?"

- "হুম্, সত্যি ।"

অরণ্য হাত টা অন্তিকার নরম হাতের ওপর রেখে বলে - "তবে, তুই আগের মতো কেন নেই? কেন আমাকে বারবার ম্যাসেজ করতে হয়? হোয়াই অলওয়েস মি? হোয়াই নট্ ইউ? আগে তো কতো কথা হতো আমাদের । এত ব্যস্ততা? বেস্ট ফ্রেন্ড বলিস, কথা বলিস না?"

অন্তিকা বলে ওঠে - "ধুর, পাগলা, এসব কিছু না । হয় না কোন ভাবে আগের মতো । কিন্তু তুই তো আমার ভালো বন্ধু, তেমনি থাকবি।"

অরণ্য বলে চলে - "দেখ, ৪ বছর আগে আমি যেটা করেছিলাম সেটা নিয়ে তো কোনো সমস্যা নেই, ছিলো না কখনোই, বন্ধুত্বের সম্পর্কটাই থাকার কথা হয়েছিল, আমি আর কিছু চেয়েছি? তবে কেন এই ইগনোর?"

অন্তিকা হাতটা দিয়ে অরণ্য'র নাক টা নেড়ে বলে - "না রে বাবা, কোথায় ইগনোর করছি? এই, ৪ বছর হয়ে গেল না?"

- "হ্যাঁ, আজই তো থার্ড মার্চ ।"

হিহি করে হেসে ওঠে অন্তিকা । মনে পরে যায় রাত সাড়ে নটা নাগাদ বৃন্দাবন পাল লেনের উলটো দিকে রাস্তায় সেই গলি যেখানে দরজায় শেষ, সেই গলিতে অরণ্য অন্তিকাকে লাল গোলাপ আর চকোলেট দিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে মনের কথা বলেছিল।

অরণ্য চায় না ওই বিষয়ে কথা বলতে । বলে ওঠে - "তুই বন্ধু হয়ে থাকতে পারিস না? আবার কি আমরা পারি না সেই আগের মত কেমিস্ট্রি টা ক্রিয়েট করতে? তুই না বলিস, তোর আর সুগত'র কেমিস্ট্রি টা এক ধরনের আর আমাদেরটা আরেক ধরনের ।"

- "ওফ্ বাবা, হয়েছে । আমি কোথাও যাচ্ছি না, এই পৃথিবীতেই আছি। তবে কেন কথা হবে না?"

- "দেখবো কেমন হয় ।" বলে অরণ্য চোখ বোঁজে, সন্ধ্যের সেই ক্লাসরুমে বয়ে আসে গঙ্গার হাওয়া । উড়তে থাকে দুরের কোনো ছাতে মেলা কাপড় । প্রাণ ভরে হাওয়া টা ইনহেল করে। বড় ভালো লাগছে । সাথে আবার বেস্ট ফ্রেন্ড ।

অন্তিকা বলে ওঠে - "জানিস, কি হয়েছে........ " বলতে থাকে জমে থাকা কথা। গল্পে ডোবে দুজন মানুষ ।

অনেক দিন পরে আজ সেই আগের মতো গল্প করছে অন্তিকা আর অরণ্য । একটা খুশি খুশি মুখ, দুজনেরই । কত কথা হয়ে চলে । সাক্ষী থাকে ক্লাসরুমের গ্রিন বোর্ড, বেঞ্চ, কৃষ্ণচূড়া ।

অরণ্য'র মনের কোণে তবু যেন কেউ বলতে থাকে - বলে তো দিলি। সেই তো আবার কথা বলা কমিয়ে দিবি, দরকারে ফোন - ম্যাসেজ করবি। কেন কথা দিস মিথ্যে মিথ্যে । বেস্ট ফ্রেন্ড এর থেকে কি এটাই ডিসার্ভিং?

মাথায় একটা চাঁটি মেরে অন্তিকা বলে - "কি ভাবছিস? অন্তিকার লাইফে অরণ্য একটা ইম্পর্টেন্ট পার্ট, সুগত আর একটা । আমি হয়তো কাজের কারনে তোকে টাইম দিতে পারছিনা, তুই ভাবছিস অন্তিকা তোকে ভুলে গেছে? নারে পাগল। কটা দিন সময় দে, দেখবি আমরা আবার আগের মতোই আছি। তুই আমার কত ভালো বন্ধু সেটা তুই জানিস না অরণ্য ।"

অন্তিকার কথায় আবারও বুক বাঁধে অরণ্য । আসলে অরণ্য সেই থার্ড মার্চের পর আর কখনোই অন্তিকার কাছে ভালো বন্ধুত্ব ছাড়া কিছুই চায়নি । অন্তিকাও চেয়েছিল সেটাই । তবু আজ এত বছর পরে কোথায় যেন সেই বন্ডিং টা হারিয়ে যাচ্ছিল ।সেটা ফিরে পেতেই অরণ্য এই প্ল্যান করে।

অন্তিকা অরণ্য'র গাল দুটো ধরে বলে - "থ্যাংক ইউ সো মাচ রে। তোর থার্ড মার্চ সেলিব্রেশন আবার আমাদের দেখা করা, আড্ডা দেওয়ার সুযোগ করে দিল।"

কলেজ থেকে বেরিয়ে হাঁটতে থাকে দুটো ছেলে মেয়ে । কেউ কারো প্রেমিক বা প্রেমিকা নয়, নির্ভেজাল বন্ধুত্বে ভরা এ সম্পর্ক কেউ বিশ্বাস করবে না হয়তো । তবু এক সাথে কোনো এক অমোঘ টানে জুড়ে থাকা দুটো মানুষ ফিরে পায় বারবার সেই কলেজ বেলার বন্ধুত্ব।

অন্তিকা হাত টেনে বলে - "এ্যাই, আইস ক্রিম খাবি? পাঁচ মাথার মোড়ের সেই দোকানটা!" বলে মুচকি হাসে ।

অরণ্য বুঝতে পারে কি বলতে চায় অন্তিকা, বলে - "কেন, তোমার বরকে বলো না।"

- "আহা বরের সাথে তো আলাদা, তোর সাথে খাওয়া টা ব্যাপারই অন্য ।" হিহি করে হেসে ওঠে মেয়ে ।

- "সেই! তোর সাথে "ফার্স্ট লাভ আইস ক্রিম" খাওয়া, ব্যাপার তো আলাদাই।" অরণ্য হেসে ওঠে হাহা করে।

-আইস ক্রিম আছে কাকা? দাও দেখি, দুটো ফার্স্ট লাভ ।।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama