STORYMIRROR

Rima Goswami

Drama Fantasy Children

3  

Rima Goswami

Drama Fantasy Children

রুদ্রদেবের তৃতীয় নয়ন

রুদ্রদেবের তৃতীয় নয়ন

7 mins
338


সসিপঞ্জর নামক এক স্থানে জন্ম নিলো এক অদ্ভুত দর্শন শিশু । তার সম্পূর্ণ শরীর স্বাভাবিক মানুষের মতো হলেও একটি ভিন্নতা তাকে আশ্চর্যের তকমা প্রদান করেছে , তার ত্রিনয়ন । সে যদি এক ব্রাহ্মণ ঘরে জন্ম নিত তা হলে তো এতক্ষন তাকে নিয়ে সারা এলাকা জুড়ে উন্মাদনা শুরু হতো এই যুক্তিতে যে এই শিশু স্বয়ং দেবাধিদেব । কিন্তু এ শিশু জন্মেছে এক কাহার ঘরে । নগরপালিকা বেদপুরীর এক পালকি বাহক কৃতসেন এর ঘরে জন্ম হয়েছে এই শিশুটির । মনে মনে সবার একে ঈশ্বরের দূত মনে হলেও কেই এ বিষয়ে কোন বক্তব্য রাখতে অপরাগ । এতে কুলপুরোহিত রাহু বর্মন অসন্তুষ্ট হবেন । তার পর একান ওকান হয়ে যখন খবরটা রাহু বর্মন পর্যন্ত পৌছালো তখন আশ্চর্যজনক ভাবে ওনার মতো সম্ভ্রান্ত এক গম্ভীর মানুষ ছুটে এলেন এক অচ্ছুৎ কাহারের ঘরে । ব্রিসাবতী হলো কৃৎসেনের স্ত্রী , সে যখন শিশুটিকে ঘুম পাড়াতে চেস্টা করছে বাইরে থেকে দূত হাঁকালো , কে আছো বেরিয়ে এসো কুলপুরোহিত এসেছেন । ব্রিসাবতী ছেলেকে কোলে নিয়েই ছুটে এলো ভয়ে ভয়ে । রাহু বর্মন বললেন ভদ্রে আপনি শিশুটিকে একটি কাপড় জড়িয়ে ভূমিতে রাখুন । আমি একে  দেখতে ইচ্ছুক । রাহু বর্মন ব্রাহ্মণ তথা রাজকুলপুরোহিত হলেও নারীদের বিশেষ সন্মান দিতেন । কাহার পত্নী হোক বা সম্ভ্রান্ত মহিষী সকলকেই এক ভাবে সম্ভাষণ করতেন । ব্রিসা তার এখনো পর্যন্ত নামকরণ না হওয়া পুত্রকে কাপড় জড়িয়ে উঠানের মাটিতে নামিয়ে দিল । সেই শিশুকে দেখেই রাহু বর্মন মাটিতে বসে পড়ে । তার গৌর বর্ন রক্তাভ হয়ে ওঠে । তার মুখে শরীরে উত্তেজনা দেখা যায় । তিনি গম্ভীর কন্ঠ পরিত্যাগ করে শিশুর মতো আচরণ করতে থাকেন । ওই অচ্ছুত ঘরের শিশুকে কোলে তুলে নিয়ে খিলখিল করে হেসে ওঠেন আর বলতে থাকেন রুদ্র ....রুদ্র .... রুদ্র এসেছেন । তার পর শিশুকে এক প্রহরীর কোলে তুলে দিয়ে ব্রিসাবতীর পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়ে বলেন , আপনাকে কোটি কোটি ধন্যবাদ ভদ্রে । আপনি রুদ্রদেবের জন্ম দিয়েছেন । এই আর্য সন্তান রাহু বর্মনের প্রণাম আপনাকে । ব্রিসা ভয়ে সরে যেতে চায় , সে বলে আপনি কি পাগলামি করছেন দেব ? আমি এক নিম্ন জাতির মেয়ে , আমাকে প্রণাম করে আপনি আমাকে পাপের ভাগী করছেন । রাহু বর্মন বলে ভদ্রে আপনি যার জন্ম দিয়েছেন সে এ জগতের স্রষ্টা । আপনি জাতির উর্ধে ভদ্রে । আমায় কৃপা করুন , এ সন্তান আপনার বক্ষের সুধায় মানুষ হোক কিন্তু এর স্থান হোক রুদ্রমন্দিরে । ব্রিসা জানে যে এ শিশু স্বাভাবিক নয় আর কুলপুরোহিত এর অনুরোধ মানেই নগরপালিকার আদেশ । যার উলংঘন করা মানে বিপদ । সে বলে দেব আপনি এভাবে বলছেন কেন ? আমার সন্তান কে আপনি নিয়ে যান , আমি মন্দিরের নিচেই গিয়ে দাঁড়াবো ওকে আপনি নীচে নামিয়ে দেবেন আমি ওকে স্তন পান করিয়ে আনবো । রাহু বর্মন বললেন , ভদ্রে আপনি দেবতার জন্ম দিয়েছেন । আপনার স্থান রাজার ও উর্ধে । আপনার সম্পূর্ণ অধিকার আছে রুদ্র মন্দিরে প্রবেশ করার । আর এই শিশুর নাম হলো রুদ্রদেব ।  আমি একে নিয়ে চললাম , আপনি সময় সময় এসে হাজির হবেন আশা করছি । এই বলে রুদ্র কে নিয়ে কুলপুরোহিত রওনা দিলো মন্দিরের দিকে । সসিপঞ্জর নামক ওই নগরে রুদ্র মন্দির কিন্তু শিব মন্দির ছিল না । রুদ্র ছিলেন বজ্রবিদ্যুৎসহ ঝড়ের দেবতা; তাকে একজন ভয়ানক, ধ্বংসকারী দেবতা হিসেবে কল্পনা করা হত। আদিদেব মহাদেব শিবের সঙ্গে বৈদিক দেবতা রুদ্রের নানা মিল লক্ষিত হয়। রুদ্র ও শিবকে একই ব্যক্তি মনে করা হয়।  সর্বোচ্চ স্তরে শিবকে সর্বোৎকর্ষ, অপরিবর্তনশীল পরম ব্রহ্ম মনে করা হয়।শিবের অনেকগুলি সদাশয় ও ভয়ঙ্কর মূর্তিও আছে। সদাশয় রূপে তিনি একজন সর্বজ্ঞ যোগী। তিনি কৈলাস পর্বতে সন্ন্যাসীর জীবন যাপন করেন। আবার গৃহস্থ রূপে তিনি পার্বতীর স্বামী। হিন্দুধর্মের প্রাচীনতম ধর্মগ্রন্থ হল ঋগ্বেদ। সেখানেও আদিদেবকেই মহত্ব দেওয়া হয়েছে । এছাড়াও বেদান্ত অনুসারে তিনিই র মহা ঈশ্বর ।শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে বলা হয়েছে - "যদাহতমস্তন্ন দিবা ন রাত্রির্নসন্ন চাসচ্ছিব এব কেবলঃ।"

অর্থাৎ যখন আলো ছিল না, অন্ধকারও ছিল না; দিন ছিল না, রাত্রিও ছিল না; সৎ ছিল না, অসৎ ও ছিল না- তখন কেবলমাত্র ভগবান শিবই ছিলেন। 


আদিদেব মহাদেব হলেন হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সর্বোচ্চ দেবতা। সনাতন ধর্মের শাস্ত্রসমূহে তিনি পরমসত্ত্বা রূপে ঘোষিত। শিব সৃষ্টি-স্থিতি-লয়রূপ তিন কারণের কারণ, পরমেশ্বর- এটা তার প্রণাম মন্ত্রেই বার বার উঠে এসেছে।সেদিন ভৈরব অষ্টমী কার্তিক পূর্ণিমার একাদশী ছিল রাহুবর্মন তার কোলের মধ্যেই ছোট্ট রুদ্র দেব কে নিয়ে যোগে বসে ছিলেন । এমন সময় ওনার যোগ অবস্থায় থাকতেই কোল থেকে হামা গুড়ি দিয়ে নেমে আসে রুদ্র দেব । তার পর মন্দিরের গর্ভ গৃহের রুদ্র দেবের ধ্যানস্থ মূর্তির কোলে উঠে বসে থাকে । শিশু রুদ্র খেলতে খেলতে ঘুমিয়ে পড়ে ওখানেই । তার পর যখন রাহু বর্মনের যোগ নিদ্রা ভঙ্গ হয় তখন তিনি দেখেন রুদ্র কুলপুরোহিতের কোল ত্যাগ করে রুদ্র দেবের মূর্তির কোলে ঘুমিয়ে আছে আর এক বিশাল গোখরো তাকে জড়িয়ে ধরে আছে । প্রথমটা ভয় পেয়ে যায় রাহু বর্মন তার পর লক্ষ্য করে দেখেন ওই অবলা বিষধর সর্প টির উদেশ্য শিশুটিকে রক্ষা করা । কারণ ঘুমন্ত শিশুটি যদি পাথরের মূর্তির কোল থেকে পিছলে পড়ে যায় তা হলে তার ক্ষতির সম্ভাবনা আছে । রাহু বর্মন এগিয়ে গিয়ে জোড়ে হাততালি দিয়ে সাপটিকে সরে যেতে নির্দেশ দেন । শিশু ও হাততালির শব্দে ঘুম থেকে উঠে যায় আর সাপটি শিশু রুদ্র কে ছেড়ে দিয়ে এগিয়ে যায় মন্দিরের চৌকাটের দিকে । এমন সময় কথা এসে উপস্থিত হন নগরপালিকা বেদপুরী । উনি এক বিষধর সাপের উপর পা দিতে দিতে ক্ষনিকের জন্য বেঁচে গেলেন আর এতে ভয় পেয়ে ওনার প্রহরীরা ওই সাপটিকে লাঠির আঘাত এর উপর আঘাত করতে থাকলেন । রাহু বর্মন বাধা দিত তার আগেই সাপটিকে মেরে ফেলে ওই প্রহরী গণ । রাহু বর্মনের বুক কেঁপে ওঠে , প্রকৃতির দেবতা রুদ্র দেবের মন্দিরে তারই প্রিয় সর্প কে মেরে ফেলা ! এর ফল হতে পারে ভয়ঙ্কর । উনি শিশু রুদ্র কে কোল থেকে নামিয়ে নগরপালিকার দিকে এগিয়ে আসেন । বেদপুরী ও এই হঠ্যাৎ ঘটে যাওয়া ঘটনায় যারপরনাই বিচলিত , সে তিব্র ভৎসনা করে তার প্রহরীদের । রাহু বর্মনের কাছে তার পর হাত জোড় করে এর নিদান প্রার্থনা করে বেদপুরী । রাহু বর্মন মুখ খুলবেন তার আগেই এক আকাশ পাতাল কাঁপানো বাজ চতুর্দিকে আলোর ছটা বিকিরণ করে করকর করে মাটিতে আছড়ে পড়ে । শিশু ভয় পাবে এই ভেবে রাহু বর্মন এগিয়ে যেতে যান শিশুকে কোলে নিতে । কিন্ত এ কি ! কোথায় সেই শিশু রুদ্র ? সামনে দাঁড়িয়ে আছে স্ব-স্বরূপে বর্তমান, সমস্ত জ্যোতির জ্যোতি স্বয়ং রুদ্রদেব ... যার ক্রোধান্বিত তৃতীয় নয়ন, গলায় বাসুকী নাগ, জটায় অর্ধচন্দ্র, জটার উপর থেকে প্রবাহিত গঙ্গা, চার হাতে   অস্ত্রপাশুপতাস্ত্র

, ত্রিশূল, পরশু , পিণাক সঙ্গে বাদ্য ডমরু। 

বেদপুরী কুলপুরোহিত রাহু বর্মনের পত্র পেয়ে দেখতেই এসেছিল তার নগরীর রুদ্র দেবের মন্দিরে শিশু রুদ্র কে । যার জন্মের কয়েক মাস যাবত তার তৃতীয় নয়ন বাদে বাকি সবটাই আর পাঁচটা শিশুর মতোই স্বাভাবিক ছিল । তার পর  প্রহরী দের মুর্খামি আজ যাকে তাদের সামনে দাঁড় করিয়েছে সে তো আদিদেব রুদ্রদেব ! বাজের প্রভাবে মৃত্যু হয়েছে প্রহরী দের একজনের । বেদপুরী ভাবে মৃত্যু হয়ত আসন্ন ... সে হাত জোড় করে বসে যায় মন্দিরের মেঝেতে । রাহু বর্মনের মনে কোন ভয় নেই , সে এত ক্ষন তার কোলে মানুষ করা শিশুর এই বিকরাল পরিবর্তন দেখে আনন্দিত আপ্লুত হয়ে হারিয়ে গেছিলো রুদ্র দেবকে নিরীক্ষনে । তার জীবন তো সার্থক হয়ে গেছে । তবে এই নগরকে রক্ষা করতে হবে রুদ্র দেবের রোষ থেকে । সে তার জলদগম্ভীর স্বরে দেবকে সন্তুষ্ট করতে মন্ত্র উচ্চারণ করতে থাকে । 


"অহং ভবানয়ঞ্চৈব রুদ্রোহয়ং যো ভবিষ্যতি।

একং রূপং ন ভেদোহস্তি ভেদে চ বন্ধনং ভবেৎ।।

তথাপীহ মদীয়ং শিবরূপং সনাতনম্।

মূলভূতং সদা প্রোক্তং সত্যং জ্ঞানমনন্তকম্।।"

রুদ্র দেবের কর্ণ কুহরে প্রবেশ করে তার ভক্তের ভক্তির সুর । ভোলা ভান্ডারী সহজ আদিদেব ভুলে যান তার সমস্ত রাগ । ধীরে ধীরে ওনার শরীর বিবর্তিত হয়ে যায় ছোট শিশুর মতো । আদিদেব রুদ্রদেব রূপান্তরিত হয়ে যায় বটুকনাথ ভৈরবে । ছোট শিশু রুদ্রদেবের বেশ ভূষা সবই আগের মতো , পরনে বাঘের ছাল তবে এ এক অনিন্দ্য সুন্দর মনোহর রূপ । ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে বটুক নাথ ভৈরব তার পালক পিতা রাহু বর্মনের দিকে । তার প্রিয় নাগের মৃত্যু তার মনে ক্রোধ শোক উৎপন্ন করেছে । রাহু বর্মন কোলে তুলে নেন ভৈরব কে । কলসে রাখা গাভীর দুধ পান করিয়ে দেন ভৈরব কে । অনাবিল শিশুর মতো হেসে উঠল আদিদেব বটুক নাথ । তার ফোকলা গালের কস বেয়ে নামছে দুধের ধারা । রাহু বর্মন ফিসফিস করে বললো হে দেব এ ধরিত্রী  আপনার ভার বহনে অক্ষম । অধমকে নিয়ে কৈলাস চলুন দেব , আমি আপনার এক গণ হয়ে থেকে যাবো । নগরপালিকা ফ্যাল ফ্যাল করে দেখতে থাকে সবকিছু । 

ভোর রাতে বৃষ্টি বাজের তান্ডব কমে এলে নগরবাসী দেখে ভূমিকম্প প্রাকৃতিক দুর্যোগ যে কারণেই হোক রুদ্র দেবের মন্দির ভূ গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে । সেই ত্রি নয়ন শিশু , কুলপুরোহিত রাহু বর্মন বা নগরপালিকা বেদপুরী কাউকেই আর খুঁজে পাওয়া যায় না । 


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama