রঙের ছোঁয়ায়
রঙের ছোঁয়ায়
আজ আবার লোডশেডিং। একে প্যাঁচপ্যাঁচে গরম তাতে গত করেকদিন ধরে ঠিক রাত বারোটায় লাইটটা যাচ্ছে। বিরক্তিকর!
একরাশ বিরক্তি নিয় দোতরার পূবের বারান্দার দরজাটা খুলে দিলাম, কিন্তু মে মাসের এক ঝলক গরম হাওয়া ঘরে প্রবেশ করল। উফ, একটা গাছের পাতাও নড়ছে না। নিচের ঘরে বাবা মা কি করে ঘুমায় কে জানে!
আকাশের পশ্চিম দিকে মেঘ জমেছে, লালচে রঙ বলছে বৃষ্টি হবে। বৃষ্টি নামুক আমরা সকলেই চাই, বড্ড গরম পড়েছে। নাঃ, ঘরে টেকাই যাচ্ছে না। একটা চাদর আর বালিশ নিয়ে ছাদে উঠে এলাম। তারায় ভরা বৈশাখের রাত। যদিও ছাদ এখনো তেতে রয়েছে। দু বালতি জল ঢাললেই অবশ্য.... ও কে? পাশের ছাদে কে দাঁড়িয়ে? একটা সাদা ওড়না গায়ে.... কে!!
স্মিতা!!
*****
"মোর বীণা ওঠে কোন সুরে বাজে.....'' উফ, রোজ সন্ধ্যা হলেই এই এক প্যান প্যানে ন্যাকামি। সামনে জয়েন্ট। একটু শান্তিতে পড়তেও দেবে না। দুই বাড়ির মাঝে আড়াইফুটের ব্যবধান। তিনতলায় আমার ঘরের লাগোয়া নতুন বাড়িটায় রায় দম্পতি এসেছে দু মাস হল। ওদের এক ছেলে এক মেয়ে। রোগা শ্যামলা মেয়েটা ক্লাস নাইন, ছেলে সেভেন, পড়াশোনা কখন করে কে জানে। সন্ধ্যা হলেই এই প্যানপ্যানানী শুরু হয় রোজ।
-''মা.… ও মা'' আমার একমাত্র পরিত্রাতাকে ডাকতে ডাকতে নিচে ছুটলাম।
সব শুনে মায়ের বক্তব্য আমায় নিচের ঘরে বসে পড়তে হবে। প্রতিবেশির মেয়েকে তো আর গলা সাধতে বাধা দেওয়া যায় না। মা কে কে বোঝাবে একটা দুটো বই নিয়ে পড়া নয়। একেক সময় একেকটা বই বা নোটস লাগে। ওভাবে কি সব টেনে আনা যায়?
দুদিন পর ও বাড়িতে সত্যনারায়নের নিমন্ত্রণ ছিল, আমাকেও যেতে হল মায়ের সঙ্গে।
-''ওমা, দিদি আপনার ছেলেটি কি শান্ত। সবাই বলে ও নাকি দারুণ পড়াশোনায়।'' লজ্জায় মুখ নামাই। রায় কাকিমা এক ঘর লোকের সামনে এভাবে আমায়...
-''ও দিদি, রণকে একটু বলবেন আমার স্মিতাকে একটু পড়া দেখিয়ে দিতে। মেয়ের আমার মাথা ভালোই। তবে চঞ্চল খুব।" রায় কাকিমার কথাতে বিষম খেতেই শ্যামলা মেয়েটা বেণী দুলিয়ে সরবত নিয়ে হাজির।
*******
একটা ছোট্ট লাফের আওয়াজ এলো যেন ছাদ থেকে। দুপুর আড়াইটা, আমি ছাদের দিকে তাকাতেই দেখি পেয়ারা গাছের ডালটা বড্ড দুলছে। আর আকাশি জামা পরা মেয়েটা দু হাতে দুটো পেয়ারা নিয়ে দাত বার করে হাসছে। আমায় দেখিয়ে একটায় কামড় দিয়ে জানালায় এগিয়ে এলো।
-''কী পড়ো এত সারাক্ষণ বলো তো!''
-''তুমি লাফ দিয়ে ঐ ছাদ থেকে এছাদে এলে! পড়ে গেলে কি হত ?'' আমি গোল গোল চোখে তাকিয়ে দস্যিটার দিকে।
-''পেয়ারার ডাল ধরে এলাম তো পড়বো কেনো?'' পেয়ারা গাছটা ওদের হলেও ঝুঁঁকে পড়েছে আমাদের ছাদে। তাইবলে
পেয়ারার নরম ডাল ধরে ঝুল্লি খেয়ে এ ছাদে! ওর কি শরীরে ভয় ডর নেই!
ততক্ষণে অবশ্য কোচর থেকে একটা ডাসা পেয়ারা জানালা দিয়ে বাড়িয়ে দিয়েছে ও।
-''তোমার ভয় করে না?'' আমি আবার বলি।
-''ধুর! এতো আমি মাঝে মাঝেই আসি।''
এরপর খুনসুটি ঝগড়াঝাটি এমনকি হাতাহাতিও হত দুই ছাদের ব্যবধান পেরিয়ে। দস্যি মেয়েটাকে শাসন করতে পারেনি কেউ।পড়া দেখিয়ে দিতে গিয়ে বুঝেছিলাম ওটাও বাহানা। পড়াশোনায় মন কোথায়!
আমার পড়া শেষ, ব্যাঙ্গালোরে নতুন চাকরী। গোছগাছ চলছে। হঠাৎ সেদিন রাত এগারোটায় আমার তিনতলার ঘরের ছাদের দিকের জানালায় ঠুকঠুক শব্দ। খুলতেই একটা মেঘে ঢাকা মুখ, -''তুমি সত্যিই চলে যাচ্ছো রণদা?''
-''প্রথম চাকরী! ভালো চাকরী!''
-'' এখানে চাকরী নেই? কত লোক তো এখানেই... '' ফ্যাচ ফ্যাচ শব্দে তাকিয়ে দেখি বন্যা নেমেছে চোখ দিয়ে। আর নাক তার সঙ্গে সঙ্গতে বাজছে।
-''কি মুশকিল ! আমি এখানে চাকরী পাইনি বলেই তো .... তাছাড়া ভালো কোম্পানি...''
-''ব্যাঙ্গালোর গিয়েই আমায় ভুলে যাবে তো !''
-'' উফ, আগে গিয়ে পৌঁঁছই।'' আমি দস্যি মেয়েটাকে আগে কখনো কাঁদতে দেখিনি এভাবে। দুষ্টুমিতে ওর জুরি মেলা ভার। কিন্তু ওর চোখে জল দেখে বুকের ভেতরটা কেমন চিনচিন করে উঠেছিল।
ওর জন্যই ব্যাঙ্গালোরের চাকরীটা চারমাসের ভেতর ছেড়ে ভুবনেশ্বর চলে এসেছিলাম। সপ্তাহের শেষে বাড়ি আসতাম। আর সেই রাত গুলো দুজনে বকবক করেই কাটাতাম। স্মিতা তখন কলেজে। ওর ভাই রাজ তখন ইলেভেনে পড়ে।
কিন্তু এমনি এক রাতে হঠাৎ করে রায় কাকু আর কাকিমা ছাদে উঠে এসেছিলেন। ওদের হাঁক ডাকে আমার বাবা মাও উঠে এসেছিলেন আমাদের ছাদে। আমি আর স্মিতা দুই অপরাধী ধরা পড়ে চুপ। রায় কাকুর ভৎসনা মাথা পেতে নিচ্ছিলাম। হঠাৎ কাকিমা বলে উঠল -''রণ তো আপনাদের পালিত পুত্র। নিজের নয়। তাই ওকে এসব স্বপ্ন দেখতে বারণ করবেন।''
বাবা সিঁড়ি দিয়ে নেমে স্মিতাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে ক্ষমা চেয়ে এসেছিল। মা পাথর।
আমার সবচেয়ে দুর্বল জায়গা ওঁরা দুজন। কারণ আমায় ওঁরা কুরিয়ে পেয়েছিল এক মন্দিরের সিঁড়িতে। সন্তান স্নেহে কোলে তুলে নিয়েছিল। নিজেদের সন্তান নেয়নি পাছে আমার অবহেলা হয়। আমি যে দত্তক সন্তান আমায় জানিয়েছিল জ্ঞান হতেই। আমি চির কৃতজ্ঞ ওঁদের কাছে। স্মিতাও জানত সবটাই। কিন্তু এই ঘটনার জেরে যে আমাদের ভালোবাসা এভাবে দুটি পরিবারের মাঝে প্রাচীর তুলে দেবে কখনো ভাবিনি।
পরদিন ওদের ছাদের দেওয়াল আরো দুফুট উঁচু হয়েছিল। আর পেয়ারা গাছটা কাটা পড়েছিল। আমাদের ছাদের দরজা আর খোলা হত না। আমিও বাড়ি আসা কমিয়ে দিয়েছিলাম। স্মিতা হোয়াটস আপ, ফেসবুক, মেল কোনোটাতেই যোগাযোগ করেনি। ও হয়তো গৃহবন্দী হয়েছিল। তবে বাবা মায়ের অপমান মেনে আমিও যোগাযোগ রাখতে চাইনি।
দুমাস পরেই দু বছরের কন্ট্রাক্টে কানাডার কাজের অফারটা পেয়ে সব ভুলে পারি দিয়েছিলাম নতুন জগতে।
প্রায় একবছর পর একদিন মেল বক্সে একটা নতুন মেল দেখে একটু চমকেছিলাম। ছোট্ট মেল।
'আমার বিয়ে! ছেলে ব্যবসায়ী। কি করবো বলে দাও।'
উত্তর দেইনি। বাবা মায়ের অপমানে লাল হওয়া মুখটা বারবার ভেসে উঠছিল মনের ভেতর। আনরিড করে বেরিয়ে গেছি। কয়েকদিন ছটফট করেছি। ভুলতে চেষ্টা করেছি স্মিতার সঙ্গে কাটানো মিষ্টি মধুর স্মৃতিগুলো।
কেটে গেছে দুটো বছর, কলকাতায় চাকরী নিয়ে ফিরে এসেছি শুধুই বাবা মায়ের জন্য। ওঁরা বৃদ্ধ, এখন আমার শক্ত কাঁধের প্রয়োজন। শুনেছি দু মাস আগে নাকি স্মিতাও ফিরে এসেছে সাদা কাপড়ে মুড়ে। রায়বাড়িটা একটা প্রেত পুরীর মত স্তব্ধ হয়ে গেছে। রাজ বাইরে পড়তে গেছে। কাকু কাকিমা বিধবা মেয়ে নিয়ে নিজেদের গৃহবন্দী করে রেখেছেন। গত দু সপ্তাহে ও বাড়ির এদিকের কোনো জানালা খোলা দেখিনি। আমিও জোড় করে মনটাকে আয়ত্তে রেখেছি।
কিন্তু আজ এই গরমে ছাদে এসে যে এভাবে.... চাঁদের আলোয় স্মিতাকে মনে হচ্ছে এক বিষাদ প্রতিমা। এই দু বছরে আরো সুন্দর হয়েছে ও। টানা টানা চোখ দুটোয় উদাস দৃষ্টি। কোমর ছাড়ানো চুলে অযত্নের ছাপ, গায়ের রঙটা যেন পরিস্কার আগের থেকে। ওড়নাটা মৃদু উড়ছে। ও একমনে আকাশের দিকে তাকিয়ে কিছু খুঁজছে। ডাকতে গিয়েও ডাকতে পারলাম না। এখন তো আমি সব অধিকারের বাইরে। ও এখন অন্যের বিধবা স্ত্রী। আবার অপমানিত হওয়ার চেয়ে.... কিন্তু হৃদয় যে এসব যুক্তি মানতে নারাজ। আমার স্মিতা আজ একলা, ঐ হাতে হাত রেখে কত রাত এই ছাদে কেটেছে তারারা সাক্ষী। চাঁদকে সাক্ষ্য রেখে ওর কোলে শুয়ে কত ক্লান্তি কাটিয়েছি একদিন। ওর ঐ নরম ঠোঁটের ছোঁয়ায় কত অভিমান জল হয়েছে কতবার। ওর খোলা চুলের গন্ধ মেখে কত রাত ভোর হয়েছে, শুকতারা দেখেছি দুজনে আঙ্গুলে আঙ্গুল জড়িয়ে।কথা দিয়েছিলাম, আগলে রাখবো, কথা দিয়েছিলাম ছেড়ে যাবো না ঐ হাত।
ক..কিন্তু স্মিতা আজ কি করছে? চিলেকোঠার উপর জলের ট্যাঙ্কে ওঠার লোহার সিঁড়ি বেয়ে ও উঠে গেলো তরতর করে, ট্যাঙ্কের ধারে দাঁড়িয়ে ও...
কয়েক সেকেন্ডের ভেতর আড়াই ফুটের দুরত্ব অতিক্রম করে বড় পাচিল টপকে কয়েক লাফে সিঁড়ি ডিঙ্গিয়ে আমি পৌঁছে গেছি ওদের ট্যাঙ্কের উপর।
শেষ মুহূর্তে জড়িয়ে ধরে হ্যাঁচকা টানে দুজনেই পাকা ট্যাঙ্কের উপর গড়িয়ে পড়লাম।
বাতাস যেন থমকে গেছে, মনের মাঝে রিনিরিনি করে তানপুরার ঝালার তান, বৃষ্টি বিধৌত মুখে স্মিতা আমার পাঞ্জাবি খামছে ধরে আমায় দেখছে। যেন কত যুগ ধরে দুজনে এভাবেই থেকে যেতাম। কিন্তু বড় বড় ফোটায় বৃষ্টি শুরু হতেই সম্বিত ফিরল। প্রচন্ড দহনের পর আজ প্রকৃতির বুকে সূধারস ঢালছে আকাশ। আমরা দুজনেও সেই বারিধারায় সিক্ত হতে হতে দু জনে দুজনকে নতুন করে আঁঁকড়ে ধরেছি।
হঠাৎ ছিটকে গেল স্মিতা। দু চোখে ভয় ।
-''চলে যাও রণদা, আমি যে বিধবা, আমায় মরতে দাও।''
-''চলে যাবো বলে তো আসিনি এবার।" দৃঢ়তার সঙ্গে বললাম।
-''ওরা বলে আমি অপয়া... আমায় বিয়ে করে ওদের ব্যবসা ডুবেছে, ছেলেটা মারা গেছে...'' ওর ঠোঁটৈ আমার ঠোঁটটা ডুবিয়ে চেপে ধরলাম। কত দিনের বুভুক্ষু মাটি যেভাবে বৃষ্টির জল শুষে নিচ্ছিল ঠিক সে ভাবেই আমরাও মিলেমিশে একাকার।
রাজ আমায় মেল করেছিল স্মিতার বিয়ের পর। ওর দিদির বিয়েটা ভালো হয়নি। জামাইবাবুটা ছিল লম্পট, পার মাতাল। পরিবারটা লোভী। দুনম্বরী কারবার। দিদির উপর অত্যাচার হত ভীষণ। আমি মেলগুলো আনরিড করেই রাখতাম। কিছুই করার ছিল না। রাজ লিখেছিল ও আর ওর দিদি ছাদের একটা একটা করে ইট তুলে দেওয়ালটা ভেঙ্গে ফেলেছিল আবার। আমি তবুও উত্তর দেইনি। দেশে ফিরে কখনো ওদের খোঁজ করিনি। ভয় পেতাম, ফল্গু ধারার মত মনের মাঝে সুপ্ত নরম ঝর্ণাটাকে।
কিন্তু আজ.... স্মিতাকে নিজের সঙ্গে মিশিয়ে নিয়ে বললাম -'' আজ তোকে রাঙিয়ে দেবো আমার ভালোবাসার রঙে, আর রঙহীন জীবন নয়। ঐ দেখ শুকতারা উঠছে আকাশে, মেঘ কেটে গেছে। পূব আকাশের সঙ্গে সঙ্গে আজ তোর জীবনেও আঁধার কেটে নতুন সূর্য উঠবে। ''
আমায় আঁঁকড়ে ধরে স্মিতা তখন কাঁপছে তীরতীর করে একটা ছোট্ট বৃষ্টি ভেজা পক্ষী শাবকের মত।