Baishakhir Golpo

Tragedy Inspirational

4.0  

Baishakhir Golpo

Tragedy Inspirational

পুরুষ তন্ত্র এবং অহল্যা

পুরুষ তন্ত্র এবং অহল্যা

5 mins
446


নিজের তৃপ্তির কথা কখনও গোপন করতে নেই প্রিয় পুরুষের কাছে। নারীসুলভ সংকোচ কাটিয়ে নিজ তুষ্টির কথা স্বীকার করেন দেবরাজ পুরন্দরের কাছে। অহল্যা কুমারী নন। সহবাসের অভিজ্ঞতা রয়েছে তাঁর। কিন্তু গৌতমের চোখে ছিল না প্রেম। সেই প্রেম, সেই মুগ্ধতা দেখেছেন তিনি পুরন্দরের চোখে। তাই তাঁর কামনায় সাড়া দেওয়া। কাব্যে উপেক্ষিতা সেই অহল্যার কাহিনি।


তৃপ্তিই সুখ? যে সুখ শরীর বেয়ে চুঁইয়ে পড়ে মনে। মন নদী হয়। উচ্ছ্বাসে ভাসে। আবার মাটিও হয়। আঁকড়ে ধরতে যায়। হাওয়াও হয়। তখন হাজারো জুঁই ফুলের সুবাস মনের শরীরে।অহল্যার তাই মনে হয়। তাঁর মন বলে, মনেরও এক সূক্ষ্ম শরীর থাকে। দেহ-সুখে সুখী হয় সেই অদৃশ্য শরীর। খুঁজে পায় মোক্ষের সন্ধান। অহল্যা শুনেছেন, মহর্ষি গৌতমের মুখে মোক্ষের ব্যাখ্যা। আর শুনে শুনে সেই আনন্দ-স্বরূপ সম্পর্কে যে ধারণা জন্মেছে, সেই সুখ-স্বরূপ ব্রহ্মের আস্বাদ তিনি অনুভব করেছেন আজ। নিজ দেহ-মনে।তৃপ্ত অহল্যা। মোক্ষের সন্ধান লাভে তৃপ্ত গৌতমও। অহল্যা জানেন সে কথা। কিন্তু সেই মোক্ষে বানভাসি কোথায়? শরীরকে উপেক্ষা করার সাধনায় যে শুষ্ক হয় মন। মহর্ষির যেমন। সেই মনে শরীর চুঁইয়ে পড়া আনন্দের প্রকাশ সম্ভব? জপতপের সাধনা কি সত্যিই উর্বর করে মন? সুখ-বৃক্ষ সরস থাকে সেই অনুর্বর জমিতে? মহর্ষি কি জানেন, দেহ যাগে দেহ যজ্ঞে যে অগ্নির জন্ম হয়, সেই অগ্নি আসলে ধারণ করেন বরুণকে? হ্যাঁ, এই বৈপরীত্যও সম্ভব। সম্ভব কারণ, ব্রহ্মের আসল আধার মন। আর মনের আধার শরীর।


অহল্যা আলোড়িত। সত্য দর্শনে। ব্রহ্ম-আস্বাদ লাভ করে। সুখ। তাঁর শরীরজুড়ে। মন জুড়েও। শরীরকে ছাড়িয়ে সেই সুখ ছুঁতে চায় প্রকৃতিকে। নতুন করে ভালোবেসে সব ছুঁয়ে দেখতে চায় মন। তৃপ্তির সুখে অহল্যা আজ উর্বরা। মোক্ষের স্বরূপ তাই সহজেই উন্মোচিত হয় তাঁর দৃষ্টি-সম্মুখে।‘কৃতার্থাস্মি সুরশ্রেষ্ঠ’-- কৃতার্থ অহল্যা। নিজের তৃপ্তির কথা কখনও গোপন করতে নেই প্রিয় পুরুষের কাছে। নারীসুলভ সংকোচ কাটিয়ে তাই নিজ তুষ্টির কথা স্বীকার করেন দেবরাজ পুরন্দরের কাছে। অহল্যা কুমারী নন। সহবাসের অভিজ্ঞতা রয়েছে তাঁর। কিন্তু সেই দেহ যজ্ঞ নিবেদনে তৃপ্ত হয়নি কখনও। হবে কী করে? গৌতমের চোখে যে মুগ্ধতা ছিল না কখনও। ছিল না প্রেম। সেই প্রেম, সেই মুগ্ধতা দেখেছেন তিনি পুরন্দরের চোখে। বহুকাল ধরেই। তাই তাঁর কামনায় সাড়া দেওয়া। ওষ্ঠ, স্তন, যোনি-- পুরন্দরকে সঁপে তৃপ্ত তিনি আজ। তাঁর সঙ্গে তিনি তরঙ্গে ভেসেছেন, তরঙ্গে ডুবেছেন। পুরোপুরি নিমজ্জিত হয়েছেন। এ বার রক্ষা করা চাই তাঁকে। ইন্দ্রকে। গৌতমের রোষ থেকে।তাড়া দেন অহল্যা। ‘গচ্ছ শীঘ্রমিতি প্রভো’-- গৌতম ফিরে আসার আগেই যেন পালিয়ে যান ইন্দ্র। যদিও জানেন, পালিয়ে গেলেও গৌতমের রোষ থেকে রক্ষা নেই তাঁদের। সর্বদ্রষ্টা ঋষি এই মহর্ষি গৌতম। ভূত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ সব নখদর্পণে তাঁর। কী ঘটবে, কী ঘটতে চলেছে, সব জানেন তিনি। তবু আশ্রম ত্যাগ করে গেছেন। অহল্যাকে রেখে। স্নানের অজুহাতে।কী চেয়েছিলেন মুনি? অহল্যাকে পরীক্ষা করতে? সতীত্বের পরীক্ষা দিক অহল্যা। সংযমের পরীক্ষা দিক। এই কি ইচ্ছে ছিল তাঁর?নিশ্চয়ই তাই। এর অন্যথা হলে ত্রিকালজ্ঞ ঋষি সাবধান করতেন তাঁকে।


তিনি মহর্ষি গৌতম। শুদ্ধ দর্পণে ভবিষ্যৎকে প্রত্যক্ষ করতে সমর্থ এই পুরুষ। পরপুরুষে উপগতা হবেন স্ত্রী তাঁর, এই ভবিতব্য কি অজানা ছিল মহর্ষি গৌতমের?এর উত্তর জানেন অহল্যা। চাইলে এই ভবিতব্যকে এড়ানো যেত। এ তাঁর বিশ্বাস। কিন্তু মহর্ষি চাননি। বৃদ্ধ তিনি। যুবতী স্ত্রীর রতি-অতৃপ্তিতে বিরক্ত তাই। অহল্যার অতৃপ্তি তাঁকে কোথায় নিয়ে যেতে পারে, পৌরুষের অহংকারে হয়তো পরীক্ষা করে দেখতে চেয়েছিলেন তা। চেয়েছিলেন সুন্দরীশ্রেষ্ঠা অহল্যার গুমর ভাঙতে। চেয়েছিলেন, নিন্দিত অহল্যার নত-শির দেখতে।তাই স্নানের অজুহাতে আশ্রম অরক্ষিত রেখে মহর্ষির চলে যাওয়া। আর অহল্যা! ঋষিপত্নী তিনি। মুহূর্ত গণনা করতে জানেন। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় পোষ মেনেছে তাঁর কাছে। কামনিবৃত্তির মুহূর্ত সমীপে, এই ইঙ্গিত পেয়েছিলেন তিনি। ‘সঙ্গমোচিত-প্রসাধনবতি’ হয়ে তাই অপেক্ষা করেছেন। একা, ঋষির পর্ণকুটিরে।হ্যাঁ, দিবাভাগেই। ‘সঙ্গমং তু অহমিচ্ছামি ত্বয়া সহ সুমধামে’-- কামমোচনের আবার নির্দিষ্ট সময় কী? কামজর্জরিতা নারী তখন পুরুষস্পর্শের অপেক্ষায়। অপেক্ষায় সেই পুরুষের, যাঁর চোখে মুগ্ধতা ছিল।এই অপেক্ষায় অহল্যার মনে কোনো পাপবোধ ছিল না। রূপবতী কন্যে তিনি। উর্বশীর রূপ তাঁর কাছে ম্লান। সাধে কি আর পুরন্দর এমন কামনা-তাড়িত? কিন্তু মহর্ষি? তাঁর চোখে কোনওদিন মুগ্ধতা দেখেননি তিনি। ছিল না তাঁর দেহকোষে অনন্ত পিপাসা। মহর্ষির সঙ্গে শয়নে তাই না ছিল প্রেম, না ছিল তৃপ্তি। অহল্যা অপেক্ষা করেছেন। অপেক্ষা করেছেন রক্তমাংসের এক পুরুষ শরীরের। যে তাঁকে কামনা করবে। পুরন্দরের চোখে তিনি সেই কামনা দেখেছেন। বহুকাল ধরেই। অহল্যার শরীরী সঙ্গের অপেক্ষায় পুরন্দরের অগুন্তি দিন-মাস-বছর কেটেছে-- ‘বহুকালম্, অভিলাষশ্রবণাৎ’।অহল্যাও কি আর অপেক্ষা করেননি? ইন্দ্র সেই অপেক্ষার খবর রাখেননি। রাখেননি বলেই ছদ্মবেশ ধারণ। গৌতমের ছদ্মবেশে পরিচয় গোপন রেখে অহল্যায় উপগত হতে চেয়েছিলেন তিনি। অহল্যা জানবে, তাঁর নিজ-পুরুষই তাঁকে গ্রহণ করেছেন।কৌতুক বোধ করেন অহল্যা। নির্বোধ পুরুষ! নারীর কাছে নিজেদের আড়াল করতে শিখেছে বুঝি তাঁরা? পুরন্দরের চোখের ভাষা, তাঁর স্পর্শই বলে দিয়েছিল ভিনপুরুষ হাজির আজ অহল্যার কুসুমশয্যায়।হ্যাঁ, অহল্যা জেনেশুনেই পরপুরুষের বাহুলগ্না হয়েছেন। তাঁকে গ্রহণকরেছেন নিজ দেহে-- ‘মতিং চকার দুর্মেধা দেবরাজকুতূহলাৎ’। মহর্ষি দু’জনকেই চরম শাস্তি দেবেন, সে কথা জেনেও। সহবাস শেষে ইন্দ্রকে রক্ষা করতে চেয়েছেন। গৌতমের রোষ থেকে। তাঁকে তাই পালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া। বলেছেন, “আত্মানাং মাঙ্গং চ দেবেশ সর্বথা রক্ষ গৌতমাৎ।’ দেবরাজ, রক্ষা করুন নিজেকে। রক্ষা করুন আমাকেও। গৌতমের ক্রোধ থেকে।ভয় ছিল ইন্দ্রের মনে। ভয় গৌতমের ঋদ্ধিকে। শয়ন-তৃপ্তির পর পালাতে চেয়েছেন তাই। তাড়া ছিল, তবু বিদায় মুহূর্তে কামনা-তৃপ্ত ইন্দ্র কাম্য-কন্যার কাছে সন্তোষ প্রকাশ করে গেছেন। এর পরই তাঁর গৌতমের মুখোমুখি হওয়া। ক্ষমা করেননি গৌতম। অভিশাপ দিয়েছেন। দু’জনকেই। কী অভিশাপ? হাজারো ভাষ্য আছে এর। একটি ভাষ্য বলে, গৌতমের অভিশাপে ইন্দ্রের অণ্ডকোষ খসে পড়েছিল। পরে মেষের অণ্ডকোষ দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া হয়। সেই থেকে তাঁর নাম ‘মেষবৃষণ।’ অপর ভাষ্যে প্রকাশ, সহস্রযোনির শাপে অভিশপ্ত তিনি। পরে সেই যোনিচিহ্ন ‘সহস্রলোচন’ হয়। প্রাদেশিক কবিরা ছিলেন সেই রূপান্তরের মূলে।আর অহল্যা? বাল্মীকি বলছেন, গৌতম তাঁকে বায়ুমাত্র ভক্ষণ করে সবার অদৃশ্যা হয়ে ভস্মশয্যায় শয়ানের নিদান দিয়েছিলেন। পরিত্যক্ত গৌতম-আশ্রমে এভাবেই সহস্র যুগ কেটে যায় তাঁর। স্বামীর অভিশাপ শিরে ধারণ করে। আর একদিন, সেই আশ্রমে পুরুষশ্রেষ্ঠ রামের আবির্ভাব হয়। তাঁর প্রসন্ন দৃষ্টি অহল্যাকে দান করে তাঁর পুরনো রূপ। ফিরে এলেন গৌতমও। পূর্ব প্রতিশ্রুতি মতো। নিশ্চিত তিনি, আত্মশুদ্ধিতে আজ পবিত্র তাঁর জায়া। রূপের অহংকার ঘুচে গেছে তাঁর। অতএব, তাঁদের যৌথ জীবনে আর বাধা নেই কোনও।তাহলে ‘গৌতমবধূঃ শিলাময়ী’-র আখ্যান? সে কালিদাসের কল্পনা-সম্ভূত। পরবর্তীতে কালিদাসের এই ভাষ্য প্রাদেশিক রামায়ণে জনপ্রিয় হয়েছিল খুব। আর তাই তো হওয়ার কথা। নারী শুধু দেহ। তাঁর কামনা থাকতে নেই। হৃদয় থাকতে নেই। তাকে মূক হতে হয়। তবেই না সে প্রতিমা হবে। পাষাণ প্রতিমা। অস্তিত্ব থেকেও যার কোনো অস্তিত্ব নেই। দেহী হলেও যার কামনা-বাসনা থাকে না। রক্তমাংসের প্রতিমাকে পাথর প্রতিমায় রূপদান-- পুরুষতন্ত্রের সাধনাই এই।





Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy