পুরুষ দেহব্যবসা (ষষ্ট পর্ব/অন্তিম পর্ব )
পুরুষ দেহব্যবসা (ষষ্ট পর্ব/অন্তিম পর্ব )
হয়ত কিছু ভুল ছিলো মনে হয়!!!
শব্দের আশ্বাসে,
মেঘের ভেলার বিশ্বাসে, কিংবা
রোদের দীর্ঘশ্বাসে...
তুমি কি পারবে মুছে দিতে?
অবেলার পদচিহ্ন।
মনের অলিন্দের জমের থাকা মিছিল মিশুক ছায়াপথে,
ভুলভ্রান্তির রাজত্বেও ফিরে আসুক
একটা বিস্মৃত ডাকনাম,
ভুল সময় জন্ম নিক একটা নিখুঁত সমপ্রেম।
গাড়ির গতির সাথে সাত্ত্বিক ভাবছে এই শহর এবার ছাড়তে হবে। পিন্ডদান করবে তার আগে মায়ের শ্রাদ্ধশান্তি করবে নিজের মতন। আজ সব কিছুর অবসান, বাবা-মা এমনকি তার দেখা স্বপ্নের। তর্পন করলে একমাত্র আত্মার শান্তি। মন্দিরে গিয়ে ঈশ্বরের কাছে পরের জন্মেও একই মায়ের সন্তান হবার বাসনা করবে সে।
আচমকা গাড়ির ব্রেক সব চিন্তার জাল ভেঙে দেয়।
“এই কমবয়সি ছেলেটাকে কোথায় পেলি প্রিন্স? একদম টাটকা মাল। দারুন জমবে...”
“একদম না পলাশদা। ও রাতের দেহব্যবসা নয়, আমার না পাওয়া স্বপ্নের ফানুস ও।”
তুমুল বৃষ্টিতে ভিজে রাস্তাতে তার গাড়ির ধাক্কায় আহত হওয়া ১৪-১৫ বছরের ছেলেটাকে সঙ্গে ক্রে নিয়ে আসে সাত্ত্বিক। পেশীবহুল সাত্ত্বিক কোলে করে গাড়িতে তুলে আনে। হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা করে এখন সে বাড়িতে ফিরেছে। মায়ের কথা ভেবে কাঁদছিল এতক্ষণ এবার সে ছেলেটার দিকে তাকাল। একটা মায়াবী চোখ, একটা সারল্য, একটা দীপ্তি। ভয়ে কুঁকড়ে আছে সাত্ত্বিককে ধরে।
সাত্ত্বিক নিজের ঘরে গিয়ে তোয়ালে দিয়ে ছেলেটাকে ভালো করে মুছিয়ে নতুন কেনা জামাকাপড় পড়িয়ে দেয় ঠিক যেমন প্রথমদিন করেছিলো পলাশদা। মা যেমন তার আদরের বাবুকে করত ঠিক তেমন করে এই ছেলেটাকে মানুষ করবার ইচ্ছে জাগে মনে।
“আমি তোর দাদার বয়সী কিন্তু আমি তোকে সন্তানস্নেহে পালন করব। আমাকে পাপাই বলে ডাকবি মেঘ?”
“ডাকব পাপাই?”
পরম মমতায় জড়িয়ে ধরে তাকে। ছেলেটার বাবা ডাকে সব সুখ। সাত্ত্বিক ভালোভাবেই জানে সমপ্রেমী জীবনে আর এই লাইনে সে কোনদিন বিয়ে কিংবা সন্তানের মুখ দেখতে পারবে না। এই মেঘকে সে সব উজার করে দেবে।
“আমি ওর খাবারের ব্যবস্থা করতে বলেছি। তুই এখানে বস।”
“বলো পলাশদা।”
“কলকাতার বাইরের রাজ্যে যাবি?”
“হ্যাঁ। আমার অনেক টাকা চাই।”
“আজকের আমার কমিশানের টাকা।”
“দিতে দেবো?”
“কি হয়েছে বলবি আমাকে?”
“কি আর হবে আমার। সব শেষ, সবকিছু...”
“মানে!!!”
“আমি আজ অবধি অপেক্ষা করতাম একটা নতুন আগামীর কিন্তু সেটা না দিয়ে ঈশ্বর পাঠাল স্বপ্ন পূরণের জন্য আমার এই মেঘবালককে। একটা অনুরোধ করব?”
“বল।”
“ওই বাচ্চা ছেলেটাকে আমি কি করি সেই বিষয়ে কিছু বলবে না। আমি ওর জন্য ভালো হোস্টেলের ব্যবস্থা করব। ভালো স্কুলে পড়াব আমি।”
“কিন্তু তোর না কাল গ্রামের বাড়ি যাবার কথা ছিলো?”
“কোথায় যাবো পলাশদা? কার কাছে?”
“তোর মা?”
“মা হারিয়ে গিয়েছে ওই দূরের আকাশে। ভবিষ্যতে কিছু পেলে হয়ত ফিরব গ্রামে।”
“সাত্ত্বিক!!!”
আচমকা কাল অতীতের একটা চিঠি পেলাম।
এক লহমাতে এক আলোকবর্ষ স্মৃতি ডুব সাঁতার লাগালো ডায়ারির পাতাতে।
পরপর লিখল অনেকগুলো কাশফুল থেকে বসন্তের সমীরণের হিসেব!
আঁকল না দেখা জ্যোৎস্না রাতের মুগ্ধতা!
জানলার পরদা সরিয়ে রাতের অন্ধকারে মিশিয়ে দিলাম ফ্যাকাসে ব্যথাগুলো...
সমপ্রেমের ক্যানভাসে তুলির টানে বানালাম সাতরং!!!
অগনিত মাথাগুলো চিৎকার করে জানান দিচ্ছে... পরাজয় অসম্ভব।
আজ তাহলে পাহাড়ি ঝরনার ইচ্ছের দল সমপ্রেমের গল্পে হোক নিবিড়!
রূপকথার সত্তার কার্নিসে আদরগুলো টাঙিয়ে দাও আরো...
“জানো দাদা। মা বারবার একটা কথা বলত।”
“কিরে?”
“এই পৃথিবীতে যাই পাপ করবে তার শাস্তি ইহজগতেই পাবে। আজ আমার আর মায়ের জীবন বরবাদ করে ঝিলিক সব শাস্তি পাচ্ছে রোজ।”
“একটা কথা বলব সাত্ত্বিক?”
“বলো না দাদা।”
“আমি জানি প্রত্যেকদিন প্রতিমুহুর্তে আমিও পাপ করে চলেছি। কিন্তু আমার এই পাপ অনেকের সংসার ভেসে যাওয়া আটকাচ্ছে। আজকের চাকরির বাজার খুব খারাপ। তাই তারা আমার কাছে গোপনে কিছু রোজগার করে সংসার চালায়। আমি একটা কথা দিলাম আজ।”
“কথা!!!”
“প্রতিজ্ঞা বলতে পারিস। আমি আজকের পর থেকে আর কাউকে কষ্ট দেবো না কিংবা জোর করে এই লাইনে নামাব না। আমি ঈশ্বরের কাছে ক্ষমাও চাইতে পারব না হয়ত।”
“একবার চেয়ে দেখো না দাদা।”
“একটা কথা সাত্ত্বিক। আজ তুই যতটা রাস্তা চলে এসেছিস সেখান থেকে ফেরত যাওয়ার উপায় নেই বললেই চলে। তুই কোনভাবে কিছুদিন কাটিয়ে ফেরত যা নিজের স্বপ্নের দেশে।”
“দাদা!!!”
“একটা কথা বলব সাত্ত্বিক।”
“বলো দাদা।”
“বিভাবন যদি তোর জীবনে আসে তাহলে?”
“আমি নিজেই সেই ফেরত আসার জায়গা রাখিনি পলাশদা। সে আমাকে নিশ্চয় ঘেন্না করে কারণ আমি তাকে প্রতারিত করেছি।”
“সাত্ত্বিক!!!”
“ঝিলিকের মতন আমিও হয়ত বিভাবনের স্বপ্ন ভেঙেছি...”
মেঘের হাতে একটা চিঠি
পাঠিয়ে দিলাম আজ,
প্রেম আমি আছি অনেক দূরে
হাতে অনেক কাজ।
বৃষ্টি তুমি একটিবার
খবর দিও তাকে,
সমপ্রেমিক আমি পাশেই আছি
হাজার কাজের ফাঁকে।
“বাবু সবাই চলে এসেছে আপনাকে ডাকছে।”
গ্রামের সেই বাড়ি আজ অনাথাশ্রম আর বৃদ্ধাশ্রম হয়েছে আর পাশে একটা স্কুল। মঞ্চ বাঁধা হয়ে। সেই বাড়িতে যে গ্রামে ফেরবার জন্য সাত্ত্বিক কলকাতাতে কুঁকড়ে মরত সেটা আজ উন্নতির মুখ দেখেছে।
বাড়ি থেকে বেড়িয়ে এলো পেশীবহুল সেই চেহারা যাকে একসময় সারা গ্রাম তাড়িয়ে দিয়েছিলো আজ সেই গ্রামের পঞ্চায়েত প্রধান।
“মাধবদা মেঘের পাঠানো পাঞ্জাবী ইস্ত্রি করে রেখো। ও কাল রাতেও আমাকে মনে করিয়ে দিয়েছে।”
“সব রেডি দাদাবাবু।”
মায়ের ছবির সামনে দাঁড়িয়ে আপনমনে বলে সাত্ত্বিক...
“মা দেখো আজ তোমার স্বপ্ন পূরণ করেছি আমি কিন্তু কিভাবে সবাইকে বোঝাব আমি বিয়ে করতে পারিনা কারণ আমি একজনকে প্রতারিত করেছি। আমি যে কাজ করেছি আমার শরীর অশুচি। তোমরা বললে মন অশুচি হয় দেহ নয় কিন্তু আমি সবাইকে ঠকিয়েছি মা। আমার আজ এই দেহ বলি কিংবা মন অভক্তিতে ভরে গিয়েছে। আমি সমপ্রেমি আমি একজনকে মন উজার করে ভালোবাসোতে পারব কিন্তু এই দেহ তাকে দিতে পারব না মা।”
সাত্ত্বিক এখানে এসে দেখে ঝিলিক তার কথা রেখে চন্দ্রমল্লিকা আর পলাশ গাছ পুঁতেছে। সাত্ত্বিক তার জমানো টাকা আর পলাশদার দেওয়া টাকাতে আশ্রম আর স্কুল বানিয়েছে। সারা চত্বরে তার জয়জয়কার।
“সাত্ত্বিক বাবা। চল সবাই অপেক্ষা করছে।”
“আসছি কাকু।”
আশ্রম আর স্কুলের নাম ‘স্বপ্নপুরি’ এটা সাত্ত্বিকের মায়ের পছন্দের নাম। মঞ্চে এলাকার বিশিষ্ট নাগরিক, সাত্ত্বিকের পুরনো স্কুলের স্যারের আছেন। নিচে আশপাশের গ্রামের অসংখ্য মানুষ। মঞ্চে সবাইকে কপালে চন্দনের ফোঁটা দিয়ে বরণ করা হয়। প্রদীপ প্রজ্বলনের জন্য সাত্ত্বিক অপেক্ষা করছে।
কার অপেক্ষা?
চেষ্টার শেষ সীমান্তে দাঁড়িয়ে
সামনে আসে একটা দীর্ঘশ্বাস।
মনের কোণায় হালকা বাসনা
ফিরে আসবে এই বিশ্বাস।
আমি এককন ব্যর্থ প্রেমিক
পরাজিত বাস্তবের কাছে,
আমার মনের অলিন্দে
তার ফিরে আসার খবর আছে।
আচমকা সবাইকে অবাক করে সাত্ত্বিক মঞ্চ থেকে সামনের রাস্তায় যায়...
“পাপাই...”
ওই তো দুইহাত বাড়িয়ে ছুটে আসছে তার স্বপ্নের উড়ান তার ‘মেঘ’। আজ মেঘ ইঞ্জিনিয়ার। ডেনিম জিন্স আর শার্টের মেঘকে স্বপ্নের রাজপুত্রের মতন লাগছে। সেই একইরকমের সুন্দর চেহারা, মায়াবী চোখ একই দীপ্তি একই রকম পড়াশুনাতে ভালো।
“আমার সোনা পাপাই। তুমি কি ভেবেছিলে তুমি আমাকে দূরে দূরে রাখবে আর আমার মন খারাপ করেনা। তোমাকে এতদিন না দেখে আমি রোজ রাতে কাঁদতাম কিন্তু তোমার দেখানো পথে হেঁটে আজ আমি সফল। আজ তুমিও জীবনের কঠিন পরীক্ষায় সফল আত্র তোমার আশীর্বাদে আমিও।”
সাত্ত্বিকের চোখে জল। সে দেখছিলো একদম তার মনের মতন হয়েছে এই মেঘ। আচমকা মেঘ তাকে কোলে তুলে নেয়...
“পাপাই ও পাপাই একবার তোমার স্বপ্নের নীলাকাশ ছুঁয়ে দেখো আর দেখো তোমার জন্য এতদিন অপেক্ষা করে কে এসেছে...”
মেঘ নামাতে সামনে হেঁটে আসা মানুষটাকে দেখে পায়ের তলার মাটি সরে যায় সাত্ত্বিকের। সেই মানুষটা এগিয়ে আসে একটা কবিতা আবৃত্তি করতে করতে...
চোখের কাজল শান্ত মায়া
মিঠে গলার স্বর।
ক্যানভাসেতে লালচে ছায়া
আমার হাতটা ধর!
খামখেয়ালী তোর প্রেমেতে
গুছিয়ে নিবি আমায়,
পাগলপারা কবিতা লিখি
তোমার অপেক্ষায়...
“কোথায় পেলি তুই ওকে!!!”
“আমি তোমার জন্য খুঁজে এনেছি পাপাই। আর একজনকে এনেছি। পলাশ বাবাই...”
পলাশদাকে আসতে দেখে চমকে ওঠে সাত্ত্বিক...
“পাপাই, তুমি পৃথিবীর সেরা বাবা। আমার বাবা-মা অকালে মারা যাবার পরে আমি যখন মরতে বসেছিলাম সেদিন তুমি আমাকে আগলে আমাকে বড় করেছো। পলাশ বাবাই কাকারা যেসব সম্পত্তি জবরদখল করে আমাকে তাড়িয়ে দেয় সব উদ্ধার করেছে।”
“সাত্ত্বিক। কি ভাবিস আমাকে। পাপী, অপরাধী। আমিও কিভাবে বাবা হবার ইচ্ছে ত্যাগ করি বল। তাই তো হোস্টেলে গিয়ে সব ডিটেলস নিয়ে আদালতে কেস করে আজ তোর অনুপ্রেরণাতে জিতেছি।”
“তোমরা কি বলছো?”
“জানিস সাত্ত্বিক। তুই ছেড়ে আসার পরে আমি সব হারিয়ে রিক্ত, নিঃস্ব হয়ে মরবার কথা ভেবেছিলাম। মরতে গিয়ে হাত ধরে টানে আমাকে মেঘ। আমার বিষণ্ণতার অধরের মিষ্টি হাসি এই মেঘ।”
মন খারাপের বিশাল রাজ্যে
একখণ্ড মেঘ
বললো এসে আমায় হেসে
‘তুমি হবে আমার আবেগ?’
আমি বললাম, আকাশ আমায়
ভীষণ বাসে ভালো,
তাকে ছেড়ে এই জীবনে
কি করে জ্বালাই আলো?
মেঘ বলল, আমার হেথা
তুমিই ‘একফালি দ্বীপ’
তোমার পেলে মেটাব আক্ষেপ
সমপ্রেমের প্রতীক।
“পাপাই। তুমি কেন ভয় পাও, নিজের কাজ নিয়ে কেন তোমার লজ্জা?”
“তুই... তু...ই... কি জানিস???”
“সব। জানা অপরাধ হলে আমাকে শাস্তি দাও কিন্তু নিজেকে এভাবে কষ্ট দিও না। পাপাই অশুদ্ধ দেহ না অশুচি সেই মনগুলো। পাপাই কোন কাজ কি খারাপ তুমিই বলো। তুমি যেভাবে দিদুনের স্বপ্ন পূরণ করলে সেটা কতজন করে। থাক না গোপন। পাপাই তুমি আজ আমার গর্ব, আমি গর্ব করে বলব আজ আমি তিনজন বাবা পেয়েছি। তিনজন মানুষের কাজ করে, মানবতার কাজ করে। তারা খুনি নয়, ধর্ষক নয়। কেন তুমি আমাকে হারানোর ভয় পাও? তুমি আমার পছন্দের পাপাই, পলাশ আঙ্কেল আমার প্রিয় বাবাই আর বিভাবন আঙ্কেলকে কি বলব সেটা তোমার ওপর।”
“সাত্ত্বিক, আমি আর তুই চল বুকের মাঝের শূন্যতার নাম দিই প্রিয় মানুষের ভালোবাসা।”
“সাত্ত্বিক, তুই আর বিভাবন এই সমাজ থেকে পাওয়া একাকীত্বের নাম দিস প্রাপ্ত বন্ধুত্ব।”
“পাপাই তোমরা তোমাদের না পাওয়া কাঙ্ক্ষিত চাওয়ার নাম দুরাশা।”
“তাহলে আজ আমি আর বিভাবন একসাথে নাম দিলাম কৃষ্ণচূড়া...”
এই বিশ্বব্যাপী অখণ্ডতায় তোমাকে চাই বিভাবন
আমি তোমার একাকী নিঃসঙ্গতার সঙ্গী হতে চাই বিভাবন
আমার ঘুম না আসা চাউনিতে আমি আমাদের দুজনকে চাই
আমি এই প্রজাপতির ডানা মেলে ওঠা রঙিন স্বপ্নে তোমাকে চাই বিভাবন
সকালবেলার প্রথম ওঠে সুর্যের ছটাতে তোমাকে চাই বিভাবন
আমাদের সব দুঃখ বেদনাতে আমাদের দুইজনকে চাই
আমি আমাদের দুইজনকে চাই আদি থেকে অন্ত, সীমা থেকে অসীমে...
সমাপ্ত
