পুজোর সাজে শাড়ির ভাঁজে
পুজোর সাজে শাড়ির ভাঁজে


সবই তো হল, কিন্তু তনয়া কাল আসবে কিনা বা এলেই কখন আসবে কিছুই তো জানা হল না। ধুর ছাই, ভাল্লাগে না। সারা সন্ধ্যায় বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে ঘুরেফিরে আগামীকালের প্ল্যান করেও সৃঞ্জয়ের চোখে আজ রাত ঘুম নেই। বড্ড ভালোবাসে যে সে মেয়েটাকে; হ্যাঁ বলতে পারে না সেটা আলাদা বিষয়। প্রতিবারই ভাবে এবার ঠিক বলবই কিন্তু কোনো বছর আর সেটা হয়ে ওঠে না। বলব আর বলতে না পারার মাঝেই দুজনের জীবনেরই ছাব্বিশটা বছর কেটে গেছে। কো-এড স্কুলে পড়ার সুবাদে ছোটো থেকেই তারা সুপরিচিত, মারপিট-খুনসুটি-একে অপরের সমস্যার সমাধান খোঁজা সবেতেই তারা সুপারহিট। বয়স হয়েছে, তারা বোঝে একে অপরের গুরুত্বটা কিন্তু তবুও আর কি...বুক ফাটে তবু মুখ আর ফোটে না। কাল আরেকটা অষ্টমী, কাল আরেকটা সুযোগ, কাল আরেকবার তনয়ার হলুদ শাড়ির ভাঁজে সৃঞ্জয়ের পাঞ্জাবীর ছুঁয়ে যাওয়ার কথা--কাল আরেকবার মায়ের কাছে নিজেদের মনের কথা খামে মুড়ে জমা দেওয়ার দিন। এবারও কি মা শুনবেন না কথা? হাবিজাবি ভাবতে ভাবতেই দুচোখের পাতা নিজের থেকেই লেগে গেছে সৃঞ্জয়ের অজান্তেই।
এই যা, আটটা বেজে গেল। কোনোক্রমে ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে স্নান সেরে পাঞ্জাবীটা পরে বেরোতে যাবে ঠিক তখনই ঠাম্মার ডাক, "দাদুভাই শোন না, আমার শাড়ির কুঁচিটা একটু ধরে দে না রে, তোর দাদুর তো বয়স হয়েছে, চোখে কম দেখে-কানে কম শোনে, তুই একটু ধরে দে না বাবা।"
"ধুর, কিসব বলছ তুমি, চোখের তো গতমাসে ছানি অপারেশন করিয়ে নিয়েছি, এখন আমি আমার বৌকে একদম সুন্দর দেখতে পায়। আর তোমাকেও বলিহারি যায়, কাকে কি বলছ, যে ছেলে আজ পর্যন্ত একবারও নিজের মনের কথা জানাতে পারল না সে ধরবে শাড়ির কুঁচি! ওর# বয়সে আমি তোমাকে তুলে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করেছিলাম গো গিন্নী। পরে অবশ্য তোমার বাবা আমাকে মেয়েধরা ভেবেছিল, সেটা আলাদা। এই হতচ্ছাড়া এদিকে শুনে যা, আজ তোর শেষ সুযোগ। যদি আমাদের তনয়া নাতবৌমাকে না নিয়ে ঘর ঢুকিস তো তোমার কপালে দুঃখ আছে। তোমার কি মনে হয় দাদুভাই, আমি তোমার ঠাম্মা কিছুই বুঝি না-কিছুই জানি না। আর শোনো মেয়েদের সামনে অমনি হাঁটু কাঁপলে কিছুই হবে না। পুজোর প্রেম কথাটা জানো তো দাদুভাই, তোমাকেও অমনি একটা ধামাকা করতেই হবে এবারে। যাও এবার প্যান্ডেলে তাড়াতাড়ি, তনয়া মা তো এসে যাবে। আমি তোমার ঠাম্মাকে নিয়ে একটু পরেই যাচ্ছি।"
"দাদু দিদা তোমরাও অঞ্জলি দেবে?"
"হ্যাঁ দেব তো, বিয়ের পর থেকে প্রতিবছর এভাবেই তো আমাদের প্রতিটা পুজো কাটে দাদুভাই, সাতান্নটা পুজো তো কাটিয়ে দিলাম, আর যে কটাদিন থাকি এভাবেই কেটে যাক। আচ্ছা আর দেরি করো না, জলদি যাও, শুভশ্র শীঘ্রম।"
তনয়া সহ বাকি বন্ধুরা সবাই আগেই পৌঁছে গেছে, এবার অঞ্জলি নিবেদনের সময়। তনয়া আসার থেকে অনেকবার খুঁজেছে সৃঞ্জয়কে, দেখা মেলেনি। একটু দুঃখ, একটু রাগ আর অনেকটা অভিমান নিয়ে অঞ্জলি দেওয়ার সারিতে দাঁড়িয়ে। হঠাৎই বাচ্চাদের দৌড়ের মাঝে একটা ছেলে তনয়ার শাড়িতে পা দিয়ে চলে যায়, "ইশ্ দেখে খেলতে পারিস না তোরা, ওদিকে গিয়ে খেল না। দিলি তো শাড়িটা ঘেঁটে পুরো।"
"আহা! বাচ্চাদের বকছিস কেন আবার। গেছে তো শুধু শাড়ির কুঁচিটাই, দাঁড়া আমি ঠিক করে দিচ্ছি। এমনিও একটু আগেই আমাকে দাদু কুঁচি ধরার প্রশিক্ষণ দিয়ে দিয়েছেন" ― এইবলেই সৃঞ্জয় বসে বসে তনয়ার কুঁচি ঠিক করতে শুরু করল। একটু ইতস্তত বোধ করেই তনয়া বলল, "সৃঞ্জয় অনেকেই দেখছে এখানে কিন্তু।"
"দেখুক না, আগামী সবদিনের জন্য যখন এই দায়িত্বটা আমারই হবে তাহলে তার শুরুটা যদি মায়ের মন্ডপ থেকেই হয় মন্দ কি, তাই না?" মুহূর্তের নীরবতা কাটিয়ে দুজনেই পাশাপাশি দাঁড়িয়ে অঞ্জলি দিয়ে বেরিয়ে এলো হাত ধরে। কথাতেই আছে না, action speaks louder than words, আর প্রেম হলে তো কথাই নেই। "একটা কথা আছে, আমরা তুই বলব না তুমি?"
" খুব কঠিন প্রশ্ন করলি রে, দেখে ভেবেচিন্তে বলব। আচ্ছা শোন আজ তোকে একটা জায়গায় নিয়ে যাব, যাবি? কোথায় রে? তোর শ্বশুরবাড়ি, আইমিন আমাদের বাড়ি। এর আগে তো কতবার গেছিস কে জানে, তবে আজ দাদু আর ঠাম্মার কাছে নিয়ে যাব।" চল তবে, এইবলে যেই দুজনে বেরোতে যাবে অমনি সৃঞ্জয়ের পিঠ চাপড়ে দাদু বললেন, "সাবাশ, এতদিনে কাজের মতন একটা কাজ করলি দাদুভাই।"
দাদু আর ঠাম্মাকে প্রণাম করেই শুরু হল তনয়া আর সৃঞ্জয়ের নতুন পথচলা, হ্যাঁ সই করাটা বাকি আছে এখনও।