পুজোর জলসা
পুজোর জলসা
আমি কোলকাতায় বড় হয়েছি। ছোটবেলা থেকেই আমার কাছে পুজো মানে নতুন জামাকাপড়, সাজগোজ, ভালো খাওয়াদাওয়া , ঠাকুর দেখা , পূজাবার্ষিকী , পুজোর গান, টি ভি তে পুজোর অনুষ্ঠান আরও কত কি। পুজোর সময় সারা কোলকাতা সেজে ওঠে। যেন এক খুশির প্লাবন যাতে সারা শহরবাসী ভেসে যায়। পুজো বললেই আমার সারা শরীরে একটা শিহরন খেলে যায়। তাই যখন কাজের সূত্রে আমরা মানে আমি, শান্তনু ও আমাদের ছেলে সোহম, নাগপুরে শিফট করলাম, তখন মন খুব খারাপ হয়ে গেলো।
প্রথম বছর পুজোর সময় খোঁজ খবর নিয়ে একটা দুটো পূজা প্যান্ডেলে গেলাম ঠাকুর দেখতে। এখানকার পুজো গুলো যেখানে হয় তার আশপাশটা একটু সাজানো হয়। প্যান্ডেলের ভিতরে গেলে পুজো পুজো মনে হয় কিন্তু বাইরে বেরোলেই ব্যাস, আর কিছুই বোঝা যায় না। কোলকাতার পুজোকে খুব মিস করছিলাম।
তারপর থাকতে থাকতে যেমন হয় , আমাদেরও লোকেদের সঙ্গে চেনা জানা হতে লাগলো। কয়েক মাস পরে আমরা কয়েকটা পরিবার খুব ভালো বন্ধু হয়ে গেলাম। বিপাশা-অনুপম, আরুণা-অনিন্দ্য, অরিজিত-কল্পনা আর আমরা। আমরা মাঝে মাঝেই দেখা করতাম। সেই রকমই একটা গেটটুগেদারে ঠিক হল যে আমরা পুজোতে একটা অনুষ্ঠান করবো। কারণ পুজোতে এখানে বিশেষ কিছু করার থাকে না। যেমন ভাবা তেমনি কাজ। পুজো কমিটির সাথে কথা বলা হল, তারা সানন্দে রাজি হয়ে গেলো। সপ্তমীর দিন সন্ধ্যায় আমাদের এক ঘণ্টা সময় দেওয়া হল। আমরা ভীষণ খুশি। আমাদের যেন কলেজের দিনগুলো ফেরত চলে এসেছে।
আরুণাদের বাড়িতে মিটিং হলো এবং তাতে ঠিক হল যে গল্প আর গান মিলিয়ে একটা অনুষ্ঠান করা হবে। আমাদের বন্ধুদের মধ্যে অরিজিৎ , শান্তনু , বিপাশা আর অরুণা ভালো গান করে। ওরা সোলো আর ডুয়েট গাইবে। আমি আর অনিন্দ্য anchoring করবো। অনুপম ও কল্পনা আমাদের সবচেয়ে বড় সমালোচক। ঠিক হল শুধুমাত্র একটার পর একটা গান না গেয়ে আমরা গানের মাঝে মাঝে একটা গল্প বলবো। অনিন্দ্য খুব ভালো লেখে, তাই তার ওপর দায়িত্ব দেওয়া হল একটা ভাষ্য লেখার। সেও প্রবল উৎসাহে একটা দারুণ রোম্যান্টিক নাটক লিখে ফেলল, “এখন রক্ত করবী” । ঠিক হল অনিন্দ্য হবে রঞ্জন আর আমি হব নন্দিনী। গানের লিস্ট তৈরি হল, কে কোনটা এবং কখন গাইবে তা ঠিক হল। কিন্তু মুশকিল হল রিহার্সাল করা নিয়ে। সবাই ব্যস্ত, সবার ছেলে মেয়েদেরই ঠিক পুজোর পর থেকে পরীক্ষা শুরু, তাই তাদের বাড়িতে ফেলে রেখে রোজ সন্ধ্যেবেলায় মহড়া দেওয়া সম্ভব নয়। তাই ঠিক হল যে যার মতো নিজের নিজের বাড়ী বসে রিহার্সাল করবে আর শনিবার বা রবিবার একসাথে বসে মহড়া হবে।
প্রবল উৎসাহে আমাদের রিহার্সাল চলতে লাগলো, এক এক সপ্তাহে এক এক জনের বাড়ী। যেদিন যার বাড়ী রিহার্সাল সেদিন তার বাড়ীতে সাজো সাজো রব। চা, জলখাবার, হাসি, গল্প আর রিহার্সাল। ঠিক হল বিপাশা, অরিজিৎএর সাথে আর অরুণা, শান্তনুর সঙ্গে ডুয়েট গাইবে। রিহার্সালের সময় প্রথমে আমি-অনিন্দ্য, শান্তনু-অরুণা আর বিপাশা-অরিজিৎ আলাদা আলাদা প্র্যাকটিস করতাম, তারপর শেষে একসাথে প্র্যাকটিস হত।
অরিজিৎ আমাদের থেকে বয়সে ছোট। ও বিপাশাকে বৌদি বলে। অরিজিৎ একটি MNC তে খুব উঁচু পোস্টএ কাজ করে। বেশির ভাগ দিনই ও প্র্যাকটিস করে আসতো না আর বিপাশা বকাবকি করলেই বলত ,” উফ বৌদি অফিসে কাজের চাপ এতো বেশি যে প্র্যাকটিস করার সময়ই পাইনি”। তাই বিপাশার সঙ্গে বসলে তবেই ওর প্র্যাকটিস হতো। বিপাশাও তার এই ছোট দেওরটিকে খুব মন দিয়ে গান শেখাতো আর ভুলভাল করলে গানের স্ক্রিপ্ট এর কাগজটা পাকিয়ে কয়েক ঘা লাগিয়ে দিত। একদিন বিপাশা হারমোনিয়াম বাজিয়ে অরিজিৎকে শেখাচ্ছে “প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে”, অরিজিৎ তার সহজ উদাত্ত গলায় গানটি বেশ তুলে নিচ্ছে। সবই ঠিকঠাক চলছিল, হঠাৎ বিপাশা “ইইইইইইইই কি সর্বনাশ , তুই কি গাইছিস? “ বলে চেঁচিয়ে উঠলো। আমরা সবাই ছুটে গেলাম। গিয়ে দেখি বিপাশা গানের স্ক্রিপ্ট এর কাগজটা পাকিয়ে অরিজিৎকে এই মারে তো সেই মারে।
“কি হয়েছে?”
“ও কি গাইছে জানিস? সুরে সুরে বাঁশী পূরে মোরে আরও আরও আরও দাও টান।“
অরিজিৎর জন্ম নাগপুরে, তার বাংলার জ্ঞান অতি সামান্য। অরিজিৎ বুঝতেই পারলো না যে সে কি ভুল গাইছে, ” ঠিকই তো গাইলাম, t-a-a-n এর উচ্চারণ তো টান ই হয়।“ (অরিজিৎ বাংলা পড়তে পারে না বলে ওর স্ত্রী কল্পনা গানগুলোকে ইংরাজি অক্ষরে লিখে দিয়েছিল।)
“ ভালো কথা, আর মানেটা কি হয়? তুমি বাঁশির মধ্যে সুর পুরে টানছো? সুর কি গ্যাঁজা?” রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী বিপাশা লাফিয়ে উঠলো।
হঠাৎ একটা ধপ করে আওয়াজ শুনে আমরা পিছন ফিরে দেখি অরুণা মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে হাসছে। আমরা সবাই হাসিতে ফেটে পড়লাম।
দেখতে দেখতে পুজো এসে গেলো। ষষ্ঠীর দিন সকালে পুজো দিয়েই আমরা সবাই বাড়ী চলে গেলাম। বিকালে যন্ত্রানুসঙ্গের সাথে রিহার্সাল অরুণার বাড়িতে। রিহার্সালের পর ঠিক হল সপ্তমীর দিন বিকালে আমরা সবাই অরুণাদের বাড়ী চলে আসবো। ওখানে ফাইনাল রিহার্সাল হবে তারপর ওখানেই আমরা সবাই সাজগোজ করবো। ছেলেরা তৈরি হয়ে আগে চলে যাবে, আর আমরা মেয়েরা পরে যাব।
ঠিক সময় মতো আমরা পৌঁছে গেলাম প্যান্ড্যালে। স্টেজ সাজানো হয়ে গেছে। আমরা যে যার জায়গায় বসে গেলাম। স্টেজের একদিকে আমি আর অনিন্দ্য, আর অন্য দিকে উইংসের পিছনে বাকিরা। আমি আর অনিন্দ্য পুরো সময়টা স্টেজের ওপর থাকব, আর বাকিরা তাদের গানের সময় হলে স্টেজএ এসে গান গেয়ে আবার উইংসের পিছনে চলে যাবে। আমাদের অনুষ্ঠান “এখন রক্ত করবী” শুরু হল। নাটকের নন্দিনী ও রঞ্জনের প্রথম যৌবনে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় আর অনেক বছর বাদে আবার দেখা হয়। গানের সঙ্গে নাটক বেশ জমে উঠেছে। নন্দিনী আর রঞ্জনের মনে পুরোনো প্রেম জেগে উঠছে। আমার একটা লম্বা সোলো পার্ট ছিল, আমি গদগদ স্বরে ডায়লগ পড়ছি, হঠাৎ ঝপাৎ করে একটা আওয়াজ হল আর অরুণা বিপাশা ও অরিজিৎ চাপাস্বরে বলে উঠলো, “ এইরে! শান্তনু পড়ে গেছে স্টেজ থেকে”।
ওদিকের উইংসএ একটা হুটোপাটির আওয়াজ পাওয়া গেলো। আমার মাথার থেকে পা অবধি একটা ঠাণ্ডা স্রোত নেমে গেলো।
অনিন্দ্য আমায় ইশারা করে বলল, “তুই পড় আমি দেখছি।“
আমার তখন দারুণ কান্না পাচ্ছে, শান্তনু যদি সত্যি পড়ে গিয়ে থাকে? কান্না চেপে কোনোরকমে আমার সংলাপটা পড়ে গেলাম। অনিন্দ্য ফিরে এসে বলল, “সব ঠিক আছে।“
শুনে আমার ধড়ে প্রাণ এলো। অনুষ্ঠান শেষ হলে জানতে পারলাম শান্তনুর তখন গান ছিলনা তাই ও সিগারেট খেতে স্টেজ থেকে নিচে নেমেছিল, কেউ সেটা খেয়াল করে নি। কোন ভাবে খালি চেয়ারটা স্টেজ থেকে নিচে পড়ে গিয়েছিল।
স্টেজ থেকে বাইরে আসতেই দর্শকরা আমাদের ঘিরে ধরল, “কি ভালো প্রোগ্রাম হয়েছে! গানগুলোতো ভালো হয়েইছে, নাটকটাও অপূর্ব হয়েছে। বিশেষ করে অপর্ণা তুমি যখন কান্না ভেজা গলায় সংলাপ গুলো বলছিলে, উফ! আমাদের মন ছুঁয়ে গেছে। এতদিন তুমি কোথায় ছিলে?”
শান্তনু আমার কানের কাছে চুপি চুপি বলেছিল,” ভাগ্যিস আমি সিগারেট খেতে গিয়েছিলাম!”
রে মোরে আরও আরও আরও দাও