Debdutta Banerjee

Drama Tragedy

1.9  

Debdutta Banerjee

Drama Tragedy

পতিত পুরুষ

পতিত পুরুষ

6 mins
18.4K


শেষ মুহূর্তে একটু দৌড়ে এসে শেষ কামরাটায় উঠে পরল সৃজন। এই ট্রেনটা মিস করলে পরের ট্রেন আবার একঘণ্টা পর; অত রাতে ষ্টেশন থেকে বাড়ি যেতে কোনো অটো, টোটো বা রিক্সা পাওয়া যায় না, প্রায় এক মাইল পথ হাটতে হয়।

পনেরো কুড়ি দিন পর পর সৃজন আজকাল বাড়ি যায়। দমদমের কাছে একটা ফ্ল্যাট নিয়েছে গত কয়েক মাস আগে। তার আগে একটা মেসে থাকতো। বাড়িতে মা আর বোন রয়েছে, সেই টানেই মাঝে মাঝে যেতে হয়।

রাতের কামরা বেশ ফাঁকা, দু চারজন ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। জানালার ধারের একটা ফাঁকা সিটে আরাম করে বসে জোড়ে নিশ্বাস নিলো সে। ঠিক তক্ষুনি উল্টোদিকের সিটে বসা মেয়েটাকে দেখতে পেলো। এর আগেও কয়েক দিন দেখেছে মেয়েটাকে, মুখটা খুব চেনা । এতো রাতের ট্রেনে একা যাতায়াত করে, বেশ সাহস আছে। ওর সাথে শেওরাফুলিতেই নেমেছিল আগের দিন।

মেয়েটাও ওকেই দেখছিল। চোখাচোখি হতে বাইরে তাকাল। সৃজনের ছ ফিট হাইট আর জিম করা পেটানো ছিপছিপে চেহারা, মাজা গায়ের রঙ, কাটা কাটা নাক মুখ আর উজ্জ্বল বড় বড় চোখ দুটো যে কোনো মেয়ের কাছেই ঈর্ষার বস্তু। পথে সবাই ওর দিকে তাকায়।

আর চোখে মেয়েটাকে দেখে সৃজন - পাতলা ছিপছিপে চেহারা, উজ্জ্বল গায়ের রঙ, ভাসা ভাসা চোখ, এক মাথা কালো চুল, একটা ক্লান্তির ছাপ চেহারায়, একটা ছাপার চুড়িদার পরে রয়েছে। হাতে একটা সস্তার মোবাইল।

নিজের দামি ফোনটা বের করে ফেসবুকে মন দেয় সৃজন। কিন্তু বার বার মনে হয় মেয়েটা তার দিকে তাকাচ্ছে। অন্য সময় সৃজন ব্যাপারটা উপভোগ করে কিন্তু আজ কেমন একটা অস্বস্তি হচ্ছিল। শেওরাফুলিতে নেমেই মেয়েটা বড় বড় পায়ে উল্টোদিকে চলে গেলো।

নিজের পুরানো দিনগুলোর কথা মনে পরে ওকে দেখে। বাবার জুটমিলের কাজটা যখন চলে গেলো সৃজন তখন কলেজের দ্বিতীয় বর্ষ। শ্রেয়া মাধ্যমিক দিয়েছে আর সৃজা ক্লাস নাইনে পড়ত সে সময়। দাঁতে দাঁত চেপে দুটো বছর সৃজনকে পড়িয়েছিল বাবা। কিন্তু চাকরীর বাজারে বিএসসি পাশ সৃজনের তেমন কোনো দাম নেই সেটা সৃজন ভালোই বুঝেছিল। কয়েকটা টিউশনি করে আর ক‍্যাটারিং এর মাধব-দার সাথে টুকটাক পরিবেশনের কাজ করে টেনেটুনে চলছিল। বাবা অসুস্থ হওয়ায় জমানো টাকা গুলো শেষ হয়ে গেলো কয়েক দিনেই।

না, বাবা আর বাড়ি ফেরেনি। চাকরীর খোঁজে চটি ছিঁড়ে যাচ্ছে যখন ঠিক তক্ষুনি মেখলা এসে জানিয়েছিল তার বিয়ে ঠিক হতে চলেছে। সৃজন যদি পারে একবার যেন তার কথা ভাবে। কিন্তু নিজের অনিশ্চিত জীবন আর মাথায় দুবোনের দায়িত্ব নিয়ে সৃজন আর নিজের ভালবাসাকে বেঁধে রাখতে পারে নি। ফাল্গুনের এক সন্ধ্যায় ইঞ্জিনিয়ার পাত্রের হাত ধরে মেখলা পারি দিয়েছিল ভূপালে। বেকার সৃজন সেদিন কল-সেন্টারের ইন্টার্ভিউটা দিতে গেছিল ধার করা টাই পরে।

চাকরীটা হলেও টিকিয়ে রাখতে পারেনি সৃজন। মধ্যবিত্ত পরিবারের মানসিকতা ঐ খোলামেলা জীবনে খাপ খাইয়ে নিতে পারেনি। জিয়া ম‍্যাডামের কথাই ছিল ওদের কোম্পানির শেষ কথা। আর উন্নতির পথটা ছিল ঐ মাঝবয়সী বিকৃতকাম মহিলার বেডরুম দিয়ে। এর পর আরও দু একটা ছোট খাটো কাজ করে একটা বছর পার করেছিল সৃজন। যে কোনো একটা কাজ খুব দরকার ছিল ওর। প্রয়োজনে চুরি করতেও হয়তো রাজি ছিল। ঠিক সেই সময় পরিচয় হয় অনিন্দ্যর সাথে। একটু কাউনসিলিং আর পারসোনালিটি গ্ৰুমিং এর জন‍্য কয়েকটা সিটিং, তারপর আর পিছনে তাকাতে হয় নি কখনো। অনিন্দ‍্যদাই কাজটা দিয়েছিল। কয়েক বছরের মধ্যে শ্রেয়ার বিয়ে দিয়েছিল। ঘরের ছাদটাও ঢেলে দোতলা করে নিচটা ভাড়া দিয়েছিল। এবার সৃজার বিয়ে প্রায় ঠিক। এখন মা আর বোন পরেছে তাকে নিয়ে। কিন্তু বিয়ের কথা উঠলেই এরিয়ে যায় সে।

পরদিন সন্ধ্যায় বারান্দায় বসে একটা বই পড়ছিল সৃজন। সৃজা এসে চুপ করে দাঁড়িয়েছিল বারান্দায়। সৃজন তাকাতেই সে বলে - "মেখলা-দিকে এখনো ভুলিসনি নারে দাদা ? তাই তুই বিয়ে করতে চাস না!"

মেখলার কথা মনে করে রাখার মতো সময় কোথায় সৃজনের। বহুদিন আগেই ঐ স্মৃতির ঘরে তালা পড়ে গেছে। নামটা শুনেও আর কোনো ঢেউ ওঠে না হৃদয় সাগরে। মুখে বলে - "না রে... এখন ফ্ল্যাটের লোণ, সামনে তোর বিয়ে ....."

-"আমার বান্ধবী মৌ কে তো তুই আগে দেখেছিস দাদা। খুব গরীব ওরা। মা আর দুই বোনের সংসার। একটা ছোট কাজ করে কলকাতায়। মায়ের ওকে খুব পছন্দ ....."

সৃজন বলে - "আমি আপাতত বিয়ে করছি না। প্লিজ .... এমন মেয়ে এখন ঘরে ঘরে। কজন কে আমি উদ্ধার করবো। ওর ঠিক কিছু জুটে যাবে, হয়তো আমার চেয়ে ভালোই জুটবে," এভাবেই আলোচনার ইতি টেনেছিল সেদিন।

আসলে বিয়ের কথা সেভাবে ভাবে না সৃজন। মাথায় তখনো অনেক দায়িত্ব। এসব বিলাসিতার সময় কোথায়? কাজের জন‍্য সবসময় তাকে ফিটফাট থাকতে হয়। দামী জামা জুতো, কলকাতায় ফ্ল্যাট এসব শুনে সবাই ভাবে সে বিশাল কিছু করে। পাড়ার বেকার ছেলে গুলো দেখলেই দাদা বলে ডেকে খাতির করতে চায়।

পলাশ তার সাথেই পড়ত। চাকরী না পেয়ে এখন লোকাল কেবল অপারেটারের কাছে কাজ করে। সে বলেছিল একটা চাকরী খুঁজে দিতে। পার্ক হোটেলে একবার এক ক্লায়েন্ট মিট করতে গিয়ে দেখা হয়েছিল অলকের সাথে। ওখানে প্রাইভেট সিকিউরিটির কাজ করছিল। সে ও বলেছিল একটা ভালো কাজের খোঁজ দিতে। কিন্তু এদের থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে চলতে শিখেছে আজকাল। অনিন্দ‍্যদা বলে আবেগের দাম নেই এ জগতে।

প্রায় বছর খানেক কেটে গেল এভাবেই, দু বোনের বিয়ে ভালো ঘরেই হয়েছে। আপাতত বোনেরা এসেছে ভাইফোঁটায় । তাই বাড়ি আসছিল, আবার সেই রাতের ট্রেন। কালীপূজার জন্যই ভিড়টা ছিল। তবুও একটা সিট পেয়েছিল সৃজন। হঠাৎ চোখ চলে যায় মেয়েটার দিকে। এখন অনেক বদলে গেছে। চেহারায় উগ্ৰ সাজগোজের ছোঁওয়া। চুল স্ট্রেইটনিং করেছে, কোল্ড শোল্ডার আর টাইট কেপ্রি পরনে। চোখের দৃষ্টিও বদলে গেছে। দরজার ধারে দাঁড়িয়ে আছে। এবার চোখাচোখি হতে চোখ সরাল না। ঠোঁটের কোনে একটা তাচ্ছিল্যের হাসি। হাতে দামী ফোন।

শেওরাফুলিতে নামার সময় ভিড়ের সুযোগে হাই-হিল দিয়ে সৃজনের পায়ে আলতো একটা খোঁচা দিল মনে হল।

বাড়ি এসে প্রথম দিনটা ভাইফোঁটার আনন্দে কাটলো ভালোই। কিন্তু এবারে মায়ের সাথে দুই বোন উঠে পড়ে লেগেছে দাদার বিয়ের জন্য। কয়েকটা ফটোও এনেছে জোগাড় করে। দুই বোন সেই সব মেয়েদের গুণগানে ব্যস্ত।

শেষে সৃজন হাসতে হাসতে বলেই ফেলে - "কেন রে, তোর ঐ বান্ধবীর কি বিয়ে হয়ে গেছে ? মৌ না কি যেন নাম!"

তিনজনেই চুপ করে যায় হঠাৎ, মা উঠে বাইরে চলে যায়। সৃজা চুপ করে ফটো গুলো গুছাতে থাকে। শ্রেয়া একটু অবাক হয়।

সৃজন আপাতত রেহাই পেয়ে বারান্দায় এসে বসে। ঠাণ্ডা উত্তরে হাওয়া ছেড়েছে। দূরে কোথাও মা কালী বিসর্জনের পথে চলেছে। ডাকের আওয়াজ আর বাতাসে বাজির গন্ধ। আকাশে মাঝে মাঝেই আতসবাজির ঝলকানি। মনটা কেমন উদাস হয়ে যায়।

-"দাদা, তুই কি সত্যি বিয়ে করবি না?" সৃজা এসে দাঁড়ায় বারান্দায়।

সৃজন জানে না কি উত্তর দেবে। চুপ করে আকাশে আতসবাজির আলপনা দেখে।

-"মা একসময় চেয়েছিল মৌ এর সাথে তোর বিয়ে দিতে। মেয়েটা অনেক কষ্টে কলকাতায় একটা প্রাইভেটে চাকরী করে সংসারটা টানছিল। মা, ছোট বোন ..... চাকরীটা চলে যায় হঠাৎ। পেটের জ্বালায় মেয়েটা এখন নাকি বদলে গেছে। সবাই জানে ও নোংরা কাজ করে কলকাতায়। এভাবেই অসুস্থ মা আর বোনকে টানছে। বোনটা এবার ইলেভেনে উঠলো। ওরা এখন একঘরে হয়ে গেছে রে দাদা। কেউ যায় না ওদের বাড়ি।"

সৃজনের কানে কে যেন গরম সিসা ঢেলে দিয়েছে। "নোংরা কাজ" - মাথাটা কেমন ঘুরে ওঠে সৃজনের। চোখের সামনে সব ঝাপসা হয়ে আসে। ট্রেনের ঐ মেয়েটার মুখ ভেসে ওঠে মানস-পটে। খুব চেনা লাগছিল মেয়েটাকে।

সৃজাকে বলে - "মৌ এর ফটো আছে তোদের কাছে?"

-"ও বোধহয় বিয়ে করবে না আর, মা আর ওকে ....... ।"

-"নোংরা বলে কিছু হয় না রে। বাবা যে অবস্থায় চলে গেছিল আমি কাজটা না পেলে তোদের কি হতো বল তো ? পাঁঁকেই পদ্ম ফোটে, আর সেই পদ্ম মায়ের পূজায় লাগে।"

সৃজা অবাক হয়ে দাদাকে দেখে। কেমন অচেনা লাগে চেনা দাদাকে। বলে - "সব জেনেও ...."

-"আমি একবার কথা বলতে চাই শুধু। একদিন তোরাও তাই চেয়েছিলি। বিয়ের কথা পড়ে ভাবা যাবে না হয়।"

অনিন্দ্যদার কথা গুলো মনে পরে। মা আর বোনেরা জানে সে একটা কল সেন্টারে কাজ করে। সত্যিটা যে এ সমাজ মেনে নেবে না। ও যে ওর শরীরটা বিক্রি করে সংসার চালায় সেটা জানলে সমাজ ওকেও নোংরা বলবে। হ্যাঁ, ও একজন জিগোলো। চাকরী বাঁচাতে বসের শয‍্যা সঙ্গী হতে পারেনি একদিন। আজ একেকটা কেসে ওর হাজার হাজার টাকা ইনকাম। এই সুন্দর শরীরটার চাহিদা মেয়ে মহলে প্রচুর। কল সেন্টারের আড়ালে অনিন্দ‍্যদা এই ব‍্যবসাটাই চালায়। ওর সুন্দর শরীরটা যে একটা কমোডিটি এটা অনিন্দ‍্যদাই ওকে বুঝিয়েছিল। মডেলিং এর মতো এটাকেও পেশা হিসাবে ভাবতে শিখিয়েছিল। মেয়ে কল-গার্লদের থেকে জিগোলোদের রেট এখনো অনেক বেশি। রাস্তায় দাঁড়াতে হয় না ওদের। এসি গাড়ি, এসি হোটেল অথবা বড়লোক ক্লায়েন্টের বাড়িতেই সার্ভিস দিতে হয়। সমাজের উচ্চস্তরের মহিলারাই ওর কাষ্টমার। অথচ পেটের টানে একই কাজ করছে যে মেয়েটা সমাজ তাকে নোংরা বলে একঘরে করে রেখেছে।

সামনের রাস্তায় তখন মা কালীর বিশাল রনংদেহি মূর্তি নিয়ে বিসর্জনের পথে চলেছে উন্মত্ত জনতার স্রোত। এতো আলো এতো আয়োজন সব শেষে আজ বিসর্জনের পালা। সেই কোলাহলে ওদের না বলা কথা গুলো চাপা পরে যায়।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama