প্রতিশোধ
প্রতিশোধ
একটা অসহায় মেয়ের গল্প বলি যে স্বার্থে অন্ধ কিছু মানুষের লোভের শিকার হয়ে নিজের জীবনে চরম সর্বনাশের কারণ হয়ে ছিল। ওর নামটি এখানে ইচ্ছে করেই উল্লেখ করছি না, ধরে নিন ওর নাম ছিল অপরিচিতা। আমরা বর্তমানে যুগে যতটাই আধুনিক উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে থাকি না কেন, এখনও আমরা আমাদের ভিতরকার পাশবিক বৃত্তিগুলোকে মুছে ফেলতে বা ভুলে যেতে পারিনি। আমাদের এই কঠিন পৃথিবীতে সোজা সরল মানুষকে একজন বোকা মানুষ হিসাবেই চিহ্নিত করা হয়ে থাকে - হয়ত কেউ মুখের সামনে বলে না কিন্তু মানুষটির পিছনে তাকে সবাই তাই বলে।
অপরিচিতা জন্মসূত্রে প্রান্তিক মফস্বলের অধিবাসী , গ্রামের মত শান্ত, সুনিবিড় স্নেহ ভালবাসার আশ্রয়ে যেভাবে বড় হয়ে উঠছে তার সঙ্গে কলকাতার নিকটবর্তী হওয়ায় আবার তার শহুরে আবহাওয়ার সাথেও থাকে অপরিচিতার পরিচিতি। লেখা পড়ার সাথে সাথে সেও গান বাজনা, অঙ্কন ইত্যাদি কলার সাথে নিজেকে পরিচিত করে তোলে এবং অঞ্চলে একটি উল্লেখযোগ্য স্থান তৈরী করে নেয়।
গঙ্গা দিয়ে অনেক জল বয়ে যায়, সময় গড়িয়ে যায় - অপরিচিতাও সময়ের সাথে সাথে বড় হয়, স্কুল ফাইনাল পরীক্ষা সম্মানের সাথে উত্তীর্ণও হয়। মোটামুটি সন্তোষজনক ফল করে সে সফল হয়। তখন তার দুচোখ ভরা স্বপ্ন - সে আরো পড়াশোনা করবে এবং ভালো ফল করে পাশ করে নিজেকে কর্মজীবনে প্রতিষ্ঠিত করবে। বাবা- মার পাশে দাঁড়াবে একজন সুসন্তানের মত।সে কলকাতায় এসে খুঁজে খুঁজে দক্ষিণ কলকাতার একটি ভালো কলেজে ভর্তি হল। কলেজ শুরু হবার পরে ওর সময় কোথা দিয়ে কেটে যাচ্ছে সেটা ও বুঝতে পারে না। সকালবেলা ঘুমের থেকে উঠে ঘরের কাজে নিজের মাকে সাহায্য করে নিজেকে তৈরী করে কলেজ যাওয়া। সারাদিন কলেজে মন দিয়ে পড়াশোনা করা, নোটস নেওয়ার পরে বাড়ি ফিরে ক্লান্ত শরীরে সাংসারিক কাজের সাথে সাথে নিজের পড়াশোনাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং নৈশাহার সেরে ঘুমের দেশে হারিয়ে যাওয়া।
এভাবে চলতে চলতে কখন যে কলেজ জীবনের ৩টি বছর কেটে গেছে, অপরিচিতা নিজেও বুঝতে পারেনি। বাঁধাধরা এই জীবনের পথ ধরে একদিন গ্রাজুয়েশনের ফাইনাল পরীক্ষাও দিয়ে দিল আর পাসও করে গেল সম্মানের সঙ্গে। এবার বাড়ীর থেকে অপরিচিতাকে বিয়ের জন্য চাপ দিল, কিন্তু তার চোখ তখন জীবনে প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে মশগুল। সে বলল এখনই বিয়ে নয়, আগে নিজেকে তৈরী করি, নিজের পায়ে দাঁড়াই - তারপরে বিয়ের কথা ভাবা যাবে।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পোস্ট গ্রাডুয়েশনে ভর্তির অল্প কিছুদিনের মধ্যেই একই বিভাগের একটি ছেলের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে... ভালই কাটছিল তাদের দিনগুলি...আসলে এই বয়েসটাই এরকম, প্রকৃতির ধর্ম। দুচোখ ভরা শুধুই স্বপ্ন, পৃথিবীটা ওর কাছে একটা স্বপ্নের জগৎ। এর সাথে মনের বসন্তও মুকুলিত হল, ওদের সম্পর্কটা আরও গাঢ় হল। মেয়েটি ধীরে ধীরে নিজের চেয়েও ছেলেটিকে বেশি বিশ্বাস করতে শুরু করল ।
সেবার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছুটিতে, ছেলেটি তাকে প্রস্তাব করে যে এই বন্ধে দুজনে মন্দারমণি থেকে ঘুরে আসতে। কিন্তু সে রাজী হয়না, কারন পরিবার থেকে অনুমতি পাবে না সে। তাছাড়া এতদূর যাওয়াও সম্ভব নয়। ছেলেটি পাল্টা অভিমান করে বলে যে , আসলে অপরিচিতা তাকে বিশ্বাস করেনা তাই নানারকম বাহানা দিয়ে তার সাথে যেতে চাইছে না। শেষে বহু মান - অভিমানের পর, ছেলেটির অভিমান ভাঙ্গানোর জন্যই শেষ পর্যন্ত অপরিচিতা যেতে রাজি হয় । বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী এক বান্ধবীর বিয়েতে অংশগ্রহণ করতে যাচ্ছে বলে পরিবার থেকে অনুমতিও নেয়...
যথাসময়ে দুইজনে মন্দারমণি রওয়ানা হয়ে যায়,সেখানে ছেলেটির একটি পরিচিত হোটেল ছিল বলে রুম পেতে কোন অসুবিধা হলনা... দুই জন, এক রুমে ছিলো তিন দিন। চতুর্থ দিন ভোরে অপরিচিতা আবিষ্কার করে যে, ছেলেটা রুমে নেই। সে অনেক খোঁজাখুঁজি করেও যখন তাকে পেলোনা, তখন হোটেল ম্যানেজারের কাছে জানাতেই, ম্যানেজার তাকে জানায় যে ছেলেটা জিনিসপত্র সবকিছু নিয়ে ভোরেই চলে গেছে এদিকে হোটেলে এন্ট্রি করার সময় ছেলেটি কৌশলে মেয়েটির নামে সব কাগজপত্র করে বলেছে সব বিল শোধ করার দায়িত্ব মেয়েটির উপরেই। হোটেলের বিল দেয়ার মত টাকা পয়সাও ছিলো না মেয়েটির সাথে ...থাকার কথাও না।
ম্যানেজারকে তার অপারগতা জানিয়ে কথা দেয় যে কলকাতায় গিয়েই সব টাকা পাঠিয়ে দিবে। কিন্তু ম্যানেজার রাজী হয়না বরং তাকে পুলিশ ডাকার হুমকি দেয়। ওদিকে অপরিচিতা , এরকম একটা কাজ করে হোটেলে আটকে পড়েছে দেখে সে লজ্জায় কাউকে ফোন করে টাকা নিয়ে আসতেও বলতেও পারছে না শেষে ম্যানেজার তাকে প্রস্তাব দেয় যে, তার সব বিল শোধ হয়ে যাবে যদি সে আগামি ৩দিন হোটেলে থাকে এবং তার কথামত চলে। ম্যানেজারের এই কথা মেনে নেওয়া ছাড়া আর পথ ছিলনা মেয়েটির । তাই সে ম্যানেজারের প্রস্তাবে রাজী হতে বাধ্য হয়... সে নাম লেখায় হোটেলের দেহপসারিনীদের খাতায়।
সে বুঝতে পারে পুরো ব্যাপারটাই ম্যানেজার এবং ছেলেটার ষড়যন্ত্র।। কিন্তু তার কিছুই করার ছিলনা। টানা ৩ দিন ধরে সে হোটেলে থেকে মন্দারমণিতে ঘুরতে আসা বিভিন্ন দেশী বিদেশী খদ্দেরদেরকে দেহদান করতে বাধ্য হয়।
মন্দারমণি থেকে ফিরে আসার কয়েকমাস পরের কথা - বেশ কিছুদিন সে অসুস্থ... ডাক্তারের পরামর্শে একসময় রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে জানতে পারে যে, সে HIV তে আক্রান্ত ...অপরিচিতা ধীরে ধীরে আরও অসুস্থ হয়ে পড়ে কিন্তু যাদের জন্য তার এই পরিনতি তারা দিব্যি সুস্থ-সুন্দর ভাবে দিন কাটাতে থাকে। মনে মনে সে এটা মেনে নিতে পারে না, ঠিক করে যে, সে এর প্রতিশোধ নেবে, মেয়েটি তখন অন্য পথ আবিষ্কার করে। সে আবার যোগাযোগ করে সেই ছেলেটির সাথে। এমনভাবে অভিনয় করতে থাকে যে, ছেলেটা ধরে নেয় যে সে তাকে ক্ষমা করে দিয়েছে।আবার দুইজনের মধ্যে সম্পর্ক হয়। এবার কলকাতাতেই চলতে থাকে তাদের শারীরিক ভালোবাসা।
কিছুদিন ছেলেটার সাথে কাটানোর পর সে চলে যায় মন্দারমণির সেই হোটেলে, ম্যানেজারের সাথেও সে একই কাজ করতে থাকে ...কিছুদিন পর অপরিচিতা কলকাতায় ফিরে আসে। ঐ ছেলেটা এবং হোটেল ম্যানেজারকে একই সাথে মোবাইল থেকে দুইটি মেসেজ পাঠায় "welcome to the world of #AIDS"
...ম্যানেজারের কথা শেষ পর্যন্ত আর জানা যায়নি,তবে ছেলেটি মৃত্যুর কিছুদিন আগে অপরিচিতার পা ধরে ক্ষমা চেয়ে নিতে পেরেছিল।
মাত্র কয়েকমাস আগে মারা গিয়েছে অপরিচিতা। মৃত্যুর আগে, সে কিছু কথা একজনকে বলে যেতে পেরেছিল; পরে সে ওর অবর্তমানে এই কথাগুলি প্রকাশ করে।
