প্রশ্ন
প্রশ্ন
দেখ পায়েল, আজকে কিন্তু যেতেই হবে আমার সাথে ,কোন কথা কিন্তু শুনবো না।
পায়ের মুখ কাচুমাচু করে বলল,, বিশ্বাস কর বিশু আমার খুব ইচ্ছা ছিল, কিন্তু আজ আমার হবে না আমার ঘরে একটু কাজ আছে।
না না ও কথা শুনবো না প্রতিবারই একই কথা শুনে কান পেকে গেছে, আজকে আমার সাথে আসতেই হবে।
পায়েল মাথা নিচু করে বলল আজ একটু ক্ষমা করে দে আমায়। আজকে হবে না ।
বিশ্বজিৎ বেশি কিছু বলল না মুখ ঘুরিয়ে চুপচাপ টেবিলের আরেকটু কোনে সরে গেল।
বিশ্বজিৎ আর পায়েল ছোট থেকেই খুব ভালো বন্ধু। সেই প্রাইমারি স্কুল থেকে বিশ্বজিৎ পায়েলকে দেখে আসছে ।আর সেই প্রাইমারি স্কুল থেকেই বিশ্বজিৎ পায়েলের সঙ্গে তার জন্মদিন কাটিয়ে এসেছে। জন্মদিন পালনের জায়গাটা ঘর থেকে বেরিয়ে হোটেল রেস্টুরেন্টে হলেও সাথী বদলানি।
তাই আজও সাথী বদলানোর কথা সে ভাবতে পারেনা ।গত বছর সে জন্মদিন পালন করতে পারেননি,, করোনার জন্য তা সম্ভব হয়ে ওঠেনি কিন্তু এবারে সুযোগটা হাতছাড়া করতে চায়না।
বিশ্বজিতের শুকনো মুখ দেখে পায়েলের কষ্ট হল সে হাতের খোঁচা দিয়ে আস্তে করে বলল ,,প্লিজ রাগ করিস না,, বাবা বকবে তাই যেতে পারব না, প্লিজ একটু বোঝার চেষ্টা কর।
"সাইলেন্স প্লিজ "লাইব্রেরিয়ান চেঁচিয়ে উঠলো।
লাইব্রেরিয়ানের ঝাঁঝালো গলাটা ভালো লাগলো না বিশ্বজিৎ এর ।বই পড়ার ইচ্ছা অনেকক্ষণ চলে গেছে, আর লাইব্রেরীতে বসে থেকে লাভ নেই ভেবে টেবিল থেকে উঠে পরলো।
পায়েল মুখ শুকনো করে টেবিলের কনে বসে থাকল।
আজকের বিশ্বজিতের জন্মদিনে অনেক বন্ধুকে নিমন্ত্রণ করেছে। কলেজের পাশেই একটা রেস্টুরেন্টে আজকে পার্টি । যদিও অনেকে থাকবে কিন্তু একা পায়েলের না থাকাটা বিষয়টা তার কাছে অনেকটাই আঘাতের,,
হয়তো পায়েল এটা জানেনা, জেনেও হয়তো না জানার ভান করছে।
ঠিক এই কথাটি বিশ্বজিৎ মনে মনে ভাবতে থাকলো আর রাগে গরগর করতে থাকলো।
যথাসময়ে সন্ধ্যা নামল। বিশ্বজিৎ ঠিক করে রেখেছিল সে এবং তার বন্ধুরা কলেজ থেকে ডাইরেক্ট রেস্টুরেন্টে যাবে।
যথারীতি সেটাই হলো ।সীমা ,পরেশ আমন ,আফতাব ,আমিনা আকাশ সবাই এলো শুধু যার আসার কথা সবার আগে,, সেই এলোনা। আর ঐ একজনের না আসাতে বিশ্বজিতের সন্ধ্যে টা ফাঁকা ফাঁকা ঠেকলো। এত আনন্দ এত উচ্ছ্বাস কোনোটিই তার মনে ঠিক লো না,
পায়েল সত্যি ই এলোনা?
ফুল অনেক ধরনের আছে কিন্তু ভালবাসার ফুল একমাত্র গোলাপ, হয়তো গোলাপ কে ই ভালবাসার ফুল হিসাবে মানায়।
পার্টি চলল দু'ঘণ্টা ধরে। শেষমেষ যখন শেষ লগ্নে পৌঁছলো ।
বিশ্বজিৎ বাইকটি নিয়ে পায়েলের নতুন ঘরের দিকে রওনা দিল।
আজকে সে ঠিক করেই রেখেছে পায়েল কে জিজ্ঞেস করবে তার কি হয়েছে? লকডাউন এরপর থেকেই প্রায় এরকম ব্যবহার কেন করছে যেন সে তাকে চিনে না ।আজকে তার জন্মদিনেও সে এলো না।
কথাটা ভাবতে ভাবতেই বাইকের গতি তীব্র করতে থাকল ।পাস দিয়ে গাড়ি গুলি শো শো করে এগিয়ে যেতে থাকল।
এক মিনিট ।বিশ্বজিতে গাড়ি থামাল। সে তো জানেই না কোথায় পায়েল নতুন বাড়ি ভাড়া নিয়েছে।
হ্যাঁ শুনেছিল আচার্জী পাড়ায় কোন একটা জায়গায় কিন্তু একদম একজ্যাক্ট লোকেশন টা তো জানো না। যদিও কোন ব্যাপার না ব্যাংক ম্যানেজারের ঘর বললেই আশাকরি লোকে বলে দেবে,, এই ভেবে সে গাড়ী ঘোরাল আচার্জী পাড়ার দিকে।
কলেজে ওঠার দু'বছর হলো তার তবুও এই দু বছরে সে পায়েলের ঘর যেতে পারেনি ।সময় হয়ে উঠেনি আর পায়েল তাকে সুযোগ ও করে দেয় নি। বিশ্বজিৎ কলেজের সেরা ছাত্র অযথা সময় নষ্ট সে পছন্দ করে না ।জন্মদিন, তাই একটু আনন্দ । তাও সেটা পায়েলের সঙ্গে কিছু মুহুর্ত কাটানোর জন্য।
কিছু কিছু ব্যাপার সরাসরি হয়ে ওঠে না সেগুলো হওয়ার জন্য কিছু মাধ্যম লাগে।
এইযে একটু শুনছেন,, বলছি ব্যাঙ্ক ম্যানেজার আশুতোষ বাবুর বাড়িটা কোথায় বলতে পারবেন?
বিশ্বজিতের কথা শুনে লোকটি ভ্রু তুলল,, এবং বিচ্ছিরি বাঁশ গলায় উত্তর দিল এপাড়ায় কোন ব্যাঙ্ক ম্যানেজার আছে বলে আমি জানিনা। আর কি নাম বললে ওই নামে কোন লোককে আমি চিনিনা।
আচ্ছা এটাই আচার্জী পাড়াতো?
লোকটি তাচ্ছিল্যের স্বরে শুধু হ্যাঁ বলল।
বিশ্বজিৎ আর কিছু বলল না শুধু বাইক স্টার্ট দিয়ে এগিয়ে গেল।
কিছুদূর যেতেই একটা কাপড় দোকানের লোককে জিজ্ঞেস করল, কিন্তু সেখানেও একই উত্তর:- এখানে কোন ব্যাংক ম্যানেজার থাকে না।
বিশ্বজিৎ ভাবতে শুরু করলো কি ব্যাপার তাহলে কি সে ভুল ঠিকানা মনে করেছে।
যাইহোক যখন এসেই গেছে তখন দেখা ই যাক এই ভেবে সে আবার বাইক স্টার্ট করল।
আর একটু গিয়ে একটা ওষুধ দোকানে গিয়ে জিজ্ঞেস করল: আচ্ছা কাকু আপনি ব্যাংক ম্যানেজার আশুতোষ বাবুর ঘরটি জানেন?
নোংরা শাড়ি পরা ছিল চেহারার একটি মধ্যবয়সী মেয়ে হয়তো কিছু কেনার জন্য এসেছিল । সে মুখ ঘুরিয়ে তাকালো একবার।
বিশ্বজিৎ তাকে সেরকম গ্রাহ্য করল না। সে ওষুধ দোকানের কাছে উত্তরের প্রত্যাশী।
কিন্তু ওষুধ দোকানে লোকটা উত্তর দেওয়ার আগেই ওই মেয়েটি বলে উঠলো আরে "বিশ্বজিৎ কেমন আছিস বাবা,"?
বিশ্বজিৎ একটু অবাক হল ।এবার ভাল করে দেখল ও বাবা এটা তো পায়েলের মা ! কিন্তু এমন অবস্থা কেন হয়েছে ?সেই ফর্সা গোলগাল চেহারার মিঠাই কাকিমা , যিনি কোনদিন গাড়ি ছাড়া বেরোতে না আজ তার কি চেহারা করেছে? বিশ্বজিৎ ও তাকে প্রথম দৃষ্টিকে চিনতে পারেনি!
আরে কাকিমা কেমন আছেন আমিতো আপনাকে চিনতেই পারিনি।
ভালোই আছি বাবা ছাড়া আমি বাড়ি যাচ্ছিলাম,, চলো তুমিও তাহলে এতদিন পর কাকিমাকে মনে পড়ল।
হ্যাঁ আসুন কাকিমা চাপুন,,
মিঠাই কাকিমা আস্তে আস্তে অনেক কষ্টে বাইকে চাপল ।চাপার পরে ক্ষীণকন্ঠে বলল বাবা অনেকদিন বাইকে ছাপা হয়নি একটু ভয় ভয় করছে আস্তে চালাবে কিন্তু।
বিশ্বজিৎ কিছু বলল না শুধু বাইকটা স্টার্ট দিল।
হতেই পারে এতদিন কাকুর বড় মারুতি তে ঘুরে হয়তো কাকিমার বাইকে চলার অভ্যাস চলে গেছে।।
"আচ্ছা কাকিমা আপনারা এই পাড়ায় এলেন কেন পারাটা কেমন একটা" ছোট ছোট ঘর আর....
বিশ্বজিৎ কথাটা শেষ করতে পারলো না তার আগেই মিঠাই কাকিমা বলল "সময় খারাপ বাবা ,সময় খারাপ থাকলে কিছু করার নেই"....
কথাটা মিঠাই কাকিমা এতটাই ঠান্ডা গলায় বললেন, কথাটা শোনার সময় অবাক হলেও বিশ্বজিৎ আর কোন কথা বলল না।
থামাও বাবা এখানে এখানেই থামাও
এখানে বিশ্বজিৎ বাইকটা থামালো। কাকিমা আস্তে আস্তে বাইক থেকে নামলেন ।
কোন ঘরটা কাকিমা?
"এই তো চলো"
রাস্তার পাশেই মাটির একটি ছোট্ট বাড়ির দিকে তাকিয়ে মিঠাই কাকিমা বললেন।
বিশ্বজিৎ আকাশ থেকে পড়লো তার ঘরের কাজের লোকেরা এ রকম বাড়ি ব্যবহার করে না আর একজন ব্যাংক ম্যানেজারের এরকম বাড়ি ব্যবহার করার কি দরকার?
তবুও কাকিমার শান্ত চেহারার দিকে তাকিয়ে বিশ্বজিৎ কিছু বলল না।
পায়েল অই পায়েল দরজা খোল আমি এসেছি,,,
কিছুক্ষণ পরেই পায়ের দরজা খুলল কিন্তু বিশ্বজিৎকে দেখেই কেমন অবাক হয়ে গেল ।
"বিশ্বজিৎ তুই এখানে "?
বিশ্বজিতে তখন এখানে আসার কারণ মনে নেই ।হঠাৎ এরকম পরিস্থিতি প্রত্যক্ষ করে বিশ্বজিৎ অবাক হয়ে গেছে
এসো বাবা ঘরে এসো
বিশ্বজিৎ ঘরে ঢুকল।
দুটো রুম আরেকটি বাথরুম। দুটি পাখা। ঘরে সেরকম আসবাবপত্র নেই একটি আলমারি একটি ছোট বাক্স, একটি আল্না, আরেকটি খাট।
খাটের উপর তেলচিটে চাদর দেখেই মনে হয় অনেক দিন ধোয়া হয়নি।
ঘরে সেরকম আলো ছিলনা
কিন্তু সেই আলোয় বিশ্বজিৎ দেখতে পেল খাটে কে যেন একটা রুগ্ন মানুষ শুয়ে আছে ঠিক করে দেখে বুঝতে পারল এটাই পায়েলের বাবা।
বিশ্বজিৎকে একদৃষ্টিতে ঘরের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে মিঠাই কাকিমা বললেন "মানুষটা মদ খেয়ে খেয়ে নিজেকে শেষ করে দিল লকডাউনে। যখন ঘরে ছিল সারাদিন মদ খেত। মদের জন্য কাজ থেকে দূর হলো ঘরের সমস্ত আসবাবপত্র বিক্রি করল। কিছু মাস হল লিভার ক্যানসার ধরা পড়েছে ওর চিকিৎসায় আমার আর পায়েলের সমস্ত গয়না বিক্রি করতে হয়েছ
যদিও লাভ কিছু হয়নি ডাক্তার আশা ছেড়ে দিয়েছে ।হয়তো কিছুদিনের মধ্যেই চলে যাবেন কিন্তু আমাদের অবস্থা অনেকটাই খারাপ"।
পায়েলের দিকে তাকিয়ে বললেন "আমাদেরকে এখন পাতা সেলাই করে দিন চালাতে হয় পায়েল টাও কিছু টিউশন ধরেছে নিচের খরচা চালানোর জন্য"।
মিঠাই কথাগুলো একনাগাড়ে বলে চলল পায়েল শুধু মাথা নিচু করে থাকলো বিশ্বজিৎ যেন অবাক এরপর অবাক হয়ে গেল।
এইজন্য পায়েল তাকে এড়িয়ে চলত? তার ঘরে এত কাজ তার জন্য সে তার সঙ্গে বেশি সময় কাটাতো না? কিন্তু কেন ?কেন তোকে সব কথা বলে নি পায়েল? সে তো তাঁর এত কাছের বন্ধু তবু কেন? তার বন্ধুর এত সমস্যা আছে? তবু সে নিশ্চিন্ত ভাবে হাজার হাজার টাকা বন্ধুদেরকে খাইয়ে নষ্ট করছে। এত অনুষ্ঠান এতে উৎসবে এত টাকা ঢালছে অবাধ ভাবে টাকার অপচয় করছে আর এদিকে তার বন্ধু পাতা সেলাই করে দিন কাটতে বাধ্য ?
কেন?
হয়তো বিশ্বজিৎ ও জানে না শতাব্দী প্রাচীন এই কেন র উত্তর।।।।।
রচনা: বিশ্বজিৎ দাস