প্রিয় অসম্পূর্ণতা (পর্ব ৮)
প্রিয় অসম্পূর্ণতা (পর্ব ৮)
Chatterjee Mansion :
-----------------------------------
সুর-এর কথা ভাবতে ভাবতে নীহারবাবুর একটু ভাতঘুম মতো এসেছিল... আসলে আজকাল তার কি যেন একটা হয়েছে... সুর-এর অনুপস্থিতিতেই যেন তিনি ওর উপস্থিতিটা বেশি করে অনুভব করছেন... তিনি জানেন, তিনি সুর-এর সাথে অন্যায় করেছেন... আর শুধু সুর-এর সাথে কেন !!! যে কথাটা তিনি আজো কাউকে বলে উঠতে পারেন নি, সেটা হলো নীহারবাবু এখনো সুর-এর মা, তার প্রথমা স্ত্রী রাগিনী-কেই ভালোবাসেন... হ্যাঁ, তাই বলে রোহিনীর প্রতি কর্তব্যকে তিনি অবহেলা করেন নি কখনো... হয়তো এখন রোহিনীর প্রতি রোজকার কর্তব্যের অভ্যাসটাই একপ্রকার ভালোবাসার নাম পেয়েছে...কিন্তু রাগিনীর প্রতি করা অবিচার-এর মূল্যস্বরূপ রাগিনীর স্বেচ্ছামৃত্যুটা আজো তাকে খুঁড়ে খুঁড়ে খায়- তার নিজের স্ত্রীর প্রতি করা নিজের অবহেলাগুলোকে বারবার মনে করিয়ে দেয়... তাই তো সুর-এর চোখে চোখ রেখে আজো দাঁড়াতে পারলেন না তিনি.... অভিরী আর রোহিনী কত সময় সুরের প্রতি অন্যায় করেছে জেনেও না জানার ভান করেছেন... কিন্তু মেয়েটাকে দেখো !!! শুধু পরিবার আর নীহার বাবুর সম্মানের কথা ভেবে নীরবে, হাসিমুখে নিজের প্রাপ্য, সুখ, স্বাচ্ছন্দ্য সবকিছু বির্সজন দিয়েছে... আর সুর-এর এই নীরবতাই ওর হয়ে ধিক্কার জানিয়েছে নীহার বাবুর পিতৃসত্ত্বাকে... নিজের মেয়ের কাছে যে তিনি আজন্ম অপরাধী... কিন্তু অন্তরের টান- সেটা তিনি অস্বীকার করেন কি করে !!! সে রাগিনী হোক বা সুর...
হঠাৎই Calling Bell-এর আওয়াজে তিনি চমকে উঠে বসলেন... ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলেন বিকেল পাঁচটা বাজে... আশায় বুক বেঁধে মনে মনে বলে উঠলেন,
নীহার : সুর এলি না কি !!! এলি না কি মা-রে !!
দৌড়ে গেলেন দরজার দিকে... দরজাটা খুলে একটু হতোদ্যম হলেন...
নীহার : এ কি !!! দেবতনু তুমি !!! এই সময়ে !!! হঠাৎ !!!
দেবতনু : সুরকে খুঁজে পাওয়া গেছে... দৈবিক ওকে আমাদের বাড়ি নিয়ে গেছে... তুমি রোহিনী আর অভিরী মা-কে নিয়ে আমার সাথে এসো... তাড়াতাড়ি...
নীহার : সে না হয় যাচ্ছি... কিন্তু দৈবিক ওকে পেলো কোথায় !!! আর এখানে না এসে তোমাদের বাড়িই বা নিয়ে গেল কেন !!!
দেবতনু : ওরা সুরকে এতটাই অত্যাচার করেছে যে সুর একদম পাথরের মূর্তির মতো অচল ও নিষ্প্রাণ হয়ে আছে... দৈবিকের মাথা কাজ করে নি বোধহয়... তোমরা আর দেরী করো না... তাড়াতাড়ি চলো...
নীহার : হ্যাঁআআআআআ... চলো... যে আমার মেয়েকে, আমার প্রথম সন্তানকে এত কষ্ট দিয়েছে- তাকে আমি ছাড়ব না... ও যেখানেই থাক, আমি লোক পাঠিয়ে ওই Scoudrel-টাকে খুঁজে বার করবই... চলো... চলো...
নীহারবাবুর মাথা কাজ করে না... সুরকে যে তিনি নিজের প্রাণের অধিক ভালোবাসেন... তাই অকস্মাৎ আসা এই খবরে তিনি প্রায় দৌড়েই ঘর থেকে বেরিয়ে যান...
Roy Villa, Go Down :
---------------------------------------
নীহার : এ কি !! দেবতনু !!! তোমরা কি সুর-কে Go Down-এ রেখেছো না কি !!!! কেন !!!
দেবতনু : আরে... ঘরে এক গাদা চাকর বাকর... কতজনের মুখ বন্ধ রাখবো বলো !!! সুর-এর গায়েই তো কাদা লাগবে না !!! আর আজই তো অভিরী আর দৈবিক-এর বিয়ে... আমি তো অভিরী মা-কে কথা দিয়েছিলুম কি না, যে সুরকে খুঁজে পেলেই...
নীহার : কিন্তু আজ কিভাবে !!!
দেবতনু : (ধূর্তহাসি হেসে) Marriage Registration তা তো হতেই পারে... Social Rituals-গুলো নয় পরে হবে... প... রে....
নীহার : এইসব কথা পরে হবে... আগে সুরকে তো দেখি...
কিছুটা এগোতেই সুরকে দেখতে পেয়ে নীহার বাবু ছুটে যান সুর-এর কাছে... সুরের গালে হাত দিতে গিয়েই একটু থমকে যান... তার জন্য, শুধুমাত্র তার জন্যই আজ তার মেয়েটা এত কষ্ট পাচ্ছে... তারই পাপে... যে বাবা তার নিজের মেয়েকেই রক্ষা করতে পারে না, অথচ তার এই মেয়েটাই দূর থেকে সর্বদা ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছে... হায় রে !! আজ এই লক্ষ্মী প্রতিমার মতো মেয়েটাকেই কিনা এই Go Down-এ পাথরপ্রতিমার মতো নিষ্প্রাণ দেখতে হচ্ছে... তাকেই কিনা লোকচক্ষুর আড়ালে রাখতে হয়েছে সামাজিক লজ্জার ভয়ে... তার নিজের এই চরম ব্যর্থতার আঘাত ঢাকতে তার নিজেরই মুখ লুকানোর প্রয়োজন... সুরকে জড়িয়ে ধরলে সুর-এর চোখ একটু চঞ্চল হয়ে ওঠে, কিন্তু নীহার বাবু ক্রমাগত বলেই চলেন,
নীহার : সুর মাআআআ... কথা বল মা... এই রকম পাথরের মতো চুপ করে থাকিস না... দেখ... দেখ, আমরা সবাই এসে গেছি... মাআআআ মা রে... মা কোথায় ছিলিস তুই !!! ঠিক আছিস তো তুই !!! কারা কোথায় ধরে নিয়ে গেছিল তোকে !!! তোকে খুব কষ্ট দিয়েছে রে মা !!!
বাবার গলা আর স্পর্শ পেয়ে সুর যেন কোনো ঘোর থেকে জেগে ওঠে.... প্রথমে বুঝে উঠতে পারে না সে কোথায় !!! ধীরে ধীরে চারপাশের দৃশ্যপট ভালো করে লক্ষ্য করে বুঝতে পারে সে দৈবিক-এর কাছেই বন্দী এবং তার পরিবারও এখানেই আছে... পুরোপুরি সম্বিত ফেরার মূহুর্তেই তার মনে পড়ে উত্তীয়র কথা... উত্তীয়র প্রতি দৈবিক-এর অমানুষিক অত্যাচারের কথা... পলকেই সুর-এর মুখটা কঠিন হয়ে আসে...
সুর : (কঠিন স্বরে) নাহহহহহ...
নীহার : আমি... আমি ওই Scoundrel টাকে একবার খুঁজে পাই, তারপর দেখ আমি....
সুর : (একই রকম কঠিন স্বরে) আরো কিছু শাস্তি দেওয়া বাকি আছে বুঝি তোমাদের ওকে !!!! দৈবিক তো ওকে মেরে প্রায় আধমরা করেই দিয়েছে... এখন তুমি বাকিটুকু করলে ষোলোকলা পূর্ণ হয়, তাই না !!! (দৈবিকের দিকে কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে) তবে কি জানো তো বাবা, কিছু মানুষ আছে যাদের তুমি বাইরে থেকে যতই আঘাতে ক্ষতবিক্ষত করো, তাদের মনের জোর তোমরা এতটুকুও কমাতে পারবে না... 'আমার উত্তীয়' ঠিক সেই রকম... সহজেই তার তল পাওয়া যায় না... (তারপর মুখ নীচু করে কোমল স্বরে) আচ্ছা, বাবা জীবনে প্রথমবার তুমি বোধহয় আমাকে এইভাবে জড়িয়ে ধরলে তাই না !!!
নীহার : (থতমত হয়ে) মা... মানে !!!
জীবনে প্রথমবার মেয়ের প্রশ্নে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে নীহার চ্যাটার্জি... সেই ছোট্টবেলা থেকে উপেক্ষা করা নিজের প্রিয় সন্তানের দিকে মুখ তুলে তাকাতেই পারে না...
সুর : আসলে আমার প্রতি তোমাকে এত মনোযোগ দিতে দেখি নি কখনো... তাই তোমার এই বিচলিত মুখ, দুশ্চিন্তায় মোড়া কন্ঠস্বর, এত যত্ন আমাকে রীতিমত অবাক করছে... আসলে প্রথমবার কি না !!! যাই হোক, ছাড়ো... আচ্ছা বাবা, বলো তো ছোটবেলায় আমি দুধ খেতে না চাইলে ঠাম্মি আমাকে কেমন করে দুধ খাওয়াতো !!!
দৈবিক : (ক্রুর স্বরে) Uncle, ওই Kidnapper-টা ওর মাথা চিবিয়ে খেয়েছে !!!
সুর : (শান্ত অথচ ঋজু স্বরে) আচ্ছা দৈবিক, তুমি কেন ওকে ওইভাবে কষ্ট দিলে !!!! ও তো তোমার কোনো ক্ষতি করে নি... যা করেছে, আমার সাথে করেছে... আর সবচেয়ে বড় কথা, আমি তো তোমার ভালোবাসাও নই যে আমাকে দেওয়া কষ্টের মূল্যস্বরূপ তুমি ওকে শাস্তি দিলে !!! যদিও সেই অধিকার তোমার নেই...তুমি নিজেই তা হেলায় হারিয়েছো... তাহলে !!!! ওর অপরাধটা ঠিক কি আমাকে একটু বলবে !!!
দৈবিক : Without your Permission, ও তোকে বন্দী করেছে !!! আর আমি তুই থেকে তুমি কবে হয়ে গেলাম !!! আমি তো তোর ছোটোবেলার বন...
সুর : যেদিন থেকে আমার চেনা 'তুই'-টা বদলে অচেনা 'তুমি' হয়ে গেলে... যেদিন থেকে তুমি আমাকে ছেড়ে অভিরীর কাছে চলে গেলে শুধুমাত্র ওর নজরকাড়া সৌন্দর্যের জন্য... (একটু চুপ থেকে) সেদিন থেকে....
দৈবিক : Revenge নিচ্ছিস !!!
সুর : (শান্ত স্বরে) Clarification চাইছি !!! বলো... কেন এতো কষ্ট দিলে ওকে !!! তার চেয়ে বড় কথা কোন অধিকারে দিলে !!! বলো !!!
দৈবিক : একটা Criminal-এর জন্য তুই আমার কাছে Clarification চাইছিস...
সুর : সত্যিই কি ওকে Criminal বলা যায় !!! ও তো বিশাল কোনো অন্যায় করে নি... হ্যাঁ... ও আমাকে Kidnap করেছিল, কিন্তু ওর ওই ছোট্ট ডেরায় যে যত্ন, ভালোবাসা, আগলে... আগলে রাখার অনুভূতি আমি পেয়েছি সেটা জ্ঞানতঃ না আমি আমার পরিচিত মানুষগুলোর সান্নিধ্যে, না বাবার ওই রাজপ্রাসাদে কখনো পেয়েছি... নাহহহহ... কক্ষনো না... আমার সবকিছু পচ্ছন্দ-অপছন্দ, ভালোলাগা-মন্দলাগা সবকিছুর খবর ও রাখতো... সবথেকে বড় কথা কি জানো দৈবিক- ও তোমার মতো বাবার পয়সায় নবাবী চাল দেখায় না...He is a Promising Doctor, a Surgeon- যেটা ওকে কষ্ট করে অর্জন করতে হয়েছে... ওকে বাঁচাতে গিয়ে যখন আমি বুকে গুলিবিদ্ধ হই, ওর চোখে আমার ব্যাথায় ব্যথিত হয়ে যে জলটা এসেছিল- আমার বাবার চোখে কখনো আমার জন্য আসে নি... ও নিজে আমার মৃত্যুর সাথে লড়ে, অপারেশন করে আমাকে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছে... স্বয়ং যমরাজও আমার প্রতি ওর ভালোবাসা, আমাকে হারিয়ে ফেলার ভয়, ওর.... ওর ব্যকুলতা দেখে যমের দেয়ার থেকে ফিরে গেছে...সবথেকে বড় কথা, আমাকে Kidnap করলেও ও আমার এতটুকু অসম্মান করে নি... এতগুলো দিন ওর সুবর্ণ সুযোগ থাকা সত্ত্বেও আমায় স্পর্শ করা তো দূর, চেষ্টাটুকুও করে নি... আর তুমি !! তুমি কি করেছিলেন মনে আছে দৈবিক !!! আমি কোমায় আছি জেনেও তুমি ইউরোপ চলে গিয়েছিল, তোমার Lavish Life Enjoy করবে বলে... আমি পরে শুনেছিলাম ঠাম্মির কাছ থেকে.... অবশ্য তোমায় বলছি কেন !!! আমি কোমায় আছি জেনেও আমার... আমার নিজের বাবাই ফিরে আসে নি তার So Called Business Trip ছেড়ে... মরিশাস থেকে ফেরে নি... তাহলে সত্যিই কি ওকে অপরাধী বলা যায় !!! আর তুমি যেটা ওর সাথে করলে !!! তাকে কি বলে দৈবিক !!!
দৈবিক : (ক্রুর স্বরে) সুরররর...
দেবতনু বাবু এসে দৈবিকের কাঁধে হাত রেখে একটু আলতো চাপ দিয়ে চোখ টিপে কিছু একটা ইশারা করে যেটা সুর-এর চোখ এড়ায় না... আজ তার পাশে উত্তীয় নেই... সে তাকে কিছু একটা বলতে চেয়েছিল, সাবধান করতে চেয়েছিল কোনো একটা বিপদ থেকে... কিন্তু পারে নি... আজ সুরকে বুঝতে হবে- কি সেই বিপদ !!! অনেক হয়েছে, আর নয়... সেই ছোট্টবেলা থেকে নিজের সমস্ত দাবী, অধিকার- সবকিছু অবহেলায় ছেড়ে দিয়েছে সুর... বিনিময়ে তার ছোট ছোট ইচ্ছে-অনিচ্ছের দামটুকুও দেয় নি কেউ... ওর চুপ করে থাকাটাই সবাই ওর দুর্বলতা ভেবে নিয়েছে... ভালো মানেই যে দুর্বল নয়- সেটা বোঝানোর সময় এসেছে... সময় এসেছে নিজের প্রাপ্যটুকু বোঝে নেবার... আর এর মধ্যে যে কোনো অন্যায় নেই সেটাই এতদিন নীরবে উত্তীয় ওকে বুঝিয়েছে... শুধু সেই মূহুর্তের ও বুঝতে পারে নি, এই যা, যার দাম হয়তো আজ উত্তীয়কে দিতে হলো... কিন্তু উত্তীয় !!! ওর কি হলো !!! সুর মনে মনে নিজেকে শান্ত করে, অন্যায় দমনের প্রত্যয়ে-প্রতিজ্ঞায় দৃঢ় হয় তার মুখ...
দেবতনু: আরে, সুর মা- একটু শান্ত হও মা... আজ একটা শুভ দিন... আজ যে তোমার বোনের বিয়ে !!!
সুর : (চমকে উঠে) আজ !!! আজই !!!!
দেবতনু : আজ ওই Marriage Registry-টা হবে আর কি !!! তুমি সাক্ষী হিসেবে Sign করবে না মা !!! তুমি তো অভিরী মা-এর বড় দিদি হও... তোমার আর্শীবাদ ছাড়া ওদের দু'জনের পথ চলা কি করে শুরু হবে বলো তো !!! তাই তোমার ফিরে আসা পর্যন্ত আমরা অপেক্ষা করছিলাম...
(মনে মনে) এই তো Emotional করে দিয়েছি.... এবার আর কোনো অসুবিধা হবে না... শুধু একবার সইটা করে দিলেই কেল্লাফতে... ব্যাসসসস....
সুর-এর মনে পড়ে উত্তীয় ওকে যে কোনো Paper-এ sign বারণ করেছিল... সুরকে চুপ থাকতে দেখে দেবতনু আর দৈবিক পরস্পরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে...
দেবতনু : (কোমল স্বরে) সুর মা... দেখো অভিরী মা এতদিন শুধু তোমার জন্য অপেক্ষা করে বিয়ে পিছিয়ে দিয়েছিল...
সুর : (ততোধিক কোমল অথচ দৃঢ় স্বরে) আপনি একদম ভাববেন না আঙ্কেল... আমি না কোনোদিন আমার বোনের পথের কাঁটা হয়েছি, না কোনোদিন হবো... তবে আপনি জানেন আঙ্কেল ঘুণ পোকা কিভাবে মারতে হয় !!!
দেবতনু : অ্যাঁআআআআআ.... ঘু... ঘু... ঘুণ... কি বলছো মা তুমি !!!
সুর : (কঠিন স্বরে) যখন ঘুণ ধরে তখন প্রথমে হয়তো কিছু বোঝা যায় না... কিন্তু ঘুণ ধরে গেলে তাকে গোড়া থেকে তুলে উপড়ে ফেলতে হয়... Papers....
দেবতনু : অ্যাঁআআআআআ..... হ্যাঁআআআআআ... Papers....
দেবতনু সুর-এর হাতে পেপারগুলো দেয়... সুর মন দিয়ে পড়তে থাকে... প্রথমে একটু একটু ভ্রু-গুলো কুচকালেও মূহুর্তে মুখটা শক্ত হয়ে ওঠে সুর-এর... নিজের পরিবারের সকলকে আড়াল করে সামনে এসে দাঁড়িয়ে একটা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে কঠিন স্বরে বলে ওঠে,
সুর : আপনাদের লোভটা বাড়তে বাড়তে আজ কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে আঙ্কেল যে আজ আর ধৈর্য্যটা ধরলো না, তাই না !!! মুখোশটা খুলেই গেল... আপনি ভাবলেন কি করে যে আমি আমার পরিবারকে পথে বসাব !!! Chatterjee & Chatterjee Company, Chatterjee Mansion, Business, সবকিছু আপনাদের নামে লিখে দিতে হবে !!! যে মেয়ে নিজের বোনের জন্য নিজের ভালোবাসা স্বেচ্ছায় ছেড়ে দিতে পারে, সে এত সহজে এই কুরুচিকর প্রস্তাবে রাজি হয়ে যাবে !!! আমি নরম বলে এতটা দুর্বল ভেবে নিলেন আমাকে !!! আমি বেঁচে থাকতে এই আশা পূরণ হবে না.... আমার দাদুর, বাবার তিলে তিলে এত কষ্ট করে গড়ে তোলা Business আমি আপনাদের মতো ভিখারীদের হাতে তুলে দেব !! আমার ঠাম্মি কি এমনি এমনি এত বড় দায়িত্ব আমার উপর দিয়ে গেছে !!!
সুর-এর কথাটা কানে যেতেই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলেন নীহারবাবু... এ তিনি কি শুনছেন !! এতদিন ধরে যাকে তিনি বন্ধু ভেবে এসেছেন, যার কথাকে আগুপিছু চিন্তা না করে সবথেকে বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন, যে দৈবিককে নিজের ছেলের মতো ভালোবেসে নিজের ছোটো মেয়েকে তার হাতে তুলে দিতে যাচ্ছিলেন- তারা কিনা তাকেই ঠকাতে চেয়েছে... তাহলে তাকে রাগিনীকে ঠকানোর প্রায়শ্চিত্ত এইভাবে করতে হবে... কাঁপা কাঁপা গলায় বলে ওঠেন নীহারবাবু,
নীহার : সুর, মা তুই এইসব কি... কি... বলছিস !!! তোর নিশ্চয়ই কোথা... কোথাও ভুল হচ্ছে... হ্যাঁ রে মা... তুই আরেকবার ভালো করে পড়ে দেখ...
ওদিকে রোহিনী দেবী এবং আভিরীও যথেষ্ট অবাক হয়ে গেছে... রোহিনীদেবী সবটা বিশ্বাস করতে না পারলেও অবিশ্বাস করতেও পারেন না... কারন, নিজের মেয়ের থেকেও সুর-এর বিচার-বুদ্ধির উপর তার যথেষ্ট আস্থা আছে...
কিন্তু অভিরী তো অভিরীই... সে এমনিতেই সুরকে সবাই গুরুত্ব দেবার কারনে পচ্ছন্দ করে না, এখন তার হবু শ্বশুরবাড়ির লোকজনকে অপমান করার কারণে সে আরো রেগে যায়....
অভিরী : (চিৎকার করে) দিদিভাইইইইইই !!! কি সব আজে বাজে বলছিস !!! তুই কিন্তু এবার ইচ্ছাকৃত দৈবিক আর Uncle-কে অপমান করছিস... তুই কি ভাবছিস, দৈবিক তোকে ছেড়ে আমাকে ভালোবাসে বলে তুই এইভাবে প্রতিশোধ নিবি !!! যে দৈবিক সবসময়ই আমাদের পরিবারের পাশে থাকে !!! Uncle আর Dad-er এতদিনের বন্ধুত্বটাকে যে তুই এইভাবে দোষারোপ করছিস... তুই কি ভাবছিস, এইভাবে তুই দৈবিক-কে পাবি !!! নিজেকে একবার আয়নায় দেখিস তুই- তোর আর আমার পার্থক্যটা এমনিতেই বুঝতে পারবি.... তাই এখনো বলছি, তুই থেমে যা....
Shut Up... Just Keep Your Mouth Shut... Stop your Nonsense Uttering...
জীবনে প্রথমবারের জন্য সুর-এর ক্রোধান্বিত কন্ঠস্বর শোনে সবাই... মূহুর্তে সারা ঘরে অখণ্ড নীরবতা, নিস্তব্ধতা শোনা যায়... ধীরে ধীরে দেবতনু আর দৈবিক চন্ডাল রূপ ধারণ করে.... রাগে তাদের সর্বাঙ্গ জ্বলছে... কিন্তু মুখে কেমন যেন তাচ্ছিল্যের হাসি...
দৈবিক : তাহহহহ... সুর, ঠাম্মির দেওয়া দায়িত্ব তুমি পালন করতে পারবে তো !!! পেপারগুলো ভালো করে পড়ো- ওতে লেখা আছে তুমি স্ব-ইচ্ছায় আমাদের দান করছো.... দেখো দেখো নীচে স্পষ্ট করে লেখা আছে, যে তুমি তোমার বোনের বিয়েতে তোমার ভগ্নিপতিকে Gift এই বিপুল সম্পত্তি...
সুর : আর আমি যে সেটা করবো না, সেটা বুঝতে পারছো না...
সুররররররররর
এবার আর সহ্য করতে না পেরে চিৎকার করে ওঠে দৈবিক.... চোখগুলো লালসায় চকচক করে ওঠে....
দৈবিক : এই এতগুলো বছর ধরে তোমার, তোমার বোনের অনেক নাটক সহ্য করেছি... তুমি তো ঠিক করে ছুঁতেই দিতে না... আর তোমার বোনের ওই ন্যাকামিগুলো সহ্য করেছি, উফফফফফ.... এই বিপুল সম্পত্তির জন্য তাও সহ্য করে গেছি... নাহলে এমন মেয়ের সাথে কেউ থাকে না কি !!
অভিরী : দৈবিককককক.... কি বলছো তুমি !!!! আমি ন্যাক.... ন্যাকামো করতাম !!! তু... তুমি সম্পত্তির জন্য আমা.... আমার সাথে প্রেমের নাটক করেছিলে এত দিন ধরে... আর আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না... নাহহহ... দৈবিক তুহহ... তুমি বলো মজা... মজা করছো বলো... বলো নাআআআ !!! হাসছো কেন !! Uncle, তুমি কিছু বলো না... কি বলছে ও এইসব !!!
অভিরী আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না... মাটিতে থপ করে বসে পড়ে... তারপর কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে.... নীহারবাবু আর রোহিনী এসে অভিরীকে জড়িয়ে ধরে....
সুর : তাহলে তুমি অভিরীকে কোনোদিনই ভালোবাসো নি... ভালোবেসেছো শুধু আমাদের সম্পত্তিকে.... আচ্ছা তুমি মানুষ !!! পারলে !!! পারলে তুমি আমাদের সাথে প্রতারণা করতে !!! আমার পরিবারের মানুষগুলো এত ভালোবাসে তোমাদের... Uncle, বাবা তোমাকে এতটা ভরসা করে... তুমি কি করে পারলে !! সম্পত্তিটাই সব !!! সম্পর্কগুলো কিছুই না !!! আর অভিরী !!! ও কি দোষ করেছিল !!! এতোটা কষ্ট কি সত্যিই আমাদের প্রাপ্য ছিল !!!
তাহলে তো Sign করার প্রশ্নই ওঠে না....
সুর পেপারগুলো ছিঁড়তে গেলে দৈবিক সুর-এর কপালে পিস্তল ধরে....
দৈবিক : ওই ভুলটা ভুলেও করতে যেও না.... একবার পেছন ফিরে দেখো....
সুর পিছন ফিরে ইতিমধ্যেই দশ-বারো জন পিস্তলধারী নীহার বাবু, রোহিনী আর অভিরীকে ঘিরে ধরেছে... সুর একবার চোখ ভর্তি জল নিয়ে দৈবিককে দেখে... এই মানুষটাকে সে একদিন ভালোবেসেছিল !!! এই মানুষটাকে !!! সেই ছোট্টবেলা থেকে তাদের বন্ধুত্ব ছিল, তবুও এতটুকু বোঝা যায় নি এদের উদ্দেশ্য... ঘেন্নায় আজ আর দৈবিক-এর দিকে তাকাতে ইচ্ছে করে না তার...এই ছেলেটার জন্য সে তার মূল্যবান চোখের জল একদিন নষ্ট করেছে এটা ভেবেই আরো লজ্জাবোধ হয় নিজের প্রতি... নীরবে ধিক্কার জানিয়ে ওঠে সে- 'ছিঃ'.... উত্তীয় তাকে অদৃশ্য হয়ে সাহায্য করে গেছে, নিঃস্বার্থভাবে ভালোবেসে গেছে... কিন্তু তাকেও তো হারাতে হলো এদের জন্য... চোখ বন্ধ করে সুর...
সুর : (মনে মনে) উত্তীয়.... উত্তীয় তুমি কোথায় !!! কোথায় !!! তোমাকে ভালোবাসতে না পারার, তোমাকে বিশ্বাস, ভরসা না করার পরিণতি যদি মৃত্যু হয়, তোমার রাঙানো সিঁদুর-এর মতো আমি সেটাও মাথা পেতে নিলাম.... আমি আসছি তোমার কাছে উত্তীয়...খুব তাড়াতাড়ি আসছি....
অভিরী : দিদিভাই.... দিদিভাই... তুই আমাদের বাঁচা...
দৈবিক : (সুরের কপালে পিস্তল দিয়ে টোকা মেরে) আমি তিন গুনব সুর.... এর মধ্যে যদি Sign না করলে, বুঝতেই পারছিস....,
নীহার : দৈবিক... দৈবিক... তুমি একটু বোঝার চেষ্টা করো.... Please... সুরকে ছেড়ে দাও... Please, এই অনর্থটা করো না...
দৈবিক : এ.... ককককক... 1.....
দেবতনু : কি হচ্ছে কি দৈবিক !!! এই মেয়েটাকে মারলে Papers Sign কে করবে !!!
দৈবিক : দু..... ই.... 2..... করবি Sign !!!
সুর : নাহহহহহ....
দৈবিক : Let her Die.... তিইইই.....
মূহুর্তে পরপর গুলির শব্দে গোটা গোডাউন কেঁপে উঠলো.... মূহুর্তের জন্য স্থির হয়ে যান নীহারবাবু.... রোহিনীদেবীর কন্ঠস্বর থেকে এক হাহাকার ভরা আর্তনাদ শুধুমাত্র প্রতিধ্বনিত হয়- 'সুরররররররর'
(অতঃপর.... সুর আর উত্তীয়র-ও মৃত্যুই কি ওদের ভালোবাসার করুন পরিণতি !!!!)