পরিবার
পরিবার


"বুইঝলে খুড়া ইবারটো চাল গুলান ছেয়ে ফেলতে হবে বটেক,বর্ষা আসি গেলান"
"কি ঝড় খান আইসবে বলছিল বটেক"?
"জানিক লাই খুড়া,রেডিও খান বোঁ,বোঁ আবাজ দিয়া থাইম্যা গেল,ঠাহর কুরতে পারিক লাই"।
"ও আইসলে ঘর গুলান উজার কইর্যা লিয়ে চইল্যা যাবেক বটে"
পশ্চিমবঙ্গের একটি গ্রাম্য পরিবার,ঝড়ের পূর্বাভাস শুনে আতঙ্কিত হয়ে পরিবারের সবাই আলোচনা করছে।আর আটচল্লিশ ঘন্টার মধ্যেই ঝড় ঢুকে পড়বে পশ্চিমবঙ্গের উল্লেখিত কিছু জেলাগুলিতে।রেডিওতে বার বার বলে চলেছে সতর্কতাবাণী।এই পরিবারের মত অনেক পরিবারই মাটির চালা ঘর গুলোতে বসে আতঙ্কিত,এই সকল মানুষদের প্রধান আলোচ্য বিষয় ঝড়।ঝড়-জলে অট্টালিকাবাসীদের প্রাণ জুড়ালেও এই মাটির ঘরগুলোতে বসবাসকারীদের প্রাণ সংশয় ঘটে ঝড়,বৃষ্টির তান্ডবে।
সকাল সকাল খর গুলো সরিয়ে একটা টিনের ছাউনি বসানো হচ্ছে।একটা ঘরেই বসাতে পারছে।এদের দিন চলে খেত-মজুরী করে,কেউ বা ভ্যান রিক্সাচালক,কেউ বা মুটে বাহক।দারিদ্রতা এদের নিত্যদিনের সঙ্গী।আধপেটা খেয়েও এরা সুখে থাকতে শিখে গেছে।পরিবারের মাথা বৃদ্ধ খুড়ো টুলে বসে বিড়ি টানতে টানতে রেডিও শুনছেন আর টিন ছাউনের লোকটাকে তাড়া লাগাচ্ছেন।অবশেষে একটা মাটির ঘরের মাথায় বসলো টিনের আচ্ছাদন।বাকী তিনটে ঘর খরের আচ্ছাদনেই মোড়া থাকলো।রান্নার সরঞ্জাম,বাক্স প্যাটরা সব এঘরে রাখা হলো খুড়োর কথা মত।পরিবারের সবচেয়ে ছোট বছর পাঁচের ছেলেটা দৌড়ে বেড়াচ্ছে।নতুন ঘরটা দেখে তারও আনন্দের সীমা নেই।ঘরের মেয়েরা নতুন ঘরে ঢুকে নিশ্চিন্তে রান্না বসালো।তাদের এবার ভয় নেই ঝড়ে।রেডিওটা নষ্ট হয়ে যাওয়াতে সতর্কতাবাণীও আর তারা পাচ্ছে না শুনতে।গ্রামে স্বেচ্ছাসেবক শিবিরের কিছু লোক এই সকল মাটির বাড়িতে বসবাসকারীদের ভ্যানে করে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে স্কুলবাড়ি গুলোতে।এই পরিবার টিকেও নিতে এসেছিল,তবে পরিবারের মাথা প্রথমে রাজি হননি যেতে,টিনের ছাউনির ভরসায়।তাদের আপত্তি সত্বেও চলে যেতে হলো বাড়ি ছেড়ে।
দুপুর থেকে আকাশের মুখ ভারাক্রান্ত।পরদিন সকাল থেকে শুরু হল ঝড়ের দাপট।তছনছ করে দিচ্ছে চারিপাশ।ঝড়ের দাপটে বড় বড় তালগাছ-খেজুর গাছ গুলো মাথা নোয়াচ্ছে মাটিতে।নদী ফুলে জলচ্ছ্বাসে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে চারিপাশ, সাথে অবিরাম পড়া বৃষ্টির জল।মাটির বাড়িগুলো ভেঙে পড়ে মিশে যাচ্ছে সমুদ্রের জলে এমন ভাবে যেন কোনদিনও বাড়ি বলে কিছুই ছিল না।নিশ্চিন্হ করে চলে যাচ্ছে চারিপাশ।অট্টালিকার কাঁচ গুলো রেহাই পায়নি তা থেকে।আর টিনের চালটা?সেটা শোলার মত উড়ে গিয়ে কোথায় গেল কেউ জানলো না।কমলো ঝড়,ভাঙ্গল বাড়ি,মরলো পক্ষীকুলের একাংশ।যে যার ঘরের দিকে রওনা হলো।পড়ে আছে মাটি কাদার স্তুপ।ঘর হারানো পরিবারদের দলে ওই পরিবারটাও ছিল।দৌড়ে এলো সবাই,এটা ভেবে টিনের ছাউনি বাঁচিয়ে রেখেছে ওদের একখানি ঘর।না!নেই,কিচ্ছু নেই,খুড়ো লোকটি হা হুতাশ করে কেঁদে উঠলেন, পরিবারের বাকী দুই ছেলে,বৌমারা,নাতি-নাতনী সবাই পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে খুড়োকে আশ্বস্ত করে বললো "খুড়া ভাবিস লাই,এ খেট্টে খাওয়া মাইনষের হাইত,কেউ পারিকবে লা ডরাইতে" সকলের কাদামাটি লাগা হাত গুলো মেলে ধরে সমস্বরে উঠলো স্লোগান "দশে মিল্যা করি কাজ,হারি-জীত্তি লাহি ল্যাজ"।
মাটির স্তুপে একে একে সবার হাত ঢুকলো, এমনকি পাঁচ বছরের বাচ্চাটারও বাড়ি তৈরীর কাজে।।
সমাপ্ত
*****