STORYMIRROR

Partha Pratim Guha Neogy

Tragedy Others

3  

Partha Pratim Guha Neogy

Tragedy Others

প্রেমদাহ

প্রেমদাহ

4 mins
129

নায়িকার নাম প্রথমে ভেবেছিলাম মনিমালা। কিন্তু তার ঘন, ভ্রমর কালো, যুগল ভুরু। বিশাল চোখ দুখানা। কৌতুকে, বুদ্ধিতে, জীবনানন্দে সদা ঝিলমিল। স্বচ্ছসলিলা অতল হ্রদের হাল্কা ঢেউয়ের উপর যেন সূর্যের কিরণ। এই চোখ দুখানার জন্য নায়িকার নাম দিয়েছি সুনয়নী । কিন্তু আপনি তো ওর সুনয়ন যুগল দেখেননি। কাজেই আপনি ইচ্ছামত অন্য যে কোনো নাম দিতে পারেন। আপনার মনের পরম মমতার ঘরটিতে যেসব আদুরে আহ্লাদি, দুলালী, রাঙা মাথায় চিরুনি রাজকন্যাদের স্থায়ী বসত, তাদেরই যে কোনো একজনের নাম। শহরের আদিম ঘিঞ্জি এলাকায় আজন্ম বাস। এবার বিশ্ববিদ্যালয়ে মানবীবিদ্যায় প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়ে প্রথম ক্যাম্পাস দর্শনেই মোহিত। এ তো কল্প লোক! দিগন্ত বিস্তীর্ণ ক্যম্পাস। ঘাসের কার্পেট। বিশাল গম্ভীর ছায়াঘন প্রাচীন সব গাছ বেয়ে উঠেছে হাতির কানের মত পাতাওয়ালা মানিপ্লান্ট। আরো কত ধরণের লতা! আবার জায়গায় জায়গায় ফুল্লকুসুমিত বাগানের হিন্দোল। কত রং বাহার! কাঠবিড়াল আর হরেক পাখির ফুড়ুক-ফাড়ুক। স্বচ্ছ জলের ঝিল।


মাছরাঙা। পানকৌড়ি। হাঁসগুলো নিশ্চয় বুনো । সুনীল আকাশ। উড়ন্ত চিল গুলোর ডানায় যেন সোনালী রোদের গন্ধ। ছেলেরা মেয়েরা ঘুরছে ফিরছে হাসছে বকবক করছে। হাত ধরাধরি। কোমর, গলা জড়াজড়ি। ঝিল ধারের কুঞ্জ ছায়ায়, ফাঁকা ক্লাস রুমে, সিঁড়িতে আশ্লিষ্ট যুগল। অজ্ঞাত যৌবনা সুনয়নী সহসা সুপ্তোত্থিতা। মানবীবিদ্যা বিভাগে করিডোরে দেওয়াল ভর্তি ছবি আর ছবি। সবথেকে নজরকাড়া বিশাল ছবিটির ফোরগ্রাউন্ডে রাজা রামমোহন। চোখে জল টলটল। ব্যাকগ্রাউন্ডে, তলার লেয়ারে, পুরোহিত, বাজনদার, উৎসাহী দর্শক বৃন্দের মাঝখানে একটা গনগনে চিতার দিকে এক মানবীকে ঠেলে হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কম্প্যুটার গ্রাফিক শিল্পীর কুশলতায় সব জীবন্ত। মানবীটির আর্তনাদ দর্শকের যেন কানে বাজে। সুনয়নী প্রথম ক’দিন ঐ ছবির সামনে দিয়ে চলতে শিউরে উঠতো। নির্ধারিত দিনে মানবাধিকারীর তত্ত্বাবধানে, নবাগতা মেয়েদের সঙ্গে প্রেম করার অধিকার নিলাম হলো। সুনয়নীর সঙ্গে প্রেম করার অধিকার নিলামে পেয়েই, কাগজ পত্র নিয়ে, তার অভীক, দয়িতাকে ভোগদখল করার জন্য খুঁজে পেতে করিডোরে পেয়ে প্রেমের প্রস্তাবটি দিল। তার চোখে তাকাতেই সুনয়নার মনের চোখে চিতা লেলিহান। সে কোন কথা না বলে, ধীর পায়ে সরে গেল। কিন্তু পিরিতি কাঁঠালের আঠা। এবং দস্তুর মত নিলামে পাওয়া। অভিক লেগে থাকলো। করিডোরে, ক্যান্টিনে, লাইব্রেরিতে, অটো স্ট্যান্ডে, সর্বত্র, বিভিন্ন আঙ্গিকে, নানা ঘরানায় প্রেমের প্রস্তাব পেশ করেই চল্লো। হস্টেলের ঘরে, এমনকি পুরী নিয়ে যেতে চাইল। দয়িতার বাড়িতেও ধাওয়া করলো। প্রেমিক আরকি করতে পারে? ওর পাগল পাগল ভাব। অথচ, সুনয়নী কদাপি, ওর সঙ্গে একটা কথাও বলে না। ক্যাম্পাসে গবেষণা: মেয়েটা তো লেসবিয়ানদের রামধনু রাঙা ব্যাজ পরে না। স্ট্রেট। তবে বেচারা অভীককে এত ল্যাজে খেলাচ্ছে কেন? নিলামের মর্যাদা ধুলোয়! ঐকমত – মহা ঠ্যাঁটা। নির্লজ্জ । অভীকের উপর সমস্ত ক্যাম্পাসের পরিপূর্ণ সহানুভূতি। একদিন ক্যাম্পাস জানলো সুনয়নী মাইগ্রেশান নিয়ে চলে যাচ্ছে। ক্যাম্পাস অধীর আগ্রহে সমাপ্তি অনুষ্ঠানের প্রতীক্ষায়। শেষের আগের দিন। এক বান্ধবীর আমন্ত্রণে সুনয়নী ক্যান্টিনে বিদায়ী ভোজ খেতে গেল। আজ অস্বাভাবিক ভিড়। ও পৌছতেই ভিড় দুভাগ হয়ে ওকে রাস্তা করে দিল। ওরই জন্য একটা খালি চেয়ার। ও বসতেই উলু। শাঁখ। বিয়ের গান। গাল বাদ্য। এসবের মাঝে ক্যান্টিন পরিচালক স্বয়ং মুচকি হাসি মুখে, বিশাল একটা কাঁসার থালায় অনেক ক’টা বাটি সাজিয়ে সামনে নামিয়ে দিল। সুনয়নী দেখে: সুক্তো, ডাল, আলু ভাজা, গলদা, পাকা মাছ, মাংস, চাটনি, পায়েস, পোলাও। অবিশ্রান্ত উলু, শাঁখ, গানের মাঝে বিমূঢ়া, স্থানু সুনয়নীর বান্ধবী আর ক’টা মেয়ে সমস্বরে কলকলিয়ে বল্লো: “আজ তোর আইবুড়ো ভাত। খেয়ে নে”। সুনয়নী ফ্যালফ্যাল করে এদিক ওদিক তাকিয়ে হঠাৎ দেখে টেবিলের ওপারে তার দিকে তাকিয়ে অভীক। অজানা তীব্র ত্রাসে সুনয়নীর মুখ কড়ির মত সাদা, হাত পা হিম। না খেয়ে উঠে যাচ্ছিল। সবার চিৎকারে বাধ্য হয়ে একগ্রাস মুখের কাছে আনতেই নিমতলা শ্মশানের মানুষ পোড়ানোর উৎকট গন্ধে প্রবল বিবমিষা। ওয়াক করতেই, “পেট ”আর “মাস” নিয়ে ইতি উতি ছোঁড়াছোঁড়ি হওয়া রসিক মন্তব্যগুলো তো আন্দাজ করতেই পারছেন। সুনয়নী কোনোমতে চেয়ার ছেড়ে টলমল করতে করতে, চুপচাপ উঠে গেল।পরদিন সুনয়নী মাইগ্রেশান নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। দলবল আর ব্যান্ড পার্টি নিয়ে অভীক গেটে আটকালো। “এতদিন নাচালি! আজ তোর গায়ে হলুদ দিয়ে তবে যেতে দেবো”। সুনয়নী ওর চোখে নিজের সর্বনাশ দেখে প্রবল কম্পমানা। উৎসুক দর্শক গিজগিজ। ব্যান্ড, শাঁখ, উলু। সুনয়নীকে পিছমোড়া করে অভীক গেটের সঙ্গে বাঁধলো। হাঁটুর উপরে সর্বাঙ্গ নির্বসনা করে নতুন গামছা জড়িয়ে দিলো। তারপর অভিসারক, সুনয়নীর মাথা থেকে পুরো শরীর অ্যাসিড-ধৌত করলো। ব্যান্ডে বাজছিল: পরান যায় জ্বলিয়া রে। সুনয়নীর দুটো সুনয়নই গলে গেলো। মুখমন্ডল থেকে জঘন—জ্বলে, গলে, দলা দলা পাকিয়ে গেলো। অনেক হাড় বেরিয়ে গেলো। মিনিট দুই/তিনের মধ্যেই সব মিটে গেল। বাজারী কাগজের রিপোর্টের শিরোনামা দিল: প্ৰেমদাহ ।

ফ্রয়েডের তত্ত্ব অনুযায়ী মানুষের আচরণ আর মানসিক প্রক্রিয়া পরিচালিত হয় ‘ইড’, ‘ইগো’ আর ‘সুপার ইগো’র মাধ্যমে। আমাদের সব কামনাবাসনার চাহিদা নিয়ন্ত্রণ করে ইড। এটি কেবলই আমাদের তৃপ্ত করতে চায় যেভাবেই হোক না কেন। আমাদের নৈতিকতার মধ্যে বেঁধে রাখতে চায় সুপার ইগো। এই দুইয়ের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে ইগো। এই ভারসাম্য রক্ষা করাকে বলা যেতে পারে ইগো ডিফেন্স মেকানিজম।


মানুষ যখন ইডের মাধ্যমে পরিচালিত হয় তখন সে কেবল চায়, যেনতেন প্রকারে নিজের চাওয়াটাকে পেতে। না পেলে তার মধ্যে পাশবিক প্রবৃত্তি মাথাচাড়া দেয়। প্রতিহিংসা আর নিষ্ঠুরতার পেছনে থাকে ইডের প্রভাব। ফলে প্রেমে ব্যর্থ হয়ে যদি কেউ আগ্রাসী হয়ে ওঠে, নিজের প্রতি বা অপরের প্রতি—তখন তার সুপার ইগো পরাজিত হয়, এলোমেলো হয় ইগো ডিফেন্স। এতে সে মানবিক গুণাবলী হারাতে থাকে। কে কীভাবে ইগোকে সুরক্ষা (ডিফেন্স) করবে, কীভাবে ইডের প্রভাববলয় থেকে নিজেকে রক্ষা করবে তা নির্ভর করে তার শৈশবের বিকাশ, পারিবারিক পরিবেশ, সামাজিক শিক্ষা, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা এবং তার সমাজ ও সংস্কৃতির ভৌত কাঠামোর ওপর। পাশাপাশি আশপাশের মানুষের আচরণও তাকে অনেকটা প্রভাবিত করে।



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy